ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয় পর্ব ১০ শিউলি আর

0
400

ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ১০

শিউলি আর রহিম তরফদার এর আগে কখনোই এই বাড়ির ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করেনি। ছেলেমেয়েদেরও বসতে দেয়নি। কেউ মানা করেছে তা নয়। এমনিতেই সাহস করেনি। জোবাইদা বেগম সরাসরি কিছু না বললেও আচরণেই সম্পর্কে পার্থক্য মনে করিয়ে দেন। তাই জোবাইদা বেগম নিজ থেকে না বললে কোন কিছু করার, খাওয়ার সাহস এই বাড়ির আত্মীয় স্বজনেরও হয় না। জোহরা বেগম নিভৃতচারী মানুষ। ঘর গৃহস্থালির বিষয় তার বড় বৌ জোবাইদার ইচ্ছে মতোই পরিচালিত হয়। তিনি কোন মতামত দেন না।

এই বাড়ির রান্নাঘরটা অনেক বড়। সেখানেও চুলা থেকে দূরে একপাশে কাঠের চেয়ার-টেবিল পাতা আছে। একটু দূরসম্পর্কের আত্মীয় স্বজনেরা এলে, বা ব্যবসার সাথে জড়িত কর্মীরা এলে তাদের সেখানেই নাস্তা পানি দেওয়া হয়। ফ্যানও লাগানো আছে। সরাসরি রান্নার ধোঁয়া আসে না। কাজের লোকেরা অবশ্য মূল রান্নাঘরে বসে খায়। ওরা এখানে বসে না।

আজ শিউলি ঘুম থেকে উঠেই দোতলায় চৈতালীর রুমে যায়। উদ্দেশ্য চৈতালীকে সাজিয়ে নিয়ে নিচে নামবে। মেয়ের সাথে একসাথে তারা ডাইনিং রুমের চেয়ার টেবিলে বসবে। এখন তো সে এই বাড়ির বেয়াইন। অবস্থান বদলে গিয়েছে। গতকাল তারা নিচতলার দুটো আলাদা গেস্ট রুমে থেকেছে। একটায় দুই ছেলে, আরেকটায় তারা স্বামী স্ত্রী। এর আগে যতবার এসেছে একটাই রুমে থাকতো। কখনো দুই ছেলে আর স্বামী নিচে বিছানা করে থাকতো। মেয়েকে নিয়ে তিনি খাটে থাকতেন। কখনো ছেলেদের নিয়ে রহিম তরফদার খাটে থাকতেন, মা মেয়ে নিচে থাকতো। আলাদা রুম চাওয়ার সাহস হয়নি।

কাল নিজেই কাজের মেয়ে হালিমাকে ডেকে বলেছেন আরেকটা রুম খুলে দিতে। এখন তারা এই বাড়ির কাছের আত্মীয়। চন্দ্রিমার মা বাবা এলে তো উপরের তলার এসি রুমে থাকে। সেখানে তারা আলাদা রুম পেতেই পারে। ততক্ষণে উপরে সবাই শুয়ে পড়েছে। হালিমা ইতস্তত করে আরেকটা রুম খুলে দেয়। আরাম করে স্বস্তির ঘুমই হয়েছে শিউলির।

উপরে এসে দেখে জোবাইদা বেগম আর জোহরা বেগম ইতোমধ্যে এই রুমে চলে এসেছে। সাথে করে নতুন কয়েকটা শাড়িও নিয়ে এসেছে।

“চৈতালী, এখান থেকে যা পছন্দ হয় নিয়ে পরবা। ভালো ভাবে পরিপাটি হয়ে থাকবা। এলোমেলো থাকা আমার পছন্দ না। সকালে শুনলাম তুমি আলুথালু বেশে বাগানে গিয়ে ফুল কুড়চ্ছিলে। এসব করবা না।”

শিউলি তড়িঘড়ি উত্তর দেয়,

“আর করবে না আপা। আমি ওরে বুঝাই দেব নে। আমি ওরে তৈয়ার কইরা নিচে নিয়া আসতেছি।”

