#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|১৬|
#শার্লিন_হাসান
সেরিন ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে যায়। কঠোর গলায় বলে,
‘দেখেছিলাম একটা জ্বীন। চাচ্চু ওটার চোখ গুলো দেখে আমি বেশী ভয় পেয়ে গেছি। জানো চাচ্চু ওই জ্বীন আমায় এতো জোরে ধমক দিয়েছে যে ভয়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ওই জ্বীন অনেক লম্বা চাচ্চু। তারউপর সাদা পোষাক পড়ে জ্বীন সেজে এসেছে। চাচ্চু আমি যে হার্ট অ্যাটাক করিনি এটাই শুকরিয়া। চাচ্চু আমায় প্লিজ দোয়া পড়ে ঝাড়ফুঁক দাও। নাহলে আমি মরেই যাবো জ্বীনের ভয়ে।’
সেরিনের কথায় মাহি ভিডিও অফ করে উচ্চস্বরে হাসতে থাকে। সেরিন মাহির দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
‘থোতমা টা বন্ধ রাখবি? আমি মরি আর ওনার ঈদ লেগেছে। চাচ্চু ওই জ্বীন যাতে আর আমাদের বাড়ী না আসে প্লিজ।’
‘না,না আর আসবে না। চিন্তা করো না জ্বীনকে তাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কিরণ পাটওয়ারীর কথায় সেরিন দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। উঠে কিচেনে যায়। কড়া করে এক মগ কফি বানিয়ে নিজের রুমে আসে। লাইট নিভিয়ে বেলকনিতে যায় সেরিন। যেখানে রাখা দোলনাটায় বসে কফিতে চুমুক দেয় আর বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে নিজের দৃষ্টি স্থির রাখে। কেমন জেনো শূন্য লাগছে নিজেকে। কিছু একটার বড্ড অভাব অনুভব হচ্ছে। সেরিন নিজের মন খারাপকে বেশী পাত্তা দেয়নি। গিটার হাতে নেয়। কী মনে হতে ফেসবুকে একটু ঢু মারে। ভাবে তার অডিয়েন্সের সাথে একটু আড্ডা দেওয়া যাক। অন্ধকার বেলকনিতে বাইরের মৃদু আলো ছড়াচ্ছে। তাতেই সেরিন গিটারে সুর তুলছে। নিজের মতো করে গান গাইছে সে।
বিকেল থেকে শুভ্রর মন খারাপ। কোন কাজে মন বসাতে পারছে না। সেরিনের গাওয়া গান শুনছিলো শুভ্র। এখন সেরিনের লাইভ দেখছে আর নিশ্চুপ হয়ে গান শুনছে। অনুভব করার চেষ্টা করছে। সে সেরিনের গানের অনেক বড় ভক্ত। যদিও কখনো প্রকাশ করবে না। তাঁদের দু’জনের মন খারাপ! একজন মন ভালো করতে গান গাইছে তো আরেকজন সেই গাওয়া গান শুনে নিজের মন ভালো করছে।
******
পরের দিন সকালে সেরিন প্রাইভেট পড়ে ক্লাসে এটেন্ড করে। তার টিসি মনে হয়না এই জনমে পাবে। হয়ত তার পরিবারের সুবাদে যদি পায়। বাট অন্য স্টুডেন্ট হলে কখনোই পেতো না। শুভ্রর রুলসের মধ্যে একটা হলো, নিজে স্বইচ্ছায় গাড় ধাক্কার সাথে টিসি দিয়ে বের করে দেয়। আরেকটা হলো, টিসি দিবে না মানে দিবেনা। হাজারটা কারণ দেখালেও। আর তার উপর কথা বলার সাহস ও কারোর নেই।
শুভ্র পিটি থেকে এসে নিজের রুমে ঢুকে। আজ-কাল তার মাথাটা গরম হয়ে যায়। সেজন্য কারোর সাথে কথা বলেনা। কখন কার সাথে রুড বিহেভ করে ফেলে ঠিক নেই। শুভ্রর মনে হচ্ছে আর কয়েকটা চিঠি আসলে ভালো হতো। চিঠি পড়ে হাসতো শুভ্র। শুভ্রর কী মনে হতে করিডোরে যায়। ডাস্টবিনের পাশে কয়েকটা খাম পায়। মূহুর্তে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে শুভ্রর। খামে দু’টো চিঠি পায় শুভ্র। একটায় লিখা,
‘বাবুর আব্বউউউউ! বাবুর আম্মুকে চাই না তাইনা? যদি ভাগ্যে থাকলে কখনো তোর বাবুর আম্মু হইনা তাহলে বাবুকে দেখা, ছোঁয়া তো দূরে থাক।কোলে নিতেই দিবো না।’
