#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_৩৬
খুব মনে পড়ে তোকে,
তোকে মনে পড়ার কোন নির্দিষ্ট সময় অসময় নেই।
তোকে মনে পড়তে কোন বাঁধা নেই।
কিন্তু মনে করতে বাঁধা আছে।
তোর মুখের বুলি,
মনে করতে বলে কে?
মনে করেন কেন আমায়?
আমি বলি আরে বোকা মনে করতে হয় না,
মনে পড়ে যাই।
সত্যিই যদি মনে করাতে হতো,
সেই মনের পায়ে শিকল বেঁধে থামিয়ে রাখতাম।
একটুও মনে করতে দিতাম না।
তুই নামক নেশাকে!
কিন্তু কি করার বল,
তোকে মনে করতে হয় না।
মনে পড়ে যায়।
এই মনে পড়াটাকে আমি শিকল বেঁধে থামাতে পারিনা,
পারিনা বেঁধে রাখতে।
কেমন জানি সব এলোমেলো হয়ে যায়।
বুকের মধ্যে চিনচিন একটা ব্যথা ওঠে।
এই ব্যথাটার নাম আমার জানা নেই।
জানা থাকবে কেমন করে বল?
এই ব্যথার সাথে যে আমি পরিচিত নই।
পরিচয় করিয়ে দিয়েছিস যে তুই,
ব্যথাটা কিন্তু খুব একটা কষ্টের নয়।
কারণ ব্যথাটা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিস যে তুই,
তোর দেওয়া পরিচিত ব্যথা কী কষ্টের হতে পারে?
তুই নামক ব্যথাটা সত্যিই বড্ড বেশিই সুখের,
চাইলেও ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছিস, আমার পুরোটা জুড়ে,সুখের ব্যথা হয়ে।
আসাদ গত তিনবছরে এই কবিতাটা দিয়ে তিনশত তেইশটা কবিতা নিরুকে ভেবে লিখেছে।
আসাদের ডিউটি আর এই মোটা কালো ডায়েরিটাই সম্বল।নিজের একান্ত বলতে এই দুটো জিনিসকে নিয়েই বেঁচে আছে।শেষ দেখা হওয়ার দিন নিরু আসাদকে বলেছিলো, ‘মনে করতে বলে কে,মনে করেন কেন আমায়?’
নিরু যদি একটা কথা বুঝতো।নিরুকে যে মনে করতে হয় না,এমনিতেই মনে পড়ে যায়।
এই তিনটা বছরে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে।আসাদ বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।আজিজুল হকের জোড়াজুড়িতে তিনবছরে চার বার বাড়িতে গেছে।আমিনা বেগম খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। কান্নাকাটি করছিলেন বলে, দুইদিনের জন্য গিয়ে থেকে এসেছে।আসাদ ছুটি পেলে দূরে ঘুরতে যায়।বাড়িতে ছুটি কাটাতে যায় না।
আজিজুল হক আনাস মোল্লার সাথে কথা বলার মুখ পান না।আনাস মোল্লার ফোনে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েও যোগাযোগ করতে পারেননি।খাদিজার সাথে একবার যোগাযোগ করেছিলেন।খাদিজা বলেছিলেন, ‘বাবা নিরু কেউ-ই আপনাদের সাথে কথা বলতে চায় না।উনাদের মতো করে থাকতে দেন।নিরু ভালো আছে,চিন্তা করার দরকার নেই।’
এর পর থেকে আর কারও সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি।আজিজুল হকের নিরুর জন্য বুক ফেটে যায়।
তিনমাস আগে আজিজুল হক রাজশাহী গেছিলেন,গিয়ে দেখেন আনাস মোল্লার বাড়িতে তালা ঝুলছে।আশপাশে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন দু’বছর আগেই এখান থেকে চলে গেছেন।আশানুরূপ কোন কিছু জানতে না পেরে আজিজুল হক চলে এলেন।আজিজুল হক কোন মুখেই বা খুজে বের করে সামনে যাবেন,তাই আর নিজ থেকে খোজাখুজি করলেন না।
