#মায়াবিনী_(২)
#Ayrah_Rahman
#পর্ব_১০
______________________________
” ফুপিমা ”
আরুহীর কাপাঁ কন্ঠ, রাইসা চমকে উঠলো দৃষ্টি রৌদসীকে পেরিয়ে ছুটে গেলো তারই পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা হলুদ রঙের শাড়ি পরা মেয়েটার উপর। ফর্সা মসৃন গায়ের রং আর বড়ো বড়ো পাপড়ি বিশিষ্ট টানা চোখ ই যেন জানান দিচ্ছে এটা তার সেই ছোট্ট আদরের আরু।
রাইসা পুনরায় রৌদসীর দিকে তাকালো চোখ দুটো তার ছলছল করছে, ইশারায় জানতে চাইলো এটা কি সত্যি ই আরু? রৌদসী মায়ের ইশারা মর্মার্থ বুঝতে সক্ষম। সেও মাথা ঝাকিয়ে উত্তর দিলো যে সে যা দেখছে তাই সত্যি।
রাইসা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করতে লাগলো, চোখের পানি লুকানোর জন্য তৎক্ষনাৎ বিপরীত দিকে ঘুরে দাড়ালো, আরুহী এগিয়ে গেলো তার প্রিয় মানুষ টার দিকে, ছোট থেকে কি কাজ নেই যা দুজন মিলে করে নি, কত হাসি তামাশা, কত আড্ডার স্মৃতি জমা আছে হৃদয়ের মনিকোঠায়।
আরুহী হুট করে গিয়ে রাইসার পিছনে থেকে জরিয়ে ধরলো,
” আমার সাথে কথা বলবে না ফুপিমা? ”
রাইসা কান্না আটকানোর চেষ্টায় খানিকটা কেঁপে উঠলো, খানিকটা থেমে থেমে বলল,
” ছাড় আমাকে! আমি তোর কেউ না আর না তুই আমার কেউ হস ”
আরুহী আরো শক্ত করে জাপ্টে ধরে আদুরে কন্ঠে বলল,
” সরি তো ফুপিমা, ইউ নোও না ফুপিমা, Aro loves you very much ”
রাইসা বাচ্চাদের মতো নাক টানতে টানতে বলল,
” লাভ না ছাই, তুই তো একটুকুও ভালো বাসিস না আমাকে, ভালোবাসলে কি এত বছর এই ফুপি থেকে দুরে থাকতি নাকি, মানলাম ওইদিন একটু বেশি ই হয়ে গিয়েছিল তাই বলে সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হবে না কি? এত জেদ কেন তোর? ”
” ওফফ ফুপিমা তুমি কি আজ আমাকে জাপটে ধরে রাখবে না কি? তোমার মেয়ের না আজ বিয়ে যাও ওকে ধরে কিছু কান্না কাটি করো যাও ”
আরুহীর কথা শুনে রাইসা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলল,
” আরে হে আমি তো এসেছিলাম রোদ কে ডেকে নিয়ে যেতে সবাই ওর জন্য অপেক্ষা করছে, তোর জন্য ই তো ভুলে গেলাম, যা হোক আমি গেলাম ওর শেষ হলে নিচে নিয়ে আস তো ”
রাইসা রৌদসীর কাছে এসে গালে হাত রেখে আলতো ছুয়ে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“মাশা আল্লাহ অনেক মিষ্টি লাগছে আমার ডাক্তারনীকে, বেঁচে থাক মা সুখে থাক ”
পিছনে থেকে আরুহী বলে উঠলো,
” রোদ আপু এক কাজ করো এক গ্লাস পানিতে তোমার আঙুল নাড়িয়ে ফুপিমা কে খেতে দাও ”
রৌদসী ভ্রু কুচকে আরুহীর দিকে তাকিয়ে বলল,
” কেন? ”
