তোমায়_যবে_পাই_দেখিতে #তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া #পর্ব_১৩

0
229

#তোমায়_যবে_পাই_দেখিতে
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
#পর্ব_১৩
(প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
কেনো জানি তিয়াসের মামার বাড়িতে যাওয়ার বিষয়টা ভালো লাগেনি অর্পার। কিন্তু সেসব নিয়ে কিছু বলা ঠিক মনে হলোনা অর্পার। কিছু বললে হয়তো অনাধিকার চর্চা হয়ে যাবে।
বাস থেকে নেমে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে তিয়াস। রাতে বাসে চড়েছিল,সকাল সকাল পৌঁছে গেছে গন্তব্যে। সেই কবে এই গ্রাম ছেড়েছিলো তিয়াস। উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার পরে,প্রায় তিন বছর হলো। এই সময়ের মধ্যে সবকিছু কেমন বদলে গেছে। বাসস্ট্যান্ডের পাশে আরো অনেকগুলো নতুন দোকান বসেছে। আগে তিনটা দোকান ছিলো মোটে,এখন তার সংখ্যা দ্বিগুণ। তাছাড়াও ভ্যানগাড়িতে করে বিভিন্ন খাবারও বিক্রি হচ্ছে। তারমধ্য বাদাম,বুট ভাজা, সিমের বিচি ভাজা,নারকেল, ভাপা পিঠা অন্যতম।
” তুমি তিয়াস না?”
মধ্যবয়স্ক আফতাব আলীর ডাকে ভাবনার ছেদ ঘটলো তিয়াসের। ভদ্রলোকের দিকে দৃষ্টিপাত করলো সে। চোখে পাওয়ারফুল চশমা উনার,পরনে লুঙ্গি আর সোয়েটার। সহসাই তিয়াসের ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ছোটো থেকেই ভদ্রলোক খুব স্নেহ করতেন তিয়াসকে।
” হ্যাঁ চাচা। কেমন আছেন আপনি? বাড়ির সবাই কেমন আছেন? ”
” আছে বাবা সবাই আলহামদুলিল্লাহ। আমিও ভালো তবে বয়স হয়েছে তো শরীরটা ইদানীং খারাপ যাচ্ছে একটু। তা তুমি এলে হঠাৎ? ”
আফতাব আলীর সাথে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসলো তিয়াস। চোখেমুখে পানি দিয়ে দু’টো চায়ের সাথে বিস্কুট অর্ডার করে কথায় মনোনিবেশ করলো তিয়াস।
” মামা-মামী অনেকদিন ধরে আসতে বলছিলেন, তাই ভাবলাম একবার ঘুরে যাই। যতই হোক একসময় তো উনাদের অন্ন খেয়েছি। আর আল্লাহ চাইলে সামনে বিয়ে-শাদি করবো,সেই বিষয়ও জানাতে আসা আরকি।”
দোকানী চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন দুজনের দিকে, সাথে সুইটি বিস্কুট। ছোটো ছোটো এই বিস্কুটগুলো খুব ভালো লাগে তিয়াসের। তিয়াসের বিয়ের কথা শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে উঠলেন আফতাব।
” বাহ! দোয়া রইলো তোমার জন্য বাবা,জীবনে সুখী হও। ”
” হ্যাঁ আমিও চাই এবার অন্তত সুখের মুখ দেখতে। ”

আফতাব আলীর সাথে কথা বলতে বলতে চা শেষ করে মামার বাড়ির উদ্দেশ্য হাঁটছে তিয়াস। ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা দিয়ে এগুচ্ছে তিয়াস। ধানের গায়ে লেপ্টে থাকা শিশিরের কণাগুলোকে দেখতে দারুণ লাগছে। অল্প-বিস্তর রোদের আলোও দেখা মিলেছে পূর্ব আকাশে।

