#শুধু_তোমায়_ভালোবেসে
#পর্ব_০৬
#সাদিয়া_রহমান_হাফসা
__________________
সুনশান-নিস্তব্ধ রাতের কালো আধারে চুপিচুপি কতগুলো মুখোশ পরিহিত লোক চাদর মুড়ি দিয়ে অতি সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছে মাঠের ভেতরের দিকে। ঘন কুয়াশার জন্যে কেউ কাউকে স্পষ্ট চোখে দেখতে পাচ্ছে না। আচমকা বিকট শব্দে চারদিক ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হতে লাগে আর তার সাথে ভেসে আসে একসাথে অনেকগুলো মানুষের করুণ আর্তচিৎকার। ভয়ে আতংকে নিশাচর পাখিরা ডানা ঝাপটাতে শুরু করে। টানা মিনিট পাঁচেক কোলাহল হওয়ার পর আবার নিরবতায় ছেয়ে যায় প্রকৃতি। ঠান্ডা শীতল হাওয়ায় মেঘ উড়ে ঢেকে দিলো চাঁদের অর্ধ- আলোকিত ফালিকে।
•
•
– একটা পারমিশন চাই মামনী।
– কিসের?
– আমি ঠিক করেছি আরাধনাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবো। আমার জানা দরকার আমার স্ত্রীর আদৌও কোনো মেন্টাল ডিজিজ আছে কি না।
– যদি থাকে?
– ওর প্রপার ট্রিটমেন্ট চালু হবে। ওকে নরমাল লাইফে ফিরতে হবে এবং এটা জরুরি।
– হুম।
– মামনী?
– বল।
– আমি চাই না কেউ আমার স্ত্রীকে ছোট করুক। আমি চাই আরাধনা তার স্বামীর যোগ্য হয়ে উঠুক, চুপ না থেকে প্রতিবাদ করুক, ভীতু না সাহসী হয়ে উঠুক, কেউ বিনাকারণে আঘাত করলে তার প্রতিঘাত করুক।
আঁখি ছেলের মুখে খাবার তুলে দিয়ে বললো,
– ইনশা-আল্লাহ, দেখিস একদিন ও সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচবে। আজ তুই ওর জীবন গোছাচ্ছিস কাল আরাধনা অন্য অসহায় মেয়েদের জীবন গোছাতে সাহায্য করবে।
– ইনশা-আল্লাহ।
•
•
মশাল জ্বেলে সাতজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। একটুপর তাদের একজনের ফোন বেজে ওঠে।
– সাহেব!
✆ – জ্বালিয়ে দে।
– জ্বে সাহেব।
দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠলো সারা ক্ষেতে। নিমিষেই সব শস্য পুড়ে ছাই হয়ে গেলো সেই আগুনে। জ্বলন্ত মশাল ছুড়ে ফেলে দ্রুত পালিয়ে যায় তারা।
|
|
– তোরে না কইছি বাড়াবাড়ি না করতে! ওর সামনে না যাইতে! তারপরও তুই ওর হাত ধইরা আমগো সবার সামনে দিয়া চইলা গেছোস! এত বড় কলিজা তোর!
এই বলেই মোটা লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে মারতে শুরু করে নূরী বেগম। দুই হাত দিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করার চেষ্টা করছে আরাধনা তবুও তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না, উল্টো লাঠির আঘাতে হাতে কালশিটে দাগ পড়ে যাচ্ছে।
– দাদী..আআমি য..যাবো নাহ্। আর ম..মেরো না আমায়!
– আরাধনা!?
– যাবো না আমি। ক..কথাও বলবো ন..নাহ্। আর মেরো নাহ্। কষ্ট হ..হচ্ছে..
– কোথায় কষ্ট হচ্ছে তোমার? আরাধনা?
•
চোখ মেলে আরাধনা। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। সারা শরীর অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে। আদনান দুই হাতে আলতো করে তার গাল স্পর্শ করে বললো,
– তুমি ঠিক আছো?
