#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_২৬
আসাদ রাত তিন’টার মধ্যে চুয়াডাঙ্গাতে চলে আসে,সঙ্গে রাকিবও আছে।নতুন বাজারে পৌঁছিয়ে আসাদ আমিনা বেগমের ফোনে ফোন দিয়ে গেট খুলতে বলে।নিরুরা সবাই ঘুমিয়ে আছে।
নিরু সকালে ঘুম থেকে উঠে আসাদকে চেয়ার নিয়ে উঠানে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে।মনিকা আর আমিনা রান্না করছেন।রাকিব নিরুকে কেমন আছো জিজ্ঞেস করল।নিরু ও ভালো আছি বলে মাথা নড়ালো।আসাদ নিরুর দিকে তাকিয়ে বলল, “চুয়াডাঙ্গাতেই থেকে যাওয়ার ইচ্ছে নাকি?”
পাশ থেকে মাহিয়া এসে বলল, “নিরুর তো চুয়াডাঙ্গা খুব পছন্দ হয়েছে, থেকে যেতেও পারে। ”
নিরু মৃদু হেসে আসাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার কি ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষার ডেট দিয়েছে?”
“এখনো না,কয়েকদিনের মধ্যে দিবে হয়তো।”
“রাকিব ভাইয়া,তানজিলা আপু কেমন আছে?এবার আপুকে ঢাকাতে আসতে বলবেন।”
“আম্মু আর আপু সামনে মাসে আসবে।”
“কিছুদিন থেকে ভাবছি আপুর সাথে কথা বলবো।এবার বাসায় গিয়ে আপুর সাথে কথা বলবো।”
আসাদ ফোড়ন কেটে বলল, “তোর ইচ্ছে ভাবনাতেই শেষ।”
পুরো দিনটা বাড়িতে আড্ডা দিয়েই পার করলো।সন্ধ্যার পর মাহিয়ার কথায় আসাদ, নিরু ,মাহিয়াদের মাথাভাঙ্গা ব্রিজে ঘুরতে নিয়ে গেল।নিরুকে ব্রিজে নিয়ে আসা হয়নি তাছাড়া মোটামুটি জায়গা গুলো দেখানো হয়েছে।বড় বাজার আর নিচের ব্রিজ এই গুলো অতিরিক্ত যানজটের ভীড় হলেও নতুন ব্রিজটা শুনশান সুন্দর।ওরা অনেকক্ষণ ব্রিজের ওপর সময় কাটালো।রাকিব ব্রিজের শেষ প্রান্তটা দেখবে বলে মাহিয়াকে এইটা সেইটা বলে নিয়ে গেল।আসাদকে চোখ মেরে বলল, ‘গাড়ি আছে তুই গাড়ির কাছে থাক।’
মাহিয়া বলল, ‘নিরু তুমি চলো।’ আসাদ পিছন থেকে নিরুর হাত চেপে ধরে রইল।নিরু কোনরকমে বলল, “আপু এখানে দাঁড়িয়েই নদী দেখতে ভালো লাগছে।তুমি রাকিব ভাইয়াকে ঘুরিয়ে নিয়ে এসো।”
মাহিয়া রাকিবকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।রাকিব মাহিয়াকে শুধালো, “এইদিকে কোন এলাকা?”
মাহিয়া বলল, “ব্রিজ পার হয়ে দৌলতদিয়া, সামনে দেখেন এইটা বাসস্ট্যান্ড।”
“এই বাসস্ট্যান্ড থেকে কোনদিকে যাওয়া যায়?”
“এখান থেকে সোজা মেহেরপুর জেলা,মেহেরপুর কলেজ মোড় পর্যন্ত নিয়ে যাবে।”
“তোমাদের এলাকায় এসে ভালো লাগলো।নতুন নতুন এলাকা ঘুরতে ভালোই লাগে।”
“আপনাদের সীতাকুণ্ড ও কিন্তু অনেক সুন্দর।”
রাকিব হেসে বলল, “তা অবশ্য ঠিক”
দুজন কথা বলতে বলতে ব্রিজের শেষ প্রান্তে চলে গেল।আসাদ নিরুর হাতটা ছেড়ে নিরুকে দাঁড়াতে বলে গাড়ি থেকে ফোনটা আনতে গেল।নিরু আসাদকে পিছু ডেকে বলল,
“হেই মিস্টার আসাদ ভালবাসি!”