আমিনা বেগম আসাদকে বিয়ে করানোর জন্য কাতর হয়ে গেছেন।আসাদকে বার বার বলেন নিজের পছন্দ মতো বিয়ে করতে,আমিনা আর কোন কিছুর মধ্যে যাবেন না। আসাদ যেন শুধু বিয়েটা করে সংসারী হয়।আসাদ আমিনার কথা শুনে মৃদু হাসে।বলার মতো কিছু থাকে না। যেই মানুষ জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছে,তার আবার সংসার! এইসব ভেবে আনমনেই হেসে উঠে।গোছালো মানুষটা একটা ঝড়ে পুরো এলোমেলো হয়ে গেছে।আর কিছু গোছানোর নেই।
বহুদিন পর রাকিবের ফোন পেয়ে আসাদের মুখে হাসি ফোটে।যাদের সাথে প্রতিটা মুহূর্ত কাটানো হতো,তাদের সাথে এখন বছরের পর বছর যোগাযোগ হয় না।দরকার পড়লে রাকিবের সাথে মেসেজে মাঝে মাঝে কথা হয় অবশ্য! কিন্তু ঘটা করে বহুদিন ফোনে কথা হয়নি।রাকিবের নাম্বার দেখে আসাদ হেসে ফোন রিসিভ করে বলল, “একদম ভুলে বসে আছিস?”
” ভুলে বসে থাকলে, ফোন করলাম কীভাবে মামা?”
“দেখ কোন গার্লফ্রেন্ডকে কল দিতে গিয়ে,আমাকে ভুলে দিয়ে ফেলেছিস।”
“মামা তাই-ই হবে।দাঁড়া চেক করে দেখি।”
“আর ভালো হবি না।”
“ভালো কখনো ছিলাম? তাই আবার নতুন করে ভালো হতে হবে?”
দুই বন্ধু হো হো করে হেসে উঠলো।রাকিব আবারও বললো, “আসাদ শোন!”
“হ্যাঁ বল।”
“সামনে মাসের ২০ তারিখে আমাদের ইন্টারের ব্যাচটা এক হতে চাচ্ছি।সময় হবে তোর?”
“পরিকল্পনা করলি কবে?”
“আরে আজ-ই করলাম।তোর নিব্বিকালের হতে হতে না হওয়া প্রেমিকা পরিকল্পনা করছে।”
“রিংকি?”
“কোন ক্লু দিলাম না,মুখ ফুটে কিছু বললাম না।বুঝে গেলে,আড়ালে কিছু চলতো নাকি মামা?”
“আড়ালে না, তোকে পাহারায় রেখেই চলতো।অফিসে আছি তাই মুখটা সামলে নিলাম।”
রাকিব হো হো করে হেসে বলল, “বেঁচে গেলাম।”
আসাদ বলল, “সামনে মাসে দেখা হচ্ছে দোস্ত!”
“শিওর?”
“তোকে আগেই জানিয়ে দেবো।যত সম্ভব যেতে পারবো।”
“ইয়াহু! আচ্ছা দোস্ত নিরুর কী খবর?”
“জানিনা দোস্ত,ভালোই আছে হয়তো।”
“তুই নিরুর কোন খোঁজ জানিস না? ”
“নিরুর সব কিছু থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি।সুখে থাক,আমাকে যেন আর কখনোই ওর মনে না পড়ে।”
“নিরু এমনটা কীভাবে করতে পারলো?”
“নিরু নিজ ইচ্ছেই কিছু করেনি আমি জানি,নিরু খুব নরম মনের আম্মু নিরুকে অনেক কিছু শুনিয়েছে আমি বুঝতে পারি।”
“তোকে তো সব বলতে পারতো।দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিতিস।”
“নিরু অনেক চাপা স্বভাবের জানিস তো।আর আম্মু কিছু বললে ওর জীবন দিয়ে হলেও সেইটা করবে।দেখ দোস্ত, নিরু শুধু নিজের জীবনটাই দিলো না।সাথে আমার জীবনটাও নিলো।”
“মন খারাপ করিস না।এবার নিজের জীবনটা গুছিয়ে নে।”
“কাউকে সহ্য হয় না দোস্ত।নিরুকে ছাড়া চোখের সামনেই কাউকে সহ্য করতে পারিনা,সংসার কীভাবে করবো বল?”
