#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_১০
নিরু ছাদ থেকে একবারে নিচে চলে এলো।বাগানে কিছু নতুন গাছ লাগানো হয়েছে।নিরু গাছের প্রতি ভীষণ আসক্ত,এই বাগানের অধিকাংশ গাছ নিরুর হাতে লাগানো।নিরু ফল গাছ লাগাতে বেশি পছন্দ করে। কিছুদিন আগে কামরাঙা আর একটা মিষ্টি তেতুল গাছের চারা লাগিয়েছে।নিরু জানে এখানে বেশিদিন থাকা হবে না তারপরও গাছ গুলো লাগায়।
আজিজুল হক নামাজ পড়ে বাসায় ঢুকলেন।নিরুকে বাগানে দেখে নিরুর কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।
_ আমার মা কি করছে?
_ মামা দেখো কামরাঙা গাছটা মনে হচ্ছিলো হবে না।কিন্তু আজ কেমন তরতাজা লাগছে।
_ আমার মায়ের হাতে লাগানো গাছ,তরতাজা তো হবেই।আর কোন গাছ লাগবে মা?
_ না মামা এখন আর কোন গাছ লাগাবো না।
_ নতুন টিচার কেমন পড়াচ্ছে।
_ তানজিলা আপু ভালো পড়ায় মামা।
_ তুমিও মনোযোগ দিয়ে পড়বা।কাল তোমার দাদু ফোন দিয়েছিলো।তোমাকে কিছুদিনের জন্য রেখে আসতে বলছে।
_ দাদু দিদা চাচ্চুরা কি গ্রামের বাসায় এসেছে মামা।
_ না। তোমাকে তোমার দাদুর কাছে কয়দিন ঘুরতে যাওয়ার জন্য রেখে আসার কথা বলল,কিন্তু আমার তো আজকালের মধ্যে যাওয়া সম্ভব নয়।তুমি কি আজকালের মধ্যে যাবা মা।কয়দিন পর গেলে ভালো হতো না?
_ মামা আমি দাদুর সাথে কথা বলে নেবো।কয়দিন পর-ই যাবো।
_ ঠিক আছে,উপরে চলো। স্কুলের সময় তোমাকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাবো।
আজিজুল হক নিরুকে নিয়ে সামনের দিকে হাঁটছিলো।নিরু পিছন থেকে বাহারির কন্ঠ শুনতে পেয়ে আজিজুল হককে বলল।
_ মামা বাহারি এসেছে।তুমি যাও আমি আসছি।
নিরুর বাহারির দিকে এগিয়ে গেল।অন্যদিনের তুলনায় বাহারির হাতে আজ বেশি ব্যাগ।নিরু এগিয়ে গিয়ে বাহারির হাত থেকে কয়েকটা ব্যাগ নিলো।
_ আজ এতো সবজি এনেছো যে?
_ গতকাল যেই বৃষ্টি হলো তার সাথে দমকা হাওয়া। অনেক সবজি নষ্ট হয়েছে।মা আজ বেশি করে দিয়েছে।আর হ্যাঁ কাল রাতে তো পাকা পেঁপে আর পেয়ারা গুলো রেখে এসেছিলে, ওই গুলোও নিয়ে আসলাম।
_ ভিতরে চলো।আজ বিকেলে আসবা।আমি স্কুল থেকে এসে সেই ভর্তাটা বানাবো।তুমি খেয়ে দেখবা।
_ আচ্ছা ঝড় বৃষ্টি যদি না হয় আসবো।
বাহারি আর নিরু সবজি গুলো রান্না ঘরে রাখল।আমিনা বেগম বাহারিকে কিছুক্ষণ থেকে যেতে বলল,নিরু পাকা পেঁপে গুলো কেটে নিলো।আমিনা বেগম নাস্তা বানাচ্ছে।নিরু রান্না ঘরে ঢুকে ছাঁচ পিঠা বানানোর জন্য আটা মেখে নিলো।নিরু ছাঁচ পিঠাটা খুব মজা করে বানাতে পারে।পিঠাপুলি নিরুই সব সময় বানায়।
আমিনা বেগম বাহারিদের জন্য বক্সে কিছু পিঠা আর নাস্তা দিয়ে দিলো।নিরু স্কুল যাওয়ার জন্য টিফিন ব্যাগ গুছিয়ে নিলো।নিরুর দু’চোখ মন্ত্রমুগ্ধর মতো আশপাশে কিছু একটা খুঁজছিলো।কোথাও ওই দু’টি চোখ খুঁজে যাওয়া মানুষটার দেখা পেল না।নিরুর অবচেতন মন কেন বার বার ওই মানুষটাকেই খোঁজে,নিরু বুঝে উঠতে পারে না। ওই জ্বালাতনময় মানুষটার মধ্যে কি নেশা আছে?
