স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর #লেখা_চাঁদনী_ইসলাম #পর্ব_৩৩

0
522

#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_৩৩

নিরুর ঘরবন্দী জীবন এখান থেকেই শুরু হয়,সাথে শুরু হয় ডিপ্রেশন।মাঝে মাঝে মামানির ফোন আসে এতিম শব্দটা মনে করানোর জন্য,আর উনার ছেলের জীবন থেকে দূরে যাওয়ার জন্য।মাসে দুই একবার এই গুলো মনে করাতেই উনি কল দেন।নিরুর চারপাশের কিছু আর ভালো লাগে না।সারারাত জেগে বসে থাকে। ফ্লোরে একবার বসে,তো আরেকবার বিছানায়।কোথাও বসে যেন শান্তি পায় না।ভোর রাতের দিকে চোখ বন্ধ হয়ে এলেও, দু’পাঁচ মিনিটের মধ্যে বুক ধড়ফড় করে ঘুম ভেঙে যায়।খেতে ইচ্ছে করে না,খাবার দেখলে গা গুলিয়ে আসে।নিজের ঘরের মধ্যে দরজা ঠেলে বসে থাকে।আনাস মোল্লা নিরুকে অনেক বুঝিয়েও কিছু করতে পারেননি।বার বার নিরুর ঘরে এসে দেখে যান,খাবার নিয়ে নিরুর পাশে বসে থাকেন।নিরু জোর করে ভাত মুখে দিলেও বমি হয়ে যায়।বুক আটকে আসে।আনাস মোল্লা এই গুলো দেখতে দেখতে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।

নিরুর চাচা, চাচি,চাচাতো বোন সুমাইয়া রাজশাহীতে একবারে চলে আসে।আনাস মোল্লা একটু চিন্তা মুক্ত হোন।বাড়ি ভর্তি মানুষ থাকলে নিরুর সময়টা ভালো কাটবে আশা করেন।কিন্তু নিরু সারাদিন নিজের ঘরেই থাকে,খুব কম সময় বের হয়।নিরুর বুক পুড়ে যায়,আসাদ ট্রেনিং শেষ করে এলে কীভাবে সামলাবে বুঝতে পারে না।আসাদ যে সবকিছু তছনছ করে দেবে,কীভাবে সবটা সামলাবে নিরু?
আমিনা বেগমের ধারালো কথা গুলো নিরুর মস্তিষ্কে যন্ত্রণা সৃষ্টি করছে। “আসলেই তো আসাদের এতো সুখ পাওয়া থেকে নিরু কেন আসাদকে বঞ্চিত করবে?নিরুর নিজের বলতে তো আসলেই কেউ নেই।আসাদের নিরুর ভালবাসা ছাড়াও চারপাশের মানুষদের ভালবাসা পাওয়ার প্রয়োজন আছে।নিরু এইটা কেন বুঝলো না।”
নিরু নিজের সঙ্গে একাই বিলাপ বকে যায়,মাথায় কাজ করে না।
খাওয়া ঘুম সব হারাম হয়ে গেছে।দিন দিন জেদি হয়ে উঠছে।আনাস মোল্লার কথা গুলো শুধু শুনে যায়,কোন উত্তর দেয় না।দরজা জানালা বন্ধ করে অন্ধকারে বসে থাকে।বুকের এই অসহ্য যন্ত্রণাটা নিরু কাউকে দেখাতে চায় না।

নিরুর দিনগুলো এইভাবেই কাটে।হাসে না,প্রয়োজনের বাইরে কারো সাথে ঠিকভাবে কথা বলেনা।আসাদ এই বাকি ছয় মাসে যতবার ফোন দিয়েছে বেশির ভাগ সময় নিরু আনাস মোল্লাকে ফোন ধরিয়ে দিয়েছে।আনাস মোল্লা বলেছেন কোন কাজে বাইরে আছেন।নিরুর যেদিন খুব অস্থির লেগেছে ফোন রিসিভ করে দুই একটা কথা বলেছে।কথা শেষ করে বদ্ধ ঘরে হাইমাউ করে কেঁদেছে।বুক ডলে বুকের যন্ত্রণা নিবারণের চেষ্টা করে গেছে।

