তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ১২.

0
746

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১২.
পাঁচতলা ভবনের গেটের সম্মুখে দাঁড়িয়ে এক মাঝ বয়সী লোক। পড়নে সাদা রঙের ফতুয়া সাথে ঢোলা প্যান্ট। হাতে চামড়ার ব্যাগ। মাথার অর্ধেকাংশেই চুলের অস্তিত্ব নেই। অনেকক্ষণ ধরেই গেটের সামনে চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারি করে চলছেন ভদ্রলোক। গেটের ভেতরে যাবেন কি যাবেন না তা নিয়ে সংশয়ে ভুগছেন তিনি। গেটের দাড়োয়ান হাসি হাসি মুখ করে বললেন,

‘আর কতক্ষণ দাঁড়াই থাকবেন মজনু ভাই? স্যারে সেই কখন আপনারে ডাকছেন। বেশি দেরি করলে আবার চাকরি নট! জানেন-ই তো!’

মজনু বিরক্ত চোখে তাকায়। ধমক দিয়ে বলে,

‘কথা কম বলতে পারেন না? চাকরি নট হলে হোক। আপনার স্যারের হাতে মান সম্মান খুয়ানোর থেকে চাকরি নট হওয়া ভালো।’

দারোয়ান লোকটার চোয়াল ঝুলে পড়লো যেন। গলার স্বরে বিস্ময় ঢেলে বললো,

‘কি বলেন ভাই! আপনের চাকরি‌ নট হওয়ার ভয় নাই? আপনের তো ভাই মেলা বড়ো কলিজা!’

মজনু মিয়া কথা বললো না। তবে তার কলিজা বড়ো বটে! নয়তো এই অসভ্য বাপ ছেলের চক্করে নিজের জীবন জরায় কখনো? চিন্তায় চিন্তায় তার বিপি লো হয়ে পড়েছে। এখনো কোনো সুরাহা হয়নি।

মজনু মিয়া পায়চারি বন্ধ করে শান্ত ভঙ্গিতে খানিকক্ষণ কিছু একটা ভাবলেন পরপর উল্টো পায়ে চলতে শুরু করলেন। রেজওয়ান মির্জার কোনো কল সে আর রিসিভ করবে না, আর না করবে দিহান মির্জার কল। এই বাপ ছেলে দুটোই অতিব মাত্রায় অসভ্য। এই অসভ্য পরিবারের অসুস্থ চাকরি সে আর করবে না।

মজনু মিয়ার ফোন বাজছে। ফতুয়ার পকেটে রাখা ফোনটা কেঁপে উঠছে থেকে থেকে। মজনু জানেন কে কল করেছে। রিসিভ করলেই কথার দু চারটা মার পরবে তার উপর সেটাও তার জানা। মজনু মিয়া দাঁড়ালেন, পকেট থেকে ফোন বের করে ফোনটার লাল বাটন চেপে ধরে অফ করে দিলেন সংযোগ। এতেও তার হৃদতুষ্ঠি হলো না। সিমটা খুলে পাশের নর্দমায় ফেলে দিলেন। অতিষ্ট ভঙ্গিতে দাঁত চেপে বিরবির করলেন,

‘মির্জা গুষ্ঠির ষষ্ঠী…!’

____________

কলেজে পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিবছর পিকনিকে কলেজ থেকে বাহিরে নিয়ে গেলেও এবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ক্যাম্পাসেই পিকনিক আয়োজন করা হবে। মেয়েরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে শাড়ি পড়বে সকলে। শাড়ি পড়ার এ ব্যাপারটায় সবথেকে বেশি আগ্রহী অন্তি। ইচ্ছা থাকলেও তার কখনো শাড়ি পড়া হয়ে ওঠেনি। এই শাড়ি পড়া নিয়ে তার মায়ের ঢের আপত্তি রয়েছে। তার মায়ের অকারণে আপত্তি থাকা ব্যাপারগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম। শাড়ি পড়ার কথা শুনলেই চোখ নাক কুঁচকে বলবেন,

