#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_১১
আসাদ ওই মুহূর্তে আর বাসায় দাঁড়ায়নি।বাসায় ঢুকে রুম থেকে বাইকের চাবি নিয়ে বের হয়ে গেছে। আমিনা বেগম পিছন থেকে অনেকবার ডেকেও আসাদের নাগাল পেল না।মনিকা বললেন।’আসাদ কি সারাদিন বাইরে থাকে?সারাদিনে বাসায় দেখলাম না।এতো ডাকলে তাও শুনলো না।’
_ আর বলো না আপা।দিন দিন বেয়াদব হচ্ছে।একটা কথা কি শোনে।
_ সারাদিন পর বাসায় এসে আবার চলে গেল।সারাদিন কি এইভাবেই বাইরে থাকে?
_ বাইরে থাকে তবে সারাদিন না।কোথাও গেলে বলে যায়।
_ মাহিয়া বলছে ওর একা ভালো লাগছে না। বাইরে ঘুরতে যাবে।আসাদ তো চলে গেল।
_ বাইক নিয়ে গেছে।এখন আসবে না। নিরু স্কুল থেকে চলে এসেছে।কিছু খেয়ে মাহিয়াকে নিয়ে বাইরে যেতে বলছি দাঁড়াও।
_ থাক খালামণি আজ আর কোথাও যাচ্ছি না।অনিমা স্কুল থেকে মাত্র এলো আজ থাক।
নিরু স্কুল থেকে এসে আইসক্রিমটা ফ্রিজে রেখেছিলো।হাত মুখ ধুয়ে এসে মাহিয়ার হাতে আইসক্রিমটা দিলো।নিরুর মনটা একটুও ভালো না।নিরুর বুকের ভিতরটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছে।এই অস্থিরতার সাথে নিরু পূর্ব পরিচিত নয়।নিরুর কাছে এই অনুভূতি বড্ড অচেনা।অন্যদিন স্কুল থেকে এসেই নিরু কিছু না কিছু খাবার খায়।কিন্তু আজ কোন কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হলো না। মাহিয়া আইসক্রিম নিতে বলল ওইটাও নিলো না।কিছুক্ষণ ছাদে গিয়ে হাঁটাহাটি করল।ছাদে অনেক ধরনের গাছ আছে।মাহিয়া গাছ গুলোর নাম জানতে চাইলো।নিরু মাহিয়াকে গাছ গুলোর নাম বলছিলো।আর ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলো।নিরুর চোখ দু’টো বার বার গেটের ওপারে চলে যাচ্ছে।কিসের আশায় নিরুর চোখ দুটোও ছটফট করছে?
বুকে চিনচিনে ব্যথা,মনে অস্থিরতা, চোখে তৃষ্ণা এতকিছু কিসের জন্য হচ্ছে নিরুর?
নিরু এইসব নিয়ে আর ভাবতে পারছেনা।নিজের মনকেই প্রশ্ন করল। ‘ কিসের এতো অস্থিরতা, আসাদ ভাই কার সাথে সম্পর্কে জড়ালো, না কি করলো তা জেনে নিরুর কি?নিরু কেন ঈর্ষান্বিত হবে?নিরু নিজেকে শান্ত করল,নিজেই নিজেকে বুঝ দিলো।আসাদের প্রতি রাগ কমালো।নিরু এমনটা আর কখনো মনের মধ্যে আনবে না।টানা একটা শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হলো।মুখে হাসি নিয়ে মাহিয়ার সাথে বসে গল্প করল।
কিছুক্ষণ পর ছাদ থেকে নিরু বাহারিকে দেখতে পেল।বাহারিকে দেখে মাহিয়াকে নিয়ে নিচে চলে এলো।বাহারি আমড়া আর কাঁচকলা নিয়ে এসেছে। নিরুই সকালে ওই গুলো আনতে বলে দিয়েছিলো।কাঁচা পেঁপে আর ধনেপাতা বাসাতেই আছে।নিরু ওই গুলো দিয়ে ঝাল ঝাল করে ভর্তা বানালো।খাঁটি সরিষার তেল আর ঝাল দিলো বেশি করে।বিশেষ করে এই ভর্তাটা আসাদকে খাওয়াবে বলেই নিরু এতো আনন্দ নিয়ে বানালো।