#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি
৭.
বর্ষাকালের আগাম বর্তা দিতে আকাশ ঘনিয়ে মেঘ করেছে। এখন জৈষ্ঠের প্রায় শেষ। কিছুদিন বাদেই আষাঢ়ের পদার্পন ঘটবে। তারই বার্তা জানাচ্ছে প্রকৃতি। মাঝে মাঝেই মেঘ গর্জন তুলছে। যখন তখন ঝুপ করে বৃষ্টি নামতে পারে। মেঘের গর্জনে দোতালার বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরীর বুক বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। তাও সে রুমে ফিরে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তার ভয়ার্ত দৃষ্টি রাস্তায় বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটির দিকে। পুরুষটি তার দিকে তাকাচ্ছে কম। ফোনে অনবরত কিছু করে চলছে। মেয়েটার অবস্থা কাঁদো কাঁদো। আজ তার সিভি জমা দেওয়ার কথা ছিলো। কোনো জবের জন্য নি। এলাকার গুন্ডার কাছে নিজের পরিচয় তুলে ধরার জন্য। কিন্তু সে সেটা করেনি। সূক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। ভেবেছিলো এই অতি সূক্ষ্ম ব্যাপারটা কারো মনে থাকবে না। কিন্তু হলো তার ভিন্ন। লোকটা ঠিক মনে রেখেছে। গুন্ডাদের মেধা এতো ভালো হয় তার ধারণা ছিলো না। লোকটা কোথা থেকে তার নম্বর খুঁজে বের করে বিকেল হতেই কল ঠুকেছে। অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসায় সে প্রথমে না ধরলেও বারবার কল আসায় ধরেছে। পরিচিত কেউ হতে পারে! সুন্দর করে সালাম দিয়ে কে জিজ্ঞেস করতেই উত্তর আসে,
‘সিভি কোথায়?’
তন্নির আর বুঝতে বাকি থাকেনা এটা কে হতে পারে। তার প্রাণ পাখি গলায় এসে আটকে আছে। লোকটা নাম্বার খুঁজে পেল কোথায়? এসব ভাবতে ভাবতেই দ্বিতীয় ধমকটা আসে।
‘স্টুপিড! চুপ করে আছো কেন? বারান্দায় আসো। এখন মাত্র। আমি না বলা অবদি এক পা ও নরবে না। চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকবে। নয়তো তোমার বাসায় আসতে একদম কৃপনতা করবো না।’
তখন থেকেই এভাবে দাঁড়িয়ে সে। এদিকে মশা তার পা কামড়ে ঝাঝড়া করে ফেলছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেই এই মশার উৎপাত শুরু হয়। তন্নি কাঁদো চোখে বাহিরে তাকালো। নাহ লোকটা আজ আর যাবে বলে মনে হচ্ছে না। তার ছোট্ট জীবনটা বোধহয় এভাবে দাঁড়িয়ে থেকে মশার কামড়েই শেষ হয়ে যাবে!
তন্নি মেয়েটা সুন্দরী। একদম ভয়ংকার সুন্দর যাকে বলে। টকটকে গায়ের রঙ আর গোলগাল মুখ। তবে নাকটা চাকমাদের মতো বোঁচা। এই বোঁচা নাকটাই বেশি সুন্দর।
অন্তি আর তন্নি একত্রে কোথাও বের হলে আশপাশের মানুষ ঘুরেফিরে তন্নিকেই দেখে। অন্তির দিকে তাকাতে যেন তারা ভুলে বসে।
তবে তন্নি মেয়েটা অন্তির থেকে অনেকটা ভিন্ন। তাদের স্বভাব একে অপরের বিপরীত। “সুন্দরী মেয়েরা বোকাসোকা হয়” এই প্রবাদটাকে প্রমাণ করতেই যেন তন্নির এই ধরণীতে আগমন। একটুতেই কেঁদে ফেলার মতো মহৎ গুণের অধিকারী সে।
এখন সেই মহৎ গুণেরই সূক্ষ্ম বহিঃপ্রকাশ করছে সে। খানিক বাদেই নাক টানছে। চোখ থেকে উপচে পড়ছে পানি। নুহাশ তার তীক্ষ্ণ চোখে সবটা পর্যবেক্ষণ করে কল করলো তন্নিকে। তন্নির পাশেই ফোন ছিল। নাক টেনে একবার দাঁড়িয়ে থাকা নুহাশকে দেখে কল রিসিভ করলো। প্রেয়সীর চোখের পানিতে তখন প্রেমিক পুরুষের মন গলে শীতল হয়ে এসেছে। নুহাশ নরম গলায় বললো,
‘কাঁদছো কেন? আমিকি তোমায় বকেছি? মেরেছি?’
