শুধু_তোমায়_ভালোবেসে #পর্ব_১০ #সাদিয়া_রহমান_হাফসা

0
443

#শুধু_তোমায়_ভালোবেসে
#পর্ব_১০
#সাদিয়া_রহমান_হাফসা

_________________

তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করার আগেই পুনরায় ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে বড়বড় করে লিখা রাইদাহ-র নাম। ফোন রিসিভ করার সাথেসাথেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে রাইদাহ-র কান্না মিশ্রিত কন্ঠস্বর।

✆ – ভাই? ভাবির প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে। হসপিটালে নিয়ে এসেছি কপালে দুইটা সেলাই লেগেছে। বাচ্চাদের মতো কাঁদছে আমরা কেউ..

– আমি এক্ষুনি আসছি!

তড়িঘড়ি করে বাড়ির পোশাকেই বেরিয়ে পড়লো আদনান। তার ক্লান্ত চোখে ভর করেছে এক অসহ্য অস্থিরতা। আজ সারা বিকেল কোট কাচারি আর থানার মধ্যে-ই কেটেছে তার। দু’টো স্ট্রোং কেইস ফাইল করে এসেছে সে। একটা মামলা খু/নে/র দায়ে সাজিদ ইব্রাহীমের নামে। আরেকটা সাজিদ ইব্রাহীমের ছেলে শান ইব্রাহীমের উপর জনসম্মুখে প্রতক্ষ ভাবে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত এমপির মানহানীর চেষ্টার অপরাধে। এরেস্ট ওয়ারেন্ট বের করে তারপর বাড়িতে ফিরেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ তাদের দুই বাপ-ছেলেকে এরেস্ট করে লক-আপের ভেতর চালান করে দেবে। এই প্রথম সে নিজের এমপি হওয়া পাওয়ারের মিস্ইউস করলো। নয়জন কৃষকের খু/ন আর শষ্যক্ষেত আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়ার পেছনে যে সরাসরি সাজিদ ইব্রাহীমের হাত রয়েছে তাতে আদনান পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত। কিন্তু তার কাছে এর উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় সে সঙ্গে সঙ্গে কোনো অ্যাকশন নিতে পারছিলো না। আজ দুপুরে যখন গ্রামের সম্মানিত সনামধন্য লোকদের নিয়ে আলোচনা সভায় বসেছিলো তখন সেখানে এসে হাজির হয় কামাল যে কিনা শানের চেলাপেলাদের সর্দার। কামালের থেকে জানতে পারে শানের পরবর্তী ধাপ ও পরিকল্পনা সম্বন্ধে। জনসমাবেশে সকলের সামনে থাপ্পড় দেওয়া মেয়েটিকে হয়রান হয়ে খুঁজছে শান। মেয়েটিকে পেলেই শান তাকে জানে মে/রে বলবে জানিয়েছে কামাল।

যদিও কেউ জানে না যে সেই মেয়েটি অন্য কেউ নয় সয়ং আদনান সাখাওয়াতের স্ত্রী, কিন্তু এটা একবার জানাজানি হলে বিশেষ করে সাজিদ ইব্রাহীম আর শান যদি ঘুনাক্ষরেও এই খবর টের পায় তবে তারা আরাধনার ক্ষতি করতে একটা কৌশলও বাদ রাখবে না। কেননা তখন তাদের উদ্দেশ্য শুধু আরাধনার ক্ষতি করা নয় বরং আদনানের সাখাওয়াতের সম্মান, ভালোবাসা, জীবনকে অস্তিত্বহীন করে দেওয়া হবে। এমন নয় যে আদনানের ক্ষমতা নেই নিজের স্ত্রীকে নিরাপত্তা দেওয়ার। সে বেঁচে থাকাকালীন কেউ-ই আরাধনার চুল অবধি বাকা করতে পারবে না তারপরও একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ভয় এসে উচ্চশব্দে ডানা ঝাপটাতে থাকে আদনানের বুকের মাঝে। ভয়ের এই তীব্র ব্যথা থেকে মুক্তি লাঘবের জন্যেই আরাধনাকে অতিদ্রুত নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দীঘিরপাড়ের ত্রিসীমানা থেকে জোর করে নিজেদের স্থায়ী বাসভবন “শিকারীপাড়া” পাঠিয়ে দেয়। আরাধনাকে নিরাপদে পাঠিয়ে দেওয়ার পরপরই সে চলে যায় আরাধনাসহ তার গ্রামের বাসিন্দা আর ক্ষেতের কৃষক-শ্রমিকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে আইনের আওতায়।

