#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_৩০
আমিনা বেগম সেদিন সারারাত ঘুমালো না।এমনকি আজিজুল হককেও ঘুমাতে দিলো না,সারারাত বিলাপ বকে গেল।আজিজুল হক কোন কথা বললেন না, আমিনার কথায় চুপচাপ শুনে গেলেন।এই সময় আমিনাকে উগ্র করে, কথা কাটাকাটি, দ্বন্দ্ব করে বিষয়টা তেতো করা ছাড়া ভালো কিছু হবে না বলেই মনে করলেন।শেষ রাতের দিকে নরম স্বরে একটা কথা বললেন, “আমিনা তোমার কাছে একটা অনুরোধ আছে,তুমি আসাদকে এখন কিছু বলবা না।”
“কেন বলবো না?এই ছেলের এতো সাহস কে দিয়েছে,কোথায় থেকে পেয়েছে এতো সাহস?তুমি আশকারা দিয়েছিলে?”
“তুমি কি আমাকে প্রথম দেখছো?আমি তোমাদের সঙ্গে কাটানোর মতো সময় কখন পাই?”
“এই সময়টা দিতে পারো না বলেই আজ এই অবস্থা!”
আজিজুল হক এখন যা কিছু বলবেন সব কথাতে আমিনা বিপরীত যাবে।তাই আজিজুল হক আসল কথায় এলেন, “আসাদ কিছুদিনের মধ্যে চলে যাবে,এই সময় আসাদকে মানসিক চাপে আমি দেখতে চাই না।যা বলার বা শাসন করার আসাদ ট্রেনিং থেকে আসলে করবা, তার আগে কোন অশান্তি আমি দেখতে চাই না।”
আজিজুল হক শেষের কথাটুকু জোর দিয়েই বললেন,আমিনাও চুপ করে গেলেন।আজিজুল হক নিজের মতো করে আমিনাকে বোঝালো, এখন আসাদকে এই বিষয়ে বললে আসাদের ক্যারিয়ারে ক্ষতি হবে,এখন এইসব নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না।আমিনা বেগম নত হলেন,আর কিছু বললেন না। আসাদ ভোরের দিকে বাড়ি এলো,আজিজুল হক দরজা খুলে দিলেন।
আমিনা কেমন থমথমে হয়ে আছেন,আসাদ ধারণাও করতে পারছে না আসলে কি হয়েছে। আমিনাকে সেদিনের পর থেকে ভালো করে জিজ্ঞেস ও করতে পারে না। আসাদ আজ বলেই ফেললো, “আম্মু তুমি এইভাবে থাকলে আমি বাড়িতেই থাকবো না,রাকিবের বাসায় গিয়ে এই কয়দিন থাকবো।তারপর ট্রেনিংয়ে চলে যাবো,চাকরির মধ্যে চলে গেলে আমাকে দেখতেও পাবা না।কি হয়েছে বলছো না, এইভাবেই থাকো যাও।কি যে হয়েছে আল্লাহ জানেন!”
আসাদ চেচামেচি করার পর থেকে আমিনা কিছুটা নরম হয়েছেন।নিজেকে ধাতস্থ করে,আসাদের সাথে কথা বলছেন।স্বাভাবিক আচরণ করছেন।
আসাদ ট্রেনিংয়ে চলে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর থেকেই নিরুর ভার্সিটি এডমিশন শুরু হয়।আসাদ ট্রেনিংয়ে যাওয়ার আগে নিরুকে বলেছিলো।একটা দিনের জন্য রাজশাহী আসবে,লুকিয়ে কাবিন করে যাবে।এখন কাউকে কিছু জানাবে না,ট্রেনিং শেষ করে এসে জানাবে।এইসবে কেন জানি নিরুর মন সায় দিচ্ছিলো না,চুপচাপ ছিলো।নিরুর মন বলছিলো আসাদের কথায় সায় দিতে,কিন্তু মস্তিষ্কটা অন্যকিছু ভাবাচ্ছিলো।নিরু অবুঝ নয়! মামা মামানির এমন আচরণে নিরুর খটকা লেগেছে।প্রথম মাসটা নিরু নিজেকে বুঝ দিলেও পরে মাথায় এসেছে।নিরুর মধ্যে একটা ভয় কাজ করছে,নিরুর শুধু মনে হয় মামানি কি কোনভাবে কিছু আঁচ করেছে?এই ভাবনাতেই নিরুর দিন যায়।তাই এতবড় সিদ্ধান্ত নিরু নিতে পারে না। আসাদকে বুঝিয়ে বলার পর আসাদ নিরুকে প্রশ্ন করেছিলো, “আমি চলে গেলে বিয়ের জন্য চাপ দিলে কি করবি?”
