স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর #লেখা_চাঁদনী_ইসলাম #পর্ব_৪২

0
520

#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_৪২

আকাশে প্রচন্ড মেঘ,গত কাল সন্ধ্যা থেকে টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে।মাঝে মাঝে ঝুম বৃষ্টি নামছে।একটা মুহূর্তের জন্য টিপটিপ বৃষ্টি থামেনি।সারাটাদিন অঝোর ধারায় ঝরছে বৃষ্টি,টিনের চালা বেয়ে টপটপ করে পানি পরছে। পেতে রাখা হাঁড়িতে মোটা ফোটার পানি পড়ে, পয়সার মতো বড় গোলাকার হয়ে আধা হাড়ি পানিতে মিলিয়ে যাচ্ছে গোলাকার হয়ে পড়া বৃষ্টির পানি।বাহারি মাথায় ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে রেস্তোরাঁয় যাওয়ার জন্য, সকাল থেকে ঝুম বৃষ্টির কারণে বের হতে পারেনি।দুপুর হয়ে যাওয়ার পরও বৃষ্টি থামার নাম নেই।কিন্তু রেস্তোরাঁয় না গেলেও হবে না। আনাস মোল্লাকে বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে।
নিরু ঢাকাতেই আছে আসাদ ছুটি কাটিয়ে বগুড়ায় ফিরে গেছে।আমিনা বেগম নিরুকে কিছু দিন থেকে যেতে বললেন।তাই নিরু ঢাকাতেই আছে।
বাহারি ছাতার মধ্যে থেকেও অনেকটা ভিজে গেল।বাহারির বর সকালে বৃষ্টির মধ্যেই রেস্তোরাঁয় চলে গেছিলো।বাহারির বর নিরুকে নিজের বোনের মতো ভালবাসে,নিরু সেইভাবেই নিজের জায়গাটা ধরে রেখেছে।নিরু কখনো বুঝতে দেয়না,রেস্তোরাঁটা নিরুর!নিরু সব সময় বলে আমাদের সবার রেস্তোরাঁ।নিরুর ব্যবহারেই নিরুকে সবাই প্রচন্ড ভালবাসে।নিরুর বিশ্বাসের জায়গাটা অটুট!

আমিনা বেগম নিরুর মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছেন,আর নিরুর মা’কে নিয়ে গল্প করছেন।নিরুর মায়ের কথা ভাবতে গেলেই নিরুর পুরো দুনিয়ায় আঁধার নেমে আসে।নিরুর চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে।আমিনা বুঝতে পেরে নিরুকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললেন,

“নিরু তোকে না বলেছি,তোর মায়ের কথা বললে কান্নাকাটি করবি না।তারপরও কান্নাকাটি করছিস?”

“মামানি আমার সাথেই কেন এমন হলো বলতে পারো?আমি হাসি মুখে চলাফেরা করি,কাজ করি,কিন্তু আমার ভিতরে ঝড় বয়ে যাই মামানি।এই যন্ত্রণা আমি কোথায় লুকাবো?”

আমিনা দু’হাতে নিরুর চোখ মুছিয়ে দিয়ে শোকাহত চাহনি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন, “এই মেয়েটাকেই কিনা এতো কষ্ট দিয়েছিলাম?”
আমিনা নিজ মনে নিজেকেই ধিক্কার জানালেন।
নিরুকে বুকে আগলে নিয়ে নিরুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

“তোর এই মা তো তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছে, যতটা কষ্ট দিয়েছি তার দ্বিগুণ যত্ন সহ ভালবাসা এই মায়ের কাছে পাবি।তোর সেই কষ্টটুকু কোনদিন ভুলিয়ে দিতে পারবো কিনা জানিনা,তবে আর কখনো তোর মনে বিন্দু পরিমাণ কষ্ট আসতে দেবো না রে মা।”

নিরু নাক টেনে বলল, “মামানি এইভাবে বলো না।আমি সেদিন-ই সব কষ্ট ভুলে গেছিলাম,যেদিন তুমি আমার কাছে এসেছিলে।সত্যি মামানি আমার আর সেই দিন গুলোর কথা মনে পড়ে না।যেখানে সেই আগের তুমি আছো, তোমার ছেলে আছে সেখানে আমার আবার মন খারাপ কিসের?কিন্তু মামানি আমার মা হারানো কষ্ট পৃথিবীর কোন সুখ-ই মুছে দিতে পারবে না।”