কোনো কথা না বলেই ঝাপটে ধরে আদনানকে। এমনভাবে জড়িয়ে ধরে যেন পারলে বুকের ভেতরে ঢুকে যাবে। বুকের পাশের শার্টের অংশ খামচে ধরে রেখে আরাধনা বললো,
– আমি যাবো না। আমায় মেরো নাহ্।
রাত্রের দ্বিপ্রহর। মনটা কেমন ভারী-ভারী লাগায় ব্যালকোনিতে এসে দাড়িয়েছিল আদনান। চারিদিক নিস্তব্ধতায় মোড়া। কিন্তু রাতের এই গুমোট নিরবতা বেশিক্ষন স্থায়ী থাকে না। কিছুক্ষণ পরই তীক্ষ্ম আর্তনাদ ভেসে আসে ঘর থেকে। আরাধনার গলার স্বর শুনে আর এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত ঘরে ফিরে এসেই শুনতে পায় কান্না মিশ্রিত গলায় অস্পষ্ট ভাবে করা অনুনয় অনুরক্তি। ঘুমের ঘোরে ছটফট করে আবোলতাবোল বলছে আরাধনা। স্বপ্ন দেখছে কি? না না, স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন! ঘুমন্ত অবস্থাতেই আরাধনাকে তুলে বসিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো আদনান। গালে হালকা চাপড় মেরে কয়েকবার ডাকার পরই ভয়ার্ত চোখে কয়েক পলক তাকিয়ে ঝাপটে ধরে আদনানকে।
– আরাধনা?
– হু?
– খারাপ স্বপ্ন দেখেছো?
দ্রুত মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানালো আরাধনা।
– ভয় করছে?
– নাহ্।
– তাহলে কাঁদছিলে কেন? ছটফট করছিলে কেন?
– ত..তখন ভয় করছিলো।
– এখন ভয় করছে না?
– নাহ্।
– কেন!?
– তুমি আছো তো!
আত্মতুষ্টির হাসি ফুটে ওঠে আদনানের ঠোঁটের কোণে। আলতোভাবে আরাধনার ঘর্মাক্ত ললাটে অধর ছুঁয়ে দিলো। এলোমেলো চুলে বিনুনি গেথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই পুনরায় ঘুমের দেশে পাড়ি জমায় আরাধনা। আদনানের নিজেরও ঘুমঘোর লেগে গিয়েছিল তখনই ফোনটা ভাইব্রেশনে কেঁপে উঠে। এতো রাতে ফোন আসায় খানিক বিরক্ত হয় সে।
– কি ব্যাপার এত রাতে ফোন করেছেন! কোনো সমস্যা হয়েছে?
✆ – বাবা আমাদের কৃষকদের উপর গুলি চালানো হয়েছে। নয়জন ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছে। বাকি আঠারো জনের অবস্থা শোচনীয়। ধানের একটা দানাও আস্ত নাই সব পুড়ে শেষ হয়ে গিয়েছে!
কথাগুলো কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো মুবিন শেখ। আদনান অস্থির হয়ে বললো,
– কৃষকদের উপর হামলা হয়েছে মানে! গার্ড’স সব কোথায় ছিলো!? আর কৃষকদের উপর ই বা কেন হামলা করা হলো!?
✆ – বাবা আমি কিছু বলতে পারি না। আপনি যত তাড়াতাড়ি পারেন এখানে চলে আসেন। আমরা কেউ কিছু বুঝতে পারতেছি নাহ্। বড় স্যাররে আপনার সঙ্গে নিয়ে আসেন বাবা!
– আপনি চিন্তা করবেন না চাচা! আমি আসছি। বাবা এই মুহুর্তে দেশের বাইরে আছে। কিছুদিন পর ফিরবে। তাকে এখন এই বিষয়ে কোনো কিছু জানানোর দরকার নেই। আমি এসে দেখছি।
✆ – আচ্ছা ঠিক আছে বাবা। আপনি জলদি আসেন। গ্রামের মানুষ অনেক ঝামেলা করতেছে। সবাই হাসপাতালের বাইরে ভীর করে দাঁড়ায় আছে।
•
বুকের মাঝে বিড়ালছানার ন্যায় চুপটি করে ঘুমিয়ে থাকা আরাধনাকে আলগোছে বিছানায় শুইয়ে উঠে দাঁড়ালো আদনান। বেড সাইড টেবিল থেকে হ্যান্ড ওয়াচ টা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। অন্ধকারেই হলরুম পেরিয়ে সদর দরজা খুলে চলে আসে গাড়ির পার্কিং প্লটে। নাইট সিকিউরিটি গার্ড’স-রাও আদনানের দেখাদেখি গাড়িতে উঠে পড়ে। বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কপাল ঘষতে থাকে সে। গাড়ি যখন বাড়ির মেইন গেইট পাড় করবে তখনই আদনান অনেকটা জোরে বললো,
– স্টপ দ্য কার!