অনেক ধকল পেরিয়ে সব কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে বাসায় ফিরে পুরো বাড়ি জুড়ে একাকিত্বের কুয়াশায় হারিয়ে ফেলে নিজেকে। মাত্র তিনদিনেই একটা মানুষ এতটা কাছের হয়ে গিয়েছে যে এখন তার অভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে আদনানের উত্তপ্ত হৃদয়। হিম শীতল ঠান্ডার মাঝেই রাত ৯ ঘটিকায় চলে যায় শাওয়ার নিতে। তবুও তার বুকের অস্থিরতা কমে না। বুকের বাম পাশের উপর হাত চেপে ধরে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আদনান, সব বিপদ দূরে সরিয়ে দেওয়ার পরেও আরাধনাকে নিয়ে তৈরি হওয়া তার বুকের সেই যন্ত্রণাটা কমে যাওয়ার বদলে আরও যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সে বুঝতে পারে তার উত্তপ্ত হৃদয়কে শুধু এবং একমাত্র আরাধনা-ই শীতল করতে পারবে। বুকের বাম পাশ চেপে ধরে রাখা অবস্থাতেই তার চোখ যায় বিছানার উপরে রাখা ল্যাপটপ স্ক্রিনের ওয়ালপেপারে দৃশ্যমান গ্রামীণ বধূয়ার ন্যায় লাল পাড়ে সাদা শাড়ি পরিহিতা আরাধনার বেখেয়ালি হয়ে পাতলা গামছা দিয়ে চুল মোছার ছবিতে। ছবিটা আদনানেরই তোলা যা সম্পর্কে আরাধনা সম্পূর্ণ বেমালুম। একদৃষ্টিতে সেই ছবির পানে চেয়ে থেকে তপ্ত গাঢ় শ্বাস ফেলে আদনান বললো,

– এ কোন রোগে ধরলো আমায় হৃদয়েশ্বরী? মাত্র কয়েক ঘন্টা তোমায় ছেড়ে দূরে থাকার কারণে তোমার বিরহের অত্যুষ্ণ আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে আমার বুকের ভেতর স্পন্দিত হওয়া দ্রোহী হৃদপিণ্ডখানা। কই আগে তো এমন হয়নি! তাহলে এখন কেন এত শক্ত প্রখর টান!? আমি নামক মুমূর্ষু রোগীর তুমি নামক ওষুধের জরুরি তলব পড়েছে এই হৃদয়ে আরাধনা! তুমিও কি একইভাবে আমার অভাবে পুড়ছো? তোমার মনটা তো এখনো বাচ্চা! তোমার ঐ বাচ্চা মন কি তোমায় জানান দিয়েছে আমার অভাব!?

বেশ কিছুক্ষণ সময় এভাবে আরাধনার সরলপ্রাণ ছবিতে চেয়ে নিজ মনে বিরবির করে পাড় করে দেয় আদনান। তারপরও তার বুকের তীক্ষ্ণ ব্যথার উপশম হয় না। বিয়ের প্রথম রাতেই কাউকে না জানিয়ে আরাধনাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে চলে এসেছিলো সে তাই আরাধনার প্রয়োজনীয় কোনোকিছু কেনাকাটা করা হয়নি। কোনো নিজস্ব ফোনও আরাধনার কাছে নেই যে একটা কল করে কথা বলবে! বাড়িতে ফোন করে আরাধনাকে চাইতেও কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে তার। নিজের মন ও মস্তিষ্কের সাথে তুমুলঝগড়া লড়াই করে অবশেষে রাইদাহকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ফোনের স্ক্রিন অন করার পরই দেখতে পায় ২৪+ মিসড্ কল’স। রাইদাহ আর আফসানের ফোন থেকে এসেছে কলগুলা। সাইলেন্ট মোডে থাকায় বেখেয়ালি আদনান কিছুই টের পায়নি। বুকের অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়টা যেন আরও আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরে তাকে। কলব্যাক করার আগেই পুনরায় ভাইব্রেট হয়ে ফোন বেজে উঠে। শুষ্ক ঢোক গিলে ফোন রিসিভ করার পর রাইদাহ-র কান্না মিশ্রিত স্বরে বলা প্রতিটি শব্দ যেন একে একে বিষাক্ত ধারালো তীরের মতো বিঁধতে থাকে তার বুকের যন্ত্রণাময় জায়গাটায়। কোনোমতে নিজেকে সামলে হন্তদন্ত হয়ে শিকারীপাড়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো আদনান।

