তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ২০.

0
519

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২০.
পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটে চলেছে। কেউ বাদররের মতো লাফঝাপ করে কেউবা মেধা দিয়ে। কিন্তু অন্তির সাথে ঘটা আশ্চর্য জনক ঘটনাটা ভিন্ন। অন্যসকল দিনের মতো আজও কলেজ ছুটি হলে তন্নির সাথে গল্প করতে করতে কলেজ গেটের পাশে দাঁড়ানো হয়। অসম্ভব ব্যস্ত রাস্তার ধারে কুঁচকানো কপাল নিয়ে অতিব বিরক্ত মাখা মুখে তন্নির কথার হুঁ হা জবাব দিচ্ছিলো সে। বিরক্তিটা মূলতো কাঙ্খিত কোনো রিকশা খুঁজে না পাওয়ায়। এ শহরে রিকশার সংখ্যা অসংখ্য হলেও তার প্রয়োজনে তাদের দেখা মেলা ভার হয়ে পড়ে। এই যে ত্রিসীমানায় রিকশার টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু অন্যসব সময় ‘আপা যাবেন কোই?’ প্রশ্ন শুনতে শুনতে হাঁটার মুডের ধফারফা হয়ে যায়। বাসা থেকে হেঁটে না যাওয়ার কড়া নিষেধ রয়েছে। এটা তার জন্য তার মায়ের তৈরি নতুন নিয়ম। আজ সকালেই বাবার মাধ্যমে তার সামনে পেশ করা হয়েছে। অন্তিও দ্বিমত করেনি। এসব ছোটখাটো ব্যাপারে সে মাথা খাটানো বন্ধ করে দিয়েছে বেশ কিছুদিন হয়েছে।
অন্তি বিরক্তে কুঁচকে আসা ভ্রুজোড়া আরো কিছুটা সংকুচিত করে বলে ওঠে,

‘আজ কি রিকশা ওয়ালাদের সরকারি ছুটি? আশ্চর্য!’

তার কথায় তন্নিও সমান ভাবে হতাশা প্রকাশ করে। পরক্ষণে কিছু মনে পড়েছে ভাব নিয়ে বলে,

‘দোস্ত? দিহান ভাইকে কল লাগা। দু মিনিটে রিকশা হাজির হয়ে যাবে। পাক্কা!’

তন্নির আইডিয়া অন্তির পছন্দ হলো না। থমথমে জবাব দিলো,

‘সামান্য রিকশার জন্য তাকে কেন লাগবে? আই ক্যান হ্যান্ডেল ইট!’

তন্নি বিপরীতে কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই ফরমাল গেটআপে একজন সুদর্শন পুরুষ এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। অপরিচিত কাউকে এভাবে সামনে দাঁড়াতে দেখে তন্নির কন্ঠনালি ওখানের বন্ধ হয়ে যায়। অন্তি তখনো ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। তন্নির হাতের চিমটিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ব্যাপারটায় সেও খানিক ঘাবড়ে যায়। এভাবে অচেনা কেউ সামনে অদ্ভুত নজরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে অস্বভাবিক। অন্তি মুহূর্তের মধ্যে বুঝে নেয় লোকটা নিঃসন্দেহে তন্নির কোনো সিক্রেট প্রেমিক। রূপবতী মেয়েদের অনেক প্রেমিক থাকে, হোক সেটা গোপনে কিংবা প্রকাশে। লোকটার চোখ ঘুরিয়ে বারবার তন্নির দিকে তাকানোর ব্যাপারটায় আপাতত তার সেটাই মনে হচ্ছে। কিন্তু ভদ্র সমাজে দাঁড়িয়ে লোকটার এমন অভদ্রের মতো আচরণ অন্তির পছন্দ হলো না। কাউকে পছন্দ হলেই বুঝি কথা বার্তা ছাড়া এভাবে মুখের সামনে এসে দাঁড়াতে হয়? কথায় ভদ্রতা ধরে রাখতে চেয়েও অন্তি ব্যার্থ হলো। কিছুটা রুক্ষ কন্ঠে বলে উঠলো,

‘আপনাকে দেখে যথেষ্ট ভদ্র মনে হলেও আপনার কাজে তা চরম অভদ্রের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। তো এখানে কি চাই?’

