ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ৭
“মাহিম, রাত অনেক হয়েছে। আমার মনে হয় তোমার এখন ঐ রুমে যাওয়া উচিত। মা কয়েকবার এসে ঘুরে গেলেন।”
“কী শুরু করলে তোমরা বলোতো? তুমি, মা, দাদী, দাদাজান প্রত্যেকে তাদের ইচ্ছেমতো আমাকে চালাতে চাইলে তো হবে না। যে মাহিম আলী খান কোনদিন নত হতে শিখেনি, তাকে আজ এভাবে সবকিছু মেনে নিতে, মানিয়ে নিতে হচ্ছে। এরচেয়ে বড় অন্তর্দহন আর কী হতে পারে? আমার নিজেকে আজ একজন মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ মনে হচ্ছে। শুধুমাত্র তোমাকে ভালোবেসেছিলাম বলে আমি এসবে নিজেকে জড়িয়েছি।”
“ভালোবেসেছিলে? তারমানে এখন আর ভালোবাসো না? তাই যদি হবে তবে কেন জড়ালে নিজেকে? অসুস্থ চন্দ্রিমাকে দয়া করতে? হ্যাঁ ঠিকই তো, ভালোবেসেছিলে। তুমি ভালোবেসেছিলে মা ভালোবেসেছিল, এই পরিবারের সবাই ভালোবেসেছিল। সেই ভালোবাসার মোহে আমি এতটাই মোহগ্রস্ত হয়ে গেলাম যে নিজের বাবার বাড়ির চেয়েও এবাড়ি বেশি আপন করে নিয়েছিলাম। মা বাবা এসে নিয়ে যেতে চাইলেও বলতাম যে এ বাড়ি ছেড়ে কী করে থাকি। আমি না থাকলে তো আমার মাহিমের ঘুম আসে না। দাদী বলেন আমি না থাকলে বাড়ির রোশনাই কমে যায়। মা তার গাম্ভীর্যের মাঝেও আমার জন্য নরম হয়ে যান। অথচ আমি বুঝিনি সবাই ভালোবেসেছিল সেই চন্দ্রিমাকে যে চাঁদের মতোই উজ্জ্বল ছিল। কিন্তু এখন তাতে গ্রহণ লেগেছে। এখন আমি ছাড়াও বাড়িতে রোশনাই এর অভাব হয় না। তাই আমি বাড়িতে না থাকলে দাদী আর মা ফোন দিয়ে কবে আসবো জানতে চান না।”
কথা শেষ করার আগেই গলা ভারী হয়ে যায়। চোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রু। মাহিম জানালার কাছে আরামকেদারায় বসেছিল। এসি চলছে বলে চন্দ্রিমা বারান্দার দরজাও বন্ধ করে রেখেছে। চন্দ্রিমার কথাগুলো শুনে উঠে এসে চন্দ্রিমাকে জড়িয়ে ধরে।
“চন্দ্র, আমার চন্দ্রিমা। আই অ্যাম স্যরি। প্লিজ এভাবে কান্না করো না। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। আমার জন্য বিষয়টা সহজ না। খুব অস্থির লাগছে মনের ভেতর। চৈতালী মেয়েটার বয়স কম। ভদ্র মেয়ে, লেখাপড়ায় ভালো। মানে আমার কেমন যেন নিজেকে প্রতারক লাগছে। তাই এমন বিক্ষিপ্ত এলোমেলো কথা বলছি।”
“আমরা যখন কুরবানির জন্য পশু নির্বাচন করি, তখনও সবচেয়ে ভালো, নিরোগ পশুই নির্বাচন করি। এখানে তো আমরা চৈতালীর জীবন নিয়ে নিচ্ছি না। আমাদের প্রয়োজনেই এই বয়সী, নিরোগ একজনের প্রয়োজন ছিল। চৈতালী তার পরিবারের ভালোর জন্য কুরবান হচ্ছে। আমাদের প্রয়োজনটুকুর বিনিময়ে ও অনেকবেশি কিছু পাবে। যথেষ্ট পরিমাণ সম্পদ, পড়ালেখা শেষ করার সুযোগ। ভালো জীবন।”
“কিন্তু সেই জীবনের গতিবিধি ওর সীমিত হয়ে যাবে। আনার মনে হচ্ছিল আজ মেয়েটা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় সফল হলেই ভালো হতো। নিজেকে প্রবোধ দিতে পারতাম যে ও পালিয়েছে। ওর যাওয়ার অন্য কোন জায়গা থাকলে হয়তো ওকে সাথে করে নিয়েও আসতাম না।”
“আর আমাকে মারা যেতে দিতে? আমি জীবন থেকে একবারে হারিয়ে যাব মাহিম, এটা জানার পরও তুমি চৈতালীর কথা ভাবছো। সত্যিই তুমি সেই মাহিম যে নিজেই ডোনার হতে চেয়েছিলে!”
