তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ১৮.

0
705

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৮.
পানি ছাড়া মাছের মতো ছটফট করতে করতেই সকাল গড়িয়ে দুপুর তারপর বিকেল এলো। ঘড়িতে চারটা বাজে। ঠিক পাঁচটায় অন্তির ব্যাচ। এই সময়টার অপেক্ষাতেই চাতক পাখির ন্যায় সময়ের কাটা গুনেছে সে। এই অপেক্ষার অল্প সময়টুকু তার কাছে কয়েকশত বছরের সমান ঠেকেছে। অপেক্ষার প্রহর সত্যিই ভিষণ বড় হয়। সময়ের কাটা যেন একই জায়গায় চক্রাকারে ঘুরছে। অপেক্ষার প্রহর কাটলো দীর্ঘ সময় নিয়ে। অন্যদিনের মতো আজ আর সাজগোজ করা হলোনা। চোখে লাগানো হলোনা কাজল আর না ঠোঁটে লাল রঙ। সাদামাটা ভাবেই পোশাক পাল্টে নিলো। চুল বাঁধার সময় আয়নায় নিজেকে লক্ষ্য করতে চমকে গেলো। সে যেন নিজের এক অন্যরূপ দেখতে পাচ্ছে। একদিনেই কেমন বদলে গেছে সে। চোখ গুলো গর্তে চলে গেছে। লাবন্যময়ী চেহারা ফ্যাকাসে রূপ ধারণ করেছে। মাত্র একটা দিনের তফাৎ এ কতকিছু ঘটে গেল! কি অদ্ভুত নিয়ম জীবনের।
অন্তি রুম ছেড়ে বেরহতেই দেখলো নাহার ডায়নিং এ বসে বাদামের খোসা ছাড়াচ্ছে। সাহেদ রোজ নিয়ম করে গুটাকয়েক কাঁচা বাদাম খায়। তার হাঁটুতে ব্যাথার রোগ রয়েছে। ডাক্তার তাকে ক্যালসিয়াম জনিত সকল প্রকার খাবার খেতে বলেছেন। এ জন্যই সে এই বাদাম খান।
অন্তিকে দেখা মাত্রই নাহার চোখ কুঁচকে ফেললেন। এমন সময় কোথায় যাচ্ছে মেয়েটা তা না জানার মতো করে প্রশ্ন করলেন,

‘কোথায় যাচ্ছিস?’

এমন প্রশ্নে অন্তিও খানিক অবাক হলো। সে তো রোজ এ সময়ে ব্যাচে যায়। এটাতো নতুন কিছু না। তবুও ছোট করে সে জবাব দিলো,

‘ব্যাচে।’

নাহার ভিষণ স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠলো,

‘ব্যাচে যেতে হবেনা আর। তোর বাবা বাসায় টিচার ঠিক করেছেন। কাল থেকে পড়াতে আসবে।’

অন্তির পা থেমে যায়। চোখে মুখে বিস্ময় খেলে যায়। অবাক গলায় বলে,

‘বাবা টিচার ঠিক করেছে? আমাকে তো জানালো না?’

নাহার বাদাম গুলো একটা কাঁচের বোয়ামে রাখতে রাখতে বেশ সাবলীল ভাবেই বললেন,

‘এখানে জানানোর কি আছে? সে যেটা ঠিক মনে করেছে সেটাই করেছে। মেয়ের ব্যাপারে বাবা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এখানে তো অস্বভাবিক কিছুই দেখছি না।’

অন্তি টু শব্দ ছাড়া রুমে ফিরে এলো। মায়ের স্বভাব সম্পর্কে সে অবগত। এইযে সে অতি স্বাভাবিক আচরণ করছে এটাও অস্বভাবিক। কিন্তু বাবা? সে তো অন্তিকে বোঝে। তাহলে সে কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করছে? অন্তির চিৎকার করে কাঁদতে মনে চাচ্ছে। নিজের পরিবারের প্রতিটা মানুষকে তার বড্ড অচেনা বলে মনে হচ্ছে। দম বন্ধ লাগছে। কাঁধের ব্যাগ খুলে দূরে ছুড়ে ফেলে। টানটান হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। রাগে দুঃখে চোখ গড়িয়ে পানি পড়ে মেয়েটার। বা হাতে চোখের পানি মুছে কাঙ্খিত মানবটার নম্বরে ডায়াল করতেই ওপাশ থেকে নারী কন্ঠ‌ জানালো, এ মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না…
মানুষটার নম্বর রাত ছাড়া দিনের যেকোনো প্রহরে বন্ধ পাওয়া যায়। দুশ্চিন্তায় অন্তির মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। দুশ্চিন্তা‌ গুলো যেন‌ গলায় কাঁটা আকারে আটকে আছে। এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে কিন্তু এ ব্যাপারে তন্নি বা দিহান কেউ‌ কিছু জানে না। অন্তি তন্নিকে ইচ্ছা করেই কল করলো‌ না। মেয়েটা বড্ড ভীতু ধরণের। এমন কিছু জানলে কেঁদে কেটে সাগর বানিয়ে ফেলবে হয়তো। তখন সমবেদনা পাওয়ায় চিন্তা বাদ দিয়ে তাকে সমবেদনা জানাতে হবে। তাই ঐ চ্যাপ্টার সে আগেই অফ করে দিয়েছে।