” আরে ফুপিমা ই তো বলল তোমাকে না কি মিষ্টি লাগছে এখন সত্যি সত্যি ই মিষ্টি লাগছে কি না একটু চেখেঁ দেখুক ”
বলেই সে মুখ টিপে হাসলো, আরুহীর কথা শুনে রৌদসী ও মুচকি হাসলো, রাইসা ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল,
” বেশি পাকাঁ হয়ে গেছিস না? বাঁদরামি করিস আমার সাথে? তাড়াতাড়ি নিয়ে আয় ওকে ”
আরুহী ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল,
” হে হে যত দোষ নন্দ ঘোষ আর কি! যাও যাও নিয়ে আসছি তোমার ডাক্তারনী মাইয়া রে ”
রাইসা মুচকি হেসে আরুহীর মাথায় একটা থাপ্পড় দিয়ে চলে গেলো,
আরুহী কোমড়ে হাত দিয়ে রৌদসীর দিকে তাকিয়ে বলল,
” শেষ আপনার সাজুগুজু? এবার যেতে পারি আমরা? ”
রৌদসী মুচকি হেসে আরুহীর কাছে এসে তার মুখ টা আজলে তুলে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল,
” আমি জানি আরু তুই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য এমন বিহেভ করছিস, আমি এও জানি তুই কিছু কিছু বিষয় নিয়ে বেশ দোটানায় আছিস, আমি কিছু জিজ্ঞেস করব না তোকে বাট একটা কথা ই বলব, কিছু কিছু সময় বিবেক থেকে আবেগ কেই বেশি গুরুত্ব দিতে হয়, কিছু জিনিসের ডিসিশন বিবেক নিতে অক্ষম যা আবেগ খুব সহজেই নিতে পারে।নিজের মনের কথা শোন, খুঁজে দেখ তোর মন কি চায়? ”
আরুহী কিছু বলল না, রৌদসী ও আর কথা বাড়ালো না।
” চল নিচে যাই ”
হঠাৎ আরুহীর ফোনে কল আসায় সে রৌদসীকে এগুতে বলে ফোন টা পিক করে,
রৌদসী এক পলক আরুহীর দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে রুম থেকে বের হলো,
” হ্যা সুলতান বলো! ”
অপর পাশ থেকে কিছু বলতেই আরুহী বাঁকা হেসে বলল,
” তুমি একটু খাতির যত্ন করো শত হোক আরুহী চৌধুরীর মেহমান বলে কথা, যত্নের যেন কমতি না থাকে, আমি পরে আসছি ”
বলেই আরুহী ফোন টা রেখে এক পলক নিজেকে আয়নায় পরখ করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে,
আরুহী রুম থেকে বের হয়ে একপলক আরুশের রুমের দিকে তাকালো, সেটা বন্ধ সামনে তাকাতেই দেখলো মিরাজের রুমের দরজা টা খোলা,
আরুহী ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো মিরাজের রুমের দিকে।
ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলো কেউ আছে নাকি! কাউকে না দেখতে পেয়ে ভেতরে ঢুকলো সে, ছোট বেলা থেকে ই মিরাজের রুম টা তার ভীষণ পছন্দের।
বিছানার উপর বসে কিছু একটা ভাবছে হঠাৎ কোথা থেকে যেনো একটা তোয়ালে উড়ে এসে পড়লো ঠিক আরুর মাথায়,
তোয়ালে সরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো মিরাজ শেরওয়ানি পরে গায়ে পারফিউম লাগাচ্ছে। হয়তো সে আরু কে খেয়াল করে নি!
