#হৃদয়ের_সন্ধিক্ষণ
#পর্বঃ১৭
#ফারিহা_খান_নোরা
তুর নিষ্প্রভকে গায়ের জো’রে সর্বশক্তি দিয়ে থা’প্প’ড় মে’রে’ছে। নিষ্প্রভ গালে হাত দিয়ে তুরের পানে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।সে থমকে যায় শান্তশিষ্ট মেয়ের এমন আচারণ দেখে।তুর নিষ্প্রভের শা’র্টে’র ক’লা’র ধরে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে,
‘অনেক বলে ফেলেছেন আর একটা কথাও নয়। আমি আমার চরিত্রের সার্টিফিকেট আপনার থেকে নিবো না। আমি কেমন সেইটা আমি নিজেই জানি।আজ আপনি আপনার নিচু মন মানসিকতার সাথে আমার পরিচয় করে দিয়েছেন। আমি ভাবতেও পারিনি আপনি আমার পুরো কথা না শুনে এমন জ’ঘ’ন্য কথা বলে আমাকে অসম্মান করবেন।’
নিষ্প্রভ তুরকে দেখে ক্ষনে ক্ষনে অবাক হয়ে যায়। নিষ্প্রভ তুরের এ কোন রূপ দেখছে।এ তুরের সাথে তো নিষ্প্রভ পরিচিত নয়।তুরের বুকে একরাশ ঘৃ’ণা জমছে।চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।তুর ঘৃ’ণা মিশ্রিত কন্ঠে আবার বলতে শুরু করে,
‘আমার কপালটায় এমন জানেন তো,যখন একটু ভালো থাকার চেষ্টা করি ঠিক তখনি কোনো ঝ’ড় এসে সবকিছু এলোমেলো করে দেয়।আমার জীবন এমন না হলেও পারতো।প্রথমে আমার মা আমার জীবণটা নিয়ে জুয়া খেলল ভাগ্যক্রমে আপনার সাথে জরিয়ে পড়লাম।আপনি বাসর রাতেই আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইলেন।আমিও চুপ ছিলাম কারণ আমি আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আপনার জীবণে এসেছি।তারপর ধীরে ধীরে আপনাকে আমার ভালো লাগতে শুরু করে।একটুর জন্য আমার মনে হয়, আপনিও আমায় পছন্দ করেন। সেজন্য তো আমি আপনাকে নিজের মনের কথা বলবো বলে আপনার জন্য এভাবে সেজেছি।আজ আমি আপনাকে বলতাম আমাদের এই অপ্রত্যাশিত সম্পর্কটাকে স্থায়ী করতে।কিন্তু এটা মনে করা ছিলো আমার জন্য সম্পূর্ণ ভুল। তারপর একটু থেকে তুর আবার বলতে শুরু করে,
‘বুজতে পারছি আমি আপনার কাছে গলায় কাঁটার মতো বিঁধে আছি। আপনি আমায় না পারছেন গিলতে না পারছেন ফিলতে। আমি নিজেই এই সম্পর্ক আর রাখতে চাই না।যে সম্পর্কে ভালোবাসা তো দূর বিশ্বাস, ভরসা, সম্মান কোনোটাই নেই সেই সম্পর্ক রেখেও লাভ নেই।’
নিষ্প্রভ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।সে বুজতে পারছে না তাঁর কি করা বা বলা উচিত।সে আহত দৃষ্টিতে তুরকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
‘তোমার ক্লাস শেষ হয় একটায়।আমি বিকালে বাড়িতে এসে দেখি তুমি নেই।তাহলে এতো সময় কোথায় ছিলে?’
তুর নিজেকে ধাতস্থ করে তাচ্ছিল্যপূর্ণ কন্ঠে বলে,
‘সেজন্য বুঝি মনে করছেন। ভেবেছেন আমি ছেলেদের সাথে ঢলাঢলি করতে তাদের বি’ছা’না অবধি গেছি?’
