শুধু_তোমায়_ভালোবেসে #পর্ব_০২ #সাদিয়া_রহমান_হাফসা

0
585

#শুধু_তোমায়_ভালোবেসে
#পর্ব_০২
#সাদিয়া_রহমান_হাফসা
___________________
আঁখি ছেলের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন,

– ঐ পরিবারের সাথে কোনো সম্পর্ক গড়তে চাইছি না আমি। শুধু মেয়েটাকে বাঁচাতে চাইছি।

প্রশ্নসূচক চাহনিতে চেয়ে রইলো আদনান। ছেলের চাহনির মানে বুঝতে পেরে আঁখি কিছুক্ষণ নিরব থেকে নরম স্বরে বললেন,

– তোর ফুপ্পি অনেক সহজসরল ছিলো আদনান। তোর দাদার কথার কখনো বরখেলাপ করতো না। তোর দাদা ভেবেছিলো নিহাল অনেক সৎ মানুষ। কিন্তু তার অন্তর যে লোভে কলুষিত সেটা বুঝতে পারেনি। বিয়ের পর তোর ফুপ্পিকে টাকার জন্যে প্রতিদিন অত্যাচার করতো ঐ ভদ্রলোকের বেশধারী নিহাল আহমেদ আর তার মা নূরী বেগম। আম্বিয়া আমাদের এসবের কিছু একবারও জানায়নি। সব মুখ বুঁজে সহ্য করেছে। বাবা আর ভাইয়ের সম্মান নিয়ে ভেবেছিলো বোকা মেয়েটা। ওর ধারণা ছিলো এমপির বোন শশুড়বাড়িতে অত্যাচারিত-নিপিড়ীত হয় এসব কথা লোক জানাজানি হলে তোর বাবার সম্মানে লাগবে! তারপর সেদিন তোকে নিয়ে আমি আর তোর বাবা গিয়ে যেই দৃশ্য দেখলাম তা তো তোর মনেই আছে। নিয়ে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু আম্বিয়া-ই দ্বিমত করে।

থেমে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,

– ওর নাকি ঐ নরপশুদের উপর মায়া পড়ে গিয়েছে। একদিন জানতে পারলাম আম্বিয়া যার মায়ায় পড়ে নরকের মাটি কামড়ে পড়ে রইলো সেই নিহাল নাকি আরেকটা সংসার পেতেছে। সেসময় মেয়েটার মাত্র পাঁচবছর বয়স। রৌদ্র ছেলে হওয়ায় বাড়ির ছেলের মতোই আদর যত্ন পেয়ে আসছে। কিন্তু মেয়েটা যেন ওদের চোখের বিষ! মা ছাড়া কারো আদর পায়নি। ওইটুকু বয়স থেকেই ও বর্ণ রং নিয়ে কথা শুনে আসছে। ওরা ওর অনেকবার অনেক রকমের ক্ষতি করার চেষ্টাও করেছে। এমনকি ওটুকুন মেয়েটাকে ওরা অগোচরে মেন্টাল হসপিটালে দেওয়ার চেষ্টা অবধি করেছে। ভাগ্যিস আম্বিয়া জানতে পেয়েছিলো। ভয়ে আম্বিয়া সারাদিন মেয়েকে ঘরে তালাবন্ধী করে রাখতো। রৌদ্র ওর বোনকে যথেষ্ট স্নেহ করে কিন্তু ওরা রৌদ্রকে তার মা-বোনের থেকে সবসময় দূরে রেখেছে। ওরা চায় রৌদ্রও ওদের মতোই হোক! কিন্তু সব খারাপেও ভালো থাকে। ওদের মতো কীটের মাঝে ওরা দুই ভাই-বোন হলো রঙিন প্রজাপতি। রৌদ্র শহরে পড়াশোনা করছে আর মেয়েটাকে ওরা প্রাইমারির গন্ডিও পেরোতে দেয়নি। তোর ফুপ্পি জীবিত থাকাকালীন অবস্থায় যেখানে ওরা মেয়েটার উপর অমানবিক অত্যাচার করেছে, তোর ফুপ্পি চলে যাওয়ার পর কি তোর মনে হয় ওরা মেয়েটাকে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে দেবে!? এমন একটা অসুস্থ পরিবেশে থেকে একটা মানুষ কিকরে ই বা মানসিক ভাবে সুস্থ থাকবে বলতে পারিস!?

