ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয় পর্ব ২০

0
313

ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ২০

চন্দ্রিমা বাড়িতে আসার পর মাহিম আবার আগের মতো চন্দ্রিমার রুমেই বেশি সময় কাটায়। চন্দ্রিমার শরীরটা খারাপ করছে। কিছু রিপোর্ট খারাপ এসেছে। কিন্তু অনেকটা জিদ করেই ও চলে এসেছে। মাহিম চৈতালীকে বলেছে চন্দ্রিমাকে বিরক্ত করতে না। দু’জন মুখোমুখি হলেও চৈতালী যেন এমন কিছু না বলে যাতে চন্দ্রিমা স্ট্রেস নেয়। চৈতালীও মেনে নিয়েছে। এই মুহূর্তে তার ধ্যানজ্ঞান লেখাপড়া। খুব একটা সামনাসামনি তাই হতে হয়নি।

সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু কিছুদিন পর চন্দ্রিমার শরীরটা বেশি খারাপ হয়ে যায়। ডাক্তারের পরামর্শে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়েছে। চন্দ্রিমার বিলিরুবিন কাউন্ট বেড়ে গিয়েছে। এএলটি এএসটি রেশিও ও বেশি। খুব খারাপ কিছু না হলেও ডাক্তারের পরামর্শে কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হবে। মাহিম নিয়মিত হাসপাতালে সময় দিচ্ছে। রাতে কাউকে থাকতে হয় না। হাসপাতাল থেকেই নিয়ম নেই। চৈতালীর ইচ্ছে করেছিল একদিন এসে চন্দ্রিমাকে দেখতে। কিন্তু মাহিমের অস্বস্তি দেখে আর আগ্রহ করেনি। জোবাইদা বেগম আর জোহরা বেগমও চন্দ্রিমাকে দেখতে হাসপাতালে গিয়েছেন। তবে ছেলের এই একবার হাসপাতাল, একবার ব্যবসার কাজে দৌঁড়ানো নিয়ে জোবাইদা বেগম বিরক্ত। চৈতালীর উপর তা ঝেড়েছেনও। চৈতালীর পরীক্ষা প্রায় শেষ। ইদানীং সারাদিন রুমে থেকেই পড়াশোনা করেছে। এমনিতেও তার খুব একটা কাজ নেই। মাহিম যখন বাড়িতে আসে তখন উঠে এসে দেখে মাহিমের কিছু প্রয়োজন কিনা। আজ জোবাইদা বেগম রুমে এসে বলেছেন,

“তোমার পরীক্ষা শেষ হয়নি এখনও?”

“প্রাকটিকাল আছে বাকি। লিখিত শেষ।”

“এখন তাহলে একটু হ্যাসবেন্ডের দিকে মন দাও। ছেলেটা সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে। তার কোন যত্ন হয় না। এভাবে দেখা যাবে তুমিও ভালো আছ, চন্দ্রিমাও ভালো আছে। মাঝে আমার ছেলেটারই না কঠিন কোন অসুখ হয়ে যায়। সময় মতো খাওয়া নেই, রেস্ট নেই। একটা সময় পর আর মা নয়, ছেলে মানুষের স্ত্রীর যত্ন প্রয়োজন হয়। আর আমার ছেলের ভাগ্য এমন, যে কেউ তার যত্ন করবে সেটাই কপালে নেই।”

“আমি কী করতে পারি। তিনি তো সারাদিন বাসায়ই থাকেন না। থাকলে তো যত্ন করবো। রাতে এসে পোশাক পাল্টে শুয়ে পড়েন। কোনদিন খান, কোনদিন খান না।”

“পুরুষ কখন ঘরে আসে? যখন ঘরে আসার টান থাকে। তোমার হ্যাসবেন্ড যদি তোমার আকর্ষণে ঘরেই না আসে তবে সেই স্ত্রীর সৌন্দর্য, কমবয়স কোন কিছুরই কি কোন মূল্য আছে?”

চৈতালীর মনে পড়ে শ্বশুর হাসান আলী খানের কথা। সারাদিন জোবাইদা বেগমের সাথে হাসান আলী খান দশ মিনিটও কথা বলেন কিনা সন্দেহ। সারাদিন নিজের মতো বাগানে কাটান। বই পড়েন। কখনো বাইরে গেলে একাই গাড়ি নিয়ে বাইরে যান। জোবাইদা বেগমও কি তাহলে স্ত্রী হিসেবে ব্যর্থ নন?