তন্নি মাথা নাড়িয়ে না জানালো। তা দেখে ছোট করে হাসলো নুহাশ। শুধালো,
‘তবে?’
‘এখানে অনেক মশা। আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।’
এ কথার জবাব কিভাবে দিবে নুহাশ বুঝতে পারলো না। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বললো,
‘এজন্য কাঁদছিলে?’
‘হুম।’
নুহাশ কেমন প্রতিক্রিয়া দিবে তা ভেবে পেলো না। মানে সত্যি? মশা কামড়ালে মানুষ কাঁদে? তাও আবার এতো বড়ো একটা মেয়ে! দুদিন পর বাচ্চার মা হবে এমন মেয়ে এখনো বাচ্চাদের মতো হুদা জায়গায় কাঁদে! নুহাশ হাসি আটকে রাখতে পারল না। হু হাঁ করে হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে এসেছে। হাসি থামিয়ে বললো,
‘রুমে যাও। কয়েল জ্বালিয়ে দাও। আর মশা কামড়াবে না। তোমার সব ভুল মাফ করা হলো।’
_______________
অন্তির নানা বাড়িতে বড়োসড় একটা বাগান আছে। বাগান ভর্তি ফলের গাছ। তার মধ্যে রয়েছে হাইব্রিড জাতের পেয়ারা। যেগুলো বছরের বারো মাস গাছে থাকে। ছোট একটা গাছে থোকা থোকা পেয়ারা ঝুলে আছে। দেখতেই কেমন সুন্দর লাগে। গাছটা লম্বায় তুলনামূলক ছোট হলেও অন্তির উচ্চতার থেকে বেশ বড়। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারেনা সে। তাই মই বেয়ে গাছে ওঠার অভিযান শুরু করেছে। তাকে সঙ্গ দিচ্ছে বাগানের পরিচালক মতলব মিয়ার ছেলে মতিন। রোগা পাতলা ছেলেটা একদিনেই অন্তিকে তার গুরু মেনে নিয়েছে। অন্তির প্রত্যেকটা কথা হরফে হরফে পালন করেই একজন ভক্ত শিষ্যর পরিচয় দিচ্ছে সে।
বহু প্রচেষ্ঠার পর বড় দেখে তিনটা পেয়ারা পাড়তে সক্ষম হয়েছে অন্তি। এই অল্পতেই তুষ্ট সে। মই বেয়ে নিচে নেমে বাগানে গোল করে সাজানো চেয়ার টেবিলে বসে পড়লো। মতিনকে বললো,
‘রান্নাঘরের ফ্রিজে দেখবে কাসুন্দি আছে। নিয়ে আসো। সাথে একটা বাটিও আনিও। ও আর, ফল কাটার ছুরি।’
‘আইচ্চা আপা।’
মতিন ছুট লাগালো। অন্তি হাসলো। তার এই ছেলেটাকে দারুন লেগেছে। মাকে বলে একে সাথে করে নিয়ে যাবে। ঢাকার একটা স্কুলেও ভর্তি করিয়ে দিবে। ছেলেটার মেধা ভালো। একবার কিছু বললে চট করে ধরে ফেলার ক্ষমতা আছে।
.
.