আমিনা বেগম নিরুকে এখন আর শান্তনা দিতে পারেন না।নিরুর-ই অনেক বুঝ,সেই নিরুকে শান্তনা দেওয়ার মতো আমিনা কিছু খুঁজে পান না।তাই আমিনা বেগম আর কিছু বললেন না।

নিরু জানালার গ্রিল ধরে বৃষ্টিময় মেঘলা আকাশের দিকে চেয়ে আছে।নিরু মায়ের কথা সব সময় ভাবে,কিন্তু আজ কেন যেন বেশিই কষ্ট হচ্ছে।মায়ের কথা ভেবে নিরুর খুব কান্না পাচ্ছে।দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে মায়ের মুখোচ্ছবি ভেবে চোখের জল ফেলছে।আকাশটা আজ বিষন্ন, এমন মেঘাচ্ছন্ন আকাশ সচরাচর দেখা যায় না।হিমশীতল পরিবেশ সাথে নিরুর মন খারাপের আলাপন!

নিরুর ফোনে কল আসায় নিরু জানালার গ্রিল ছেড়ে বিছানা থেকে ফোন নিয়ে দেখে আসাদের কল,ফোন রিসিভ করতেই আসাদ বলল,

“বউ গো,দুঃখিত গো!আজ একটুও সময় দিতে পারলাম না।”

নিরু শান্ত কণ্ঠে বলল, “এই যে এখন সময় দিবেন।”

“এখন থেকে সকাল পর্যন্ত পুরো সময়টায় তোমার,অফিসে জরুরি কিছু কাজ ছিলো।তাই সারাদিন খুবই ব্যস্ততা গেল।”

“এই দাঁড়ান আপনি আমাকে তুমি করে বললেন?”

“তুমি করে বলেছি বলে, ভাবিস না দূরে চলে এসেছি বলে ভালবাসা বেড়েছে।তোর প্রতি ভালবাসায় একটু ফাঁকফোকর নেই।”

“তুমিটা শুনতে ভালো লেগেছে।”

আসাদ হালকা কেশে জিজ্ঞেস করল, “তুই করে শুনতে মন্দ লাগে?”

“না,না!তুই করে শুনতেও মন্দ লাগে না।”

“শোন না নিরু!”

“হ্যাঁ বলুন!”

“আমার কাছে চলে আয় না,একটা বাসা নিই।”

“বিসিএস পরীক্ষার ধাপ গুলো শেষ হোক।সামনে তো রিটেন আছে, প্রস্তুতি কেমন নিচ্ছেন?সময় পাচ্ছেন তো?”

“মোটামুটি সময় পাচ্ছি,চিন্তা করিস না হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ!”

নিরু গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, “মিস করছি!”

“আমাকে মিস করছিস?”

“কেন আপনাকে মিস করতে পারিনা।”

“সব সময় যেভাবে ভান ধরে থাকিস,তাই-ই মনে হয়।”

“পচাচ্ছেন তাই না।”

“নিরু রে তোকেও যে ভীষণ মিস করছি।এই চাকরি না করে ব্যবসা করাই ভালো ছিলো,কাছে তো থাকতে পারতাম।যখন ইচ্ছে ছুয়ে দিতে পারতাম।”

“এইসব চিন্তা করে কেউ চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করতে ইচ্ছুক হয়?”

“আমি এতো জানি না,মনের মধ্যে ঝড় বয়ে চললে,এমনটাই করে বসবো।চাকরি ছেড়ে বউয়ের রেস্তোরাঁয় চাকরি নেবো।”

“বউয়ের রেস্তোরাঁতেও তো চাকরিই হচ্ছে মিস্টার।”

“এইটাতে সমস্যা নেই। বউ তো চোখের সামনে থাকবে।”

“এই আপনি আগে এমন ছিলেন না,কেমন যেন অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন।”

“বউয়ের কাছে সবাই অসভ্য!”