” তিয়াস ভাইইইইইই!”
কিছুটা সামনে থেকে নয়নের আওয়াজ ভেসে আসছে। ছেলেটা মনে হয় তার আসার জন্যই পথে অপেক্ষা করে আছে। নয়ন এবার ক্লাস নাইনে পড়ে, খুব মিশুক স্বভাবের ছেলে। ছোটো থেকেই তিয়াসের পিছুপিছু থাকতো।
” কেমন আছিস নয়ন?”
তিয়াস হাঁটার গতি দ্বিগুণ করে দ্রুত পায়ে এগুলো সামনে। নয়নও দৌড়ে এগিয়ে এলো তিয়াসের দিকে।
” ভালো আছি,তুমি কেমন আছো? ”
” এইতো আছি বেশ। সকাল হতেই কি এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছিস না-কি? ”
দু’জনে একসাথে হাঁটছে। এই রাস্তার শেষে তিয়াসের মামার বাড়ি। ভাইয়ের কথায় সবগুলো দাঁত বের করে হাসলো নয়ন। কী স্নিগ্ধ সেই হাসি!
” হ ভাই। তবে একটা কথা!”
” কী কথা নয়ন?”
” মা-বাবা হঠাৎ তোমার কথা এতো মনে করে কেনো? বিষয়টা কেমন সন্দেহজনক মনে হয় আমার কাছে। আমার যতদূর মনে হয় মাধবী আপার সাথে তোমার বিয়ে দিতে চায় মা।”
” দূর পাগল,মাধবী আমার বোন। মামা-মামী এরকম কিছু বললে আমি বুঝিয়ে বলবো চিন্তা করিস না। ”
নয়ন ভাইয়ের কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।

সকালের নাস্তা করছে প্রিয়ন্তি ও রেজওয়ান। আজকাল রান্নাবান্না করতে ভালোই শিখেছে প্রিয়ন্তি। পরিস্থিতি আসলে মানুষকে সবকিছু শিখিয়ে দেয়।
” এক বছর তো গ্যাপ গেলো এবার ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য আবেদন কর আবার। এক বছর যাওয়া কোনো ব্যাপার না। অনেকে তো ফেইল করেও পিছনে পড়ে যায়। ”
খেতে খেতে বললো রেজওয়ান। প্রিয়ন্তিও তাই ভাবছিলো। তিয়াসও সেদিন বললো একইকথা। তিয়াস চায় প্রিয়ন্তি লেখাপড়া করে ভালো চাকরি করুক কিংবা নিজের ইচ্ছে মতো কিছু করুক। নিজে যা করতে পারেনি সেটা প্রিয়ন্তি করুক।
” হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছিলাম বাবা। ”
” এডমিশন ডেট তো অনেক পরে ততদিন অপেক্ষা কর।”
” হুম,মা কল দিয়েছিলো রাতে। ”
” কী বললো?”
” মা কিছুতেই আর তোমার কাছে ফিরবে না বাবা। তোমরা মিউচুয়াল ডিবোর্স করে নাও। ”
রেজওয়ানের গলায় যেনো খাবার আঁটকে গেছে। বিষম খেলো। প্রিয়ন্তি পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো বাবাকে। রেজওয়ান সময় নিয়ে পানি পান করলো। কিছুটা সময় পরে মুখ খুললো রেজওয়ান।
” আমি কী করলে তোর মা ফিরবে বলতে পারিস?”
প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললো রেজওয়ান। প্রিয়ন্তি বাবার ছলছল নয়নের দিকে তাকিয়ে আছে।
” মন থেকে উঠে গেছো তুমি এবং এর পিছনে যে তোমার কতটা ভূমিকা আছে সেটা নিশ্চই বলতে হবে না? ”
রেজওয়ান নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। প্রিয়ন্তি আবারও বলতে লাগলো,
” এভাবে মনে অশান্তি রেখে সারাজীবন কাটানো যায় না বাবা। তবুও যদি তোমার মনে হয় আরো কিছুদিন চেষ্টা করবে তাহলে করো। মনে হয় না মায়ের মন গলবে।”
” আমি সারাজীবনে আর চোখের পানি ফেলতে দিবো না তোর মা’কে। মা রে তুই একটু বোঝা তোর মা’কে। আমি, আমি তাকে ছাড়া থাকতে পারবোনা। ”
প্রিয়ন্তি চুপ করে আছে। একটা মানুষ কতটা অনুশোচনার অনলে পুড়লে এভাবে কাঁদতে পারে। এই পৃথিবীতে বিবিকের আদালতে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হওয়ার চেয়ে বড়ো কোনো শাস্তি কি আছে? একটা মানুষ দিনের পর দিন মন থেকে অনুশোচনায় ভুগছে এরচেয়ে যন্ত্রণা বোধহয় আর কিছুতেই নেই। ক্ষমা হচ্ছে মহৎ গুণ, সেই কথা অনুযায়ী মা’কে শেষ বারের মতো বোঝাবে বলে রেজওয়ানকে আস্বস্ত করে প্রিয়ন্তি।