দিহান আজ ও কিছু কাজের জন্য বাহিরে গিয়েছে। আড্ডাস্থানে আজ ও তার দেখা নেই। তবে অন্যদিনের মতো সবাই আড্ডায় মত্ত নেই আজ। সবাই কেমন থমকে আছে। চোখে মুখে ক্রোধ স্পষ্ট। নুহাশ খানিক বাদে বাদেই পানির বোতরে চুমুক দিচ্ছে। এটা তার রাগ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যম। সে যখন খুব রেগে থাকে তখন খুব বেশি পানি খায়।
মূলত এই মহল্লায় দুটো দল রয়েছে। একটা দিহানের অপরটা পরশের।
একই বনে যদি দুটো বাঘ থাকে তবে রাজা হওয়ার লড়াই তাদের আমৃত্যু তাড়া করবে। এখানেও ঘটনা তেমন। দিহানের সাথে পরশের দন্দের কথা পুরো মহল্লা যানে। এর মাঝে এক ঝামেলা ঘটেছে। দিহানের এক ছেলেকে পরশের ছেলেরা বেধরম পিটিয়েছে। ছেলেটা এখন হাসপাতালে ভর্তি। মাথা ফেটেছে। বারোটা সেলাই লেগেছে। ডান হাত ভেঙেছে। পা নাড়ানোর মতো অবস্থা নেই। একথা জানতেই নুহাশ ফুঁসে উঠেছে। দিহান এখনো কিছু জানে না। জানলে বড় একটা ঝামেলা হবে যা নুহাশ চাচ্ছে না। কিন্তু না জানালেও যে সমস্যা। এখনি কোনো ব্যাবস্থা না নিলে পরবর্তীতে ওরা যে এভাবে আবারো হামলা চালাবেনা তার কি নিশ্চয়তা?
___________
রাত প্রায় বারোটা। অন্তির দুচোখের পাতায় ঘুম নেই। এত রাতেও সে বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছে। খোলা বারান্দায় বাহির থেকে আসা বাতাস গায়ে মাখছে দারুন।
নানু বারবার করে না করেছে রাতে বাহিরে বসতে। এটা তাদের শহর না। এখানে রাতে অনেক কিছু ঘটে যা শহরের ঝকঝকে কৃত্রিম আলোয় ঘটে না। তখন ভয় পেলেও এখন কেন যেন ভয় লাগছে না। তার মন খারাপ করেছে। দিহানকে বহুবার কল করেছে সে। কিন্তু প্রত্যেকবার ফোন বন্ধ বলছে। লোকটা কি নম্বর বদলে ফেলেছে? ভাবতেই অসর হয়ে আসে মন। বাহিরের ঘুটঘুটে অন্ধকারের মতোই শুন্য হয়ে আসে মস্তিষ্ক। তার ভেতর সত্তা তাকে জানায়,
‘এই লোক পাথরের থেকেও কঠিন অন্তি। এই কঠিনতা ভেদ করা সম্ভব নয়।’
অন্তি সম্মতি জানায়। লোকটা সত্যিই পাথুরে হৃদয়ের। অন্তি মনে মনে আজ থেকে দিহান নামক মানুষটির সাথে হৃদয়ের সকল লেনদেন বন্ধ ঘোষণা করে দিলো নিমিষেই। এই মানুষটাকে আর ভালোবেসে দুঃখ বাড়াতে চায় না সে। এমনিতেই দুঃখকি কম পাচ্ছে সে? নতুন করে আর দুঃখর দরকার নেই। বারান্দার দরজা আটকে রুমে এসে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। আজ কিছুতেই সে দিহানকে নিয়ে ভাববে না। তার জন্য সুন্দর একটা ঘুম দরকার। তখনি তার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতে কল এলো। পাশে পড়ে থাকা ফোনের স্ক্রিণে জ্বলজ্বল করছে কলদাতার সেভ করা নাম ‘মাই ভিলেন’।
চলবে……..
(ছোট পর্বের জন্য দুঃখিত। ভুল ত্রুটি মার্জনা করবেন।)