_____________

সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। সারাদিন বাইক কিংবা জিপে করে ছুটতে থাকা ছেলে গুলোকে আজ রাস্তার প্রাঙ্গনে দেখা গেলো না। না দেখা গেলো চায়ের দোকানে আড্ডা। দীর্ঘদিনের নিয়ম ভেঙে আজ দিহান মির্জা আজ নিজেকে গৃহবন্দি করেছে। ঠিক বন্দি বলা চলে না, তার নিজ মর্জিতেই আজ সে ঘরে রয়েছে। তার এই হঠাৎ পরিবর্তন সবথেকে যে ব্যক্তিকে আশ্চর্য করেছে সেটা হচ্ছে তার মা। রেহানা এ পর্যন্ত তিন থেকে চারবার ছেলের ঘর থেকে ঘুরে গেছে। দু একবার বুকে কপালে হাত রেখে চেক করে গেছেন ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়লো কিনা। চিন্তায় তার প্রেশার ফল করেছে। ছেলেটাকে নিয়ে এমনিতেই তার দুশ্চিন্তার শেষ নেই, তার উপর হঠাৎ এমন পরিবর্তন তাকে আরো চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। দিক শূন্য হয়ে সে নুহাশকে কল করে। ছেলের কাছের বন্ধু বলতে নুহাশকেই চেনেন তিনি। তার ব্যাকুলতায় নুহাশ তাকে আশ্বস্ত করলো কিছুক্ষণের মাঝেই সে আসছে। ঠিক তাই হলো। দশ মিনিটের মাথায় আগমন ঘটলো নুহাশের। রেহানা ড্রয়িংয়ে বসে ছিলেন। কাজের মহিলা দরজা খুলে দেয়। নুহাশকে দেখতেই রেহানা তাকে হাসিমুখে ভেতরে ডাকেন। মিষ্টি হেসে বলেন,

‘তোমাকে তো দেখাই যায়না বাবা। মাঝে মধ্যে তো আসতে পারো?’

নুহাশ বোকা হাসে। সে কেন আসে না তা যদি আন্টি জানতো!

দিহানকে আজকাল কেমন অন্যধরণের মানুষ বলে মনে হচ্ছে নুহাশ। যেই ছেলে সারাদিন শুয়ে বসে থেকে আড্ডা আর রাজনীতি নামক ঝামেলায় জড়িয়ে থাকতে পছন্দ করে সে আজকাল নিজেকে আড্ডা, মারামারি থেকে দূরে দূরে রাখছে। এই তো আজ সকাল সকাল কল এসেছে পার্টি অফিস থেকে। অন্যান্য সময় কল আসা মাত্র সে প্রস্থান করে কিন্তু আজ সুস্থ সবল মানুষটা অসুস্থতার দোহাই দিয়ে থেকে গেল। দিহান মির্জাকে অবিশ্বাস করার কথা কেউ ভুলেও ভাববে না। এমন শক্ত সমর্থ এক কথার পাথুরে মানুষটাকি মিথ্যা বলতে পারে? নিজ চোখে না দেখলে হয়তো নুহাশ ও কখনো বিশ্বাস করতে পারতো না। নুহাশকে অন্যমনষ্ক দেখে দিহান ওর দিকে কুশান ছুঁড়ে মারে।

‘তোকে আমার নীতিবান বাপ দেখেনি আসতে?’

নুহাশ অসহায়ের মতো মুখ করে জবাব দেয়,

‘দেখলে তোর রুম অবদি আসার ক্ষমতা আমার থাকতো না ভাই। দরজা থেকেই জুতো হাতে পালাতে হতো। বুঝিনা ভাই আমি কি করলাম? আমার উপর এত জুলুম কেন?’

এর উত্তর দিহান খুব ভালো করেই জানে। তার পিতা মহাশয় ভাবেন তার ছোট বেপরোয়া ছেলেটা বিগরে যাওয়ার একমাত্র কারণ এই নুহাশ। এমন বাউন্ডুল ছেলের সাথে মিশেই তার সোনার ছেলে তামায় পরিণত হয়েছে। দিহান পিঠের পেছনে বালিশ দিয়ে হেলান দেয়। নুহাশের কথাকে পুরোপুরি ভাবে এড়িয়ে গিয়ে প্রশ্ন করে,

‘রূপের সাথে যে ছোট খাটো করে মেয়েটা ওর নাম যেন কি?’