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো আদনান। এমন নয় যে সে মেয়েটাকে অপছন্দ করে তবে শিশু বয়সের একটা রাগ এখনও উজ্জীবিত হয়ে আছে মনের দেয়ালের কোনো এক কোণে। যদিও সেটা ঠুনকো বিষয় তবুও সেই বয়সে রাগটা অনেক গভীর ছিলো। ঘটনাটি সংক্ষেপে ছিলো এমন~

সেই বার সে প্রথমবারের মতো তার একমাত্র ছোট বোনের জন্মদিনের দাওয়াত দেওয়ার জন্যে বাবা-মায়ের সাথে ফুপ্পির বাড়িতে যায়। আদনানের বয়স তখন নয় কি দশ বছর হবে। সেখানে গিয়েই তারা দেখতে পায় নূরী বেগম তার ফুপ্পিকে অনেক বাজে ও নোংরা ভাবে কথা শোনাচ্ছে আর প্রহার করছে। বোনের সাথে এমন আচরণ করতে থেকে গর্জে উঠে রাশেদ সাখাওয়াত। হঠাৎ তাদের আগমনে ঘাবড়ে যায় নূরী বেগম। কোনোরকম ইনিয়েবিনিয়ে সে দ্রুত সেই জায়গা ত্যাগ করে। ভাইকে দেখে শুকিয়ে যায় আম্বিয়ার মুখ। তার গালে স্পষ্ট থাপ্পড়ের ছাপ। রাশেদ অশ্রুসজল চোখে ধমক দিয়ে বোনকে বললেন,

– তুই কি বানের জলে ভেসে এসেছিস? তোর কি কোনো পরিচয় নেই? নাকি আমাদের বোঝা তুই? যে এভাবে পড়েপড়ে নিপীড়িত হচ্ছিস! ভুলে গেছিস তুই কার মেয়ে? কে তোর ভাই?

অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকা আম্বিয়ার নিকট এসে স্নেহের হাত বাড়িয়ে দিতেই সে জড়িয়ে ধরে আঁখিকে। সম্পর্কে ননদ হলেও নিজ বোনের মতো আদর, যত্ন ভালোবাসা দিয়েছে আম্বিয়াকে। এত আদরের ননদের এই দশা দেখে নিজেকে সামলাতে অনেক বেগ পেতে হয় আঁখির। এই ঘটনা ছোট্ট আদনানের মনে একটা গভীর আঁচর কাটে। সবাই বাড়ির ভেতরে চলে গেলেও সে চলে যায় বাড়ির পাশের বাগানটায়। মনমরা হয়ে বাগানে হাঁটছিল তখনই চোখ যায় পাশের বিশাল আমগাছটায় ঝুলে থাকা রসাল মিষ্টি ঘ্রানযুক্ত বড়বড় আমে। অমনি তার চঞ্চল মনে ঝোঁক বসে যায় আম পাড়ার। যখনি গাছের দিকে পা বাড়াবে তখনই লাল রঙের ফ্যাকাসে ফ্রক পরিধেয় শ্যামবর্ণের চিকনচাকন দেখতে একটা বছর ছয়েকের মেয়ে এসে দাঁড়ায় তার পথে। আদনান কপাল কুঁচকায় তাকে দেখে কেননা সে দেখতে একদম অগোছালো ছিলো।