আসাদের কথার পিঠে রাকিব কি বলবে বুঝতে পারলো না,চুপ করে রইলো।আসাদ রাকিবের মন খারাপ করাতে চায় না।কিছুক্ষণ এইটা সেইটা বলে হাসালো।তারপর বলল,”সবাই ঢাকায় এক সাথে হতে চাচ্ছিস?”
“আরে না সীতাকুণ্ডে আমাদের কলেজেই।”
“দুর্দান্ত পরিকল্পনা।”
“দুর্দান্ত তো হবেই।তোমার রিংকি প্রেগন্যান্ট তাই জার্নি করবে না।তাই হাতের কাছে আয়োজন করছে।আমরা তো আর প্রেগন্যান্ট না,তাই আমাদের-ই জার্নি করে যেতে হবে।”
আসাদ পেট চেপে হাসছে।রাকিব সেই আগের মতোই রয়ে গেছে।দুই বন্ধুর কথোপকথন শেষ হলে।আসাদ ডিউটিরত সৈনিকদের কাছে টহল দিয়ে দেখে আসে সব ঠিকঠাক আছে কিনা।
আসাদ সময়মতো রাকিবকে জানিয়ে দিলো যেতে পারবে।সবাই সীতাকুণ্ডে একত্র হবে।আসাদ সাতদিনের ছুটি পেলো।সীতাকুণ্ডে দু’দিন থেকে বাড়িতে এসে এবার কয়দিন থাকবে।যা হয়ে গেছে সেইটা আসাদ ফিরে পাবে না। কিন্তু আসাদ আর চায় না, আসাদের কারণে মা-বাবার মধ্যে মনোমালিন্য চলতেই থাকুক।আসাদ স্বাভাবিক থাকলে মা-বাবার দূরত্বটুকু ঘুচে যাবে।
আজ আসাদের মনটা অজানা কারণেই ফুরফুরে লাগছে।সীতাকুণ্ডে নিরুর সাথে অসংখ্য স্মৃতি আছে।নিরুর স্মৃতি আসাদকে এখন আর কষ্ট দেয় না।আসাদ এখন নিরুর স্মৃতির মাঝে সুখ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে।খারাপ সময় গুলোকে একপাশে রেখে মা-বাবাকে ভালো রাখার জন্য আসাদ এখন নিজেকে নতুন ভাবে গড়বে।
ভিতরটা এলোমেলো হয়েই থাকুক।ভিতরের অগোছালো এলোমেলো ভাবটুকু আর কাউকে দেখাতে ইচ্ছে করে না।উপরে একটু গোছালো ভাব ধরে থাকলো না হয়,এতে যদি আপন দুটো মানুষ ভালো থাকে।আসাদ আমিনার সাথে ফোনে অনেকক্ষণ গল্প করলো,বাড়ি গিয়ে কয়দিন থাকবে ঘুরতে নিয়ে যাবে।বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে ফোন রেখে দিলো।নিজের কাছেই আসাদের আজ অনেক হালকা লাগছে।
১৯ তারিখ সকালে আসাদ রওনা দিলো,রাকিব আগের দিন চলে গেছে।আসাদ রাকিবের বাড়িতে গিয়ে উঠে।রাকিবের আব্বু, আম্মু, তানজিলা আসাদকে দেখে খুব খুশি হয়।তানজিলা এখন ঢাকায় শশুর বাড়িতে থাকে।দুইদিন আগেই চলে যেতো।আসাদ আসছে শুনে থেকে গেছে।রাতে সবাই মিলে আড্ডা দিলো।
সীতাকুণ্ডে স্থায়ীভাবে থাকা বন্ধু গুলোকে সব দায়িত্ব দেওয়া ছিলো।পরিকল্পনা করা আছে তিন বেলার খাবার দিবে।রাতের খাবার খেয়ে সবাই যার যার মতো চলে যাবে।পুরো দিনটাই সবাই ঘুরবে, মজা করবে।
সকাল দশ’টার মধ্যে সবাই ক্যাম্পাসে হাজির হয়ে যায়।পুরোনো বন্ধু পেয়ে সবার খুশি আকাশ ছোঁয়া,এতো আনন্দ, এতো খুশি সবাই যেন বাচ্চা হয়ে উঠেছে।হাসাহাসি, গল্প, আড্ডায় চারপাশ মুখরিত!