ভর দুপুরবেলা, তবুও তেমন রোদের তাপ নেই। আশেপাশে হালকা কুয়াশা, মেঘলা আকাশ। তিয়াস আসায় এ বাড়িতে আজ ভালো খাবার-দাবারের আয়োজন করেছেন। জসিম মামা আর তিয়াস একসাথে বারান্দায় হোগলায় বসে খাবার খাচ্ছে। নয়ন আগেই খেয়েছে। খেয়েদেয়ে উঠোনের এক কোণে বসে ময়নার সাথে কথা বলছে সে। ময়না তার পোষা পাখি। পাখিটা খুব সুন্দর কথা বলে। মাধবী মায়ের সাথে খাবার পরিবেশন করেছে এতক্ষণ, এখন দাঁড়িয়ে আছে। এসএসসি পরীক্ষার পরে কলেজে আর ভর্তি হওয়া হয়নি মাধবীর। ঘরে বসে আছে বছর দুয়েক হবে। নয়ন স্বভাব চরিত্রে বাবার মতো হয়েছে আর মাধবী মায়ের মতো কুটিল বুদ্ধি সম্পন্ন হয়েছে। একটা বিষয় তিয়াস খেয়াল করছে, তার মামাতো বোন আর মামি কিছু একটা নিয়ে মতলব করছে। খেতে খেতে এইসব ভাবছিল তিয়াস,তখনই প্রিয়ন্তির কল আসে। তিয়াস কল রিসিভ না করে একটা টেক্সট পাঠিয়ে খাওয়াতে মন দেয় আবারও।