‘ওসব পড়তে হবে না। ভালো একটা জামা পড়েনে।’

স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠানে সবাই শাড়ি পড়েছিল। সে নিজেও খুব শখ করে মায়ের কাছে শাড়ি পড়ার আবদার নিয়ে হাজির হতেই নাহার কাটকাট গলায় বললেন,

‘ছোট মেয়ে মানুষের শাড়ি পড়ে কি কাজ? ভালো কোনো জামা পড়ে যাও। বড়ো হওয়ার দরকার নেই এত।’

ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায় উজ্জ্বল মুখটা। গলা খাদে নামিয়ে মায়ের কথায় বিস্ময় নিয়ে অন্তি বলেছিল,

‘শাড়ি পড়লেই মেয়েরা বড়ো হয়ে যায় বুঝি?’

নাহার তাখন মেয়ের কথার জবাব না দিয়ে কেবল বলেছিলেন,

‘আজ শপিং এ যাবো। সুন্দর দেখে একটা কুর্তি কিনে নিও।’

অন্তির আর সেবার শাড়ি পড়া হলো না। অনুষ্ঠানে সবাই লাল রঙের শাড়ি পড়লেও সে পড়েছিল গাঢ় নীল রঙের লং কুর্তি। কি বেমানান ই না লাগছিলো! মনে হচ্ছিলো ঝাঁক ঝাঁক পাখির মধ্যে সে একমার কাক! কি অস্বস্তিকর একটা অবস্থা। পুরোটা সময় অন্তির হাঁসফাঁস করেই কাটলো। কিছুটা লজ্জাও পেয়েছিলো সে। এত বড় বড় কথা বলে শেষে কিনা সে নিজেই ড্রেসকোড ফলো করেনি!

অনুষ্ঠানের মাঝ পথেই সে বাসায় চলে এসেছিলো। টানা দুদিন সে মায়ের সাথে কথা বলেনি।

সেসব পুরোনো দিনের কথা ভেবেই অন্তি শাড়ি পড়ার কথাটা সাবধানে লুকিয়ে গেলো। এবার সে কোনোভাবেই এটা মিস করতে চায় না। নাহার জানতে পারলে কখোনোই তাকে শাড়ি পড়তে দিবে না।

তন্নিকে সাথে নিয়ে কোচিং শেষে শপিংয়ে চলেছে অন্তি। যাওয়ার পথে দিহানের সাথে দেখা হয়েছে। লোকটার গম্ভীর চোখজোড়ার বন্ধী হয়েছে সাথেই। অন্তি খুব সাবলীল ভাবেই মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। যেন দিহান নামক মানুষটার কোনো অস্তিত্ব নেই এ জগতে। অন্তির এহেন কান্ডে দিহানের সাথে সাথে বাদবাকি সকলেই অবাক। তারা যা দেখলো তা কি সত্যি!

দিহানের দুই ভ্রুর মাঝে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। এই মেয়ের মতিগতি সে বুঝতে পারে না। এই কেঁদে কেটে বন্যা বইয়ে দেয় তো এই মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। মেয়ে মানুষ এতো ঘোলাটে কেন? দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিহান। তার এত শক্ত ব্যক্তিত্বকে নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা যে মেয়ে রাখে সে মেয়ে নিশ্চই সাধারণ কেউ নয়। বিশেষ কেউ একজন! আর এই বিশেষতাই দিহানকে খুব করে টানে। মস্তিষ্ক চায় একবার মনকে প্রশ্রয় দিতে। কিন্তু প্রশ্রয় দিলেই যে তার ধ্বংস নিশ্চিত!

দিহানের ভাবনার সুতো ছেড়ে নুহাশের কথায়।

‘মেয়েগুলো উল্টোপথে কোথায় যাচ্ছে? হাত পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখা দরকার। এত টো টো করে ঘোরার কি আছে বুঝিনা!’

