ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ৬
চৈতালী কাঠ হয়ে হয়ে বসে থাকে। চন্দ্রিমা, মাহিম এবং চৈতালী দু’জনকেই হলুদ মাখায়। নিজের মুখেও একটু হলুদ লাগিয়ে নেয়। লাল হলুদ শাড়ি চৈতালীও পড়েছে, চন্দ্রিমাও পরেছে। এবং দু’জনই একই শাড়ি পরেছে। এটা সেই শাড়ি যা আজ মাহিম কিনে এনেছিল। কেনাকাটা কী করা হয়েছিল চৈতালী জানে না। বারোটা ব্যাগের ছয়টি চৈতালীর জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চৈতালী বুঝতে পেরেছে মাহিম যা কিনেছে তা চৈতালী আর চন্দ্রিমা দু’জনের জন্যই কিনেছে। বিষয়টা চৈতালীর জন্য একই সাথে ভালো লাগার, আবার বিষণ্ণতারও। আর কিছুক্ষণ পর যে মানুষটা তার নিজের হতে চলেছে, সে পুরোপুরি নিজের নয়। তাকে ভাগ করতে হবে। একান্ত নিজের করে কখনোই কিছু পায়নি চৈতালী। জীবনসঙ্গী কে হবে, কেমন হবে তা নিয়ে আগে কখনও না ভাবলেও সেই মানুষটা একান্ত তার নিজেরই হবে এই আশাটুকু অন্ততঃ ছিল। কিন্তু এখানেও ভাগ্য সহায় নয়। তার আর মাহিমের মাঝেই থাকবে চন্দ্রিমা। আর এটাই তার নিয়তি। আবার ভালা লাগা এই যে মাহিম তার আর চন্দ্রিমার মাঝে পার্থক্য করেনি। দু’জনকে একই জিনিস দিয়েছে।
না চাইলেও চৈতালীর চোখ চলে যায় চন্দ্রিমার দিকে। ফর্সা মুখখানি স্বাভাবিক লাগলেও চোখদুটো কেমন অন্য রকম। কান্নাকাটি করলে লাল হওয়ার কথা বা ফোলা ফোলা থাকার কথা। কিন্তু চন্দ্রিমার চোখ জোড়া কেমন হলদে। লাল নেইলপালিশ দেওয়া নখের হাতগুলোর ত্বকও কেমন হলুদাভ। চৈতালী মনে করে অসুস্থ হওয়ার আগেও চন্দ্রিমাকে দেখেছে। ফরসা ত্বকে একটা গোলাপি আভা ছিল চন্দ্রিমার। এখন কেমন জানি মলিন হলদে। খুব বেশি স্বাস্থ্য চন্দ্রিমার কখনোই ছিল না, তবে এখন অনেক বেশি শুকিয়ে গিয়েছে। ব্লাউজের খোলা অংশ দিয়ে কণ্ঠা হাড় দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। কী অসুখ হয়েছে চন্দ্রিমার যে স্বামীকে এভাবে অন্য মেয়ের হাতে তুলে দিতেও পিছুপা হচ্ছে না। বরং একটু বেশিই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে। সেই স্বাভাবিক থাকার চেষ্টাই মাহিম আর চৈতালীকে বড় বেশি অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে।
“চন্দ্রিমা, আর কতক্ষণ বসে থাকবে? বাকিরাও হলুদ দেবে। নেমে আসো।”
জোবাইদা বেগমের কণ্ঠস্বরে ধ্যান ভাঙে চৈতালীর।
“নামছি মা। দুটো ছবি তুলে নেই ভালো করে।”
চন্দ্রিমা হাসিহাসি মুখে ক্যামেরার দিকে তাকায় আবার।
****
পার্লার থেকে দুটো মেয়ে এসেছে। চৈতালীর জন্য দামি ব্রান্ডের কসমেটিকস কেনা হয়েছে। মেয়েগুলো সেসব ব্যবহার করেই সাজাচ্ছে। পাশে বসে আছে শিউলি।
“একটু সাদা করে দিও বুঝছো মাইয়ারা। আমার মেয়ের গায়ের রঙ চাপা তো, একটু সাদা পাউডার বেশি কইরা দিও। হাতে আর গলায়ও দিও। না হইলে হাত আর গলা কালা লাগবো।”
পার্লাদের মেয়েগুলো শিউলির কথায় বিরক্ত হলেও কিছু বলে না। একমনে কাজ করে যায়।
“রঙ তো সাদা লাগে না। কী কাজ শিখছো তোমরা? বিয়ার দিন বৌয়ের লাগবো সবার চাইতে সুন্দর, সাদা। সেই তো শ্যামলাই লাগে।”
“তাকিয়ে দেখেন কত সুন্দর লাগছে আপনার মেয়েকে। কী সুন্দর টানাটানা চোখ। ঘন পাপড়ি। আলাদা করে নকল পাপড়ি লাগানোরও প্রয়োজন নেই।”
“তারপরও আরেকটু সাদা কইরা দাও।”
“আম্মা, বাদ দেন তো। আমার চামড়ার রঙ কয়েকঘন্টার জন্য বদলে দিলে কী লাভ হবে? মুখ ধুইলে সব শেষ।”
শিউলি মুখ বাঁকায়। এই মেয়েটা বেশি বোঝে। হলুদের সময় দেখেছে শিউলি। অসুস্থ চন্দ্রিমার পাশেও কী নিষ্প্রভ লাগছিল চৈতালীকে। এমন হলে মাহিমের নজর তারদিকে আনবে কী করে চৈতালী?