আসাদ এখন বাসায় নেই।তাই আলাদা একটা বাটিতে নিরু আসাদের জন্য তুলে রাখলো।তারপর বাসার সবাইকে ভর্তাটা মেখে খাওয়ালো।মাহিয়া ঝালের জন্য একটু খেয়ে আর খেতে পারলো না। আমিনা বেগম আর মনিকা ও ভর্তাটা মজা করে খেলো।ততক্ষণে আজিজুল হক ও বাসায় চলে এসেছেন। নিরু মামার জন্যও তুলে দিলো।আজিজুল হক ভর্তাটা খেয়ে এক কথায় দুর্দান্ত বলল।নিরুর মুখে আরও বেশি হাসি ফুটে উঠল এবং বাহারির মায়ের কাছ থেকে কাল শিখে এসেছে এইটাও বলল।
নিরু বার বার গেটের দিকে তাকাচ্ছিলো।সন্ধ্যা হয়ে এসেছে আসাদ এখনো বাসায় এলো না।পড়তে বসেও পড়ায় মনোযোগী হতে পারলো না।আজিজুল হক বললেন কাল সবাইকে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকো পার্কে ঘুরতে নিয়ে যাবে।বাসার সবাই কত খুশি।আর নিরু, বখাটে অসহ্যকর একটা ছেলের পথ চেয়ে গেটের দিকে চেয়ে আছে।ভিতরে কোন আনন্দ নেই।আসাদ আজ যেভাবে বের হয়েছে।নিরু কোনদিন ওইভাবে আসাদকে দেখেনি।কিছুটা চিন্তাও হচ্ছে।
আমিনা বেগম সবাইকে নাস্তা দিয়ে,আজিজুল হকের জন্য বারান্দায় চা নিয়ে গেল।সন্ধ্যার সময় বাসায় থাকলে আজিজুল হক বারান্দায় বসে চা খান।আমিনা বেগম দু’কাপ চা নিয়ে আজিজুল হকের পাশের চেয়ারে বসলেন।
_ তাহলে কাল সারাদিন বাসায় থাকছো?
_ হুম কাল সারাদিন ঘুরাবো।তোমাকে তো ঘুরতেই নিয়ে যাওয়া হয় না।
_ এতদিনে মনে হয়েছে?
_ মনে তো হয়-ই।কিন্তু সময়-ই পাই না।
_ চা শেষ করো, ঠান্ডা হয়ে যাবে।
_ আচ্ছা শোনো,নিরুর দাদু ফোন করেছিলো।নিরুকে কিছুদিনের জন্য ওর দাদুর কাছে রেখে আসতে বলছে।
_ রেখে আসো, ঘুরে আসুক নিরুর ও ভালো লাগবে।
_ সময় হচ্ছে না গো।
_ আসাদ ও তো সামনে সপ্তাহে চলে যাবে।ওকে বলো রেখে আসুক।কয়দিন পর তুমি গিয়ে নিয়ে এসো।
_ নিরু বড় হচ্ছে।আমি বা তুমি ছাড়া ওকে কারো সাথে কোথাও পাঠাবো না আমিনা।
_ আসাদ কেমন তুমি জানো না?
_ আসাদ কেমন আমি জানি আমিনা।আসাদ আমাদের সন্তান ঠিক আছে।আসাদ আর পাঁচজনের মতো অসভ্য নয় এইটাও ঠিক আছে। কিন্তু আমি চাই না দুজনকে যেখানে সেখানে পাঠাতে।
_ হুম ঠিক আছে।
_ তুমি দেখোনা তুমি যেখানেই যাও নিরুকে সাথে নিয়ে যেতে বলি।ওর ভালো মন্দ ওকে সবটুকু দিয়ে আগলে রাখার কোন ত্রুটি আমাদের দ্বারা যেন না হয় আমিনা।
_ চিন্তা করো না। নিরুকে আমরা আগলেই রাখবো।কয়টা দিন পর তুমি গিয়ে রেখো এসো।
রাত দশটার পর আসাদ বাসায় এলো।চোখ মুখের বিধ্বস্ত অবস্থা। নিরু মাহিয়া ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলো আর চানাচুর খাচ্ছিলো।মাহিয়া আসাদকে দেখে কথা বলল।
_ সারাদিন কোথায় ছিলে? ভাবলাম ঘুরতে বের হবো।
_ বাইরে ছিলাম।
_ নিরু আজ একটা দারুণ ভর্তা বানিয়েছিলো।খেতে সেইরকম মজা।তুমি থাকলে খেতে পারতে।মিস করে গেলে। সারাদিন কি করছিলে?