সকালের নাস্তা আর দুপুরের খাবার সবাই ক্যাম্পাসে বসেই খেলো।সকালের নাস্তা করে গল্পে আড্ডায় একে অপরের খোঁজ নিয়ে, কিছু গেম রাখা হয়েছিলো।এই গুলো শেষ করতেই দেড়টা বেজে গেলো।সবাই বের হতে চাচ্ছিলো, ফেরা হবে কখন কোন ঠিক নেই।তাই দুপুরের খাবারটা খেয়ে নিলো।সময় মতো রেস্তোরাঁ থেকে পার্সেল গুলো পাঠিয়ে দিয়েছে।
রিংকি, আসাদ, রাকিব, সামিয়া পাশাপাশি বসে ছিলো।রিংকি খাওয়া শেষ করে সামিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই চারমাসে আজ পেট পুড়ে খেলাম।এমন সুস্বাদু খাবার আমি কোন রেস্তোরাঁয় খাইনি।রেস্তোরাঁর খাবার এতো সুস্বাদু হয়?না কেউ বাড়ি থেকে রান্না করে দিয়েছে?”
“নাহ রেস্তোরাঁ বুক করা হয়েছে।রেস্তোরাঁ থেকে পার্সেল এলো।”
“খাবারের দায়িত্বে ছিলো কে শুনে দেখবি রেস্তোরাঁটা কোথায়?আমার পক্ষ থেকে দাওয়াত তোর।”
রাকিব ফোড়ন কেটে বললো, “আমরা কি পাপ করেছি?”
“রেস্তোরাঁর নাম শুনে বল,বরের পকেট ফাঁকা করবো।”
রিংকির কথায় সামিয়ারা হেসে উঠলো।রাকিব বলল, “আসলেই খাবারটা দারুণ! সীতাকুণ্ডে সব রেস্তোরাঁয় খাওয়া শেষ, কিন্তু এই স্বাদটা ভিন্ন।”
পাশ থেকে শাহিন নামের রাকিবদের এক কাছের বন্ধু বলল, এই রেস্তোরাঁটা এখন ভীষণ পপুলার।দু’বছরে সীতাকুণ্ডে পুরোনো রেস্তোরাঁ গুলোকে হার মানিয়ে দিয়েছে।প্রচুর ভীড় হয়,হাটু ভেঙে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কোমরের হাড় ক্ষয়ে যাওয়া মতো হয়।”
রাকিব ফিচেল হেসে বলল, “এমনিতেও তোর কোমরের হাড় আছে বলে আমার মনে হয় না।”
শাহিন রাকিবের পেটে একটা ঘুসি মেরে বলল, “এই রেস্তোরাঁয় নিয়ে গিয়ে একদিন খাওয়া,দেখ কেমন তরতাজা হয়ে যাই।”
“চল রাতে যাওয়া যাক।”
“রাতের খাবার রেস্তোরাঁতেই হবে দোস্ত।রেস্তোরাঁ বুকিং দেওয়া আছে।কাল পরশু নিয়ে যাস।”
আসাদ চুপচাপ খাচ্ছিলো।আসলেই খাবারটা সুস্বাদু।রাধুনির রান্নার হাত খুবই ভালো, প্রশংসা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে।
কিছুক্ষণ পর সামিয়া রিংকিকে বলল, “দোস্ত রেস্তোরাঁর নাম স্বচ্ছতা আহার্য রেস্তোরাঁ।”
আসাদের বুকটা ধক করে উঠলো।গলায় খাবার আটকে গেল।রাকিব আসাদের দিকে পানি এগিয়ে দিয়ে সামিয়াদের বলল, “খেতে খেতে এতো কথা বলতে হয় না,খাওয়া শেষ কর।”
বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবাই ঘুরলো।অনেক ছবি তুললো।আবার সামনে বছর দেখা করার পরিকল্পনা করলো।পুরো দিনটা অসম্ভব সুন্দর ভাবে কাটলো।
রাত আট’টায় স্বচ্ছতা আহার্যে সবাই মিলে রাতের খাবার খেতে যায়।আসাদ আর রাকিব বাইকে করে যায়।আসাদ রেস্তোরাঁর গেটের কাছ থেকেই মুগ্ধ হয়ে যায়।রেস্তোরাঁর সামনে অনেক গাছ গাছালি,সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো। মাঝখানে রাস্তা, রাস্তার দু’পাশে ভিন্ন ভিন্ন রঙের লাইটে আলো জ্বলছে।
রেস্তোরাঁর ভিতরে ঢুকে আসাদ আরেক ধাপ অবাক হয়।মনে মনে আওড়ায়, “একজন রুচিশীল মানুষের দ্বারা সম্ভব,এতো পরিপাটি,এতো সুন্দর করে সাজানো।”
রাতের খাবার শেষ করে সবাই রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে আসে।সবাই বিদায় নিয়ে যার যার মতো চলে যায়।রাকিব বাইকে উঠে আসাদকে উঠতে বলে।আসাদ বাইকে উঠেও রাকিবকে একটু দাঁড়াতে বলে বাইক থেকে নামে, “কিরে কোথায় যাচ্ছিস?”
“একটু অপেক্ষা কর,রেস্তোরাঁটা খুবই পছন্দ হয়েছে।একটা কার্ড নিয়ে আসি।ভবিষ্যতে কাজে দিবে।”
“আচ্ছা যা আমি একটা সিগারেট ধরাই।”
“এখনো অভ্যাস পরিবর্তন করলি না।”
রাকিব ভ্রু উঁচিয়ে বলল,”এই অভ্যাস পরিবর্তন করা যায় না। তোর জন্য এক টান রাখবো দোস্ত?”
“নিরু আমার গলা টিপে মারবে।”
আসাদ নিজের কথায় নিজেই বকা বনে গেলো।দ্রুত পায়ে রাকিবের কাছ থেকে চলে এলো।রাকিব চিল্লিয়ে বলল, “দোস্ত আস্তে যা,একটু দেরি করে আসিস।পারলে সুন্দরী একটা মেয়ে দেখলে কফি খেয়ে আসিস।আমার সময় লাগবে,এসে তাড়া দিবি না যেন।”
আসাদ রেস্তোরাঁয় ঢুকে ক্যাশ কাউন্টের দিকে গিয়ে থমকে যায়।ক্যাশ কাউন্টারে নিরু বসে।নিরু আসাদকে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।কাউন্টার থেকে বেরিয়ে আসাদের দিকে এগিয়ে আসে।আসাদ নিরুর দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে আছে।নিরু একটা নীল আর শেওলা রঙের মিশ্রণে মনিপুরী শাড়ি পড়ে আছে।চুল গুলো হাত খোপা করা।স্বচ্ছ চোখ জোড়ায় গাঢ় করে কাজল দেওয়া।
এতোটা রূপবতী নিরু কবে হলো?এই না সেদিন কান্নাকাটি করে চোখের নিচে কালি পড়ে, চেহারায় বিধ্বস্ত অবস্থা করেছিলো।
এখন এতো পরিপাটি,এতো সৌন্দর্যতা!এইটা কী সেই নিরু?কোন নিরুকে দেখছে আসাদ?
নিরুর কাছের মানুষটা এতো ভালো রেখেছে নিরুকে?
