তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ১৬.

0
807

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৬.
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। অদ্ভূত মায়াজড়ানো মাদকতায় পূর্ণ সে গন্ধ। প্রকৃতি ভিষণ শীতল হয়ে পড়েছে। গায়ে পাতলা চাদর টানতেই ঘুমে চোখ দুটো বুঝে আসতে চায়। যেন কত বছরের নির্ঘুমতায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছে চোখ দুটো! বছর পর রকৃতির পরশ পেয়ে সকল ক্লান্তিকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। অন্তির রুমের জানালায় টাঙানো সাদা ধবধবে পর্দাগুলো চঞ্চল ছুটছে। বাতাসের তাড়নায় তারা স্থির থাকতে ব্যর্থ। রাতে জানালা বন্ধ করা হয়নি। বৃষ্টির ছিটে জানালার পর্দার অনেকাংশই ভিজে গেছে। পর্দার উড়ে চলার ফাঁকে ফাঁকে বাহিরের স্বল্প সতেজ দৃশ্য চোখে আটকায় অন্তির। রান্নাঘর থেকে টুংটাং শব্দ আসছে। সাথে আসছে চাল, ডাল একত্রে করে রান্না নরম খিচুড়ির ঘ্রাণ। অন্তি আলগোছে উঠে বসে। নাসারন্ধ্রে খিচুড়ির ঘ্রাণ প্রবেশ করা মাত্রই তার নিজেকে ভিষণ ক্ষুধার্ত মনে হচ্ছে। পেটের ভেতর অদ্ভুত সব শব্দ হচ্ছে। অগোছালো চুলগুলো হাত খোপা করে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ায় সে। ঝটপট ফ্রেশ হয়ে ডায়নিং যেতেই দেখা যায় সেখানে আগে থেকেই তার বাবা বসে আছেন। আজ অফ ডে না হওয়াতেও সে বাসায়। এমনটা খুব কমই দেখা যায়। প্লেটে খাবার নিয়ে তার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। খিচুড়ির পাশেই বড়ো বাটিতে রাখা মুরগির ঝাল মাংস। বেগুন ভাজি ও করা হয়েছে। এসব অন্তির পছন্দের খাবার। বৃষ্টির দিনে নরম খিচুড়ি খাওয়া অন্যরকম একটা আনন্দ। নাহার এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

‘ওভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জলদি খেতে বোস। খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে যাবে।’

সাহেদ মেয়েকে দেখে মুচকি হাসে। বলে,

‘আচার আছে মা? নিয়ে আসো তো।’

অন্তি মাথা নাড়িয়ে আচার আনতে রান্নাঘরে চলে যায়। পরিবারের প্রতিটা মানুষ কত স্বাভাবিক আচরণ করছে। যেন সব আগের মতো সাজানো গোছানো রয়েছে। ছোট্ট একটা সুখি পরিবার। যেখানে সব কিছুতে রয়েছে ভালোবাসার ছোঁয়া। কিন্তু আদেও কি তাই? এই সবটাই কি সত্যি নাকি কেবল অভিনয়? অন্তি গতকালের কথা মনে করে,

গতকাল সন্ধ্যায় সাহেদের সাথে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। সম্পর্কে তিনি সাহেদের ভিষণ কাছের একজন বন্ধু। অন্তি অবশ্য তার নাম কয়েকবার শুনেছে। ডা: আজিম খন্দকর। বেশ ভালোমানের ডাক্তার তিনি। ভদ্রলোক বেশ রসিক ধরণের। অন্তির তার সাথে কথা বলে তেমনটাই মনে হয়েছে। কথায় কথায় জানতে পেরেছে ভদ্রলোকের একটা মাত্র ছেলে রয়েছে। সে ও একজন ডাক্তার। ভদ্রলোকের ছেলের গল্প শুনে অন্তির এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল আরাব নামের লোকটা অত্যন্ত রকমের সুপুরুষ। যার এত এত ভালো গুণ সে সুপুরুষ ব্যাতীত কি হতে পারে যানা নেই অন্তির। কথার এক পর্যায়ে ভদ্রলোক কৌশলে তার গুনধর ছেলের ছবিখানাও দেখিয়েছে অন্তিকে। বেশ সুদর্শন বলা চলে। ব্যাপারটা এ পর্যন্ত এসে থামলেই চলত কিন্তু ব্যাপারটা তখনই খারাপের দিকে গেলো যখন ভদ্রলোক কথার ছলে অন্তির সামনে সাহেদকে বললো,