” মির ভাইয়া ”
” ওওফ রোদ তোর না গায়ে হ.. ”
মিরাজ থমকে গেলো, এটা তো রোদের কন্ঠ না! তৎক্ষনাৎ পিছনে ঘুরে তাকালো সে,
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে চিনতে তার মোটে ও ভুল হয় নি,
মিরাজ ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আরুহীর গাল জরিয়ে ধরে বলল,
” বোনু তুই? আমি কি সত্যি দেখছি নাকি স্বপ্ন? ”
” তুমি সত্যি ই দেখছো ভাইয়া ”
আরুহী জোরে একটা চিমটি কাটলো মিরাজের হাতে, মিরাজ আহ্ শব্দ করে সেখানে ডলতে ডলতে বলল,
” তুই কখন এলি আরু? জানিস তুই তোর এই ভাইটা তোকে কতটা মিস করছে? ”
” হুম জানি তো, তুমি আমাকে অনেক অনেক মিস করছো তাই তো আসলাম তোমাকে দেখতে ”
” তুই কি আবার চলে যাবি আরু? ”
আরুহী মুচকি হেসে বলল,
” সে কথা পরে হবে এখন তাড়াতাড়ি রেডি হও, অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে ”
বলেই আরুহী রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে খেয়াল হলো সবাই কেমন জেনো অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
আরুহী নিচে নেমে আসতেই তার নজর কারলো মেরুন রঙের শাড়ি পড়া মহিলার দিকে, মাথায় আধা পাকা চুল অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে,
আরুহী এগিয়ে গেলো সেই মহিলার দিকে,
” মামিমা! ”
মিরা চুপ করে আরুহীকেই পর্যবপক্ষন করছে,
আরুহী আদুরে কন্ঠে বলে উঠলো,
” মামিমা! আমাকে চিনতে পারছো না? আমি আরুহী ”
মিরা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে বলল,
” আআআরুহী? আরু তুই এত দিন পর? আই কান্ট বিলিভ দিস! ”
আরুহী মুচকি হেসে মিরা কে জরিয়ে ধরে বলল,
” হুম আমি সত্যি ই এসেছি মামিমা ”
মিরা আরুহীর কপালে চুমু খেয়ে বলল,
” আমার মেয়েটা কত বড় হয়ে গেছে, মাশা আল্লাহ ”
আরুহী একে একে সবার সাথে ই কথা হলো, সবাই খুব বেশি অবাক হয়েছে আরুহী কে দেখে।
আরুহীর অস্থির মন এদিক সেদিক তাকাচ্ছে এক পলক সেই মানুষ টাকে দেখার তৃষ্ণায়।
হঠাৎ তার চোখ যায় খান মেনশনের মেইন গেইটে
ব্ল্যাক শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে এদিকেই এগিয়ে আসছে আরুশ খান।
কাছাকাছি আসতেই আরুহীর চোখ পড়ে আরুশের চোখে, দৃষ্টি শান্ত তার।
আরুশ থেমে গেলো আরুহী ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো তার দিকে, আরুশ ভাবলো হয়তো আরু তার সাথে ই কথা বলতে আসছে কিন্তু তার ধারণা পুরোপুরি ভাবে মিথ্যা প্রমান করে আরুহী তাকে পাশ কাটিয়ে পিছনে চলে গেলো ,
অনুষ্ঠান প্রায় শেষ দিকে আরুহী সবার সাথে ই কথা বলেছে টুকটাক কিন্ত তার মায়ের সাথে না, মায়ের উপর তার বড্ড অভিমান।
আরুহী আনমনেই হাটছিলো পুলের পাশ দিয়ে হঠাৎ একটা ইট বা পাথর জাতীয় কিছু তে পা আটকে পুলের উপর পড়ে যেতে নিলে কেউ তার হাত ধরে আটকায়,
আরুহী পিছনে তাকিয়ে দেখলো তার হাত ধরে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে আয়াত। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা থাকায় চোখ দুটির ভাষা ঠিক ঠাওর করতে পারছে না আরু।
আয়াত টান দিয়ে আরুকে সোজা করে দাড় করালো,