শুভ্র চিঠি পড়ে হাসে। দ্বিতীয় চিঠিটায় লেখা,
‘বাবুর আব্বু সত্যি ভালোবাসিইইইইইইইই আপনায়।’
শুভ্র চিঠিগুলো আগের চিঠির সাথে রেখে দেয়। সে জানে এখন সিসিটিভি ফুটেজ চেক দিলে বাবুর আম্মুকে পেয়ে যাবে। কিন্তু জানার ইচ্ছে নেই। অপরিচিত বাবুর আম্মুর চিঠি পড়ার মধ্যে যে অনুভূতি জেনে গেলে সেটা কাজ করবে না। শুভ্র আর সাত পাঁচ না ভেবে বড় একটা কাগজে লিখে,
‘বাবুর আম্মুকে খুঁজে বের করা কোন ব্যপার না। তবে আমি খুঁজতে চাই না আর। এই অপরিচিতার চিঠি গুলো পড়তে চাই। হুট করে একদিন সত্যি বাবুর আম্মু বানানোর প্রথম ধাপ (বিয়ে) করে নিবো। এনি ওয়ে এতো বাবুর আম্মু হওয়ার জন্য লাফালাফি করছো তো
দূরে সরে যাচ্ছো কেন? হুম! এতো গুণবতী হতে হবে না চঞ্চল মেয়ে। চিঠি পাঠ করে তো….. অন্য আরেকদিন বলবো। তেমন ভালো লিখতে পারি না বাবুর আম্মু।’
ইতি
‘বাবুর আব্বু’
শুভ্র কাগজটা একটা খামে রেখে ডাস্টবিনের পাশে রেখে দেয়। উপরে লিখে দেয়, ‘বাবুর আম্মুর জন্য’ চিঠিটার উপর ভারী কিছু রেখে দেয়। শুভ্র জানে আগামী কালকে আবার আসবে চিঠি। তার এসিস্ট্যান্ট সাথে দপ্তরি দেরকে বলে দেয় তার করিডোর বা রুমে যাতে কেউ না আসে। আর না ঝাড়ু দেয় আগামী কাল।
নিশাতের সাথে বসে,বসে এটা ওটা বলছে সেরিন। শশীর এনগেজমেন্টের ডেট ফিক্সড হলেও বিয়ে তার এক্সামের পর হবে। একবারে উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে। নিশাত সেরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘এমন মন মরা হয়ে বসে আছিস কেন? আচ্ছা এতো কিছু থাকতে হাসিখুশী থাকবি তা না মুখ একটা বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছিস।’
‘আমার সব আছে শুধু একটা জিনিস নেই। যার না থাকাটা সব পূর্ণতাকে শূন্য করে দেয়। এতো পূর্ণতার মাঝে একটা শূন্যতাই মনে হাহাকার করে। ভালো থাকতে দেয়না আমায়।’
‘হুম! প্রেমে পড়লে এমনই হয়।’
‘আজব কার প্রেমে পড়লাম? শোন সেরিন কারোর প্রেমে পড়েনি আর না কখনো পড়বে। আমার সুন্দর জীবনে প্রেমের আগমন করে অসুন্দর জীবন গড়তে চাই না।’
‘এটা ভুল কথা। প্রেম জীবনে বলে কয়ে আসে না। কখন কার প্রেমে পড়ে যাই বলতে পারি না। আমরা হুটহাট প্রেমে পড়ি। আর যার প্রেমে পড়লাম ওই মানুষটাকে নিয়ে দিনরাত এক করে ভাবতে থাকি। যতই ব্যস্ত থাকি মাথায় সেই ব্যক্তির নামটাই ঘুরে। এবং সেই ব্যক্তির একটু দর্শন পাওয়া, তার সাথে কথা বলতে পারা অনেকটা শান্তি লাগে মনে। প্রেমে পড়ার অনুভূতি যেমন সুন্দর এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া অনেক ভয়ানক।’
সেরিন মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শোনে। তবে কোন কিছু বলেনি। তার এসব জেনে কাজ নেই। সে তো কারোর প্রেমে পড়েনি আর না কাউকে ভালোবাসে।সেরিনকে চুপ থাকতে দেখে নিশাত বুঝে ওর এসবে আগ্রহ নেই।
*******
শশীর সাথে আর্থ বিয়ে হবে তাঁদের প্রেম আছে কথাটা কোনভাবে লিক হয়ে যায়। অনেকে ভালো ভাবে নিলেও অনেকে নিতে পারেনি। কারোর কারোর মতে, ‘চৌধুরীদের সাথে পাটওয়ারীদের সম্পর্ক ভালো। আর পাটওয়ারীদের একজন মেয়ে হলেও চৌধুরী বাড়ীতে যেতো।’
কারোর কারোর মতে লো’ভে পড়ে বিয়ে দিচ্ছি এই ছোট মেয়ের। যদিও আর্থ শশী অনেকটাই ঠিক আছে বয়সের দিক দিয়ে। হয়ত পড়াশোনায় একটু গ্যাপ। সেরিনের ও পড়াশোনায় গ্যাপ আছে। প্লে,নার্সারি শেষ করতে,করতে দুই বছর গেলো।