আসাদ নিরুর দিকে ঘুরে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে হাসলো।তারপর ফোনটা নিয়ে নিরুর কিছু ছবি তুলে দিয়ে নিরুর পিছনে দাঁড়িয়ে নিরুকে সঙ্গে নিয়ে কয়েকটা সেলফি তুললো।তারপর নিরুর পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, “খুব ভালবাসি !”
তারপর নিরুকে নিয়ে ব্রিজের শেষ প্রান্তের দিকে হেঁটে গেল।একান্তে সময় কাটানোর চেয়ে নিরুকে ঘুরে দেখানোতেই আসাদ বেশি তৃপ্তি পায়।নিরু নদীর জলে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। নিরু আসাদের দিকে একবার তাকিয়ে আবার ব্রিজের নিচে তাকালো।জায়গাটা শুনশান, নিরিবিলি, অন্যরকম সুন্দর,কেমন যেন শীতল খুবই সুন্দর! নিরু আসাদের দিকে তাকিয়ে বলল, জায়গাটা অনেক সুন্দর বলুন।”
“তোর মতো সুন্দর?”
“আপনার চোখে সবই-ই আমার মতো সুন্দর। ”
আসাদ হেসে ফেলল তারপর বলল, “নিরু আসপাশে কাজী অফিস আছে শুনেছি,চল বিয়ে করে ফেলি।”
“ঢাকাতে কাজী অফিস নেই, তাই না?”
আসাদ পিছনে একবার তাকিয়ে নিয়ে নিরুকে বলল, “তা তো আছেই,কিন্তু দূর এলাকা থেকে বিয়ে করে যাওয়াও একটা সুন্দরতম মুহূর্ত তৈরি করা।কিন্তু থাক করছি না।”
“কেন?”
আসাদ অত্যান্ত গুরুত্ব সহকারে বলল, “বাসর কোথায় করবো?খালামণিদের বাড়িতে কী সম্ভব তুই-ই বল?”
নিরু মনে মনে আওড়ালো, ‘ভাগ্যিস সম্ভব নয়।না হলে এই বিয়ে বিয়ে করা মানুষটা কখন কি করে বসে তার ঠিক নেই।’ কিছু সময় এমন এমন কথা বলে নিরু লজ্জায় পরে যায়, উত্তর দিতে পারে না। ‘
নিরু মাহিয়াদের দেখতে পেয়ে আসাদকে বলল, “মাহিয়া আপুরা ফিরে আসছে।”
“নিরু রে এই নিরু!”
নিরু কিছুটা সামনে এগিয়ে গেছিলো।আসাদের এইভাবে ডাকতে শুনে পিছু ফিরে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, “কি হু?”
“আমি বিয়ের কথা বলতেই তুই শুধু এড়িয়ে যাস কেন?ছেড়ে যাওয়ার মতলব করছিস নাকি?”
নিরু এগিয়ে এসে বলল, “আপনার এইটা মনে হয়?”
“তাহলে চল না বিয়ে করে ফেলি।”
“মামা আর মামানিকে গিয়ে বলেন।”
আসাদ ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ বাকা করে বলল, “বিয়ে কী তোর মামা মামানি করবে?”
রাকিবরা আসাদদের কাছাকাছি চলে এসেছে।মাহিয়া এসে নিরুর হাত ধরে দাঁড়ালো।নিরু এখন আর কোন উত্তর দিতে পারলো না।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চারজন গল্প করলো।রাকিব মাহিয়াকে প্রশ্ন করছিলো।মাহিয়া চুয়াডাঙ্গা সম্পর্কে রাকিবের করা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলো।এইদিকে আসাদ আর নিরু চোখে চোখেই শত স্মৃতি রচিত করলো।
পরের দিন ভোরেই চুয়াডাঙ্গা থেকে রওনা দিলো ওরা।নিরু এই কয়দিন খুব ভালো সময় কাটিয়েছে।যাওয়ার আগে মাহিয়াকে ওড়নাটা দিয়ে গেল।নিরুর এমন মায়াভরা ভালবাসা পেয়ে মাহিয়া খুবই আনন্দিত হলো।