নিরু তখন বলেছিলো, “আপনাকে না সেদিন বললাম,দাদু আমাদের সম্পর্কের কথা জানে,দাদুকে বলে ঠিক সামলিয়ে নিতে পারবো।ট্রেনিংয়ে যাওয়ার আগে রিস্ক নিতে হবে না।এইসব কথা বাতাসের আগে উড়ে,দেখা গেল হেড অফিসে এই খবর পৌঁছে গেল।”
আসাদ রাগ নিয়ে বলল, “কারো তো কাজ নেই, আমার বিয়ের খবর দিতে হেড অফিসে যাবে।”
“যেই মামা মামানি আমাকে আদর যত্নে বড় করে তুলেছে, প্রতিটা মুহূর্তে আমার ভালো খারাপ খেয়াল করে,আমাকে বুকে আগলে রেখেছে তাদের লুকিয়ে এতো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া আমাদের ঠিক হবে না।দাদু যতক্ষণ জানে, আমার বিয়ে নিয়ে চাপ দিবে না।আপনি নিশ্চিত থাকেন।আমি আর আপনি সব পরিস্থিতি এক সঙ্গে সামলিয়ে নেবো।”
“আমি ঢাকাতে থাকলে,এইসব প্যারা তোকে দিতাম না নিরু।”
“আমাকে তো আর নিজের কাছে রাখতে পারছেন না,তাহলে বিয়ে বিয়ে করছেন কেন?”
আসাদের মনটা অস্থির হয়ে আছে।অস্থির মন নিয়েই নিরুকে বলল, “তোকে আমার কাছে রাখা জরুরি না নিরু,তোকে আমার করে রাখাটা জরুরি!”
“আমি তো আপনারই, সাধ্যি কার যে আপনি অন্যের না হলে, আপনার কাছ থেকে আমাকে কেড়ে নিবে।”
“আমি জানিনা নিরু,আমার ভালো লাগছে না। তোকে মিস করছি,আমার কাছে চলে আয়, বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আটকে নিই।”
“আমি সব সময় আপনাকে অনুভব করি।”
“আমি তোর প্রেমে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি নিরু,এতো অস্থিরতা আমার কখনো লাগেনি।পাগল হয়ে যাচ্ছি।তোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।”
“ট্রেনিংয়ে তো চারদিন পর যাচ্ছেন?”
“হ্যাঁ!”
“ফ্রেমটা নিয়ে যাবেন?”
“অনেক আগেই ব্যাগের মধ্যে পুড়ে নিয়েছি।”
“আপনি এতো পাগল কেন?”
“তোর জন্য!”
“ভালবাসি আপনাকে!”
“খুব ভালবাসি!”
আসাদের সাথে কথা বলতে বলতেই জানালা দিয়ে নিরুর বাইরে চোখ গেল।একটা পিচ্চি ছেলে, অন্য একটা পিচ্চি ছেলের চুল ধরে টেনে দিলো।তারপর পিচ্চিটা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চুল টেনে দেওয়া পিচ্চিটার এক টানে প্যান্ট খুলে দিয়ে পালিয়ে গেল।এই দৃশ্যটাই নিরু দেখে খিলখিল করে হেসে উঠল।নিরুকে এইভাবে হাসতে দেখে, আসাদের বুকটা শান্তিতে ভরে গেল।মুচকি হেসে নিরুকে বলল, “ইশ!দিলি তো বুকে ছু*রি বসিয়ে।”
আসাদের কথায় নিরু আরও হেসে কুটি কুটি হলো,কোন রকম হাসি থামিয়ে নিরু বলল, “হেই মিস্টার আসাদ একদিন আমিও আপনার সাথে এই সিনটা করবো।”
“কোন সিনটা?”
নিরু তখন দুই পিচ্চির ঘটনাটা বলল,এবার আসাদ,নিরু দুজনেই এক সাথে হো হো করে হেসে উঠল।নিরু বলল, “আপনি শুধু আমার চুল ধরে টানেন,আপনার সাথে আমি এইটাই করবো।”
“আমি তোকে ছেড়ে দেবো মনে হচ্ছে।”
“কি করবেন চুমু দিবেন?”
“রাজশাহী গিয়ে বড় হয়ে গেছিস,দুষ্টুমি শিখেছিস।”
“তা একটু শিখেছি।”
সেদিনই দুজনের মধ্যে অধিক কথাবার্তা হয়েছিলো।হাসাহাসি হয়েছিলো,তারপর থেকে এতো মুগ্ধতা নিয়ে দুজনের আর কথোপকথন এগোয়নি।
আমিনা বেগম আনাস মোল্লাকে বলেছেন, “চাচা আপনি একা থাকেন,নিরুকেও অনেক আগে থেকেই নিজেদের কাছে রাখতে চান।আমরাই জোর করে রেখেছিলাম।এখন আমি আর আসাদের আব্বু আপনার কথাটাও ভাবছি,নিরু শুধু রাজশাহী ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিক।ঢাকাতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে হবে না।পরের ঘরে যাওয়া পর্যন্ত আপনার সঙ্গে থাকুক।”
আনাস মোল্লা আমিনার কথায় খুশি হলেও,ভিতরে একটা দুশ্চিন্তা ভর করলো।যেই আমিনা, আজিজুল নিরুকে এক সপ্তাহের বেশি কাছছাড়া করতো না,বেলায় বেলায় ফোন দিয়ে খোঁজ নিতো।তারা হঠাৎ এমন একটা সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলো?আনাস মোল্লা তো আজ থেকে একা নেই, বছর পার করে ফেলেছে।আনাস মোল্লার হুট করেই মনে হলো,নিরু এবার এসে পর্যন্ত আজিজুল, আমিনা কেউ-ই ঠিক ভাবে ফোন করেনি।ভিতর ভিতর একটা দুশ্চিন্তা গেড়ে বসলো।আনাস মোল্লা নিরুকে কাছে ডেকে বললেন, “ওই বাড়িতে কী তোমাকে নিয়ে কিছু হয়েছে দাদু?”