“কী ভাবছো?”

“না কিছু না।”

“জানি কী ভাবছো। ভাবছো আমার আর মাহিমের বাবার কথা? তবে হ্যাঁ, সত্যি তো। কী মূল্য আছে আমাদের সম্পর্কের? মাহিমের জন্ম আমাদের ভালোবাসার চেয়ে এই পরিবারের প্রয়োজন বেশি ছিল। বংশধর হিসেবে মাহিমের আগমন হয়েছে। তারপর ঘরের লক্ষী হিসেবে মিন্নী এসেছে। আমার জীবনে মাহিমের বাবার ভূমিকা এখানেই শেষ। আমার জীবনে এসব প্রয়োজনও ছিল না। এই সংসারের কর্ত্রী হওয়া, মাহিমকে নিজের মতো গড়ে নেওয়াই আমার জীবন ছিল, এবং আছে। এখানে আমি অন্য কারও হস্তক্ষেপ চাই না। কিন্তু তোমার জীবন এরকম না। তুমি এখানে কর্ত্রী হয়ে আসোনি। না কারও বদলি হয়ে এসেছো। তুমি এসেছ মাহিমের জীবনে বাড়তি অংশ হয়ে। বাড়তি অংশ হতে মাহিমের জীবনের অংশ হতে চাইলে নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করো। মাহিমের জীবনে চন্দ্রিমাকে আর চাই না বলেই তোমাকে সে সুযোগ দিতে চাই। আমি চাই না আমার ছেলে একটা অসুস্থ মেয়ের পেছনে এভাবে নিজের জীবন ক্ষয় করুক। তোমার কাছে মাহিমের অস্থির মন শান্তি আর আশ্রয় পাবে ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি যদি তা না পারো, তাহলে এই পরিবারে তোমার প্রয়োজনটা কী?”

*****
আজও মাহিমের আসতে বেশ লেট হচ্ছে। চৈতলীর ঘুম এসে পড়েছে। এমনিতেও যে সে ইচ্ছে করে মাহিমের অপেক্ষায় ছিল তা নয়। তবু অবচেতন মনে অপেক্ষা করার একটা প্রবণতা তৈরি হয়েই যায়। রাত প্রায় একটা। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। গাড়ির সামান্য শব্দে চৈতলীর তন্দ্রা কেটে যায়। হালকা হালকা ঠান্ডা পড়ছে। চৈতালী পাতলা শাল জড়িয়ে নিচে নেমে এসেছে।

“তুমি জেগে আছ এখনো? পরীক্ষা নেই?”

“নাহ। লিখিত শেষ। প্রাকটিকাল হবে পরে। খাবার দিতে বলবো?”

“নাহ। মাথা ব্যথা করছে। কফি দিতে পারবে?”

“খেয়েছেন কিছু? এসময় কফি খেলে ঘুম নষ্ট হবে।”

“হাসপাতাল থেকে আসলাম তো। মাথা ধরেছে। কফি দাও পারলে। আমি উপরে গেলাম।”

“আপা কেমন আছে?”

“অনেকটা ভালো। কাল না হয় পরশু রিলিজ দিবে। আমি ওকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাব ভাবছি।”

চৈতালী কী বলবে জানে না। চুপচাপ কফি বানাতে যায়। এখন এই ব্ল্যাক কফি ও নিজেই বানাতে পারে। পরীক্ষার সময় বানিয়ে খেয়েছে।

রুমে এসে দেখে মাহিম লাইট অফ করে শুয়ে আছে।

“আপনার কফি। টেবিলে রাখবো?”

একটু অপেক্ষা করে চৈতালী হাত দিয়ে আলতো করে ধাক্কা দেয়। অবাক হয়ে লক্ষ করে মাহিমের গা বেশ গরম। এবার ভালো করে কপালে হাত দিতে বুঝতে পারে মাহিমের জ্বর এসেছে। ওর স্পর্শে মাহিমের তন্দ্রা ছুটে যায়।

“কফি এনেছ? ধন্যবাদ।”

“আপনার তো জ্বর এসেছে।”

“হ্যাঁ অনুভব করছি। মুখটা তাই তখন থেকে তিতে লাগছিল।”

“আম্মিকে ডাকি?”