|
|

❝কুহেলিকা কুঞ্জ❞~

দিঘীরপাড় থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে ঢাকার একটু কাছাকাছি মফস্বল শহর শিকারীপাড়ায় জন কোলাহল থেকে কিছুটা নিরিবিলি পরিবেশে দন্ডায়মান সাদা রঙের দোতলা এই কুহেলিকা কুঞ্জ। এবাড়িতেই আঁখি সাখাওয়াত বধূ রূপে প্রবেশ করেছিলো। আদনান, আফসান, রাইদাহ-র ছোট থেকে একটু একটু করে বেড়ে ওঠার প্রতিটি স্মৃতি মিশে আছে বাড়ির আনাচে-কানাচেতে। আদনানের মরহুম দাদা জনাব আজাদ সাখাওয়াত তার প্রিয়তমা স্ত্রী কুহেলিকা বিবির জন্যে ভালোবেসে এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। স্ত্রীর নামের সাথে মিলিয়েই বাড়ির নাম রাখা হয় কুহেলিকা কুঞ্জ। এ কুঞ্জে রংবেরঙের বাহারি ফুল আর হরেকরকমের পাখির ছড়াছড়ি আর পুরো বাড়ি জুড়ে সুখের সুভাস।

হলরুমে সোফায় দুই পা তুলে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে আরাধনা। ডানহাতের কব্জি থেকে কনুইয়ের আগ পর্যন্ত সাদা বেন্ডেজ, কপালের বাঁধা সাদা বেন্ডেজের উপর র/ক্তের এক ছোপ দাগ, ডানপাশের ঠোঁটের কোণে র/ক্ত জমে আছে। পড়নের নীল-বেগুনী রঙের মিক্স কম্বিনেশনর শাড়ির লম্বা আঁচল ফ্লোরে বিছিয়ে পড়ে রয়েছে। ঢেউখেলানো খোলা চুলের থেকে কিছু চুল এসে তার চেহারা লুকাতে ব্যস্ত। পরম মমতায় মাথায় হাত রাখতেই আঁতকে উঠলো আরাধনা। পাশে বসে তাকে আস্বস্ত করতে আঁখি বললো,

– আরু মা! এমন করছিস কেন? অনেক রাত হয়েছে। ঘুমতে হবে তো!

আরাধনার চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। যেকোনো মুহুর্তে জল গড়িয়ে পড়বে যেন। কাঁপা কাঁপা গলায় রাইদাহ-র দিকে তাকিয়ে অনুনয়ের স্বরে বললো,

– আমি আদনানের কাছে যাবো। তোমরা আমায় এখানে কেন নিয়ে আসলে? আদনানের থেকে এতদূরে কেন দূরে নিয়ে আসলে? তোমরা আমাকে এখন দাদীর কাছে দিয়ে আসবে তাই না?

রাইদাহ কিছু বলতে যাবে তার আগেই বাইরে থেকে গাড়ির হর্ণের শব্দ ভেসে আসে। সময় নষ্ট না করে রাইদাহ দৌড়ে চলে গেলো সদর দরজা খুলে দিতে। একটু পর দরজার বাইরে এসে দাঁড়ায় আদনান যাকে দেখে ঘাবড়ে যায় আঁখি সাখাওয়াত সহ উপস্থিত প্রত্যেকে। উসকোখুসকো চুল, লাল ফোলা চোখ, মলিন মুখে একদম বিধ্বস্ত দেখতে লাগছে তাকে। আঁখি চিন্তিত হয়ে বললো,

– তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন আদি?

আদনান ক্লান্ত স্বরে বললো,

– মামনী আমার আরাধনা কোথায়?