একটু ভালো করে দেখার পরে আদনান বুঝতে পারে এটা তার ফুপ্পির একমাত্র মেয়ে। তার ফুপ্পিকে সে কখনো তাদের বাসায় আসতে দেখেনি। ফুপাতো ভাই রৌদ্র আর সে একই স্কুলে পড়ার সুবাদে প্রতিবার স্কুলেই সাক্ষাত হয় ফুপ্পির সাথে। তেমনি একদিন ফুপ্পি এই মেয়েটাকে স্কুলে নিয়ে এসে তার ফুপাতো বোন বলে পরিচয় করায় তার সাথে।

মেয়েটা একদম চুপচাপ ছিলো, আদনানের সাথে টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। অথচ সেই বয়সে সবাই থাকে চঞ্চলতায় মশগুল। তাছাড়াও আদনান আরো একটা বিষয় লক্ষ্য করে সেটা হলো মেয়েটার হাত তার ফুপ্পির শাড়ির আঁচলে বাঁধা। বাঁধনটা ছিলো বেশ শক্ত-পোক্ত। এতটাই শক্ত যে সহজে এর গেঁড়ো কেউ খুলতে পারবে না। আদনানের ক্লাসের অনেকেই এই বিষয়টি নিয়ে সেদিন মজা করেছিলো। স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে এসেছে বললেও আদনান সেদিনের পর আর স্কুলে দেখেনি তাকে। ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে আদনান খেয়াল করে মেয়েটি ভয় মিশ্রিত চোখে অবাক হয়ে তাকে দেখছে। তার এই দৃষ্টি এমন যেন গভীর মনোযোগ দিয়ে জটিল অংক বোঝার প্রয়াস চালাচ্ছে। এতে ছোট্ট আদনান কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে। মেয়েটাকে অন্যমনস্ক করতে গলা ঝেড়ে প্রশ্ন করলো,

– এভাবে হা করে তাকিয়ে আছো কেন? আমাকে চিনতে পেরেছো? আমি তোমার কে হই জানো?

মেয়েটা যেন আরও ভয় পেয়ে গেলো। তার চোখমুখ শুকিয়ে আসে। সে দ্রুত পায়ে গাছের আড়ালে চলে যেতে নেয় আর ওমনি গাছের শিকড়ে বেধে ধপ করে মাটিতে পড়ে যায়। যার দরুন ধুলোয় মাখামাখি হয়ে যায় সারা শরীর। বিরক্ত হয়ে গেলো আদনান। নোংরা, অগোছালো, অপরিচ্ছন্নতায় আদনানের এলার্জি বলা যেতে পারে। মাটি থেকে উঠেই মেয়েটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে উঁকি দিয়ে তাকায় আদনানের মুখপানে। আদনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়েটির উদ্দেশ্যে বললো,

– শোনো আমি লুকিয়ে তোমাদের এই গাছের আম পারবো। আর তোমার কাজ হলো এখানে দাঁড়িয়ে আমায় পাহারা দেওয়া। কেউ চলে আসলে আমাকে তাড়াতাড়ি ডাকবে। বুঝতে পেরেছো?

মেয়েটি আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। উত্তরের তোয়াক্কা না করে আদনান উঠে পড়ে গাছে। দুইটা বড় টসটসে আমও ছিঁড়ে নেয়।

– ঐ কেড়ে তুই ছেমড়া? নাম আমার গাছ থেকে নাম! (জোরে চেঁচিয়ে)

নিহালের হাঁকডাকে চকিত হয়ে যায় আদনান। সাথে কিছুটা ভয়ও পায়। এক লাফে নেমে পড়ে গাছ থেকে। নিহাল এসে কান টেনে ধরে আদনানের। বিশ্রি ভাষায় বলে,