“আমি সেই মাহিমই। যদি ম্যাচ হতো, মা, দাদা কারও নিষেধর পরোয়া না করেই আমি খুশি খুশি মনে তোমাকে লিভারের কিছু অংশ ডোনেট করতাম। এ তুমি জানো চন্দ্রিমা। তোমার প্রতি ভালোবাসায় কোন খাদ আমার নেই। আমি শুধু আরেকজনের শরীর থেকে তাকে না জানিয়ে তার লিভারের কিছুটা অংশ নিয়ে নিতে নিজের মনকে মানাতে পারছি না।”
“এত অপরাধবোধ নিয়ে আগালে কেন তবে? তোমার অপরাধবোধ নিজের মানসিক শান্তি নষ্ট করে দেবে। তাছাড়া আমরা তো মৃত ডোনার খুঁজছিই। তা পেয়ে গেলে চৈতালীর লিভার আমার প্রয়োজন হবে না। ওর কাছ থেকে আমাদের সন্তান পেলেই আমি খুশি। ও আমাদের বৈধ সারোগেট মা হবে। সন্তান তো তোমার আমারই থাকবে, ও শুধু গর্ভ দেবে।”
“সেটাও তো আমরা ওকে জানাইনি।”
মাহিমের এমন আচরণে অধৈর্য হয়ে যায় চন্দ্রিমা।
“তুমি কী চাইছো মাহিম? এসব কিছু বারবার কথা বলে ঠিক করে নেওয়ার পরই তো আমরা এগিয়েছি তাই না? মা চেয়েছেন তার ছেলের বংশধর আসবে, আমি আমার ডোনার পাব। তাই তো চৈতালীকে আমি তোমার আমার মাঝে আসার অনুমতি দিয়েছি। আমার জন্য সহজ নিজের ভালোবাসার মানুষকে হাসিহাসি মুখে আরেকজনের হাতে তুলে দেওয়া? আজ যখন তোমাদের দু’জনকে বর কনের সাজে দেখেছি, তখন মনে হয়েছে আমি আসলে মারাই গিয়েছি। আছে শুধু এই ক্ষয়ে যাওয়া শরীর।
হলুদের সময় নিজেকে টেনে নিয়ে সামনে দাঁড়াতে পারলেও বিয়ের সময় আর পারিনি। তোমাকে ভাগ করা আমার জন্য কতটা কঠিন তা তুমি জানো না?”