আরুহী কিছু বলতে নিবে তার আগেই আয়াত তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বলল,
” সাবধানে দেখে শুনে চলাফেরা করবেন তো মিস আরুহী চৌধুরী! ”
বলেই গটগট পায়ে চলে গেলো, আরুহী নাক ফুলিয়ে মায়ের এর যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, কই সে রাগ করে কথা বলবে! তা না উল্টো তার উপর ই রাগ করে কথা বলছে, আরু তো ভুলেই গিয়েছিলো তার মা তো মাহাবীন খান আয়াত, যে সবার থেকে ডিফারেন্ট চরিত্র বহন করে।
” আরু ”
আরুহী নিজের মায়ের কথা চিন্তা করছে আর হাটছে! হঠাৎ পিছন থেকে পরিচিত কন্ঠ শুনে পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো আরুহী।
আরুশ দাড়িয়ে,
আরুহী পিছনে ঘুরে আরুশের দিকে খানিকটা এগিয়ে গেলো,
” কিছু বলবেন ডক্টর আরুশ খান? ”
” আরু আমি! আমি সত্যি সরি ”
” ফাস্ট অফ অল আমি আরুহী চৌধুরী নট আরু, সেকেন্ড সরি বলছেন কেন? ”
” আমার সকল কাজের জন্য আমি দুঃখীত আরুহী, আমি সত্যি ই সরি! ”
আরুহী ভ্রু কুঁচকে তাকালো আরুশের দিকে,
” দেখুন ডক্টর! আমি একজন সাইকো সাথে ভীষণ ছোট আমার মন মানসিকতা! উহুম এটা আমার কথা নয়, এক সময় আমার ভীষণ প্রিয় একজন মানুষের কথা যা এখন শুধু মাত্র ই স্মৃতি আমার কাছে, আজ আমি আপনার কাছে একজন সাধারণ মানুষ আর আপনি আমার কাছে একজন সাধারণ ডক্টর, আর কিছু ই না, আশা করি আমার কথার মর্মার্থ বুঝতে আপনি সক্ষম ”
বলেই আরুহী পিছনে ঘুরে গটগট পায়ে চলে গেলো, আরুশ ঠিক একই জায়গায় থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো, কিছু বলল ও না আর না আরু কে আটকালো! কোন অধিকারে আটকাবে সে আরু কে? আজ তার হাতে তো কোন অধিকার ই অবশিষ্ট নেই যা ছিলো তা আরু চলে যাবার সময় সব ছিন্ন করে চলে গিয়েছিল।
আরু হেঁটে স্টেজের দিকে যেতেই শুনতে পেলো কেউ একজন এনাউন্সমেন্ট করছে, তার মা কে গান গাইতে, এখন আর আয়াত গান করে না, মনোযোগ দিয়ে ব্যবসা টায় সামলায়, তাই বহু দিন পর মায়ের গলার গানের লোভ টা সে সামলাতে পারে নি,
দ্রত পায়ে স্টেজের এক কোনায় গিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো,
আয়াত স্টেজে মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,
সোনার পালঙ্কের ঘরে
লিখে রেখে ছিলেম তারে
যাও পাখি বল তারে
সে যেন ভোলে না মোরে
সুখে থেকো ভালো থেকো
মনে রেখো এ আমারে
বুকের ভেতর নোনা ব্যাথা
চোখে আমার ঝরে কথা
এপার ওপার তোলপাড় একা
বুকের ভেতর নোনা ব্যাথা
চোখে আমার ঝরে কথা
এপার ওপার তোলপাড় একা
যাও পাখি বল তারে
সে যেন ভোলে না মোরে
সুখে থেকো ভালো থেকো
মনে রেখো এ আমারে….
[ বাকিটা নিজ দায়িত্বে শুনে নেবেন ]
গান শেষ হতেই চারপাশ মুখরিত হলো করতালির শব্দে। এতো পুরানো একটা গান এতদিন পর এতো সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করায় বেশ ভালো লাগলো সবার।
অনুষ্ঠান প্রায় শেষ দিকে আরুহী ঠিক একই জায়গায় বসে ফোন ঘাটছে হঠাৎ তার সামনে কেউ খাবার ধরায় সে চমকে উঠলো।
ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে দিকে…
চলবে..
[ কেমন হয়েছে জানাবেন আর গঠন গত মন্তব্য আশা করছি ]