এতক্ষণে লোকটা পুরোপুরি ভাবে অন্তির দিএ তাকায়। মোটা গ্লাসের চশমা গলিয়ে কিছুটা কৌতুহলি দৃষ্টি ফেলে বলে ওঠে,

‘আপনাদের মধ্যে রূপন্তি কে?’

পরপর তন্নির দিকে ইশারা করে বলে ওঠে,

‘বাবার বর্ণনা মতে অত্যন্ত চমৎকার দেখতে বলতে তাকে মনে হলেও কথার ধরণটা আপনাকে ইঙ্গিত করছে। আ’ম কনফিউজড!’

লোকটার কথার সারমর্ম বুঝতে না পারলেও তাকে কেন খোঁজ করছে ব্যাপারটায় ভিষণ কৌতুহল বোধ করলো। সে কিছু বলার আগেই তন্নি উঠলো,

‘কনফিউজড হওয়ার কি আছে? আমরা দুজনেই রূপন্তি। এবার ঝটপট বলে ফেলুন কি চাই?’

তন্নির জবাবে লোকটা মুচকি হেসে জবাব দিলো,

‘তাহলে তো বেশ হয়। ওয়াইফ হিসেবে আমার দুজনকেই পছন্দ হয়েছে।’

তন্নি‌চুপ হয়ে যায়। দেখতে সভ্য মনে হলেও লোকটা চরম অসভ্য। অন্তির হঠাৎ টনক নড়ে। সে সন্দিহান গলায় বলে,

‘আপনি আরাব?’

‘এতক্ষণে চিনতে পারলেন! যাক চিনতে পেরেছেন তাতেই খুশি আমি।’

‘কিন্তু এখানে কেন এসেছেন?’

‘আপনাকে দেখতে। অবশ্য অনেক দিন ধরেই আসার‌ প্লান করছিলাম, কিন্তু সময় করে উঠতে পারিনি। আজ কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ায় ভাবলাম আপনাকে ছোটখাটো একটা চমক দেই!’

আরাব লোকটাকে অন্তি মোবাইলের মাঝে দেখে যেমনটা ভেবেছিলো লোকটা পুরোটাই তার ভিন্ন। যথেষ্ট সুন্দর হলেও লোকটা ভিষণ রকম ফ্লার্টি। কথার ধরণেই তা প্রকাশ পাচ্ছে। ছবিতে চোখে চশমা ছিলো না। কিন্তু বাস্তবে মোটা গ্লাসের চশমা চোখে থাকায় চিনতে পারেনি। এরকম একটা ছেলে কিভাবে তার বাবা তার জন্য পছন্দ করতে পারে? আর মা! তার মা কি জানে আরাব এমন ধরণের মানুষ? না জেনেই এই লোকটার প্রশংসায় মত্ত হয়ে পড়েছে সবাই। অন্যদিকে কোনো কিছু না জেনেই দিহানকে খারাপ চরিত্রের লোক বলে আক্ষায়িত করলো! অন্তার বুক আবারো ভারী হয়ে আসে। বিয়ের ব্যাপারটা এখনো দিহানকে বলা হয়নি। সে ভেবেছিল তাকে ভয় দিতে তর বাব মা অমন বলেছিলো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তাদের কথা সত্যি ছিলো, মাঝখান থেকে তাদের উপর বিশ্বাস করে সে নিজেই বোকা সাজলো।

‘কি ভাবছেন এতো? চলুন কোথাও বসি?’

অন্তি সরাসরি না করে দেয়।

‘আজ হচ্ছে না। দুঃখিত। আমার একটু কাজ রয়েছে।’

‘কি কাজ?’

অন্তি কিছুটা বিরক্ত গলায় জবাব দেয়,

‘এটা পার্সোনাল। আল্লাহ হাফেজ।’

তন্নির হাত শক্ত করে ধরে সামনে হাঁটা দিতেই চোখ পড়ে রাস্তার ওপারে। দিহান বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাইকটা নুহাশের। তবে আশপাশে নুহাশকে দেখা যাচ্ছে না। লোকটা সরু চোখে তাকিয়ে আছে।

‘দোস্ত! কথা বলবি না? তোর দিকেই তাকাই আছে।’

‘উহু। আমার থেকেও তার ওতবড় বুকে ভয় বেশি। রাস্তার মাঝে তার সাথে কথা বলা আমার মানা। ঢং সব।’