আজিজুল হক নিরুকে স্কুলে রেখে এলো।নিরুর বাসায় আসতে আসতে বিকেল হবে।মাহিয়া সারাটাদিন একা কাটাল।আসাদ ও সেই সকালে বের হয়েছে।মাহিয়া আসাদকে কয়েকবার কল দিয়েছে তাড়াতাড়ি বাসায় এসে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেতে বলেছে।কিন্তু আসাদের বাসায় আসার নাম নেই।
কিছুক্ষণ আগে নিরুর স্কুল ছুটি হয়েছে।রাহিমা আর নিরু বাজার রোডে দাঁড়িয়ে তিনটা আইসক্রিম নিলো।নিরু আর রাহিমা দু’টো খেতে খেতে যাবে।আর নিরু মাহিয়ার জন্য একটা আইসক্রিম বাসায় নিয়ে যাবে।কিছুটা পথ এগিয়ে নিরু দাঁড়িয়ে পরে।রাহিমা একা একা কথা বলে যাচ্ছে, নিরুর সাড়াশব্দ না পেয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে নিরু দাঁড়িয়ে আছে।
_ এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
নিরু কোন উত্তর দিলো না। নিরুর দৃষ্টি বরাবর রাহিমা তাকিয়ে দেখে আসাদ ভাই।
_ নিরু ওইটা আসাদ ভাই না?
_ হুম চল।
_ আসাদ ভাই রিংকি আপুকে কিসের কাগজ দিচ্ছে?
_ জানিনা।
_ এই নিরু জানিস ওইটা রিংকি আপু।আমাদের পাশের ফ্লাটে থাকে।খুবই মেধাবী ছাত্রী। মাঝে মাঝেই তো আমার ম্যাথে সমস্যা হলে আপুর কাছে ম্যাথ শিখতে যাই।
_ ওহ ভালোই তো।
_ মাঝে মাঝে তোর কথা জিজ্ঞেস করে।
_ আমার কথা কি জিজ্ঞেস করে?
_ ওই যে তুই আসাদ ভাইয়াদের বাসায় থাকিস।আসাদ ভাইয়ারা তোকে খুব স্নেহ করে।আন্টি আংকেল নেই।তোর সব দায়িত্ব নিয়ে তোর সব দিকে খেয়াল রাখে।এইসব বলে।
_ ওহ!
_ রিংকি আপু আসাদ ভাইয়ের খুব গল্প করে।আপুর কথা শুনে মনে হয়,আসাদ ভাইয়ের সাথে রিংকি আপুর ভালো সম্পর্ক। এখন তো মনে হচ্ছে খুবই ভালো সম্পর্ক। কোন রিলেশনে আছে মনে হয়। রিংকি আপু তো এমনিতেই অনেক সুন্দরী।
_ তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে চল,মাহিয়া আপু তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে।
_ তোদের বাসায় তো অনেক মজা হচ্ছে।আত্নীয় আসলে অনেক মজা লাগে।
_ হুম,তুই আসিস।
রাহিমা আচ্ছা বলে নিজের বাসার রাস্তায় ঢুকে পরল।নিরুকে এখনো একটু সামনে যেতে হবে।
নিরুর শরীর রাগে অভিমানে কাঁপছে।নিরুর কেন এমন হবে?আসাদ ভাই কার সাথে ঘুরল,কি করল নিরুর এতো বুকে লাগছে কেন?