‘তোর মেয়ে ছোট তাতে কি? তোর মেয়েকে কি আমি বা তোর ভাবী অন্যসব শশুর শাশুড়ির মতো রান্নাঘরে আটকে রাখবো নাকি? আমার বউমা হবে আমার সন্তানের মতো। এখানে যেভাবে আছে আমার কাছেও সেভাবেই থাকবে।’

বন্ধুর কথায় ভরসা পায় সাহেদ। উজ্জ্বল হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘তাহলেতো সমস্যার আর কিছু দেখছি না।’

অন্তি শক্ত হয়ে বসে তাদের আলোচনা শোনে। তার কান অব্দি বাদবাকি কথা পৌছাতে পারলো না। বুকের ভেতরটা কেমন জমে এসেছে। কলিজা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে যেন। এমন বিপদের কথা তো সে কখনো ভাবেনি। তার বয়স সবে সতেরো। এত দ্রুত… কেন? অন্তির চোখ ভরে আসে। মাথায় হাজার চিন্তা দলা পাকাতে থাকে। কোনো কথা ছাড়া দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। রুমে যেতে নিলে আজিম সাহেব বাঁধা দিয়ে বলে ওঠেন,

‘মামনি বসো। আরো কিছুক্ষণ গল্প করি তোমার সাথে।’

অন্তির পা আবস হয়ে আসছে। সে কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। দিহানকে ছাড়া অন্যকাউকে তার চাই না। সে ব্যক্তি যতই সুপুরুষ হোক না কেন অন্তির কেবল দিহানকে চাই।
আজিম সাহেবর কথায় খুব কষ্টে ঠোঁট টেনে স্বল্প হেসে সে বলে,

‘আমার শরীর খারাপ করছে আঙ্কেল। অন্য এক সময় কথা হবে।’

দ্রুত প্রস্থান করতে নিলে অন্তির মনে হয় তার পায়ে যেন পাথর বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সে কিছুতেই পা টেনে রুম অবদি যেতে পারছে না।
সাহেদকে চিন্তিত দেখালো। মেয়ের এভাবে চলে যাওয়াটা তার কাছে ভালো লাগলো না। চোখ ঘুরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকাতে দেখা গেলো সেও অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। অন্তি স্বভাবত চটপটে ধরণের। কথা বলার মানুষ পেলে তার মুখ ননস্টপ চলতে থাকে। এতক্ষণ পর্যন্ত সব তো ঠিক ছিল। বিয়ের কথা উঠতেই মেয়েটা…… !!
সাহেদের যতটুকু বোঝার সে বুঝে ফেললেন। এ বয়সের মেয়েরা বিয়ে করে নিজের স্বাধীনতা নষ্ট করতে চায় না। বিয়ে বলতেই তারা চার দেয়ালে বন্দি জীবন মনে করে। মেয়েকে বুঝিয়ে বললেই বুঝতে পারবে ভেবে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে।
আজিম সাহেব বিদায় নেন তার খানিক বাদেই। রাতে খাবার টেবিলে অন্তি না আসায় সাহেদ স্ত্রীকে বলেন,

‘মেয়েকে ডাকছো না কেন?’

নাহার প্লেটে ভাত তুলতে তুলতে বলে,

‘তোমার মেয়েকে তুমি কেন ডাকছো না? দুবার ডেকেছি দরজা খোলেনি।’

স্ত্রীর এমন গা ছাড়া ভাব সাহেদের কখনোই পছন্দ হয় না। মেয়েটা না খেয়ে থাকবে নাকি রাতে? নিজেই উঠে এসে অন্তির রুমের দরজায় কড়া নাড়ে।

‘দরজা খোলো রূপন্তি।’

ভেতর থেকে জবাব আসে,

‘আমি খাব না। ক্ষুধা নেই।’

সাহেদের হঠাৎ করেই হাসি পায় খুব। পুরোনো দিনের কিছু কথা মনে পড়ে। তার যখন বিয়ে হলো নাহার তখন বেশ ছোট। তাকে একটু আধটু বকলেই ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকতো। সব রাগ খাবারের উপর দিয়ে চলে যেত। মেয়েটাও হয়েছে তেমন। একদম মায়ের কপি।
কিন্তু এখন হাসলে চলবে না। মেয়ের ছোট্ট মনে নিশ্চই বাবার প্রতি অভিমান জন্মেছে। এই অভিমানকে ক্ষোভে রূপ নিতে দেওয়া যাবে না। তার পূর্বেই মেয়েকে বোঝাতে হবে তাকে। এই বয়সটা খারাপ। এ বয়সেই ছেলে মেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। সে বাবা হয়ে মেয়ের বিন্দু ক্ষতি চান না।