“আমার আগের আসাদ-ই সেরা ছিলো।”

“তাহলে এসো হে প্রিয় আবার প্রেম শুরু করি,
প্রিয় পথে হেঁটে প্রেম নিবোদন করি।”

আসাদের প্রেমময় কথা শুনে নিরু খিলখিল করে হেসে উঠলো।মনে জমে থাকা মেঘলা আকাশের মতো কালো মেঘের আস্তরণ আর নেই।আসাদের দুষ্টুমির কাছে ম্লান হয়ে গেছে। এই মানুষটা যেন যাদুবলের মানুষ, যাদু দিয়ে সব মন খারাপ কোথায় জানি বিলীন করে দেয়।এই মানুষটা কাছাকাছি থাকলে কোন দুঃখ-ই যেন ছুতে পারে না।
নিরুর মা-বাবা হারানোর কষ্টটা অতি তীব্র যা পৃথিবীর কোন মানুষ-ই মুছে দিতে পারবে না।কিন্তু হুটহাট মা বাবার জন্য হওয়া মন খারাপটা আসাদ বিদ্যুৎ গতিতে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করে।
এইভাবেই নিরুদের দিন গুলো যাচ্ছিলো।নিরু ও কিছুদিনের মধ্যে সীতাকুণ্ডে চলে যায়।রেস্তরাঁর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।আসাদের সাথে ফোনে কথা বলা,খুনসুটি, রেস্তোরাঁর কাজ এই গুলো নিয়েই পুরো সময়টা যায়।

বিসিএস রিটেনেও আসাদ উত্তীর্ণ হয়।এইবার ভাইবার প্রস্তুতি নিতে থাকে।আসাদের বাবা মা সবাই ভীষণ খুশি,আসাদকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিলো।সব স্বপ্ন গুলো পূরণ হচ্ছে।নিরুও ভীষণ খুশি,আসাদের সফলতা নিরু খুব উপভোগ করে।

আসাদ আবার ছুটিতে এসে,ঢাকাতে মায়ের কাছে দু’দিন থেকে সীতাকুণ্ডে আসে।ঠিক ভোর রাতে আসাদ নিরুর এখানে আসে,এবার আগে থেকে নিরুকে জানিয়ে আসেনি,নিরুকে চমকে দেবে বলেই না জানিয়ে এসেছে।আসাদ কলিংবেল চেপে দাঁড়িয়ে থাকে।গুণে গুণে চার মিনিট পর বিলাপ বকে ঘুম চোখে নিরু উঠে আসে।দরজার গোল ছিদ্র দিয়ে নিরু আসাদকে দেখে ভীষণ চমকিয়ে উঠে।এইটা নিরুর জীবনে পাওয়া অন্যরকম এক অনুভূতি, নিরু ঘুমানোর আগেও ভাবেনি আসাদকে এতোদিন পর এইভাবে হঠাৎ করে সামনে দেখবে।নিরু খুবই খুশি হয়,দরজা খুলে আসাদের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে।আসাদ নিরুকে দু’হাতে জড়িয়ে নেই,হাসি বিনিময় করে।
আসাদ নিরুর গালে কপালে অজস্র চুমু খেয়ে আবার বুকে জড়িয়ে নেই।
সকালে উঠে নিরু আসাদের জন্য রান্না করে।তারপর আসাদকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় যায়।দুপুরের পর বাড়ি এসে দুজনে খাওয়া দাওয়া করে বিকেলের দিকে বের হয়।আজ চেনা জায়গা গুলোতে দুজনে ঘুরবে।

আসাদ নিরু বাশবাড়িয়াতে ঘুরতে যাবে আজ,নিরু একটা মেরুন রঙের শাড়ি পড়েছে।আসাদ সাদা পাঞ্জাবি পড়ে বাইক নিয়ে বের হলো।কিছুটা পথ যাওয়ার পর নিরু বলল, “এই রাস্তাটা খুবই খারাপ,সাবধানে চালান।”

“কিছুদিন আগে এক্সিডেন্ট হয়েছিলো তাই না?”

“হ্যাঁ! সবাই বলে খুব খারাপ রাস্তা।”

“সাবধানেই যাচ্ছি ভয় পাস না।”

“আপনি একটা কথা শুধু এরিয়ে যান কেন?”

“কী কথা?”

“মাহিয়া আপুর কথা,মাহিয়া আপু আর আপনার কাছে ফোন দেয় না?এতো জিজ্ঞেস করি শুধু অন্য কথায় চলে যান।”

“মাহিয়া আর নেই নিরু!”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here