“ওর কথা শুইনেন না। আরেকটু সাদা করো।”
“আর সাদা হবে না।”
“ক্যান?”
“যে ফাউন্ডেশন আনা হয়েছে ওনার জন্য, তা ওনার গায়ের রঙ অনুযায়ী এনেছে। তাই এর বেশি সাদা হবে না।”
“তোমগো কাছে নাই?”
“নাহ।”
মুখ কালো করে ফেলেন শিউলি। মেয়েরা পাত্তা দেয় না। মেয়ে দুটো শহরের নামকরা বিউটি পার্লার থেকে এসেছে। এত বড় বাড়ির বৌ সাজাবে সাথে পেমেন্টও বেশি পাবে। তাই বাড়িতেই সাজাতে এসেছে। নিজেদের কিছু আনতে ওদের নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল। হবু বৌকে সাজানোর জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই কেনা হয়েছে। তারা সেসব দিয়েই সাজাচ্ছে। শিউলি তো দূর চৈতালী নিজেও এত কিছু চেনে না। সাজের জিনিস বলতে ক্রিম, পাউডার, লিপস্টিক আর কাজল। এই পর্যন্ত দৌড় চৈতালীর। মাঝেমধ্যে এই বাড়িতে এলে জোবাইদা আর চন্দ্রিমার রুমে কোন কাজে গেলে অবাক চোখে ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে থাকতো। বিশাল বড় ড্রেসিং টেবিলের দু’পাশে কাছের দেয়ালের ওপাশে থরে থরে সাজানো কত রকম প্রসাধনী। দেখতেও ভীষণ সুন্দর। চৈতালীর সবচেয়ে ভালো লাগতো পারফিউমের বোতল গুলো দেখতে। রঙ বেরঙের বোতলগুলো থেকে একটু গায়ে ছিটিয়ে দিতে ইচ্ছে করতো। চন্দ্রিমার গায়ে মিষ্টি একটা গন্ধ পাওয়া যায় সবসময়। কোন পারফিউম থেকে এমন গন্ধ আসে জানতে ইচ্ছে করতো। কখনও টাকা হলে কিনবে ভাবতো। আজ তার সামনেই তিনটি পারফিউমের বোতল আছে। মেয়েগুলোর সাজানোর ফাঁকে একটা বোতল হাতে তুলে নেয় চৈতালী। নাকের কাছে নিয়ে সুবাস টেনে দেখে। না এটা কড়া গন্ধ। বাকি দুটো বোতলও দেখে। একটায় কাছাকাছি গন্ধ পায়। সেটাই গায়ে মেখে নেয়।
ওড়না সেট করা শেষে আয়নায় নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে দেখে চৈতালী। নিজেকে দেখে নিজেই মুগ্ধ হয়ে যায়। আজকের আগে কখনোই নিজেকে এতটা সুন্দর লাগেনি। তার শ্যামলা গায়ের রঙটাই বরং এই লাল জামদানী শাড়িতে অনেক বেশি সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে। একদমই চিরায়ত বাঙলার মায়াবী বিয়ের কন্যা মনে হচ্ছে। চৈতালীর লম্বা চুলে আলাদা করে টার্সেল লাগিয়ে খোঁপা বড় করতে হয়নি। এমনিতেই সুন্দর খোঁপা হয়েছে। খোঁপা জুড়ে বেলী ফুলের মালা দেওয়া হয়েছে। মাথায় টিকলি, গলা আর কানে সোনার ছিমছাম দুল, নাকে হীরের নাকফুল। হাত ভর্তি সোনার চিকন চুড়ি। শিউলি নিজেও সাজ শেষে মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যান।