আসাদ ট্রেনিং শেষ করে বাড়ি এসে,আনাস মোল্লার ফোনে একভাবে কল দিচ্ছে।কিন্তু রিং হচ্ছে না,কেটে যাচ্ছে।আজিজুল হককে আসাদ জিজ্ঞেস করে, ‘দাদুর ফোনে কল যায় না কেন?’ আজিজুল হক ও বলতে পারলেন না।
আসাদ আজিজুল হক আর আমিনাকে বলে রাজশাহী আসতে চাইলে, আমিনা বাধা দেন।আর বলেন, “কাল রাতে বাড়ি এসেছো,তোমার এখন রাজশাহীতে কী প্রয়োজন?”

“দাদু আর নিরুকে দেখতে যাবো আম্মু, নিরু কী এই একবছরে একবারো আমাদের বাড়িতে আসেনি?”

“আমিনার কাঠ কাঠ উত্তর, ” না আসেনি।”

“আম্মু আমি নিরু আর দাদুর সাথে দেখা করতে যাবো।”

আমিনা বললেন, “চুয়াডাঙ্গায় গিয়ে তোমার খালামণি,মাহিয়াদের সাথে দেখা করে এসো।”

“চুয়াডাঙ্গায় যাবো কেন?খালামণিদের আসতে বলো ঘুরে যাক।আমার সময় নেই।”

“আমিনা বেগমের রাগ হলো, ” সময় নেই তো রাজশাহী কীভাবে যেতে চাচ্ছো?”

“আমার দরকার আছে আম্মু।”

“কী দরকার বলো শুনি?”

আসাদ মাথা নিচু করে বললো, “নিরুর সাথে দেখা করতে যাবো।”

“আসাদ তোমার সাথে জরুরি কথা আছে?”

“বলো শুনছি।”

“এবার কী তোমার সময় হবে?”

“কিসের সময় আম্মু?”

“তোমার কাবিন করতে চাচ্ছিলাম।”

আসাদ একটু লজ্জা পেল,মাথাটা নিচু করে ফেললো।আসাদের আর নিজের মুখে বলতে হলো না,আসাদের মনের কথা বুঝে গেল?আসাদ মুখ ফুটে না বলতেই আসাদের সব পছন্দের জিনিস গুলো আম্মুর থেকে পেয়েছে। এইসব ভেবে আসাদ মনে মনে আনন্দিত হলো।
আমিনা বেগম আবার বললেন, “তুমি চুয়াডাঙ্গাতে যাবা?না তোমার খালামণিকে বলবো মাহিয়াকে নিয়ে চলে আসতে?”

আসাদ বিরক্ত মুখে বলল, “আমি আবার চুয়াডাঙ্গায় কী করতে যাবো?”

“বিয়ে কী আমাদের বাড়িতে পড়াবো?মেয়ের বাসায় গিয়ে পড়াতে হয় বাবু।”

আসাদ এবার একটু নড়ে উঠলো।তারপর বলল, “বুঝলাম না ভালো করে বলো?”

“মাহিয়ার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি।”

আসাদ মুহূর্তে রাগে গর্জে উঠলো,বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।আসাদের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে,কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে।আসাদ চিৎকার করে কিছু বলতে গিয়েও চুপ হয়ে গেল,নিজের রাগটা সংবরণ করে বলল, “এমন সিদ্ধান্ত কাকে বলে নিয়েছো আম্মু?”

“এতদিন তোমার সব সিদ্ধান্ত আমি কাকে বলে নিতাম?”