নিরু আসাদের সামনে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলল, “কেমন আছেন আসাদ ভাই? আপনাকে আবার দেখবো ভাবিনি।”
আসাদ কোনরকমে বলল, “ভালো আছি!”
আসাদের একটু পানি খাওয়া প্রয়োজন।নিরুর কাছে পানি চাইলো।নিরু আসাদকে পানি দিয়ে বসতে বললো।মামা মামানি কেমন আছে জানতে চাইলো।
আসাদ এখনো নিরুর দিকে নিষ্পলক চোখে চেয়ে আছে।আসাদের এই নিরু অন্যকারো, ভাবলেই দুনিয়া কেপে উঠে।
“দাদু কেমন আছেন?”
“এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছেন।বয়স হয়েছে,রেস্তোরাঁয় ছিলো।সন্ধ্যার আগে বাড়ি চলে গেল।”
“পাহাড়ে ঘর বাঁধার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে তোর,পছন্দের জায়গাতেই আছিস।”
“হ্যাঁ আসাদ ভাই!এইটাই আমার জীবনের সবচেয়ে দ্বিতীয় তম অর্জন।”
“ভালো আছিস নিরু?”
নিরু বুঝতে পারছে আসাদের গলা কাপছে।
“হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ! মাহিয়া আপুকে বিয়ে করেছেন তো? কি বাবু হয়েছে?”
“না করিনি।”
“অন্যকাউকে করেছেন?”
“হু!”
নিরু কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের অজান্তেই বলে ফেলল, “উনি কী আপনাকে আমার মতো করে ভালবাসতে পারে?আমার মতো করে গাল ফুলিয়ে বলে,একটুও ভালবাসি না আপনাকে।
উনি কি পারে আমার মতো করে রাগ দেখাতে?”
নিরু নিজের করা প্রশ্নে নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।কিসব প্রশ্ন করছে আসাদকে? তারপরও মস্তিষ্ক একপাশে ফেলে ম্যাচিউর নিরু কিশোরীতে রুপান্তরিত হলো।আসাদের সোজাসুজি উত্তর।
“উহু !পারে না।
“তাহলে কেন আপনি এই মেয়েটাকে আপনার জীবনে আনলেন?মাহিয়া আপুকে বিয়ে করলে আপু ঠিকই আপনাকে অনেক ভালবাসতো।ঠিক আমার মতো।”
শেষের কথাটুকু বলতে গিয়ে নিরু মাথা নিচু করে ফেললো।
“তুই কেন আমাকে ছেড়ে গেলি?”
নিরু মুখটা কাচুমাচু করে বলল, “আমি নিরুপায় ছিলাম বলে।”
আসাদ পকেটে হাত রেখে সোজা দাড়িয়ে বলল, “আমি নিরুপায় ছিলাম না,দায়িত্বে বাঁধা পড়ে গেছি।”
“কেমন?
যেমন তুই নিরুপায় হয়ে গেছিলি আমার পরিবারের দিকে চেয়ে,আর আমি বাঁধা পড়ে গেছি নিরুপায়ে নয় দায়িত্বে! আমার মাথার উপরে এখন অনেক বোঝা।আম্মুর শরীর ভালো না।আব্বুর জব শেষের দিকে,বয়স হচ্ছে।নিজের কর্মস্থলেও দায়িত্ব পালন করতে হয়।কত কাজ এখন বুঝতে পারছিস?
সময় কোথায় তুই যেভাবে ভালবাসতি, সেইভাবে ভালবাসা চেয়ে নেওয়ার।তোর মতো করে ভালবাসতে পারবে কিনা সেইটা জানার।তোর মতো করে গাল ফুলিয়ে বসে থাকলেও হয়তো বুঝতে পারবো না, সে রেগে আছে।আসল কথা কী জানিস নিরু,আমি নিজেই বুঝতে চাইবো না।”
“কেন বুঝতে চাইবেন না?”
“আর হারাতে পারবো না তাই।”
“খুব বেশি ভালবেসে ফেলেছেন?”