‘ব্যস্ত ছিলাম।’ বলে আসাদ নিজের রুমে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরেই আমিনা বেগমকে ডাকতে ডাকতে রুম থেকে বের হলো।
_ আম্মু কাল ভোরে আমার বাস, এডমিশন কোচিংয়ের জন্য কালকেই চলে যেতে হবে।
‘কালকেই চলে যেতে হবে।’ কথাটা কি নিরুর বুকে ঢিপঢিপ শব্দ তুলে দিলো।নিরু সোজাসুজি আসাদের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।
আমিনা বেগম রান্না ঘরে ছিলো।রান্না ঘর থেকে ড্রয়িংরুমে আসলো।আজিজুল হক আসাদের কথা শুনে ড্রয়িংরুমে এসে বসল।
_ তোমার তো সামনে সপ্তাহে যাওয়ার কথা বাবা।
_ সামনের সপ্তাহে যাওয়ার কথা ছিলো আব্বু,কিন্তু কালকেই সবাই যাচ্ছে।আমাকেও যেতে হবে।
_ বাসে কেন? ড্রাইভার রেখে আসবে।
_ সবাই এক সাথে বাসেই যাবো আব্বু।
_ পরশু যেও।কাল সবাই মিলে ঘুরতে যেতে চাচ্ছিলাম।
_ তোমরা যেও আব্বু।আমার যাওয়া হবে না। টিকিট করা হয়ে গেছে।
_ ফোন করে টিকিট বাতিল করে দাও।পরশু যেও।
_ আব্বু পরশু থেকে কোচিং শুরু। আমি একটা ঘন্টাও পিছাতে চাই না।সেইখানে পুরো একটা দিন পিছাতে হবে?আর আশপাশের সব জায়গা গুলো আমার দেখা।সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না।তোমরা ঘুরে এসো।আমি এডমিশনের পর তোমাদের সঙ্গে একটা টুর দেবো।
_ আচ্ছা!কয়টার বাস, কোথায় গিয়ে উঠবে,কতজন যাচ্ছো আমাকে জানিও সব।
‘ঠিক আছে বলে,আসাদ নিজের রুমে চলে গেল।’
আসাদের এমন রুপ নিরু আগে দেখেনি।এমন উদ্ভট আচরণ কেন?আসাদের চোখের দিকে তাকালে নিরু আগে ভরসা পেতো।আর এখন ভয় পাচ্ছে।কয়েক ঘন্টায় এতো পরিবর্তন? রাগ তো হওয়ার কথা নিরুর,সেখানে আসাদের এমন রুপ নিরু মানতে পারছে না।নিরুর দিকে আসাদ ভাই কেন আগের মতো শীতল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে না?নিরুর মনে শত প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে।
রাতে খাবার টেবিলে সবাই খেতে বসলেও আসাদ খেতে এলো না।পরে খেয়ে নিচ্ছে বলে পড়ার টেবিলে বসে রইল।সবাই খেয়ে উঠে পড়লে,আধা ঘন্টা পর আসাদের জন্য বেড়ে রাখা খাবার নিয়ে আসাদ খেতে বসল।
নিরু আসাদকে খেতে আসতে দেখে অপেক্ষা করছিলো। আসাদের খাওয়া শেষ হলেই ভর্তাটা নিয়ে গিয়ে দেবে।
আসাদের খাওয়া শেষ দেখে নিরু রান্না ঘরে গেল।ভর্তাটা নিয়ে আসাদের সামনে রাখলো।
_ আসাদ ভাই ভর্তা বানিয়েছিলাম।আপনার জন্য কিছুটা তুলে রেখেছিলাম।খেয়ে দেখেন।
আসাদ নিরুর দিকে তাকালো না।এমনকি ভর্তাটাও দেখল না।খাবার খাওয়া শেষ করে উঠে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে নিজের রুমে চলে যাচ্ছিলো।নিরু আবারও পিছন থেকে ডেকে বলল।
_ খাবেন না আসাদ ভাই?
আসাদ নিরুর কথা তোয়াক্কা না করে সোজা রুমে চলে গেল।আসাদের চারপাশের কিছু ভালো লাগছে না। নিজের এতো পছন্দের শান্তির রুমটাও অসহ্য লাগছে।ইচ্ছে করছে চন্দ্রনাথ পাহাড়টার উপরে গিয়ে বসে থাকতে।
নিরু ওখানেই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।পা দু’টো যেন কেউ সিমেন্ট বালির মিশ্রণে এঁটে দিয়েছে।নিরু বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের রুমে এসে বসল।আবার মনে হলো আসাদ ভাই কয়দিনের জন্য যাবে? কতদিন দেখতে পাবে না?