দিহানের ভাবনার কাঠি আরো একবার নড়ে উঠলো। এতো হেলেদুলে কোথায় যাচ্ছে মেয়েটা? চোখের চাহনি দৃঢ় হলো। জিপের উপর থেকে সটান নেমে দাঁড়িয়ে নুহাশকে বললো,

‘বাইকের চাবি দে।’

নুহাশ তৎক্ষণাৎ মানা করে দিলো।

‘মামা বাড়ির আবদার নাকি? তোর গাড়ি নিয়ে যেখানে খুশি যা। বাইক দিতাম না।’

দিহান অবশ্য নুহাশের কথায় কান দিলো না। ছো মেরে চাবি নিয়ে নিলো। বাইক স্টার্ট দিতেই নুহাশ লাফ দিয়ে পেছনে উঠে বসলো। দিহান ধমকে বললো,

‘নেমে দাঁড়া! তোর সাথে রাইড করার ইচ্ছা‌ নেই আমার।’

‘আমারো নেই। বাধ্য হয়ে উঠেছি।’

দিহান আর কথা বাড়ালো না। এখন ফালতু আলাপ করার মুড নেই তার। কিন্তু তাদের এ যাত্রা বৃথা হলো। অন্তি এবং তন্নির টিকিটাও তারা কোথাও খুঁজে পেল না। মুহূর্তের মাঝে কোথায় গায়েব হলো মেয়ে দুটো? দিহানের মেজাজ খারাপ হয়। সাদা মুখটা রাগে লাল হয়ে আসে। নুহাশ মুখ দিয়ে চ শব্দ করে নেমে যায়। আজ সে তন্নিকে হারে হারে বোঝাবে টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর শাস্তি ঠিক কেমন হতে পারে!

অন্তি ঘুরে ঘুরে কাবার্ড খুলে সদ্য কিনে আনা কলাপাতা রঙের শাড়িটা দেখছে। তার কাবার্ড ভরা জামাকাপড়ের মাঝে শাড়িটা জাগা পেয়েছে সবার উপরে। এটাই তার একমাত্র শাড়ি। সাথে ম্যাচিং করে ব্লাউজ পেটিকোট ও কিনে এনেছে সে। কিন্তু তার এই রঙের চুড়ি নেই। বাজারে কোথাও খুঁজে পায়নি ম্যাচিং চুড়ি। এজন্য অল্প স্বল্প মন খারাপ। কিন্তু ওটা আপাতত কোনো ব্যাপার না। অন্তি উৎফুল্ল মনে হেলেদুলে রুম থেকে বের হয়। ড্রয়িংরুমে তার মায়ের সাথে খোশ গল্পে মগ্ন মিলাকে দেখে মুখ বাঁকায়। মিলাকে রাগাতে নাহারকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘বড় কাকি কি তোমার আদরের মেয়েকে ঘর ছাড়া করেছে মা? আজকাল এ বাসায় যে ঘাটি গেড়ে বসেছে!’

আশ্চর্য জনক ভাবে মিলা এ কথার কোনো জবাব দেয় না। উল্টো নাহার রেগে কিছু বলতে গেলে বলে,

‘ওর কথায় কান দিওনা তো মেজ মা। তারপর বলো, কোথায় যেন ছিলাম আমরা? ও হ্যাঁ শোনো…’

অন্তি চোখ কপালে তুলে তাকায়। এই ন্যাকা এতো ভালো হলো কবে থেকে? নাকি এটাও নতুন ন্যাকামির ট্রেইলার!