ঘড়িতে দশটা বাজে। অন্তি বসার ঘরে এক কোণে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সামনেই সোফায় বসে তার বাবা মা এবং বড় চাচা। বড় চাচার হঠাৎ এই রাতে এখানে আসার কারণটা অন্তির অজানা। সাহেদ মুশত মেয়েকে বোঝানোর জন্য এত রাতে বড় ভাইকে কল করে ডেকেছেন। বংশের মাথা তিনি। বাচ্চা থেকে বড় সকলেই বেশ মেনে চলেন তাকে। নিরবতা ভেঙে অন্তির বড় চাচা শাহিন রাশভারী গলায় বলেন,

‘এখানে এসে বোসো। আসামির মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন? কোনো অন্যায় করেছ তুমি?’

অন্তি দুদিকে মাথা নাড়ায়। সাহেদ মুচকি হাসে। সে উপযুক্ত লোককেই এনেছেন মেয়েকে বোঝাতে। অন্তি চুপটি করে সামনের সোফায় বসে।তার বুক অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। ইতিমধ্যে তার সচেতন‌ মস্তিষ্ক বড় চাচার আসার কারণ উদঘাটন করে ফেলেছে।

‘সোজা কথায় আসি। আরাব ছেলেটার ছবি দেখেছো?’

চাচার কথায় মেরুদন্ড বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। তার ধারণাই ঠিক। ঝেঁপে আসা কান্না চেপে রেখে অন্তি মাথা নাড়ায়। সে দেখেছে। শাহিন সাহেব পুনরায় বলেন,

‘ছেলেকে দেখে তোমার অপছন্দ হয়েছে?’

অন্তি মাথা নাড়িয়ে না জানায়। শাহিনের সাথে সাহেদ ও স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। এ পর্যায়ে সাহেদ কথা বলেন,

‘বাবা তোমার খারাপ চায়না মা। আরাব ছেলেটা ভিষণ ভালো। আমি খোঁজ নিয়েছি। তাছাড়া এখন বিয়ে হলেই আমরা তোমায় দিয়ে দিব না ওদের কাছে। তোমার যাখন মনে হবে তুমি ওবাড়িতে যেতে প্রস্তুত তখন আমরা ব্যাবস্থা নিব।’

অন্তি বাবা চাচাকে সম্মান করে এবং ভয় ও পায়। কিন্তু তাই বলে নিজের মতের বিরুদ্ধে সে কারো কথাই চুপ করে মেনে নেওয়ার মতো মেয়ে নয়। এবারো তাই হলো। সে বাবার মুখের উপর বললো,

‘আমি তাকে বিয়ে করতে চাই না বাবা। আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।’

‘কেন মা? খুলে বলো। না বললে বাবা বুঝবে কিভাবে?’

অন্তি এখানেই ভুলটা করে বসে। বাবার কাছে বায়না করলেই সব পাওয়া যায় সে চিন্তা থেকেই জীবনে প্রথম বারের মতো চুড়ান্ত বোকামিটা করে বসে সে। কিন্তু মেয়েটা যানেই না বাবার কাছে পুতুল চেয়ে আবদার করা আর জীবন সঙ্গী আবদার করা দুটোর মধ্যে মাইল মাইল পার্থক্য রয়েছে!
আবেগে আপ্লুত অন্তি কেঁদে কেঁদে ততক্ষনে হেঁচকি তুলে ফেলেছে।‌ মেয়ের এমন কান্না দেখে নাহার এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে চেষ্টা করে। সাহেদ অস্হির হয়ে ওঠে। তার ছটফটে চঞ্চল মেয়েটা হঠাৎ করে এমন ভেঙে পড়লো কেন? শাহিনকেও চিন্তিত দেখালো। তার বংশের তারা এই মেয়েটা। নিজের মেয়ের থেকেও বোদহয় এজন্য ভাইয়ের মেয়েটার প্রতি এত স্নেহ তার।

নাহার মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত ছুঁয়ে দেয়।

‘কাঁদে না পাগল মেয়ে। তুমি চা চাইবে সেটাই হবে। বাবাকে বলো তুমি কি চাও।’

মায়ের পরম স্নেহে অশান্ত মন শান্ত হয়ে আসে। ভাবনা চিন্তা ছাড়াই মেয়েটা তার মনের অত্যন্ত গোপন তথ্য তাদের নিকট পেশ করে।

‘আমি দিহান মির্জাকে পছন্দ করি। আমি তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আমার দিহান মির্জাকে চাই বাবা।”

চলবে…….

(পরবর্তী পর্ব আগামী কাল পোস্ট করা হবে ইনশাআল্লাহ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here