নিষ্প্রভ রে’গে যায়।রা’গে’র ফলে তাঁর কপালের দুই পাশের রগ ফুলে যায়।সে ধ’ম’কে’র স্বরে চিৎকার করে বলে ওঠে,
‘তুর।’
এমন চিৎ’কা’রে তুর কেঁপে উঠে। অবজ্ঞার স্বরে সম্পুর্ন ঘটনা বলে তারসাথে এটাও বলে,
‘আপনার থেকে আফসানকে বিয়ে করায় ভালো ছিল কারণ ও খারাপ সবাই তা জানে লুকিয়ে রাখার কিছু নেই কিন্তু আপনি? খোলস পড়ে ঘুরে বেড়ান।’
সব শুনে নিষ্প্রভের নিজের প্রতি ভীষণ রা’গ হয়। কিন্তু শেষর কথা শুনে তুরের উপর রে’গে যায় সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘কি বললে তুমি? আফসান আফসান আর আফসান।সে আমার জীবণটা শেষ করে দিলো।’
তারপর গাঁয়ের সর্বশক্তি দিয়ে দেওয়ালে ঘু’ষি মে’রে রা’গ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে নিষ্প্রভ । কিন্তু ফলাফল সফল না হলে, রুম থেকে বেরিয়ে যায়।তার হাত থেকে র’ক্ত চুয়ে চুয়ে প’ড়’ছে।তুর শাড়ি আঁচলা দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে বারান্দায় যেয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে।
_________________________
ভোরের দিকে নিষ্প্রভ বাড়ি ফিরে আসে এতক্ষণ ফুটপাতে বসেছিলো সে।রুমে এসে তার দৃষ্টি যায় ব্যালকনিতে অগোছালো ভাবে বসে থাকা তুরের পানে।মেয়েটাকে খুব বিষন্ন দেখাচ্ছে। কাল রাতে নিষ্প্রভে তুরের সাথে বেশি বা’জে ব্যবহার করে ফেলে মনের অজান্তেই।নিষ্প্রভ অনুসুচনা ও দ্বিধা নিয়ে এগিয়ে গেল তুরের দিকে।
তুর উপস্থিতি টের পেল নিষ্প্রভের, কারণ সে সারারাত এভাবেই জেগে ছিলো। হাঁটু থেকে মাথা তুলে সামনে চোখ মেলে একবার তাকালো নিষ্প্রভের দিকে। মানুষ মুখ কি স্নিগ্ধ লাগছে।অথচ এই স্নিগ্ধ মুখ দেখলে বোঝাই যায় না এই মুখনিঃসৃত কথাগুলো কাউকে ক্ষ’ত’বি’ক্ষ’ত করতে পারে।তুরের চোখে আবার ও পানি আসে।চোখের পানি আড়াল করতে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। নিষ্প্রভ তুরের পাশে হাঁটু ভেঙ্গে ফ্লোরে বসে পড়ে।তুরের মুখ উচু করে ধরে কাতর স্বরে বলে,
‘বেশি আঘাত করে ফেলেছি তাই না?’
তুর মুখ সরিয়ে নিয়ে ঝামটা দিয়ে বলল,
‘আপনি তো কমই বলেছেন।এর থেকে বেশি কিছু আপনার থেকে আশা করি।’
‘তুর!’
‘চেঁ’চি’য়ে ভালো পুরুষ হওয়া যায় না।আপনাদের মতো কিছু পুরুষ আছে যারা যখন ইচ্ছে হয় বউ এর উপর চেঁ’চা’মে’চি করে আবার যখন ইচ্ছে হয় বউকে কাছে টেনে নেয়।বউকে তারা নিজের হাতের পুতুল মনে করে।আপনিও ঠিক তাদের দলে।’
‘নিজের বউকে মাঠ ভরা মানুষের সামনে অন্য পুরুষকে প্রপোজ করতে দেখে আমি ঠিক থাকব? তাছাড়া তুমি যেতেই ছেলেটা তোমাকে জরিয়ে ধরেছিল।’
‘এখানে আমার দোষটা কোথায়? আমি কি তাকে বলেছিলাম আমাকে জড়িয়ে ধরতে নাকি বলেছিলাম প্রপোজ করতে?’
নিষ্প্রভ অসহায় ভঙ্গিতে বলে,
‘আমি জানি তোমার দোষ নেই।তবে তুমি কেন ওর এসব মুখ বুঝে দেখতে গেলে।হাত ছিলো না তোমার থা’প্প’ড় মে’রে দিতে।’
‘এতো মানুষের সামনে আমি লোকটাকে থা’প্প’র দিবো কেন? এমনটা করলে সে লজ্জা পেতো আমার খা’রা’প লাগতো।’
‘ওহ, লোকটাকে থা’প্প’র মা’র’লে তোমার খা’রা’প লাগতো। আর স্বামী! আমাকে তো থা’প্প’র ঠিক মা’র’লে এতে তোমার খারাপ লাগে নি?’