_____________

গভীর রাত। ব্যস্ত রাস্তা এখন পুরোপুরি নিরব হয়ে উঠেছে। দূর থেকে কুকুরের ডাকের শব্দ ভেসে আসছে। এই গভীর রাতেও রাস্তার দিকে মুখ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে লাগাতর কান ধরে উঠবস করছে তন্নি। চোখ ছলছল করছে মেয়েটার। যখন তখন টুপ করে জল গড়িয়ে পড়বে। কান্না চেপে রেখে ছোট ছোট করে উচ্চারণ করছে,

‘সাতান্ন, আটান্ন, ঊনষাট…….’

বারান্দা বরাবর রাস্তায় বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নুহাশ। রাস্তার ধারের হলদে রঙের আলোতে তার মুখ জ্বলজ্বল করছে। চঞ্চল লোখজোড়া নিবদ্ধ সম্মুখে দোতলায় শাস্তিপ্রাপ্ত মেয়েটার দিকে। মেয়েটা সেই কখন থেকে মাথা নিচু করে আছে। মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। এই ভুলের জন্য কি শাস্তিটা আর একটু বাড়ানো উচিত? ননুহাশের আবার দয়ার হৃদয়। প্রেয়সীর এতো কষ্ট সে ঠিক সহ্য করতে পারবে না। নুহাশ ফোন হাতে কল করলো। রিং বাজলো দোতালার বারান্দায়।‌ সময় কল রিসিভ করলো মেয়েটা।

‘কাছে এগিয়ে আসো। সোজা হয়ে দাঁড়াবে। একদম সোজা আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। বিন্দু নড়চড় চাই না!’

‘আচ্ছা।’

মেয়েটা সত্যি এগিয়ে আসে। রোবটের মতো করে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এই অল্প আলোতেও সে লক্ষ্য করে মেয়েটার চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। কেঁদেছে খুব‌। নাকের ডগা ও ডালিমের মতো লাল টুকটুকে হয়ে আছে। নুহাশ আবিষ্কার করলো মেয়েটাকে কাঁদলে একটু বেশিই সুন্দর লাগে। মেয়েটার এই ডালিম রাঙা রূপটাই তার বেশি পছন্দ হয়েছে। নুহাশ খুব আফসোস করে বলে,

‘দুঃখিত সুন্দরী। তোমাকে যে এখন থেকে একটু বেশিই কাঁদতে হবে!’

তন্নি বুঝতে পারে না তার কথার অর্থ। চোখ ঝাপটায় কেবল। প্রশ্ন করার সাহস হয়ে ওঠে না। নুহাশ হাত ঘড়ির দিকে চোখ বূলায় একবার। রাত দুইটা বেজে পাঁচ মিনিট। ফের দৃষ্টি ফেলে তন্নির দিকে। মেয়েটার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছে।

‘ঘুম পায়?’

তন্নি তৎক্ষণাৎ দু পাশে মাথা নাড়িয়ে না জানায়। নুহাশ ঠোঁট কামড়ে হাসে। মেয়েটা তাকে বাঘের থেকেও বেশি ভয় পায়। এটা নুহাশের ভালো লাগে। মেয়েটার ভয় পেয়ে আড় চোখে তাকানোটা দারুন।

‘রুমে যাও। ঘুমিয়ে পড়ো।’

নুহাশের কথাটা বলতে দেরী হলেও তন্নির বারান্দা থেকে গায়েব হতে দেরী হলো না। রুমে ঢুকেই চট করে দরজা আটকে দিলো। যেন সে এতক্ষন ধরে এই অপেক্ষাতেই ছিল। নুহাশ হেসে ফেলে। বুকের মাঝে শান্তি অনুভব হয়। এই মেয়েটাকে পাওয়ার জন্য সে বরবাদ হতেও দুবার ভাববে না।

বারান্দার বদ্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে নুহাশ। বলে,

‘এখন না হয় একটু ভিলেন হলাম! ভালোবাসা দিয়ে পুষিয়ে দিব পড়ে। তখন তোমার যা শাস্তি মন চায় দিও! আমি নুহাশ হাসতে হাসতে প্রাণ দিতেও প্রস্তুত থাকবো।’

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here