আসাদ টানা একটা শ্বাস নিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলল,”আমার পড়াশোনা ক্যারিয়ার এইসব সিদ্ধান্ত, আর এই সিদ্ধান্ত এক নয় আম্মু।”

“আমি তোমার পড়াশোনা, ক্যারিয়ার সব সিদ্ধান্ত যেমন ঠিকটাই নিয়েছি।এইটাও ঠিকটাই নেবো।”

“আম্মু তোমাকে বোঝাতে পারছি না। এইসব বাদ দাও।”

“কোন কিছু বাদ দেওয়া যাবে না। ”

“কেন বাদ দেওয়া যাবে না আম্মু?”

আমিনা উচ্চস্বরে বললেন, “কিসের জন্য বাদ দেবো?তোমার পছন্দের কালসাপ ঘরে নেওয়ার জন্য বাদ দেবো বলো?”

“আম্মু কিসব বলছো?”

“বেশি কথা বলো না আসাদ।আমি তোমার খালামণিকে আসতে বলছি।”

“আমার কথা কি তুমি বুঝতে পারছো না।আব্বু কোথায়?আব্বু, ও আব্বু!”

“বাসার নেই তোমার আব্বু।”

“আম্মু আমি নিরুকে পছন্দ করি,নিরুকেই বিয়ে করবো।অন্যকাউকে না।”

আমিনা বেগম একটুও অবাক হলেন না।আসাদকে বোঝানোর মতো ঠান্ডা মাথাও আমিনার না।এখন অল্পতেই মাথা গরম হয়ে যায়।আমিনা তাই একটু সময় নিলেন।

আসাদ বাড়ি থেকে বের হয়ে গাড়ি নিয়ে রাজশাহীর উদ্দেশ্য রওনা দিলো।আসাদের মস্তিষ্কে বার বার একটা কথায় আসছে।নিরু কি এইসব সম্পর্কে কিছু জানে? জানলে কীভাবেই বা সহ্য করে আছে।নিরু নরম মনের, একদম কষ্ট সহ্য করতে পারে না।আসাদ ড্রাইভ করার সময়েও আনাস মোল্লার ফোনে কল দিয়ে গেল।একবারও গেল না।আসাদ মনে মনে আওড়ালো ‘ফোন কেন বন্ধ করে রেখেছে।’

আসাদ বিকেলের মধ্যে রাজশাহী পৌছিয়ে গেল।নিরুর প্রচন্ড গলা ব্যাথা হওয়ায় রান্না ঘরে গরম পানি করতে এসেছিলো।রান্না ঘরের জানালা দিয়ে আসাদকে দেখে, নিরু দ্রুত পায়ে ড্রয়িংরুমে এসে তাড়াহুড়ো করে নিরুর চাচি আর চাচাতো বোন সুমাইয়ার উদ্দেশ্য বলল, “চাচি আসাদ ভাই আসছে।তোমরা শুধু বলবা দাদুকে নিয়ে নিরু ঢাকা মেডিকেলে ডক্টর দেখাতে গেছে।যদি বলে দাদুর ফোন বন্ধ কেন,তাহলে বলবা হয়তো নেট সমস্যা আর কিছু বলবা না। তোমরা আসাদের খুব একটা পরিচিত নও,বেশি কিছু জিজ্ঞেস করবে না।দয়া করে এইটুকু বলে এখান থেকে বিদায় করবা প্লিজ!কলিংবেল বাজছে দরজাটা খুলে দাও। চাচি বা সুমাইয়াকে একটা কথা বলার সুযোগ দিলো না।হাত জোর করে বলে,এক সেকেন্ড না দাঁড়িয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা লক করে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল।আনাস মোল্লা খাদিজার বাড়িতে গেছেন।আনাস মোল্লা থাকলে হয়তো সব বলে ঠিক করার চেষ্টা করতেন।

সুমাইয়া দরজা খুলে দিলো।ছোট চাচি মিথ্যা বলবে না বলে নিজের ঘরে চলে গেল।নিরুকে দেখে সবার শুধু কষ্টই হয়,কিন্তু সেই কষ্ট নিবারণ করার সাধ্যি কারো নেই।নিরু চায় না কেউ এই বিষয়ে আসাদের বাড়িতে কথা বলুক।নিরুর জেদের কাছে সবাই দমে গেছে।

সুমাইয়া দরজা খুলে দিয়ে আসাদকে ভিতরে আসতে বললো।আসাদ সুমাইয়ার সঙ্গে কথোপকথন শেষ করে বলল, “দাদু কোথায় সুমাইয়া?”