“গতকালও আমি তোমার ভাবিসাব ছিলাম শিউলি৷ একদিনে আপা হয়ে গেলাম কিভাবে? অন্য কে আমাকে কী ডাকবে তা আমি ঠিক করে দেই। আর তোমাকে আপা ডাকতে মনে হয় না আমি বলেছি। অযথা গায়ে পড়ে খাতির দেখাতে আসবে না। নিচে যাও, ছেলেদের নিয়ে নাস্তা করো। চৈতালী বিয়ের পর খোঁড়া, লুলা হয়নি যে তুমি ধরে ধরে রেডি করবা। আর শোন কোন কিছু চাইলে সরাসরি আমাকে বলবা। খাব বাড়ির কাজের বেটিদের হুকুম শুধু খান বাড়ির মানুষেরা দেয়। বাইরের কারও হুকুমে তারা কাজ করলে তাদের চাকরি থাকে না। আর শোন সব তো বুঝে পেয়েছ। অযথা এখানে কষ্ট করে না থেকে নিজেদের বাড়িতে যাও। তোমাদের বাড়ি তো দেওয়াই হয়েছে। নিজের বাড়িতে গিয়ে এখন আরাম করে থাকো, খাও।”

শিউলির মুখটা পাংশুবর্ণ ধারণ করে। জোবাইদা আকারে বুঝিয়ে দিলেন যে এই বাড়িতে শুধু তার মেয়েটা গ্রহণ করা হয়েছে প্রয়োজনে। কিন্তু এতে তাদের অবস্থানে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মায়া হয় চৈতালীর। দরিদ্র্যতার সাথে দীর্ঘ সখ্যতায় কারও মনটা বড় হয়ে যায় কারও ছোট। কেউ সেখান থেকে পালাতে ভয় পায়, কেউ পালানোর সুযোগ পেলে স্থান-কাল পাত্র ভুলে যায়। শিউলিও তাই। মা বাবাকে খারাপ লাগে না চৈতালীর। মেয়ের বিয়ের বিনিময়ে অর্থ সম্পদ পাওয়ার মাধ্যমে দ্রুত ভাগ্য পরিবর্তনের এই রাস্তা তাদের কাছে যথার্থ মনে হয়েছে। তাও তো তারা কিছু নরপশুর মতো তাকে কোথাও বিক্রি করে দেয়নি। রাস্তায় ফেলে দিয়ে যায়নি। ভেবেছে এত বড় বাড়ির ছেটো বৌ হয়েও যা পাবে তা অনেক অনেক বেশি।

জোবাইদা আর জোহরা বেগম বের হয়ে গেলে চৈতালী মায়ের হাত ধরে খাটে বসায়।

“চাচী আম্মার কথায় মনে কষ্ট পাইছেন আম্মা? মনে কষ্ট পাওয়ার কিছু নাই। আপনি কী ভাবছেন একরাতেই তিনি জোবাইদা বেগম ভাবিসাব থেকে আপনার বেয়াইন জোবাইদা আপা হয়ে যাবেন?”

“খোঁচা দিস না চৈতালী। একরাইতে না হোক, আস্তে ধীরে হইবো। তুই মন জয় করলে আমগো পথও এই বাড়িতে সহজ হইবো। এর জন্য তাড়াতাড়ি একটা বাইচ্চা জন্ম দিতে হইবো।”

“বাচ্চা কেম্নে দেব আম্মা? জামাই এখনও বড় বৌয়ের আঁচলে বাঁধা।”

“একরাইত বাইন্ধা রাখতে পারছে শরীর খারাপের দোহাই দিয়া। রোজ তো পারবো না। তোরে সব শিখায়ে দেওয়ার তো দরকার নাই। ছোটোবেলা থেইক্কা তোর বুঝ জ্ঞান ভালা। এখন আমাগো উপর তার রাগ আছে ঠিক আছে। কিন্তু যা হইছে তা মাইন্না নেওন ই ভালা। চেষ্টা কর এইখানে তোর জায়গা বানাইতে। আমাগোরে বাইরের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা জোবাইদা বেগমের জন্য সহজ। তোরে সহজ না। তোর সাথে তার ছেলের নাম সমাজের আর দশজনের সামনে বাঁধা পড়ছে। মন জয় কর। আগে বুড়ির কর। বুড়ি নাতিরে ভালোবাসে, আর বৌরে ঘৃণা করে। বুড়ির মন জয় করলে নাতির কাছাকাছি যাইতে পারবি। জোবাইদা বেগম এমনিও তোরে ভালোবাসা দিব না। তার সাথে দ্বন্দ্বে যাবি না, আবার তার গোলামও হয়ে থাকবি না। তুই আড ঐ চন্দ্রিমার অধিকার এখন সমান সমান।”

“আমার মনে হয় চাচী আম্মা একমাত্র নিজের ছেলেরে ভালোবাসেন। আর কাউকে না। আমি যদি ওনার ছেলের বেশি কাছে যাই আমারেই শত্রু ভাববো আম্মা।”

“ভাবলে ভাববো। তুই ওনার সামনে ওনার ছেলের দিকে হাত দিবি না। আড়ালে দিবি। সামনাসামনি ওনার সাথে ভেজালে যাবি না।”

“চল নিচে যাই। খিদা লাগছে।”

“শাড়ি পাটাইয়া যা। কত সুন্দর সুন্দর শাড়ি দিছে।”

“এইগুলো পরবো না আমি। গায়ের শাড়িই ঠিকঠাক আছে।”

“ক্যান পরবি না? আস্তে আস্তে ভারী কাপড় পরার অভ্যাস কর। আমারে এই খয়েরি শাড়িটা দিবি?”