– জমিদারের বাচ্চা হয়েও চুরি করার স্বভাব! দাড়া বেটা মজা দেখাচ্ছি তোরে।

তারপর কান টেনেই তাকে নিয়ে যায় বাড়ির ভেতর। যাওয়ার সময় আদনান অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে থাকায় মেয়েটির দিকে। সে বলার পরেও তাকে কেন সতর্ক করলো না এই কারণে। ঐ ঘটনার পর অনেকটা বকাঝকা শুনতে হয়েছিল তার বাবার থেকে। এরপর আর কখনো সে ঐবাড়িতে যায়নি। ফুপ্পির মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর দ্বিতীয়বারের মতো যায় আর তারপর আজ। ঐ তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে আগে থেকেই একটা রাগ ছিলো আদনানের মনে আর তারপর আজ যখন দেখলো বিনা দোষে অযথা গাল-মন্দ করার পরও মেয়েটি নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে তখন তার রাগের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। যে নিজের সম্মান নিজে রাখতে জানে না তাকে অন্যেরা কি সম্মান করবে? এমপি আদনান সাখাওয়াতের মতো সম্মানিত মানুষের স্ত্রী কিনা এমন ব্যক্তিত্বহীন! রাগে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে আদনানের। আর তাই সে ওভাবে চলে যায় সেখান থেকে।

ফ্লোরের দিকে একধ্যানে চেয়ে বসে আছে আদনান। চায়ের কাপটা নিয়ে আঁখি বললো,

– কালকে সময় করে তোর একবার ভুবনপুরে যেতে হবে আদি।

– না মামনি প্লিজ! ঐ বাড়িমুখো হতে আমার বিরক্ত লাগে আর ঐ জঘন্য মানুষগুলোর সাথে তো কথা বলতেই রুচিতে বাঁধে।

আঁখি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

– তোকে ওদের সাথে খাজুরেআলাপ করতে পাঠাচ্ছি না। আজ বাদে কাল বিয়ে, তাই তোর হবু বউয়ের লওয়াজিমা দিতে পাঠাচ্ছি। আমিই যেতাম কিন্তু আমার এনজিওতে জরুরি কাজ পড়ে গিয়েছে। আমি সব গুছিয়ে রেখেছি শুধু বিয়ের শাড়ি টা কেনা হয়নি। সেটা তুই সময় করে একদিন ওকে সাথে নিয়ে কিনে দিয়ে আসবি। পারলে কালই যাস। এবার বিশ্রাম নে।

|
|

পা টিপেটিপে খুব সাবধানে পেছনের দরজা দিয়ে ক্লাসে ঢুকে মাথা নিচু করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে রাইদাহ। হাঁপাচ্ছে সে, হয়তো দৌড়ে এসেছে। ‘রাইদাহ ‘ আদনান আর আফসানের অতি আদরের ছোট বোন এবং রাশেদ সাখাওয়াত আর আঁখি সাখাওয়াতের একমাত্র আদরের মেয়ে। “অতি আদরে বাঁদর” বাক্যটা যেন এর জন্যেই তৈরি। সবার আদর পেয়ে এতটা ঘাড়ত্যাড়া হয়েছে যে যখন যা ইচ্ছা তাই করবে। ঝামেলা মেটানোর জন্যে বাবা আর দুই ভাই আছে না! শাসন একে দুইজন মানুষই করে একজন তার মা আর দ্বিতীয়জন হলো….যদিও এই শাসনে তেমন কোনো লাভ হয় না। কারণ সেই শাসনে রাইদাহ-র মন খারাপ হওয়ার আগেই যেই দুইজন তাকে শাসন তাদেরই মন ভেঙে যায়। যতই হোক নিজের দুর্বল জায়গায় তো আর আঘাত করা যায়না আর করলেও তা সহ্য করা বড়-ই দুষ্কর। রাইদাহ হলো ঐ দুইজনের সেই দুর্বল জায়গা।

ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে পানি গিলতে লাগলো। একেই তো দেরি হয়ে গেছে তারমধ্যে আবার পথে জ্যাম ছিলো। তাই অনেকটা পথ দৌড়ে আসতে হয়েছে।

– এই যে পেছনের চশমাওয়ালী! পানি খাওয়া শেষ হলে সোজা দাড়িয়ে পড়েন।

রাইদাহ-র পিপাসা মেটানোর জন্যে এই কথাটাই যথেষ্ট। যার জন্যে এভাবে লুকিয়ে-চুরিয়ে এলো শেষমেশ তার হাতে ধরা পড়েই গেলো। মীর আবারো বললো,