“আমার কি চৈতালীর ঘরে যেতেই হবে? না গেলে হয় না? ও থাকুক ওর মতো।”
“তবে বিয়েটা সত্যি মনে হবে কী করে? যদিও আমরা ওর গর্ভে আমাদের সন্তানের জন্ম হোক তাই চাই। তবুও ওর সাথে তোমাকে সম্পর্ক বানাতে হবে।”
মাহিমের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকায় চন্দ্রিমা। নিজের কথাটুকু শেষ করে বলে,
“তুমি ওকে না ছুঁয়েই ওর গর্ভে সন্তান আসাটা ও কিভাবে গ্রহণ করবে।”
চন্দ্রিমাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে মাহিম। ভালোবাসা, দায়িত্ব আর বিবেকের কঠিন লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে মাহিম। একবছর আগেও সব কী চমৎকার সুন্দর ছিল। চন্দ্রিমাকে পেয়ে সে সুখী ছিল। চন্দ্রিমাও তাকে ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছিল। তারপরই আসে সেই কালো দিন। সন্তান নেওয়ার আগে রুটিন কিছু পরীক্ষা নীরিক্ষার জন্য হাসপাতালে যায় তারা। রক্তপরীক্ষার ফলাফল দেখে আরও কিছু টেস্ট দেয় ডাক্তার। সেসময় চন্দ্রিমার শরীরও খারাপ করতে থাকে। খেতে পারতো না, বমি হতো, জন্ডিস দেখা দিয়েছিল। দাদী ভাবতেন সুন্দর নাতবৌয়ের উপর নজর পড়েছে, তাই হুজুর ডেকে ঝাড়ফুঁক করেছিলেন। মাহিম ভাবতো কনসিভ করার টেনশনে চন্দ্রিমা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে, তাই মাকে নিষেধ করে দিয়েছিল বাচ্চা নিয়ে চন্দ্রিমাকে কোন চাপ না দিতে। অথচ সব ধারণা ভুল প্রমাণ করে ধরা পড়ে চন্দ্রিমার লিভার সিরোসিস। লিভার তার কার্যক্ষমতা অনেক খানি হারিয়েছে। এসময় নিরাপদ গর্ভধারণ বা আইভিএফ কোনটাই সম্ভব নয়। শুরু হয় চিকিৎসা। চন্দ্রিমাকে নিয়ে পাশের দেশ ইন্ডিয়া গিয়েছে মাহিম। তারপর ব্যাংকক। সবখানে এক কথা, লিভারের এই সমস্যার সমাধান সহজ নয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিতে হবে। সুস্থতা চাইলে একজন ডোনার প্রয়োজন। যে তার সুস্থ লিভারের খানিকটা চন্দ্রিমাকে দান করবে।
কিডনি ডোনার তবু টাকার বিনিময়ে পাওয়া গেলেও, সুস্থ নিরোগ, সেম ব্লাড গ্রুপের লিভার ডোনার পাওয়া যায় না বললেই চলে। অনেক টাকার বিনিময়ে ডোনার পাওয়া গেলেও ভালো ম্যাচ হয় না। জীবিত ডোনার না পাওয়া গেলে মৃত ব্যক্তির খোঁজও করা হচ্ছে। সেখানেও একবছরে কোন আশার আলো দেখতে পায়নি মাহিম চন্দ্রিমা।
চন্দ্রিমা অসুস্থ এতটুকু জানেন খান বাড়ির সবাই। লিভারের অসুখ, সুস্থ হওয়া দীর্ঘদিনের বিষয়, সুস্থ হলেও কখনও সন্তান নিতে পারবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। এটা জানার পর থেকেই জোবাইদা বেগম মাহিমের দ্বিতীয় বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকেন। তার সাথে মাহিমের দাদীও যোগ দেন। কিন্তু তাদের চাপ মাহিমকে টলাতে পারেননি। যতদিন না চাপটা চন্দ্রিমার তরফ থেকে এসেছে। চন্দ্রিমাই এই সমাধান বের করেছে।
মাস দুয়েক আগের ঘটনা। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে যায় চৈতালীর। বাড়িতে তখন জোবাইদা, জোহরা বেগম কেউ ছিল না। কাজের লোকদের সহায়তায় অসুস্থ শরীরে চন্দ্রিমাই হাসপাতালে নিয়ে যায়। মাথায় সেলাই দিতে হয়েছিল। চন্দ্রিমা সে সময় চৈতালীর বেশকিছু ব্লাড টেস্ট করতে দেয়। চন্দ্রিমা হাসপাতালে শুনে মাহিমও যায়। অসুস্থ শরীরে ছোটাছুটি করার জন্য চন্দ্রিমাকে বকা দেওয়ার আগেই চন্দ্রিমা জানায়, তারা সম্ভবত তাদের কাঙ্ক্ষিত ডোনার পেতে চলেছে। একটু অপেক্ষা করতে, রিপোর্ট আসলে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
(চলবে)