“আরেহ না। এতরাতে আম্মুকে ডাকার প্রয়োজন নেই। আমি ঔষধ খাব। ঠিক হয়ে যাবে। ঐ ড্রয়ারের ভেতর ঔষধের বক্স আছে। পরিশ্রম বেশি হচ্ছে তো তাই একটু গা গরম হয়েছে। সিজোনাল ফ্লুও হতে পারে। প্যানিকের কিছু নেই।”

চৈতালী বক্স এনে দেয় বের হয়ে যায়। মাহিম ঔষধ খেয়ে কফির কাপ হাতে নিলে দেখে চৈতালী বাটিতে করে পানি নিয়ে এসেছে।

“কী করবে?”

“চুপচাপ শুয়ে থাকেন। একটু জল পট্টি দেব।”

“লাগবে না। ঔষধ খেয়েছি। ফ্লু হয়েছে আর কিছু না।”

চৈতালী কোন জবাব না দিয়ে জোর করে মাথায় জলপট্টি দিতে থাকে। চৈতালীর যত্নে আর ঔষধের প্রভাবে অল্প সময়েই চোখে ঘুম নেমে আসে মাহিমের।

হঠাৎ শেষ রাতে ঘুম ভেঙে কোথায় আছে মনে করতে পারে না মাহিম। একটু পর বুঝতে পারে রুমেই আছে। পাশেই জলপট্টি দিতে দিতে চৈতালীও কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। চৈতালীর সত্যিকারের মায়া আর যত্নে মাহিমের মনটা আদ্র হয়ে যায়। জ্বর ছেড়ে যাওয়ায় মাহিমের শরীরটাও ফ্রেশ লাগছে। আলগোছে উঠে চৈতালীকে সাবধানে বিছানায় শুইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। চৈতালী শরীরে স্পর্শ পেয়ে ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে ওঠে।

“কী হয়েছে? কিছু লাগবে? জ্বর এসেছে আবার।”

“না না। তুমি এমন অদ্ভুত ভাবে শুয়ে ছিলে। ভাবলাম বিছানায় উঠিয়ে দেই। ঘাড় ব্যথা করবে না হলে।”

রুমটায় আবছা নীল আলো। চৈতালীর মুখটা আঁধারে ভীষণ মায়াবী লাগছে। চৈতালী উঠে এসে মাহিমের মুখোমুখি হয়।

“চৈতালী, ভালোবাসা ছাড়া কী দু’জন মানুষ কাছাকাছি আসতে পারে?”

“কোন ধরনের কাছাকাছি?”

মাহিম চৈতালীর মুখটা তুলে ধরে বলে

“এতটা কাছাকাছি। ভালোবাসি না বলেও কী তোমার এতটা কাছাকাছি আসা যায়? না তা অনুচিত?”

“ছল করে কাছে আসা অন্যায়। আপনি যদি আমাকে ভালো না বেসেও মিথ্যা ভালেবাসার দোহাই দিয়ে কাছে আসতে চান তা অনুচিত, তা অন্যায়। আর যদি স্পষ্ট বলেন শরীরের টানে কাছে আসতে চান, তা অন্যায় না আমার কাছে। আপনি সেই দাবি রাখার অধিকার রাখেন। আমার মতামত আছে কিনা জানতে চাইতেই পারেন।”

“আছে?”

চৈতালীর চোখের পানি গড়িয়ে পড়ে

“তাহলে কথা দিন আমাকে ভালো না বাসেন, কখনো অসম্মান করবেন না। আমাকে কারও জায়গা দিতে হবে না। কিন্তু আমি আপনার জীবনে আগাছাও হয়ে রবো না।”

মাহিম চৈতালীর মুখ থেকে হাত নামিয়ে নেয়।

“আমাকে ক্ষমা করো। যতগুলো ওয়াদা করেছি তার চাপেই আমি পিষ্ট। আমি জানি না সেসব আমি পূরণ করতে পারবো কিনা। আর কোন ওয়াদার চাপ নিয়ে নিজেকে আর পিষ্ট করতে পারবো না। আমারও ভীষণ ক্লান্ত লাগে।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here