– পানি খাওয়া শেষ হলে আপনি দাঁড়াতে পারেন।

‘মীর হক’ এই ভার্সিটির এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। ইনি-ই সেই দ্বিতীয় ব্যাক্তি যে সবসময় রাইদাহকে কড়া শাসনে রাখে। যাকে রাইদাহ ভয় না পেলেও অমান্যও করে না। তৃতীয়বার বলার আগেই দাঁড়িয়ে পড়ে রাইদাহ। মীর দুইহাত বুকে গুঁজে শীতল কন্ঠে প্রশ্ন করে,

– আপনি কি বলতে পারেন আমার ক্লাস সপ্তাহে কদিন হয়!?

– দুইদিন।

– কয়টা বাজে শুরু হয়?

– ১১:০০ টায়।

– এখন কয়টা বাজে?

রাইদাহ সোয়েটারের লম্বা হাতা গুটিয়ে হাতঘড়িতে সময় দেখে শুকনো ঢোক গিলে বললো,

– ১১:৫৩ মিনিট স্যার।

চোয়াল শক্ত করে কিছুটা ধমকের সুরে মীর জিজ্ঞেস করে,

– আপনার দেরি হওয়ার কারণ?

রাইদাহ চশমাটা ঠিক করার ভান করে বললো,

– ট্রাফিক জ্যাম ছিলো স্যার।

– বাংলাদেশের যত ট্রাফিক জ্যাম হয় সব কি আপনার পথেই হয় নাকি আপনিই ঘুরেফিরে ট্রাফিক জ্যাম যে পথে হয় সেখানে চলে যান!? না মানে রোজরোজ আপনার এই একই বাহানা শুনে আমি আর আমার স্টুডেন্ট সবাই-ই বোর হয়ে যাচ্ছি। আপনি কি বোর হচ্ছেন না?

সারা ক্লাস জুড়ে হাসির রোল পড়ে গেলো। মীর ধমক দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললো,

– এভরিওয়ান সাইলেন্ট!

তারপর আবার রাইদাহ-র দিকে তাকায়। রাইদাহ বাম হাতে ডান হাতের কব্জিসন্ধি ধরে টেবিলের উপর চেয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর একটু পরপর নাকের ডগায় চলে আসা চশমাটা টেনে ঠিক করছে। নিচু হয়ে দাড়িয়ে থাকায় তার মুখভঙ্গি ঠাওর করতে পারছে না মীর। শব্দ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে ডেস্ক থেকে মার্কার তুলে হোয়াইট বোর্ডের সামনে গিয়ে মীর নিজের মুখোমুখি টেবিলটা দেখিয়ে অনেকটা আদেশের ন্যায় বলে,

– পেছন থেকে সামনের সিটে এসে বসুন। হারি-আপ!

রাইদাহ্ও দেরি না করে ভদ্র মেয়ের মতো সোজা সামনে এসে বসে পড়ে। মীর আবার ক্লাসে মনোযোগ দেয়। সবাই মনোযোগ দিলেও রাইদাহ কলম নিয়ে শোঁশোঁ শব্দ করে খাতায় গভীর দাগ টানতে লাগলো। যা মীরের নজর এড়ায় না। মুখে কিছু না বললেও মীর বিরবির করে বলে,

– গাধাকে যত পেটাও, গাধা কি ঘোড়া হয়!? ওহ্ মিস্টেক! ইনি তো বেডি মানুষ। আর গাধার বেডি ভার্সন হলো গাঁধি। গাঁধিকে যত পেটাও গাঁধি কি ঘোড়া..ঘোড়া! ওয়েট ঘোড়ার বেডি ভার্সন কি!?