নিরু বাসার সামনে আসতেই জাফর নামের ছেলেটি নিরুকে পিছন থেকে ডাকল।নিরু জাফর কে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল।জাফর নামের ছেলেটি সকালে নিরুদের স্কুলে গেছিলো।তার ছোট বোনের জন্য কিছু বইয়ের দরকার।জাফররা পাঁচ ভাইবোন, পুরো একটা সংসারের দায়িত্ব জাফরের উপর।বোনটা এবার অষ্টম শ্রেণিতে উঠেছে।নিরুদের স্কুলেই পড়ে।মেয়েটা স্কুলে পুরাতন বই খোঁজ করাতে, নিরুই বলেছিলো তার সব বই গুলো রাখা আছে।বই গুলো দিবে।তাই জাফর স্কুলে শুনতে গেছিলো।বই গুলো কত টাকায় দিবে জানতে,নিরু বলেছে টাকা দিতে হবে না। বই গুলো এমনিই দিবে।চারটার পর যেন এখানে আসে, নিরু বই গুলো দিয়ে দেবে।তাই জাফর এসেছে।নিরু দারোয়ানকে দিয়ে বই গুলো নিচে নিয়ে আসলো।জাফরের মেজো ভাইটা বই গুলো সাইকেলে করে নিয়ে চলে গেল। জাফর নিরুকে ধন্যবাদ দিয়ে কিছুটা রাস্তা চলে গেছিলো।নিরু দৌড়ে যেয়ে জাফরকে দাঁড়াতে বলল।
_ ভাইয়া এই বইটা ফেলে যাচ্ছিলেন।আমিও বাঁধার সময় খেয়াল করিনি।
_ আমিও খেয়াল করিনি বোন।দোয়া করো আমার বোনের জন্য,ও যেন ভালো করে পড়াশোনা করতে পারে। তোমার জন্যও দোয়া করবো বোন।
নিরু মিষ্টি হাসল।জাফর বইটা নিয়ে চলে গেল।আসাদ তখন জাফরকে বিদায় দেওয়া থেকে নিরুর মুখে মিষ্টি হাসিটাই দেখল।আসাদের মাথায় এলো না নিরু বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে একটা ছেলের সঙ্গে কি কথা বলবে,কেনই বা বলবে?আসাদের মাথা মুহূর্তে গরম হয়ে গেল।নিরু একটা ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে তাও বাসার সামনে হেসে বিদায় দিলো।কিছুক্ষণের জন্য আসাদের মাথায় কাজ করা বন্ধ হয়ে গেল।
নিরু গেট দিয়ে ঢুকতেই আসাদ নিরুকে ডাকল।দারোয়ান আসরের নামাজ পড়তে গেছে।
_ নিরু ওই ছেলেটা কে?
আসাদের কর্কশ কন্ঠ শুনে নিরু কিছুটা ভড়কে গেল।তারপর শান্ত হয়ে আসা নিরু, আসাদকে ওই মেয়েটার সাথে দেখা ওই মুহূর্তের কথা মনে পড়ায় দ্বিগুণ জ্বলে উঠল।
_ আপনাকে জানতে হবে কেন আসাদ ভাই?
_ আমি ছাড়া কে জানবে?
_ কেউ-ই জানবে না।
_ রাস্তার ছেলেপিলে জানবে?
_ আপনাকে এতো ভাবতে কে বলেছে আসাদ ভাই।আমি কার সাথে কথা বলবো সেইটাও কি আপনি ঠিক করে দিবেন?
_ হ্যাঁ আমিই ঠিক করে দেবো।
_ আপনার কথা শুনতে আমি বাধ্য নই।আপনি রাস্তায় কার সাথে দাঁড়িয়ে থাকেন।কি দেওয়া নেওয়া করেন।সেইসব কি আমি দেখতে যাই।না আপনাকে বলতে যাই?
_ আমি তোর মতো বাসার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে হাসাহাসি করিনা নিরু।
_ আমার প্রয়োজনে আমি হাসাহাসি করেছি।
_ খুব প্রয়োজনের মানুষ হয়ে গেছিস দেখছি?
_ আমি আপনাদের বাসার আশ্রিতা, আমাকে আদর করেন, স্নেহ করেন।দায়িত্ব পালন করেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।দয়া করে আমার বিষয়ে কিছু বলতে আসবেন না।একদম না।
নিরু চোখের জল আড়াল করে, কোনরকমে চোখ মুছতে মুছতে দৌড়ে চলে গেল। আসাদের রাগ হয়ে গেল আকাশ ছোঁয়া।সাথে সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, আর একটা দিনও নিরুর সামনে থাকবে না। এক সপ্তাহ পর যাওয়ার কথা কিন্তু আসাদ কাল খুব ভোরেই চলে যাবে।যা ইচ্ছে করুক তার নিরু,আসাদ আর ফিরেও তাকাবে না।একদমই তাকাবে না।
চলবে….