– আ..আদনান!

আদনানের কন্ঠস্বর শুনে অভিযোগের সুরে ডাক দিলো আরাধনা। তড়িঘড়ি করে আরাধনার সামনে গিয়ে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো আদনান। আলগোছে আরাধনার উষ্ণ গালে হাত রেখে হাত আর কপালের বেন্ডেজের উপর আলতো চুমু খেলো। অভিমানী আরাধনা ঠোঁট উল্টে আদনানের এক হাতের উপর হাত রেখে বললো,

– আমাকে তুমি একা দূরে কেন পাঠিয়ে দিলে? তুমি জানো তুমি ছাড়া সবাই আমাকে তাড়িয়ে দেয়। তাড়িয়ে দিলে আমি তোমায় কোথায় পেতাম? তোমায় ছেড়ে কোথায় যাবো আমি? বলো! বলো কোথায় যাবো?

একের পর এক অভিযোগ করেই যাচ্ছে আরাধনা। কথা বলার কারণে সৃষ্ট কম্পনে তার ঠোঁটের কোণে কেটে যাওয়া অংশটুকু হালকা তরল র/ক্তে ভিজে ওঠে। তীর্যক চোখে চেয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে সেই র/ক্ত মুছে দিয়ে আরাধনার ললাটে অধর ছুঁইয়ে দিয়ে ধরা গলায় আদনান বললো,

– কোথাও যাবে না তুমি আমায় ছেড়ে, কোত্থাও না।

– ঐ মেয়েটা আমায় তাড়িয়ে দেবে আদনান। তুমি আমাকে আর একা ছেড়ে দিও না!

আদনান কপাল কুঁচকে বললো,

– তাড়িয়ে দেবে! কে তাড়িয়ে দেবে?

আরাধনা আবার ঠোঁট উল্টে কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো,

– ঐ যে উপরের মেয়েটা। জানো তুমি আমাকে যেই ঘরে ঘুমতে বলেছিলে না! ঐ মেয়েটা সেই ঘরে গিয়েছে। আমি যেতে দিতে চাইনি বলে আমাকে খুব ব্যথা দিলো আর তাড়িয়ে দিলো। এই দেখো কতগুলা ব্যথা দিয়েছে!

এই বলেই সে তার বেন্ডেজে বাঁধা হাতটি বাড়িয়ে দিলো সামনে। এক ভ্রু উঁচু করে প্রশ্নবোধক চাহনিতে মা আর বোনের দিকে চাইলো আদনান। রাইদাহ তড়িৎগতিতে বললো,

– রেশমিপু এমনটা করেছে ভাই। ও তোমার রুমে যাচ্ছিল ভাবী নিষেধ করায়..

হাত দিয়ে ইশারা করে থামিয়ে দিয়ে উঠে টানটান হয়ে দাঁড়ায় আদনান। চেহারার শান্ত স্বাভাবিক ভাবভঙ্গি দেখে কেউ তার মেজাজ আচ করতে পারছে না। আরাধনার কান্না সিক্ত চেহারার দিকে এক পলক চেয়ে থেকে চোখের পলকে তাকে সোফা থেকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিলো আদনান। আচমকা এমনটা হওয়ায় আরাধনা ভয় পেয়ে এক হাতে আদনানের শার্টের কলার আরেকহাতে পিঠের অংশ আঁকড়ে ধরলো। দুইটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে চলার গতি থামিয়ে পেছন ঘুরে অত্যন্ত শান্ত স্বরে সবার উদ্দেশ্যে বললো,

– বাড়িতে উপস্থিত দুই না বলে চলে আসা মেহমানদের বলো আদনান সাখাওয়াত তাদের স্মরণ করেছে। তারা যেন আমার রুমে আমার সাথে দেখা করতে আসে। শুভেচ্ছা জানানো হবে।



চলবে…

(শব্দসংখ্যা~১৩৯১। রিভিশন দেওয়ার টাইম পাইনি প্রচন্ড মাথাব্যথা কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না যেন! সাথে ভুলগুলিও ধরিয়ে দিবেন আমি সুধরে নেওয়ার চেষ্টা করবো। বানান সংক্রান্ত ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং🐚🐌)

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here