নিরু চকিতে তাকিয়ে বলল, “কোন বাড়িতে দাদু?”
আনাস মোল্লা বললেন,”আজিজুলদের বাড়িতে,”
“না তো দাদু আমাকে নিয়ে কী হবে?”
আনাস মোল্লা নিরুকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না।এখন যদি বলে এখানে থেকেই পড়াশোনা করতে বলছে।ঢাকায় ভর্তি পরীক্ষা দিতে না করছে, নিরু মন খারাপ করবে।তাই বললেন, “নাহ অনেকদিন হলো আজিজুল আসছে না তাই বলছি।”
“মামা তো অনেক ব্যস্ত থাকে।আমার কোচিংয়ের জন্য আসছে না, একবারে ঢাকায় ভর্তি পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই নিতে আসবে দেখবা।”
আনাস মোল্লা এখন আর এই বিষয়ে কিছু বললেন না। রাতে খাবার খেয়ে নিরুকে পাশে বসিয়ে, আজিজুল আর আমিনার কথা না বলে, নিজের কথা বলেই নিরুকে কথা গুলো বললেন।
“নিরু আমি চাচ্ছি তুমি রাজশাহী থেকেই পড়াশোনা করো,এখানে আমার একা ভালো লাগে না। সারাদিন একা থেকে হতাশা ঘিরে ধরে,শরীর খারাপ লাগে।”
নিরু মাথা নিচু করে বলল, “কিন্তু মামা মামানি!”
“আমি আজিজুলের সাথে কথা বলে নেবো।আমার কথা রাখবে,কিছু বলবে না ”
নিরু আর কিছু বলল না,আসাদ তো বলেছেই রাজশাহীতে ভর্তি হলেও সমস্যা নেই।রাজশাহীতে পোস্টিং হয়ে যেতে পারে। বাকি রইল মামা মামানির জন্য মন খারাপ হওয়া,দাদুর জন্য এতটুকু মন খারাপ নিরুকে মেনে নিতে হবে।নিরুর এই মানুষটাই অধিক আপন!
নিরু আমিনার কাছে দিনে দুইবার করে ফোন দেয়।আমিনা ভালো মন্দ কথা জিজ্ঞেস করে, কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে তারপর কথা শেষ করে দেয়।আগের মতো নিরুর সাথে গল্প করে না।সারাদিনে কি কি করলো সেগুলো আর বলে না।নিরুর ভীষণ মন খারাপ হয়,মামানির কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। বলতে ইচ্ছে করে, ‘আমার উপর রেগে আছো কেন বলো? তুমি না আমার মা!’ নিরুর মনের কথা গুলো মনেই জমা রাখে।আসাদ ট্রেনিংয়ে যাওয়ার পর থেকে একদিন দু’মিনিট কথা হয়েছে।
নিরু শুধু রাজশাহী ভার্সিটিতেই ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলো,কিন্তু ভার্সিটিতে হয়নি।ইচ্ছে ছিলো ঢাকাতে পরীক্ষা দেওয়ার,কিন্তু ইচ্ছে গুলো চাপা পড়ে গেছে।নিরু রাজশাহী কলেজেই ভর্তি হয়।
এর মধ্যে নিরুর দাদু একদিন একটা দরকারে ঢাকায় যাবে বলে। নিরু দাদুকে নিরুর জিনিসপত্র গুলো আনার কথা বলল।আনাস মোল্লা বললেন, “আমি কি সব গুছিয়ে আনতে পারবো।তার চেয়ে তুমি আমার সঙ্গে চলো, গুছিয়ে নিয়ে আসা যাবে।”
নিরু আমিনার ফোনে কল দিলো,আমিনা রান্না ঘরে থাকায় কল রিসিভ করতে পারলো না।পরে নিরু আজিজুল হকের কাছে ফোন দিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে দেয়।
আজিজুল হকের বুকের মধ্যে চিনচিন করে,কোনদিকে যাবে কি বলবে বুঝতে পারেনা।আজিজুল হক এমন একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছে।যেখানে এই শক্ত মানুষটাও ভেঙে পড়েছে।কোনো সিদ্ধান্তে যেতে পারছেন না।
চলবে…