কথাগুলো সেরিনের কানে আসে। সে জানেনা তার বাবারা সেসব খবর পেয়েছে কীনা! সেরিনের জেনো আরো এক্সট্রা চিন্তা ঢুকে গেলো মনে। তারউপর অক্ষর দেশে আসতে বেশীদিন নেই। শুভ্র টিসি দিচ্ছে না। ঢাকা যাওয়া হচ্ছে না। সেরিন রাগ নিয়ে তার বাবার রুমে যায়। না চাইতেই চিৎকার চলে আসে। চিল্লিয়ে বলে,
‘ওই জ্বীনের বাচ্চা জ্বীনকে বলো টিসি দিতে আমি আর একমূহুর্ত ওই কলেজে যেতে চাইনা। আর আমায় নিয়ে ঢাকা কবে যাবে? কিছুই হচ্ছে না। পরিকল্পনা করে বসে থাকলেই শুধু হয়। বাবা তুমি আজকাল আমার কোন কথাই শোনছো না।’
সিহান পাটওয়ারী মেয়ের চিৎকার শোনে আর একমূহুর্ত ও দেরী করেনি। সোজা শুভ্রকে কল লাগায়। সেরিন পাশে বসা। সিহান পাটওয়ারীর কল রিসিভ করে শুভ্র সালাম দেয়। সিহান পাটওয়ারী সালামের জবাব নিয়ে বলেন,
‘আগামী কালকে সেরিন যাবে। ওর টিসি দরকার। তুমি দিয়ে দিও! ঢাকা পাঠিয়ে দেবো ওকে।’
‘আংকেল আমার কলেজ কী খারাপ বলুন? ঢাকা গেলে এতো প্যারা ও নিতে পারবে না। আর ওকে কেউ র্যাগ বা কিছু বলবে না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন আপনার ভালো রেজাল্ট চাই তো নাকী?’
শুভ্রর কথায় সেরিনের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। জানতো শুভ্র এমন কিছুই বলবে। সেরিন তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সিহান পাটওয়ারী বলেন,
‘রেজাল্ট চাই তবে সেটা পরিশ্রম করে। শুধু রেজাল্ট হলেই হবে না ওকে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে হবে।’
‘তাহলে ওর জন্য হোম টিউটর রেখে দিন। আর মাথায় যদি সত্যি কিছু না ঢুকে তো আমার কাছে পাঠান দু’টো বা’রি মেরে ঠিক করে দেই মাথা। তাহলে কথা বলার আগে ব্রেনে সেট-আপ হয়ে যাবে।’
সেরিন তার বাবার দিকে তাকিয়ে ইশারা করছে বলার জন্য। সিহান পাটওয়ারী বলেন,
‘না সেসব কিছু না। সেরিন চায়না এই কলেজে। ও ওর আন্টির বাসায় চলে যাবে। সেখান থেকেই পড়াশোনা করবে।’
‘আচ্ছা আগামী কালকে আসতে বলুন।’
শুভ্রর কথায় সেরিন কিছুটা শক খায়। এতো তাড়াতাড়ি মেনে নিলো? তাতে কী? সেরিনের টিসি ফেলেই হলো।
***********
চৌধুরী বাড়ীতে বিয়ে নিয়ে সব প্লানিং চলছে। যদিও শুভ্র এসবে নেই। তবে আজকে আর্থর জোরাজুরিতে সে সবার সাথে নিচে আসে। বাকীরা গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেও শুভ্র উঠে তাঁদের মেইন ডোর খোলে বাইরে আসে। ছোট,ছোট সবুজ ঘাস ভর্তি গার্ডেনে পা রাখতে অন্ধকারে কারোর সরে যাওয়া টের পায় শুভ্র। দু’পাশে গাছ থাকলেও কেউ লুকালেও সেটা দেখা যাবে। তাঁদের বাড়ীটাও না! সামনে অনেকটা গাছ, বাগানবিলাস, মাঝখানে শান দিয়ে বাধাইকৃত ধোয়া সাদা রাস্তা। শুভ্রর খেয়াল হয় লাইট অফ করা। কিন্তু সবসময় তো সন্ধ্যার সাথে,সাথে লাইট অন থাকে। শুভ্র সার্ভেন্টকে আদেশ দেয় বাইরের লাইট সব অন করে দিতে। তখন চোখে পড়ে রাস্তার পাশে সাদা একটা ব্যাগ। শুভ্র কৌতূহল ধমাতে না পেরে সাদা ব্যাগটা হাতে নেয়। ঠিক তখনি তার মাথায় কেউ জোরে আঘাত করে। শুভ্রর থেকে ব্যাগ নিয়ে সেই ব্যক্তি গেট দিয়ে পালিয়ে যায়। শুভ্র মাথার পেছনে হাত দিতে র’ক্তে তার হাত ভিজে উঠে।
#চলবে