সাথে-সাথেই গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভার বশির জিজ্ঞেস করলেন,
– কোনো সমস্যা স্যার?
– পাঁচ মিনিট।
দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো সে। খুব আস্তে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করে ঘুমন্ত আরাধনার নিকটে এগিয়ে যায়। আলতো চুমু খেলো অর্ধাঙ্গিনীর ললাটে। আলগোছে কোলে তুলে নিয়ে পুনরায় বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো আরাধনাকে। তারপর খুব সাবধানে পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। নিজের ফেরারি কারের ড্রাইভিং সিটে বসে আরাধনাকে বুকের উপর রেখে সিট বেল্ট লাগিয়ে নিয়ে নিজের গায়ের চাদরে ওকে ভালোভাবে ঢেকে দেওয়ার পর গাড়ি স্টার্ট দিলো। আদনানের গাড়ির পিছুপিছু বেরিয়ে পড়ে গার্ড’স ভর্তি আরো দুইটি বড় কালো গাড়ি। ফাঁকা রাস্তায় মিডিয়াম স্পিডে এক হাতে আরাধনাকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে গাড়ি ড্রাইভ করছে আদনান। ভোর হতে বেশি সময় নেই। সকালের আগেই দিঘিরপাড় পৌছুতে হবে।
|
|
– ভাই সকল! আমি বরাবরই আপনাদের সবার ভালো চেয়ে এসেছি। আমি চেয়েছি আমার সহজ-সরল জনগনের ভালো করতে। কিন্তু পারলাম নাহ্। ঐ রাশেদ সাখাওয়াত তার টাকার জোরে আবার আমার থেকে আমার প্রাপ্য স্থান ছিনিয়ে নিয়েছে। তার জোয়ান অপক্ব ছেলের হাতে তুলে দিয়েছে আপনাদের জানমাল। সে খুব জোর দিয়ে বলছিলো যে সে আপনাদের সেবা করবে। এই তার সেবা! আমার অবলা গরীব কৃষক ভাইদের নৃশংস মৃত্যু! কি ক্ষতি করেছিলো তারা!? কি দোষ করেছিলো তারা যার জন্যে তাদের এত নৃশংসভাবে মরতে হলো!? একটাই কারণ! ঐ তরুণ অপরিপক্ব নেতা আদনান সাখাওয়াতের জিম্মায় তারা কাজ করতো আর এই কারণেই তাদের এমন ভয়াবহ মৃত্যু স্বাদ ভোগ করতে হয়েছে। এরপরও কি আপনারা এমন নেতাকে সাপোর্ট করবেন!?