” তিয়াস আজ কিন্তু ফিরতে পারবি না। এতদিন পরে এসেছিস যখন একটা রাত অন্তত থেকে যা।”
নিতু তিয়াসের প্লেটে এক পিচ মাংস দিলো। জসিম কিছু বলতে চায় কিন্তু নিতুর জন্য বলতে পারে না।
” মামি রাতেই ফিরতে হবে আমাকে, ওদিকে অনেক কাজ।”
” কাজ বললেই ছাড়বো না-কি? ”
মাধবী জোর দিয়ে বললো। সাথে তাল মেলালো মামিও। মামির চোখ পাকানো দেখে শেষে মামাও থেকে যেতে বললো। অগত্যা সবার আবদার রাখতে আজকের রাতটা থেকে যেতে রাজি হয় তিয়াস। ছেলেটা যদি জানতো কী নোংরা পরিকল্পনা এঁটেছে তার মামি!
বিকেলে স্নেহা এসেছিলো প্রিয়ন্তির সাথে দেখা করতে। রিক্তাও এসেছিলো সেদিন। মেয়েটা লজ্জায় এড়িয়ে চলে প্রিয়ন্তিকে। আজকে স্নেহা থাকবে এখানেই। সন্ধ্যা নেমেছে। প্রিয়ন্তি চায়ের সাথে টোস্ট দিয়েছিলো খেতে কিন্তু স্নেহা আবার চা খায় না। দু’জনের কথোপকথনের মধ্যে কল আসে তিয়াসের। কিন্তু প্রিয়ন্তিও কল কেটে একটা টেক্সট পাঠিয়ে দেয়।
” কী হলো কল কাটলি কেনো?”
স্নেহা জিজ্ঞেস করলো। প্রিয়ন্তি মুড়ি আর চানাচুর মাখছে একসাথে।
” দেখছিস না কাজ করছি? দুপুরে কল দিলাম আর এখন পাল্টা কল দিয়েছে। দূরে গেলে বুঝি এভাবে ভুলে যায় মানুষ? ”
” আরে বোকা ব্যস্ত ছিলো হয়তো। কথা বলে নে তুই, স্পেশাল কিছু বলার থাকলে আমি না হয় কানে আঙুল চেপে বসলাম। ”
প্রিয়ন্তি আলতো করে স্নেহার কাঁধে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো কয়েকটা। স্নেহা হাসছে।
” হুঁশ! তেমন কিছু না। তুই খাওয়া শুরু কর তো।”
প্রিয়ন্তি কল দিলো তিয়াসকে। কল দেওয়া মাত্রই রিসিভ হলো।
” আমার প্রিয় কি খুব বেশি অভিমান করেছে? ”
প্রিয়ন্তির মনটা কেমন উড়তে শুরু করেছে। প্রিয় মানুষটা যখন না চাইতেই মনের কথা বুঝে যায় তখন নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী মনে করে মেয়েরা। প্রিয়ন্তি মেকি রাগ দেখিয়ে বললো,
” মোটেই না। আমার তো খেয়েদেয়ে কোনো কাজ নেই যে অহেতুক অভিমান করবো।”
” বুঝলাম তোমার হ্যাঁ মানে না আর না মানে হ্যাঁ। কে যেনো বলেছিলো, মেয়েদের মন বোঝা নয়রে খুব সোজা! ”
” বুঝতে হবেও না তোমাকে। ”
” অথচ মনে মনে তুমি বলছো,খুব করে যেনো বুঝি তোমাকে। ”
প্রিয়ন্তি একটু চমকালো। সে কীভাবে বুঝলো মনের কথা? মুখে যাই বলুক মনে মনে তো সে সত্যি চায় তিয়াস তাকে বুঝুক।
” ভালো তো। এতই যখন বোঝো তাহলে এটুকু নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো কেনো অভিমান করেছি।”
” কেনো আবার! ওই যে দুপুরে কল দিয়ে পেলে না,তারপর আর কলও দিলাম না। এজন্যই মহারাণী মান করেছে, সেকি বুঝতে বাকি আছে আমার? ”
” তা এতোটাই যখন বোঝো তবে কল দিলে না কেনো? ”
” মামা বাড়ি তো কারেন্ট নেই। গাছ কাটতে গিয়ে কারেন্টের তার কেটে ফেলেছে পাশের বাড়ির লোক। ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছিলো। বিকেলে দোকানে গিয়ে চার্জ দিলাম। এখন বাড়ি ফিরে কল দিয়েছি। চার্জে বসিয়ে ফোন মামাতো ভাইয়ের সাথে গ্রামে ঘুরলাম একটু। ”
প্রিয়ন্তিও চানাচুর মুখে দিয়ে চিবুচ্ছে আর কথা বলছে। স্নেহা মেসেঞ্জারে চ্যাট করতে ব্যস্ত।
” হুম বুঝতে পেরেছি। ফিরবে কখন? ”
” কালকে সকালে। রাতেই তো ফিরতাম কিন্তু সবাই এমনভাবে বললো সবাই যে থাকতে হলো।”
” ভালো কিন্তু মামাতো বোন হতে সাবধান। বেশি কথাবার্তা বলবা না। জানি এগুলো বলা ঠিক না কিন্তু আমি খুব হিংসুটে, সেটা তো জানোই।”
” ঠিক আছে জান মনে থাকবে। এখন রাখছি কাল দেখা হবে ইনশাআল্লাহ। ”
” আল্লাহ হাফেজ। ”
কল কাটতেই নয়ন এসে ঢুকলো ঘরে। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে সে। ফোনে কথা বলতে শুনেছে বলেই যে নয়নের এই খুশির কারণ সেটুকু বুঝতে বাকি রইলো না তিয়াসের।
চলবে,
আগের পর্বের লিংক https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/938993397822433/?mibextid=Nif5oz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here