নুহাশ না বোঝার মতো করে বললো,

‘কার কথা বলিস ভাই? মাইয়া মানুষের খোঁজ খবর কি আমি রাখি?’

দিহান ফিচেল হাসে। বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,

‘বেশ! আমি লোক পাঠিয়ে নাহয় খোঁজ নিব। ভাইয়ার জন্য মা মেয়ে দেখতে বলছে। ভাইয়া খুব চুজি জানিস তো! ভাবলাম ভাবী হিসেবে ঐ মেয়েটাকে বেশ মানাবে! মেয়েটা একদম ভাইয়ার টাইপ।’

নুহাশের মুখ কালো হয়ে এলো। এই মির্জা বংশটাই খারাপ। বাপ ছেলে কেউ তাকে সহ্য করতে পারে না। এদের কোন জমিতে আগুন দিয়েছিল সে? মন চায় গুল্লি মেরে উড়াই দিতে সব। কিন্তু মনের এসব আক্ষেপ সে প্রকাশ করলো না। মিনমিনে গলায় বললো,

‘কি জানতে চাস বললেই তো হয় ভাই। শত্রুর মতো আচরণ করোস কেন?’

দিহান সোজা হয়ে বসে। বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

‘ওর থেকে রূপদের বাসার নকশাটা ম্যানেজ করবি।’

কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যাওয়ায় যেমন রিয়্যাকশন হওয়ার কথা তার থেকেও ভয়ানক রিয়্যাকশন দেখা দিলো নুহাশের মাঝে। যেন সে আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে পাতালের গভীরে হারিয়ে গেছে।

‘কি বলিস? ডাকাতি করবি ভাই?’

দিহান বাঁকা হাসে। ল্যাপটপ অন করে কোলে নিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে কিছু একটা করতে লাগে। মাঝ পথে কথা থামানোতে নুহাশ মহা বিরক্ত হয়। দিহানের এই স্বভাবগুলো তার কাছে বড্ড অসহ্য ঠেকে। ব্যাটা যা বলবি সরাসরি বলবি। ধর তক্তা মার পেরেক টাইপের। তা না করে এত ভনিতা কেন?

‘বা*ল মেজাজ খারাপ হয় কিন্তু। ক্লিয়ার করনা ভাই।’

নুহাশ ভাবেনি দিহান এত দ্রুত মুখ খুলবে। অবশ্য আজকাল দিহানের সকল কার্যক্রম তার ভাবনার বিপরীতে হয়। এক্ষেত্রে ও তেমন হলো। দিহান ভিষণ দাম্ভিকতার সহিত জানালো।

‘না হওয়া শ্বশুর সাহেব আমার প্রেম হওয়ার আগেই বিরহের ব্যাবস্থা করতেছে। ভাবতে পারিস? এমন বোকামি কেউ করে? বাঘের সামনে থেকে খাবার টেনে নিতে চাইছে! অথচ এটাই জানেনা যে, তার মেয়েকে তুলে আনতে আমার দু মিনিট সময়ের দরকার হবে না। বোকা শ্বশুর!’

নুহাশের অক্ষিকোটর থেকে চক্ষুদ্বয় বেরিয়ে আসার উপক্রম। তার কানদ্বয় সত্যি শুনছে? নাকি সবটা ভ্রম? ব্যাটা প্রেমে পড়েছে তা সে বহুআগেই বুঝেছে কিন্তু মুখ ফুটে এভাবে শ্বশুর বলার মতো প্রেমে পড়েছে এটা তার জানা ছিলো না। মানে ব্যাপারটা এতোটা গভীরে কখন এবং কিভাবে গেলো? সে কেনো জানলো না?
দিহান নুহাশের এহেন রিয়্যাকশনে কপাল বরাবর ভাঁজ ফেলে কাঠকাঠ গলায় বললো,

‘ঠিক যতটুকু বলেছি ততটুকুই ভাব, কম বেশি ভাবতে যাবি না। নয়তো তোর পথে কাঁটা হতে দুবার ভাববো না।’

নুহাশ দমে গেলো। চিন্তা ভাবনাকে ওখানেই ছুঁড়ে ফেললো। মেকি হেসে বললো,

‘তোর শ্বশুর, তোর শ্বশুরের মেয়ে, সবই তোর। অযথা আমি ভাবাভাবি কেন করবো? নো ওয়ে। আন্টি মাংস রান্না করছে। সেটাই ভাবছিলাম। আজ না খেয়ে যাচ্ছি না। তোর নীতিবান বাপটা মাঝখান থেকে না আসলেই হচ্ছে!’

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here