নিরু ঢাকায় আসার পরের দিন কলেজে গিয়েই রুটিন পেলো পরীক্ষা শুরু মাত্র কয়টা দিন পরেই।নিরু পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।ক্লাস পড়াশোনা প্রাইভেট এই গুলো নিয়ে এখন পুরোটা সময় ব্যস্ত।এর মধ্যে আসাদের সাথে পড়াশোনার ব্যাপারে কথা হয়।মাঝে মাঝে ক্যাম্পাসে ঘুরে গল্প করে,ক্যান্টিনে বসে।
দেখতে দেখতে নিরুর এইচ এস সি পরীক্ষা চলে আসে।ওইদিকে আসাদের ও চতুর্থ বর্ষের ফাইনাল সেমিস্টার শেষের দিকে চলে আসে।সময় গুলো দ্রুতবেগে এগোচ্ছে যেন।
নিরুর পরীক্ষার মাঝামাঝি সময়ে মাহিয়ারা ঢাকাতে এলো,মাহিয়ার আব্বুকে ডক্টর দেখাবে বলে।স্ট্রোক করার পর থেকে মাহিয়ার আব্বুর অসুস্থতাই কাটে না।আজিজুল হক ডক্টরের সিরিয়াল নিয়ে রেখে নিজেই ভালো করে ডক্টর দেখিয়ে দেন,আসাদ ও সঙ্গে যায়।
আমিনা মনিকাদের কয়টা দিন রেখে দেন।দূরের পথ সহজে আসা যাওয়া করা যায় না। এসে দুই একদিনের মধ্যে চলে গেলে ভালো লাগে না।
এর মধ্যে আজিজুল হক ড্রয়িংরুমে এসে টিভিতে খবর দেখছেন।আসাদ এসে বলল, “আব্বু সামনে মাসে আর্মির একটা সার্কুলার দিবে হয়তো।”
“মাঠে দাঁড়িয়ে যেও,হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ! ”
“কিন্তু আব্বু তোমার তো ইচ্ছে আমি যেন এস এই নিয়োগে মাঠে দাঁড়াই।”
“কিন্তু তোমার স্বপ্ন তো আর্মিতে বাবা।”
“কিন্তু…! ”
“কোন কিন্তু না,তোমার স্বপ্ন তোমার ইচ্ছেটাই আমার ইচ্ছে।নিজের যেইটা ভালো লাগবে করবা,আমি সাথে আছি।আর খোঁজ নিয়ে দেখছি কতদিনে মাঠ আছে।”
আসাদ আনন্দে আত্নহারা হয়ে গেল।ছোট থেকেই স্বপ্ন সেনাবাহিনীতে যাবে।ইন্টারের পর চাকরিতে ঢোকার কোন ইচ্ছে ছিলো না বলেই তখন ভাবেনি।আর আজিজুল হক তখন ঢুকতেও দিতেন না।অবশেষে অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে।
মনিকারা চুয়াডাঙ্গা চলে যাওয়ার ঠিক আগের দিন আমিনাকে ডেকে ছাদে নিয়ে গেলেন।তারপর বললেন, “আপা নিরুকে কী তোমার ঘরেই রাখবা ভেবেছো?”
“মেয়েদের কি আর সারাজীবন ঘরে রাখা যায়? অনার্স ভর্তি করিয়ে আসাদের আব্বুকে ভালো একটা ছেলে দেখতে বলবো।মেয়েটার জন্য মায়া হয় কোথায় গিয়ে থাকবে কি করবে।”
“হ্যাঁ আপা ভাইকে বলবা।এমনিতেই এতিম মেয়েদের কেউ সহজে ঘরে নেয় না। এখন থেকেই দেখাশোনা করো।আর আমাদের আশপাশে ভালো ছেলে পেলে বলবো।”
“এই সময়ে নিরুর মতো মেয়ে হয় না,গুণবতী, নম্র,নিরুর মধ্যে কোন জটিলতা নেই।”
“এইটা আমরা জানি আপা,কিন্তু বাইরের মানুষ এতো কিছু ভাববে না।”
“মেয়েটাকে নিয়ে চিন্তা হয়।”
“নিরুর দাদু কিছু বলে না? মেয়ে বড় হচ্ছে।”
“হ্যাঁ ওনারা তো বলছেই।কিন্তু আসাদের আর আসাদের বাবার পছন্দ হয় না।একবারে না করে দেয়।”
“বউমা ঘরে আনছো কবে আপা?”
“আনবো খুব শিঘ্রই!নিরুর বিয়ে দিয়ে দিলে তো একা থাকাই মুশকিল হয়ে যাবে।নিরুর বিয়ে দেওয়ার আগেই ঘরে বউ আনবো।”
“আমার ঘরটা ফাঁকা হয়ে যাবে আপা।”
আমিনা হেসে বললেন, “তোরা সহ চলে আসিস,সবাই এক সাথে থাকবো।”
চলবে…