তুর কাট কাট গলায় বলে,
‘না, খারাপ লাগে নি।মাত্র একটা মে’রে’ছি আমার আরও তিন থেকে চারটা থা’প্প’র মা’রা উচিত ছিলো আপনাকে।আপনি আমার চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলেছেন যেখানে দোষটা আমার ছিলোই না।’
তুর বলতে বলতে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।তুরের কান্না দেখে নিষ্প্রভের ভিতরটা ভে’ঙে যাচ্ছে এমন হয়।সে আর বেশি সময় না নিয়ে তুরকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয়।কাতর হয়ে বলে,
‘আমার থেকে নিজের অজান্তেই অনেক বড় ভুল হয়েছে বউ।দয়াকরে আমায় মাফ করে দাও।কথা দিচ্ছি আর কখনো এমন হবে না।তবুও তুমি কান্না করো না পাখি।’
নিষ্প্রভের বুকের মধ্যে তুর থাকতে চাইছে না,ছটফট করছে আর বলছে,
‘ছাড়েন আপনি আমায় স্পর্শ করবেন না।আমি খারাপ মেয়ে তাহলে আমার কাছে আসছেন কেন? ভালো মেয়ের কাছে যান।আমি তো আপনার চোখে দুঃ’চ’রি’ত্রা। আমি আপনার কাছে থাকবো না।’
বলেই নিষ্প্রভকে ধাক্কা দিতে শুরু করে। নিষ্প্রভকে এক চুল ও নড়াতে পারে না। নিষ্প্রভ বলে,
‘তুমি এমন করো না বউ। আমার ভুল আমি স্বীকার করছি। আমি তোমার পা’য়ে পড়ি। তুমি যা বলবে এখন থেকে আমি তাই করবো।আগের সবকিছু ভুলে আমরা নতুন করে সব শুরু করবো।ওসব ডিভোর্স বাদ,তোমাকে তিন কবুল বলে বিয়ে করছি দরকার হলে এবার ছয় কবুল বলে বিয়ে করবো তাও তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না।আমি আমার ভুল বুজতে পেরেছি মাফ করে দেও বউ।’
এসব বলে নিষ্প্রভ তুরের পা ধরতে যায়।তুর নিষ্প্রভের সব কথা মনোযোগ সহকারে শুনছিলো শেষের কথা শুনে তুর তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে।মানুষটা ক্ষমা চাইছে নাকি তারসাথে ম’শ’ক’রা করছে।ছয় কবুল বলে বিয়ে করবে? আদেও কেউ ছয় কবুল বলে এর আগে বিয়ে করেছিলো নাকি!
‘পাগলের বাচ্চা’
এই কথাটা বলেই তুর তাড়াতাড়ি ফ্লোর থেকে উঠে রুমে এসে বারান্দার দরজা লাগিয়ে দেয়।নিষ্প্রভ বেচারা বারান্দায় বন্দি হয়ে থাকে। নিষ্প্রভ চেঁ’চি’য়ে বলে,
‘এটা কি হলো?’
‘শাস্তি ,আপনি এভাবেই থাকেন।’
‘ওহ এভাবে কিছুক্ষণ থাকলে তুমি আমায় ক্ষমা করে দিবে।’
নিষ্প্রভ প্রফুল্ল কন্ঠে বলে।তুর একটু কন্ঠ বাড়িয়ে বলে,
‘জি না! এটা আমাকে ছয় কবুল বলে বিয়ে করতে চাওয়ার শাস্তি।বাকি গুলো নিয়ে পড়ে ভাববো’
নিষ্প্রভ অসহায় হয়ে বলে,
‘যাহ্ বাবা এটা কি হলো।তিনের জায়গায় ছয় বললাম যাতে করে অন্য বউয়ের থেকে আমার বউয়ের মনে স্বামীর প্রতি ভালোবাসটাও বেশি হয়, থাক তো ভালোবাসা আমার বউ এর জন্য আমার শাস্তির ব্যাবস্থা করলো।এই শীতে ভোর বেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিষ্প্রভ ঠান্ডায় কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা ঠোঁট সে এসব বলল।’
___________________
সকাল দশটা! নিষ্প্রভ এক নাগাড়ে হাঁচি ফেলছে।তুর বেশ মজা পাচ্ছে। লিভিং রুমে ইলিয়াস মির্জা ও আশা বেগম বসেছিলো।আফসানকে কি ভাবে ছাড়ানো যায় সেই বুদ্ধি করছে। ইলিয়াস মির্জা বিশ্বাস করে আফসান নির্দোষ।তুর ও নিষ্প্রভ খাবার টেবিলে বসে। হঠাৎ করেই সদর দরজার কলিং বেল বেজে ওঠে। সিতারা দরজা খুলে দেয়।একটা অচেনা ভদ্রলোক প্রবেশ করে।আশা বেগম বসে থাকা অবস্থায় দাঁড়িয়ে পড়ে। ইলিয়াস মির্জা অজ্ঞাত লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘আপনি কে আপনাকে তো চিনলাম না!’
লোকটি গমগমে স্বরে বলে,
‘আমি আফসানের বাবা……..’
চলমান।।
*বিঃদ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।
হৃদয়ের সন্ধিক্ষণ ১৭পর্ব পর সব গুলো চাই