আরাব বোকার মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উল্টো পথে পা বাড়ায়। তাকে এভাবে ইগনোর করাটা তার সম্মানে আঘাত করেছে। কোনো মেয়ের থেকে সে এমন জবাব পায়নি। ব্যাপারটা ভিষণ অপমানজনক। এতটুকু মেয়ের কথার তেজ দেখে সে কিছুটা অবাক। যদিও তার কাছে চুপচাপ শান্ত সুন্দরী মেয়েটাকে ভালো লেগেছে খুব।

_______________

তন্নি খুব মনোযোগ দিয়ে অন্তিদের বাসার কাঠামো আকাচ্ছে। এটাকে ম্যাপ বললেই চলে। আঁকাআঁকি ব্যাপারটায় সে কখনোই ভালো না। মানুষ আঁকালে সেটাকে গরু বলেই বেশি মনে হয় দরণের দক্ষতা তার। এমন দক্ষতা নিয়ে বাড়ির ম্যাপ আঁকা বেশ চ্যালেন্জিং তার জন্য। এই চ্যালেন্জটাই গ্রহণ করেছে সে।‌ সেচ্ছায় নয়, নুহাশ নামক লোকটার গম্ভীর চাহনিতে। আজকাল তার মাথায় কিছু একটা ঘুরছে। লোকটার এমন নির্যাতনের জন্য তার নামে কেস ঠুকে দিলে কেমন হয়? পুলিশের ডান্ডির দু তিনটা আঘাতে ঠিক সোজা হয়ে যাবে। বজ্জাত লোক।
তন্নির ফোনে কল আসে। নম্বর দেখতেই তন্নি বিরবির করে বলে,

‘শয়তানের নাম নিতেই সে হাজির।’

ফোন রিসিভ না করেই ছোট ছোট পায়ে বারান্দায় যেয়ে দাড়ায়। এখন অল্প রাত। রাস্তায় মানুষের আনাগোনা খুব। নুহাশ দাঁড়িয়ে আছে তার বারন্দার নিচে। তন্নির তার আঁকা ম্যাপট ফোল্ড করে নিচে ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে রুমে ঢুকে যায়। কেউ তকে দেখে নিলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

রাত বেজে বারোটা। অন্তি দিহানের ফোনের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়েছে। রোজ নিয়ম করে এই সময়ে কল দেয় দিহান। কখনো বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। অন্তি তখন চুরি করে দেখা করতে যায় তার নাক উঁচু প্রেমিকের সাথে।‌ অন্তির ঘুম ভাঙে ফোনের শব্দে। ঘুম চোখে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আদেশ আসে,

‘ছাদে আসো।’

অন্তি বুঝতে না পেরে অস্পষ্ট গলায় বলে,

‘হু?’

‘তোমার বাসার ছাদে আসো। অপেক্ষা করছি। দেরী হলে রুমে চলে আসবো। সো ফাস্ট।’

অন্তির কপাল কুঁচকে আসে। বুঝতে দু মিনিট সময় লাগে। ফোন কেটে গেছে ততক্ষনে। যতক্ষণে বুঝতে পারে তার বুক ধক করে ওঠে। এই লোক ছাদে কিভাবে আসলো? নাকি ঘুমের ঘোরে সে স্বপ্ন দেখেছে? ফোনের ডায়াল লিস্টে দিহানের নাম্বার দেখতেই শিওর হয় সে। কোনো রকম গায়ে ওড়না জড়িয়ে পা টিপে ঘর থেকে বের হয়। ছাদ পুরোপুরি অন্ধকার। লাইটটা দুদিন হলো কেটে গেছে। লোহার গেট ঠেলে ছাদে পা‌ রাখতেই তার‌ ভেতর হাল্কা ভয় লাগা কাজ করে। যদি দিহান এখানে না থাকে? এর বেশি ভাবার অবকাশ পেলো‌না সে। শক্ত একটা হাত তার নরম হাতকে আঁকড়ে ধরে তার দিকে টেনে নিলো। হাতের কঠিন বন্ধন অনুভব হতেই অন্তির বুক শান্ত হয়ে আসে। এই হতের অধিকারীকে তার চেনা। খুব বেশিই চেনা।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here