“নিরু আপু দাদুভাইকে নিয়ে ঢাকায় ডক্টর দেখাতে গিয়েছে ভাইয়া।”

“ইশ! কবে গিয়েছে?”

“গতকাল গিয়েছে ভাইয়া।”

“দাদুর নাম্বার বন্ধ কেন জানো?”

“জানিনা তো ভাইয়া।নেটের সমস্যা হতে পারে।”

আসাদ ‘হয়তো’ বলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।

“বসুন না ভাইয়া।”

“আমি আর বসছি না।কোথায় ডক্টর দেখাচ্ছে জানো?”

“মেডিকেলে ভাইয়া।”

“আমি আসছি তাহলে,ফোনে কথা হবে আপু।”

সুমাইয়ার এতো গুলো মিথ্যা কথা বলতে কান্না পাচ্ছিলো।বার বার বলতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, “ভাইয়া আপু ঘরে,আপনি আপুর সব কষ্ট দূর করে দেন।”

আসাদ দরজার কাছ থেকে আবার ফিরে এলো,চারপাশে তাকিয়ে ক্লান্ত চোখ জোড়া নিয়ে সুমাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো, “সুমাইয়া তোমার আপুর শরীর ভালো আছে?”

সুমাইয়া না চাইতেও সুমাইয়ার মুখ দিয়ে একটা কথা বেরিয়ে এলো, “আপু ভালো নেই ভাইয়া।আপু খুব কষ্ট পাচ্ছে।আপনি তাড়াতাড়ি আপুকে আপনার কাছে নিয়ে যান।অন্য কোথাও বিয়ে করবেন না প্লিজ!”
সুমাইয়া কথা গুলো বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললো।আসাদ সুমাইয়ার কাছে এগিয়ে এসে বলল, “আমার মন বলছিলো তোমার আপু ভালো নেই।এই জন্য আমি ছুটে এসেছি।তোমার আপু আর কষ্ট পাবে না।আমি এসে গেছি,আমি আজই ঢাকায় ব্যাক করে নিরুকে খুঁজে বের করবো।আর কষ্ট পাবে না তোমার আপু।তুমি ভালো থেকো,আমি যাচ্ছি।”

আসাদ আর একটা সেকেন্ড না দাঁড়িয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে।সুমাইয়া পিছন থেকে কয়েকবার ডেকেছে কিন্তু আসাদ শুনতে পায়নি।নিরু দরজাটা খুলে রান্না ঘরে এসে আসাদের পিছনটুকু দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো।সুমাইয়া গিয়ে নিরুকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো।
“ভাইয়া তোমাকে অনেক ভালবাসে আপু।”

নিরু সুমাইয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লো।অস্থির হয়ে বিলাপ বকে গেল।নিরুর নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।দৌড়ে গিয়ে আসাদকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে, “আমাকে একটু শক্ত করে আপনার বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরুন।আমার বুকের ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে,দম বন্ধ হয়ে আসছে।আপনাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। আপনি আমাকে আজীবন শক্ত করে জড়িয়ে রাখুন না।”

আসাদ ঢাকায় ব্যাক করে মেডিকেল সহ আশপাশের হসপিটাল, ডক্টরের চেম্বার সব জায়গায় খোঁজ করলো।আশপাশের চেনা জায়গা গুলো হন্যে হয়ে খুজলো।কিন্তু আসাদের সেই চেনা মুখ, চেনা মানুষটার দেখা পেলো না।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here