“উহু!”
“তাহলে,হারাতে পারবেন না কেন?”
“আর কত?”
…………….
“কী হলো, কথা বলছিস না যে?”
“এমনিতেই।”
“মন খারাপ হয়ে গেল?”
নিরু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “নাহ!”
“তাহলে,চুপ কেন?”
“ওই মেয়েটাকে কী আপনি অনেক ভালবাসেন?”
“হ্যাঁ, বাসছি তো।ভালো না বেসে কী করবো বল?আমারো তো ইচ্ছে করে কাউকে আকড়ে ধরে বাঁচতে।”
“অনেক সুখী আপনি তাই-না?”
“হ্যাঁ!সে চলে যাওয়ার সময় অনেক বেশি সুখী করে গেছে।”
আসাদ নিচুস্বরে বিড়বিড় করে কথাটা বললো।
“কী হলো বিড়বিড় করছেন কেন?”
“নাহ কিছু না।যাই তাহলে, রাকিব অপেক্ষা করছে।আম্মু এখন তোকে অনেক মিস করে। পারলে আম্মুকে ক্ষমা করে দিয়ে, আমাদের বাড়িতে গিয়ে বেরিয়ে আসিস।আব্বু আম্মু তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে।দুজন প্রতিনিয়ত শেষ হয়ে যাচ্ছে।তুই আর তোর বর গিয়ে বেরিয়ে আসিস।সমস্যা নেই আমি বাড়িতে থাকবো না।”
আসাদ আর এক সেকেন্ড না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এলো।নিরুও নিজের বিশ্রাম নেওয়ার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
দুজন দু-পথে পা বাড়াল।কেউ আর পিছু ফিরল না।একবারের জন্যেও যদি,পিছু ফিরে দুজনের চোখাচোখি হতো, দুজন দুজনকে বুঝে ফেলতো।বুকের মধ্যে কি বিশাল ঝড় নিয়ে ঝাপসা চোখে এলোমেলো পা ফেলে দুজনে দু’দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।বুকে লক্ষ টন পাথর চাপা দিয়ে দুজন আবারও দু’পথে।
রেস্তোরাঁর গেটের মুখেই আসাদের বাহারির সাথে দেখা হয়।বাহারি আসাদকে দেখে ভাইয়া বলে ডেকে উঠলো।আসাদ বাহারিকে দেখে হেসে বলল, “কেমন আছো বাহারি?তোমার আব্বু আম্মু কেমন আছেন? ”
“আমরা সবাই ভালো ভাইয়া।আপনি কোথায় থাকেন আগে বলেন,নিরুর সাথে আপনার কী হয়েছে?”
“কই কী হবে,কিছু হইনি তো।তোমার কি অবস্থা বলো,তুমি কি এখানেই থাকো?”
“হ্যাঁ ভাইয়া আমি আর আমার বর নিরুর এখানেই চাকরি করি,নিরু রেখেছে।”
“নিরুর বরের রেস্তোরাঁ এইটা বাহারি?”
“নিরুর বর কোথায় পেলেন?নিরু তো বিয়েই করেনি।আপনি নিরুকে কষ্ট দিয়ে নিরুকে ছেড়ে অন্য কোথাও কেন বিয়ে করলেন ভাইয়া।কেন দুঃখী মেয়েটাকে এতো কষ্ট দিলেন?”
আসাদের মনে হলো আশপাশটা থমকে গেছে।চারপাশের কোন শব্দ যেন কানে আসছে না। বাহারি ভাইয়া বলে ডাকতেই আসাদ স্বাভাবিক হলো।আসাদ বাহারিকে আবারও বলল, “তুমি সত্যি জানো নিরুর বিয়ে হয়নি?”