নিরুর অস্থিরতা কমছিলো না।নিরু আবারও রুম থেকে বেড়িয়ে এলো।আসাদ ভাই কে বিকেলের ঘটনাটা বলবে,ওই ছেলেটা কে ছিলো ওখানে দাঁড়িয়ে কি করছিলো সবটা বলবে নিরু ।বিকেলে রাগের মাথায় কিসব বলে ফেলেছে।নিরু ভেবে নিলো আসাদ ভাইকে ড্রয়িংরুমে ডাকবে।ভর্তাটা আরেকবার খেতে বলবে।আর কথা গুলো বলবে।নিরু রুমের বাইরে গিয়ে আসাদের রুমে নক করবে তখনই আসাদের কণ্ঠ শোনা গেল।কার সাথে যেন বলছে।
‘সামনে সপ্তাহেই যেতাম।এতো তাড়াতাড়ি কেন যাচ্ছি এখন তোকে বলতে পারছিনা।আমার সাথে গেলে চল।এক সপ্তাহ ঘুরবি।তা না হলে সামনের সপ্তাহে আসিস।আমি আগে চলে যাই।আমার এখানে ভালো লাগছে না দোস্ত। আমি পারলে বিকেলেই গাড়িতে উঠতাম।বাসার সবাইকে কৈফিয়ত দিতে হবে বলেই রাতটুকু থাকা।এখানে আমার দম বন্ধ লাগছে।যত দ্রুত সম্ভব বের হবো। তাড়াতাড়ি বের হবি।আর রিংকিকেও সাথে নিয়ে আসবি।আমাদের এখান থেকে এক সাথে গাড়িতে উঠব।এখন রাখছি।
নিরু কথা গুলো শুনে ওখানে আর দাঁড়াল না।চোখের জল উপছে পড়ছে।বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে যেন।এতো কষ্ট কেন হচ্ছে নিরুর?
‘নিরুর মন কী চাচ্ছে, আসাদ ভাই প্রতিটা মুহূর্ত নিরুর সামনে ঘুরঘুর করুক?’
ভোর পাঁচটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট, নিরু ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। ছাদ থেকে পুরো নজর গেটের কাছে আসাদ ভাই আর তার দু’টো বন্ধু আর রিংকি নামের মেয়েটার উপরে।আসাদের ঠিক সামনেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। আসাদ ভাই চলে যাচ্ছে,নিরুর থেকে অনেকটা দূরে।নিরু চাইলেও এখন আর লুকিয়ে লুকিয়ে আসাদ ভাই কে দেখতে পারবে না। আসাদ ভাই কখন ধমকে উঠবে সেই ভয়ে তটস্থ থাকতে হবে না। নিরুর বুকটা খা খা করছে।বাম হাতের উল্টো পিঠে যত চোখের জল মুছছে, তত বেশি জল গড়িয়ে পড়ছে।নিরুর আসাদ ভাই কি নিরুর চোখের এই জল দেখতে পাচ্ছে না?
আজিজুল হক, আমিনা বেগম মাহিয়ারা সবাই বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো।আসাদকে বিদায় দিয়ে সবাই ভিতরে চলে এলো।নিরু ছাদে দাঁড়িয়ে নিষ্পলক ভাবে আসাদের দিকেই চেয়ে ছিলো।রিংকি নামের মেয়েটাকে আসাদ একটা টিস্যুর প্যাকেট দিলো।নিরু চোখের জল মুছতে মুছতে ছাদের অন্য কিনারে চলে গেল।
‘এই নিরুর তোমার সহ্যশক্তি এতো কম কেন? তোমারই তো সহ্যশক্তি বেশি হওয়ার কথা।তুমি এমন ছিদকাঁদুনে কোথায় থেকে হয়েছো?তোমার আসাদ ভাই তোমারই আছে।তোমার থেকে তোমার আসাদ ভাইকে কেউ নিতে পারবে না। ‘
নিরু একা একা কথা গুলো ভেবে চোখ মুছে আকাশের দিকে চেয়ে রইল।আসাদের মুখটা আরও একবার দেখার জন্য ছাদের এই কিনারে এসে টলমলে চোখে অপলক ভাবে শুধু আসাদের দিকেই তাকিয়ে রইল।
চলবে…….