চমকে তাকালো রাইদাহ্। নিজের হতবুদ্ধিতায় বেশ লজ্জায় পড়ে গেলো মীর কেননা সে শেষের কথাটা বেশ জোরেই বলে ফেলেছে। যার ফলে সারা ক্লাসরুম কয়েক সেকেন্ড থম মেরে থেকে আবার হোহো হাসির শব্দে ফেটে পড়ে।

|
|

ভোর~৫টা

কনকনে শীতের সকাল। পুরু কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে চারিপাশ। গ্রামীণ কুয়াশাচ্ছন্ন এই দৃশ্যটা দেখলে মনে হয় পাতলা কাঁচের আবরণে যেন সারা প্রকৃতি আবরিত। মাঠে হলদে সরিষা ফুলও বরফের মতো জমে আছে। দুয়েকজন জোয়ানমর্দ লোক কাধে বাঁশের পাটাতনে দুইটা মাটির কলস ঝুলিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছে। ঐ কলসে রয়েছে কাঁচা খেজুরের রস। ছোটছোট বাচ্চারা এমন কনকনে শীতের মাঝেই গরম কাপড় পড়ে কায়দা-সিপাড়া হাতে ছুটছে মক্তবের পথে। এসকল দৃশ্য শুধু গ্রামের পথেই দেখা যায়। গ্রামীণ মানুষই এসবের সাথে পরিচিত। গায়ে কালো চাদর জড়িয়ে পলকহীনভাবে গাড়িতে বসে সেই মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছে আদনান। ঠোঁটের কোণে তার এক চিলতে হাসি। ২৮ বছরের যুবক ‘আদনান সাখাওয়াত আদি’। উচ্চতা মধ্যম, গায়ের রং হলদে ফর্সা। ছোটবেলা থেকেই যে তার বাবাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বপ্ন দেখে আসছে একজন সৎ দায়িত্বশীল নেতা হওয়ার। যেই স্বপ্ন পূরণ করতেও সে সক্ষম হয়েছে। আজ সে তার জীবনে একজন সফল মানুষ। যদিও এ স্বপ্ন পূরণে তার বাবার সততারও অনেকটা অবদান রয়েছে।৷ প্রকৃতির মাঝে বুদ হয়ে থাকতে থাকতে একসময় গাড়ি এসে থামে গন্তব্যে।

সারাদিন ব্যস্ত থাকবে বলে এত সকালেই বেশকিছু গার্ড’স নিয়েই ভূবনপুরের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে আদনান। মরিচাধরা লোহার গেট ক্যাচক্যাচ শব্দ করে খুলে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই স্তব্ধ হয়ে যায় সে। এই স্তব্ধতার কারণ উঠোনের পাশের কলপাড়ে থালাবাসন মাজতে বসা তার হবু স্ত্রী। হাড়কাঁপানো শীতে সাধারণ পানি-ই যেখানে বরফ গলা পানির ন্যায় ঠান্ডা অনুভুত হয় সেখানে তার হবু স্ত্রীর পড়নে কোনো শীতের পোশাকও নেই। এতগুলো শপিং ব্যাগ হাতে আদনানকে দেখে চকচক করে উঠলো নূরী বেগমের চোখজোড়া। লাঠিতে ভর করে দ্রুত আদনানের সামনে গিয়ে পানের পিক ফেলে লাল দন্তে বললেন,

– আসো ভাই আসো। ঠান্ডার মধ্যে বাইরে দাঁড়ায় আছো ক্যা? আসো ঘরে আসো।

কথার মাঝে আদনানের হাত থেকে ব্যাগ নিতে উদ্বত হয়। বিরক্তিতে ছেয়ে যায় আদনানের চোখমুখ। সে তার এক হাত সামনে এনে বাধা দিয়ে বললো,

– আমি এখানে জামাই আদর নিতে আসিনি। আমার হবু বউয়ের লওয়াজিমা দিতে এসেছি। তাকে একটু ডেকে পাঠান।