“জানবো না কেন? নিরুর সাথে কি আমার নতুন বন্ধুত্ব নাকি।আপনার ছবি বুকে জড়িয়ে নিরুকে হাউমাউ করে কাঁদতে দেখেছি।আমি যদি পারতাম কবেই আপনাকে তুলে নিয়ে আসতাম।শুধু নিরু বলতো আপনি নিজের মতো করে ভালো আছেন।নিরুর কষ্ট আমি দেখতে পারিনা।নিরুকে যখন কান্না করতে দেখি আমি এই রেস্তোরাঁ থেকে বাইরে বেরিয়ে যাই।”
আসাদ বাহারির আর একটা কথাও শুনলো না। রেস্তোরাঁর মধ্যে ছুটে গেল।কাউন্টারে নিরুকে না পেয়ে অস্থির হয়ে এক ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলো নিরু বিশ্রাম ঘরে।আসাদ বিশ্রাম ঘরটা কোনদিকে জেনে নিয়ে, দৌড়ে বিশ্রাম ঘরের দিকে গেল।ওয়েটার আসাদকে থামাতে যায়,ততক্ষণে বাহারি চলে এসে ওয়েটারকে নিজের কাজ করতে বলে।
আসাদ বিশ্রাম ঘরের দরজা ঠেলে দেখে নিরু সোফায় বসে বুকে কিছু জড়িয়ে মুখে শাড়ির আঁচল চেপে ধরে কান্না করছে।
আসাদ পিছন থেকে নিরুর কাঁধে হাত রাখলো।নিরু ভাবলো বাহারি এসেছে।নিরু কান্না ভেজা গলায় বলল, “বাহারি তুমি যাও, আমি আসছি।”
আসাদ নিরু বলে ডাকলো।নিরু আসাদের কণ্ঠ শুনে পিছন ঘুরে আসাদকে দেখে তড়িৎ গতিতে আসাদের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।আসাদ নিরুকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে কেঁদে ফেললো।দুজনের বুকে জমা যন্ত্রণা গুলো আশ্রয় খুঁজে পেলো যেন।কতক্ষণ পর নিরু বুঝলো আসাদ ও কান্না করছে তার ঠিক নেই।নিরুকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠছে।নিরু আসাদের বুক থেকে মুখটা উঁচু করে আসাদের দিকে তাকিয়ে নাক টেনে বলল, “ছাড়ুন!”
আসাদ আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা গলায় বলল, “ছাড়ার জন্য ধরিনি।”
নিরু ফুপিয়ে উঠে বলল, “ঘরে বউ রেখে,আমাকে ধরতে এসেছেন কেন?”
“বউ কোথায় পেলি তুই?”
“কিছুক্ষণ আগেই তো আপনি বললেন।”
“আমি কি একবারও মুখে বলেছি বিয়ে করেছি?”
“নাহ বলেননি।”
“আমি বিয়ে করিনি নিরু,তুই ছাড়া আমি কাউকে আমার এই বুকে নিতে পারবো না।”
আমি বিয়ে করিনি নিরু, এই কথাটায় বদ্ধ ঘরে ধাক্কা লেগে বার বার নিরুর মস্তিষ্কে আলোড়ন সৃষ্টি করলো।নিরু আবারও শব্দ করে কেঁদে উঠে আসাদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “আরও আগে কেন আসেননি,আমার কষ্ট হয় না তাই না? আমাকে মানুষ বলে মনে হয় না? এই আপনি জানতেন না আমি আপনাকে উম্মাদের মতো ভালবাসি।আপনি এতদিন কেন আমার কাছে এলেন না।আমি যে ভিতর ভিতর শেষ হয়ে যাই।আমার বুকের এই যন্ত্রণাটা আপনি বুঝেও ছুটে আসেননি।আমার আপনার এই বুক আর লাগবে না।ছাড়ুন আমাকে!”
আসাদ নিরুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো।নিরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিরুকে শান্ত করলো।নিরু শান্ত হলে, আসাদ বললো,” চল এখনই বিয়ে করবো।আর একটা মিনিট আমি এইদিক সেইদিক হতে দেবো না।”
“দাদু,মামা, মামানিদের না জানিয়ে?”
“একবারে বাসর করে জানাবো।আমার সাথে আগে আয় তুই!”
চলবে….