পার্লারের মেয়েগুলো বেরিয়ে গেলে বলেন,
“আমার উপর রাগ হইছস জানি। কিন্তু একসময় বুঝবি, যা করছি ভালাই করছি। তোর বাপে তোরে এর চাইতে ভালা বিয়া দিতে পারতো না। দেখ কেমন রাজরানীর মতো লাগতেছে তোরে।”
“আমি তো বিয়ে করতে চাই নাই আম্মা।”
“হইছে হইছে। পড়ালেখা কইরা দুনিয়া উদ্ধার করতি। গেছিলি না স্যারের কাছে। জায়গা দিছে এমনে? সব জানি আমি। শফিক স্বীকার গেছে আমার কাছে। শোন কোথাও এমনে তোরে জায়গা দিব না। আর আমরাও আর এমনে বসাইয়া বসাইয়া তোরে লেখাপড়া করাইতে পারতাম না। বাপ মায়ের কথাও একটু ভাব।”
“ভাবছি বলেই তো বিয়া বসতেছি আম্মা। আর আমি তো নিজের পড়ালেখার খরচ নিজেই চালাতাম।”
“তুই একটা স্বার্থপর মাইয়া। কী সোন্দর খোঁটা দিলি। বাপ মায়ের ভালা হোক চাস না।”
“আমি খোঁটা দিলাম আম্মা? আর নিজের মেয়ের বদলে জায়গা জমি নেওয়া খুব ভালো, সেইটা অধিকার। স্বার্থপরতা না? মাহিম সাহেব বিয়া ভাঙ্গাই দিতেন। তোমাদের কথা চিন্তা করে বিয়া ভাঙা আটকেছি।”
“হ খুব উপকার করছিস। কোথাও যাওনের জায়গা পাস নাই তাই ফিরা আসছস। আমাদের কথা ভাইবা না। এখন এত সুন্দর শাড়ি, গয়না কে পরছে। আমি না তুই?”
শিউলি রাগ করে বের হয়ে যায়। চৈতালীও মন শক্ত করে নিয়েছে। কাঁদবে না সে। মাহিমকে কথা দিয়েছে, বিয়ে নিয়ে কোন সিনক্রিয়েট করবে না।
****
বিয়ে পড়ানোর জন্য চৈতালীকে বসার ঘরে নিয়ে আসা হয়। চন্দ্রিমা এখানে এখন উপস্থিত নেই। মাহিম মাথানিচু করে বসে আছে। একবার চোখ তুলে চৈতলাীকে কেমন লাগছে তা দেখার আগ্রহও প্রকাশ করে না। কাজী সাহেব বিয়ে পড়িয়ে দেন। বড় সাদামাটা ভাবে কাবিন হয় চৈতালীর। সবকিছু কেমন রঙহীন ধূসর মলিন লাগে চৈতালীর। মাহিমের মুখে কবুল শব্দের উচ্চারণ একমুহূর্তের জন্য মনে একটা স্পন্দন এনে আবার হারিয়ে যায়। কাগজে কলমে মানুষটা তার হলেও, সত্যিই কী তাকে পেল চৈতালী?
পনেরো লাখা টাকা কাবিনে বিয়ে হয়ে যায় চৈতালীর, দশ লাখ টাকা শাড়ি গয়নায় উসুল, পাঁচ লাখ নগদ চৈতলীর হাতে একটা ব্যাগে করে তুলে দেয় মাহিম। ব্যাগটা চৈতালীর হাতে দিয়ে চৈতালীর মুখের দিকে তাকায় মাহিম। একমুহূর্তের জন্য হৃদযন্ত্র যেন থমকে যায়। সামনে বসে আছে এ কেন চৈতালী! যেন সাক্ষাৎ অপ্সরা।
(চলবে)