নূরী বেগম হেসে বললেন,

– আইজ আমার রৌদ্র ভাই আসতেছে তো তাই ভালো-মন্দ রান্না করতে হইবো, এই জন্যে এত সকাল সকাল কাজ করতেছে। বোঝো-ই তো আমি বুড়া মানুষ। আমার রৌদ্র ভাই তো তোমার বন্ধুও লাগে! সে আসলে তার সাথে দেখা সাক্ষাত কইরা দুপুরের ভাত খাইয়া তারপর যাইবা। এখন আর যাইতে পারবা না। এই আমি গেইটে তালা দিলাম।

এখানে থাকার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে না থাকলেও রৌদ্রের কথা শুনে আর দ্বিমত করলো না আদনান। অনেক বছর হয়েছে দেখা হয় না তাদের। শেষ দেখাটা হয়েছিল ফুপ্পির মৃত্যুর দিন। শোকের দিনে তেমন কথা বলাও হয়নি। ফোনের আলাপে কি আর মন ভরে! তাই ঠিক করলো এসেই যখন পড়েছে তাহলে নাহয় দেখা করেই ফিরবে। আদনান সম্মতি জানালো,

– আচ্ছা ঠিক আছে।

কলপাড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিক্ষেপ করে নূরী বেগমকে জিজ্ঞেস করলো,

– যার জন্যে এসেছি সে মানে আমার হবু স্ত্রীকে ডাকতে পারবেন? আমার হাত ব্যথা হয়ে আসছে।

নূরী বেগম আবারো বিশ্রী হেসে হাঁক ছাড়লেন,

– ঐ ছেড়..আরু? ঐ আরু? ঐ এইখানে আয় দেখ কে আইছে!

ডাক শোনার সাথেসাথে বেরিয়ে আসলো মেয়েটি। আম্বিয়া আহমেদের একমাত্র মেয়ে ‘আরাধনা আহমেদ’। যাকে সবাই আরু বলে ডাকে। সবাই বলতে আম্বিয়া আর রৌদ্র। অবশ্য এখন তাকে কেউ-ই আর নাম ধরে ডাকে না। দাদি আর বাবা তাকে মুখপুড়ি আর কালি বলেই ডাকে সবসময়। আজ হঠাৎ ‘আরু’ ডাকায় হয়তো কিছুটা অবাক হয়েছে তবে সেটা সে চেহারায় প্রকাশ করে না। আদনান কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে আরাধনার দিকে। আরাধনার হাত-মুখ হলুদ আর কালিতে মেখে আছে। পড়নে অনেক পুড়নো একটা সালোয়ার কামিজ আর সেটাও নোংরা। কাজের লোকের চেয়েও বিশ্রীভাবে রেখেছে বাড়ির মেয়েটাকে। হাত দুটো ঠান্ডায় সাদা হয়ে গিয়েছে। আদনান হাতের ব্যাগগুলো আরাধনার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললো,

– আমি সবসময় হাইজেন মেইনটেইন করে চলি। নোংরা, অপরিচ্ছন্নতা একদম পছন্দ করিনা। এখানে অনেকক্ষন আছি। এগুলো সব তোমার জন্যে। এখানে কিছু সালোয়ার কামিজও আছে। পরিষ্কার হয়ে এখান থেকে পছন্দমতো একটা পড়ে তারপর নিজের কাজে যাও।

নূরী বেগম তাড়া দিয়ে বললেন,

– কিরে কথা বুঝছ নাই? জামাই যা কইলো কর যাইয়া।

দাদীর আদেশ পেয়ে আদনানের থেকে ব্যাগগুলো হাতে নিলো আরাধনা। তখন আদনানের নজরে পড়ে আরাধনার ঠান্ডায় সাদা ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া হাতের লাল ফোসকা পড়া দাগগুলি। এ দাগ যেন আদনানের মনে বিন্দু বিন্দু জমে থাকা তীব্র ক্ষোভকে ক্রমে আরও ভয়ানক করে তুললো। চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস টেনে আদনান নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।

– কিরে নেতা! সাতসকালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোন স্বপ্নে হারালি?



চলবে..

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here