“নাহ্। এগুলো অন্য কাজে লাগবে।”

“কী কামে?”

“দেখবা। আমার সাথে নিচে চলো।”

****

চন্দ্রিমা নিচে নামেনি। নাস্তা নিজের ঘরেই করবে। মাহিমও সেখানেই আছে। নাস্তার টেবিলে ফজলে আলী খান, জোহরা বেগম আর জোবাইদা বেগম বসে আছেন। চৈতালী শাড়ি বদল করেনি বলে জোবাইদা বেগমের ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কিছু বললেন না। কাজের মেয়েটা নাস্তা রেডি করছে উপরে চন্দ্রিমার রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

“সখিনা, শুধু চন্দ্রিমার নাস্তা নিয়ে যা। মাহিমকে বলবি যে নিচে এসে আমাদের সাথে নাস্তা করতে।”

“সখিনা, তুমি ট্রে রাখ। আমি নিয়ে যাচ্ছি আপার রুমে। মাহিম সাহেবকেও আমি ডেকে নেব।”

সখিনা জোবাইদা বেগমের দিকে তাকায়। গতকাল রাতে হালিমা জোবাইদা বেগমের অনুমতি ছাড়া গেস্ট রুমের দরজা খুলে দেওয়ায় আজ সকালে তাকে হিসাবপত্র দিয়ে বিদায় করে দিয়েছেন জোবাইদা।

“সখিনা, তোমাকে রাখতে বললাম না। আমি নিয়ে যাচ্ছি। আম্মি তোমাকে কিছু বলবে না। তাই না আম্মি? আমি নেই?”

“নাও। সখিনা রেখে যা।”

“আম্মি, আম্মা আব্বা আজ একটু পর চলে যাবেন। নাস্তাটা আপনাদের সাথে করে যাক।”

“তা যাক। নাস্তা তো দেওয়াই আছে।”

“আম্মা, আব্বা কই? শফিজ, শাহীন কই গেল? আসো নাস্তা করতে বসো।”

জোবাইদা হতভম্ব হয়ে গেল। চকিতে তাকালো ফজলে আলী খানের দিকে। ফজলে আলী খান আর জোহরা বেগমও তাকিয়ে আছেন চৈতালীর দিকে। রহিম তরফদার আর শিউলি আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শফিক আর শাহীন অবশ্য খুশিখুশি মনে বসে গেল।

“আহ্ আম্মা বসেন না কেন? আব্বা বসেন।”

অন্য সময় হলে ফজলে আলী খান হয়তো কড়া ভাষায় কিছু বলতেন। কিন্তু এখন বয়সের সাথে অনেকটাই নরম হয়ে গিয়েছেন। তারপরও উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,

“জোহরা, এখন খিদে নেই আমার। ভাজাপোড়া কিছু খাব না। একটু পর চিঁড়া, দই দিও আমার জন্য।”

চৈতালী দেখেও না দেখার ভান করলো। জোবাইদা বেগম কাঠ হয়ে বসে আছেন। চৈতালী জোহরা বেগমের প্লেটে পরোটা তুলে দেয়।

“দাদী আপনিও খাবেন না? একটু খান। ডিম দেব?”

বড় বৌয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে জোহরা বেগম মনে মনে সন্তুষ্টই হোন। প্রথমদিনেই এতটা সাবলীল আচরণ চন্দ্রিমাও করতে পারেনি।

শফিক আর শাহীনকে নাস্তা করতে দেখে শিউলি আর রহিমও হাত বাড়িয়ে এটা সেটা নেয়। জোবাইদা কিছু না বলে উঠে যান। চৈতালী কিছু জিজ্ঞেস করে না। শিউলিরও কিছু বলতে সাহস হয় না। মেয়েকে সাহস রাখতে বলেছিলেন। কিন্তু মেয়ে মনে হচ্ছে দ্বন্দ্বেই জড়াবে। চিন্তার রেখা পড়ে শিউলির কপালে। রহিম অবশ্য খাওয়ায় মন দিয়েছে। চৈতালী ট্রেতে তিনজনের পরিমাণ খাবার নিয়ে উপরে উঠে যায়।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here