– একদম ঠিক বলেছেন চাচাজান! ওদের একটাই দোষ ওরা আমার আওয়াতাধীন হয়ে কাজ করতো। আমাকে সাপোর্ট করেছে। আর তাই আপনি আপনার রাগ, ক্ষোভ, প্রতিহিংসা, ঝোঁকের বশে এসে এই নিরপরাধ মানুষগুলোর প্রাণ কেড়ে নিলেন, ঘর ভেঙে দিলেন, ওদের ছোটছোট স্বপ্ন-আশা সব তছনছ করে দিলেন।
•
হসপিটালের বাইরে আদনানের বিরুদ্ধে জনসমাবেশ ডেকেছিলো সাজিদ ইব্রাহীম। টাকা-পয়সা, ধন-দৌলত, বাড়ি-জমিতে যে কিনা কোনো অংশে আদনানের থেকে কম না বরং অনেকটা এগিয়ে। আদনানের বাবা জনাব রাশেদ সাখাওয়াত এবং বর্তমানে আদনানের প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হলো এই সাজিদ ইব্রাহীম, যে প্রতিবারই শুধু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে মাত্র। নিজের রুক্ষ ব্যবহার, অহংকার, অত্যচারী স্বভাবের কারণে প্রতিবারই হারতে হয়েছে তাকে।
এবছরে যখন রাশেদ সাখাওয়াতের পরিবর্তে আদনানের নামে নমিনেশন পেপার ওঠে তখন সে ভেবেছিলো তার জয়ই নিশ্চিত। কেননা আদনান তরুণ বয়সী। কিন্তু এবারও তাকে হারিয়ে জিতে যায় আদনান। হেরে যাওয়ার লজ্জার থেকেও বেশি লজ্জা তাকে পেতে হয়েছে ছেলের বয়সী ছেলের কাছে হেরে যাওয়ার কারণে। সমাজে, এলাকায়, পার্টি অফিসে কোথাও তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করতে বাদ রাখেনি কেউ। পুরনো ক্ষোভকে আরও তরতাজা করে তোলে এই অপমান গুলো। আর এই অপমান-ই তাকে প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে। আদনানের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া-ই এখন তার মূল লক্ষবস্তু।
•
তিনিই রাতে তার লোকদের পাঠিয়েছিলো গরীবদের জন্যে মজুদ কৃত শস্যক্ষেতে আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্যে আর তার সাথে সেই ক্ষেত চাষ করা কৃষকদের হ/ত্যা করতে। সবকিছু প্ল্যানমাফিক-ই চলতে থাকে। তার কিছু লোকেরা সাধারণ মানুষদের সাথে মিশে যায় এবং সবাইকে আদনানের বিরোধিতা করার জন্যে উসকে দেয়। স্বজন হারানোর শোকে অনেকেই তাদের সাথে তাল মিলায়। অতঃপর নিজের ষড়যন্ত্রকে সফল করার উদ্দেশ্যেই এই জনসমাবেশ ডাকা হয়েছিলো। কিন্তু হঠাৎ উত্তপ্ত ভরা সমাবেশে এসে উপস্থিত হয় আদনান। সাজিদের থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে উপরোক্ত কথাগুলো বলার পর কানাঘুঁষা শুরু হয় সভায় উপস্থিত সবার মাঝে। রেগে গিয়ে সাজিদ ইব্রাহীম হুংকার ছেড়ে বললেন,
– কি বলতে চাইছো তুমি! এই নিরীহ মানুষগুলোকে আমি হ/ত্যা করিয়েছি!? এতবড় হিম্মৎ তোমার!? (চেঁচিয়ে)
দুইহাত পেছনে মুষ্টিবদ্ধ করে দাড়িয়ে সাজিদ ইব্রাহীমের মুখোমুখি হয়ে আদনান বললো,
– আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আমি সিনা টান করে বলছি আমার কৃষকদের আপনি খু/ন করিয়েছেন চাচাজান। আর এর দাম আপনাকে দিতে হবে।
– হুহ! নেতা হয়েছো বলে কি আইন কিনে নিয়েছো তুমি!? তোমার মুখের মনগড়া কথায় কি আমি খু/নি হয়ে যাবো? দু’দিনের ছেলে! তোমার কথায় সব হবে নাকি! কোথাকার কে তুমি হ্যাঁ?
আদনান মুচকি হেসে বললো,
– বয়স বাড়ার সাথেসাথে আপনার স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে শুরু করেছে চাচাজান। আমি আদনান সাখাওয়াত, এলাকার প্রতিটি ধূলিকণা জানে এই আদনান সাখাওয়াত কে? আর আপনি জানেন না!? কোনো ব্যাপার নাহ্। অন্তত আমাকে জানার জন্যে হলেও আপনাকে ধুলোর সাথে মিশে যেতে হবে! খেলার সবকিছুই ঠিকঠাক ছিলো তবে গুটিটা ভুল জায়গায় চালান করে দিয়েছেন। আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না আমি চলে এসেছি। যা করার আমি নিজে করবো।
•
•
•
চলবে…
(শব্দসংখ্যা~১৪০৭। দেরি হওয়ার জন্যে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না যেন! সাথে ভুলগুলিও ধরিয়ে দিবেন আমি সুধরে নেবো। বানান সংক্রান্ত ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং💛💚)
গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/