তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ২২.

0
717

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

২২.
চোখের পলকের মাঝেই যেন সময় কেটে যেতে লাগলো। বাড়তে লাগলো ভালোবাসায় ঘেরা পাগলামি গুলো। অন্তি মাঝে মাঝেই দিহানের ভিন্ন রূপ দেখে হতবাক হয়, মনে হয় লোকটাকে চিনতে তার এখনো বহু বাকি। তাদের কথা হয় খুব কম। দেখা হয় হুটহাট। তবুও অনুভূতি যেন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে হুরহুর করে বেড়ে চলছে।
রাস্তায় লোকটা তাকে খুব করে এড়িয়ে চলে। অপরিচিতর মতো আচরণ করলেও সেই আচরণ অন্তিকে আঘাত করতে পারেনা কখনো। রাস্তা পার হওয়ার ব্যাপারেও কি সূক্ষ্ম নজরদারি! দূর থেকেও যত্ন নেওয়া যায় এই কথাটার প্রমাণ অন্তি দিহানের থেকেই পেয়েছে। একটা মানুষ এতটা পর্ফেক্ট কিভাবে হতে পারে?

এখন নভেম্বর মাস বিদায় নেওয়ার পথে। ঠান্ডা পড়েছে খুব। অন্যবছরের তুলনায় এবার শীতের প্রকোপ কিছুটা বেশি। বর্ষপঞ্জিকার হিসেবে আজ নভেম্বরের ২৯ তারিখ। এখন ভোর ছয়টা। বাহিরে কুয়াশারা কুন্ডলী পাকিয়ে পাক খাচ্ছে চারদিকে। কাছের জিনিস ও কেমন ধোঁয়াশা মনে হয়। এই শীতের সকালে যেখানে বাড়ির সকলে লেপের ওমে শান্তির ঘুম দিচ্ছে, অন্তি সেখানে পাতলা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে রান্নাঘরে হাজির। উদ্দেশ্য হালকা কিছু রান্না। আজ তার প্রিয় পুরুষটির জন্মদিন বলে কথা।

রান্নাঘরের ছোট্ট জানালাটা‌ খুলে দেওয়া। হুরমুর করে শীতল বাতাস প্রবেশ করছে চিকন লোহার বেদ পেরিয়ে। জানালার পাশেই এ বাড়ির সবথেকে পুরোনো সজনে গাছটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। যার বিস্তার ডালপালা থেকে হলদে রঙের পাতা গুলো ঝরে ঝরে পড়ছে। জানালা গলিয়ে আসা বাতাসে শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তবুও অন্তির ভালো লাগছে। ভালোলাগার সময় গুলোতে বোধহয় বিষ ও মধুর মনে হয়!

ইউটিউব থেকে সিলেক্ট করা রেসিপিটা প্লে করে সামনে রেখে রান্নায় মনোযোগ দিলো অন্তি। রেসিপিটা হোমমেড নুডুলসের। রান্নার সবথেকে প্রয়োজনিয় উপাদান হচ্ছে ময়দা। কিন্তু সমস্যা হলো প্রয়োজন ব্যাতীত সখের বসেও কখনো রান্নাঘরে পা ফেলা হয়নি তার। রান্নার উপকরণ কোনটা কোথায় আছে তা সম্পর্কে নূন্যতম ধারণা নেই তার। একটা ডিম ভাজতে কতটুকু লবণ লাগে তার হিসাব না জানা অন্তি এতবড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভাবতেই সে অবাক। বলতেই হবে তার সাহস আছে! অনেক খুঁজে তাকের উপরে সে তার কাঙ্খিত জিনিস দেখতে পেল। কিন্তু এখানেও শান্তি নেই। পাশাপাশি দুটো বোয়ামে রাখা সাদা বস্তু দেখে চেনার উপায় নেই কোনটা ময়দা কোনটা আটা। কপাল বরাবর ভাঁজ ফেলে বিচক্ষণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেও কোনো সুরহা না হলে রান্নাঘরের পাশের ছোট কক্ষে হামলা চালায়।
এ বাড়িতে সবার জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষ রয়েছে। এ কক্ষটি কাজের মেয়ে পারুর জন্য বরাদ্দ। দরজায় ধুমধাম আঘাতে পারু বিরক্ত হয়েই কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসে। দরজার সামনে অন্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার বিরক্তির মাত্রা আরো এক কাঠি উপরে উঠে যায়। বড়োলোক বাড়ির ন্যাকা ধরনের মেয়ে মানুষ তার পছন্দ না। এরা নিজের জামাটাও ধুয়ে গায়ে জড়াতে পারে না। শুধু পারে উঠতে বসতে হুকুম জারি করতে।

‘সকাল সকাল আপনের কি লাগবে আবার? শীতের দিন সাতটার আগে আমি উঠবার পারতাম না, আগেই জানাইছি।’

‘উঠতে হবে না। দু সেকেন্ডের জন্য রান্নাঘরে আয়। ময়দার বোয়াম কোনটা বললেই তোর ছুটি।’

পারু না বোঝার মতো করে বলে,

‘কি কন?’

অন্তি বিরক্ত জবাব দেয়,

‘ময়দা লাগবে আমার। বোয়ামটা দিয়ে যা।’

পারুল এবার কন্ঠে কৌতুহল ধরে বললো,

‘ময়দা কি করতেন? রূপচর্চা?’

অন্তি চোখ‌ কটমট করে চাইতেই পারু থেমে যায়। তার মুখ সর্বদা তার আগে দৌড়ায়। মুখ বন্ধ হলেও পারুর কৌতুহল দমে না। আজ এ ব্যাপারে তদন্ত করে দিহানকে গরম গরম নিউজ দিবে সে। দুশো টাকা বাড়ায়ে চাইবে। ঘুম রেখে তদন্ত করার জন্য দুশো টাকাতো বাড়তি লাগবেই! না দিলে সে ও কাজে না করে দিবে। তদন্তর কাজ অত সহজ নাকি?

_____________

গতকাল রাত থেকে দিহানের কোনো খোঁজ নেই। হঠাৎ করেই যেন নিরুদ্দেশ হয়েছে মানুষটা। মোবাইল ফোনও বন্ধ বলছে। রেহানা সারারাত ছেলের চিন্তায় দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি। পুরোটা রাত কেটেছে সোফায় বসে অপেক্ষা করতে করতে। ভয়ে মুখ ফুটে ছেলের বাড়িতে না ফেরার কথা স্বামীকেও জানাতে পারেনি। আবার নতুন কোনো অশান্তির ভয়ে মুখ বন্ধ রাখলেও সকাল দশটা পেরুলে ভয়ে বুকটা ধক করে ওঠে। স্বামীকে না জানিয়ে ভুল করলো কি? রেহানার বুক শুকিয়ে আসে। মনের ভেতর কেমন কু ডাকছে। কোনো বিপদ হলো না তো? এই তো সকালে গতকাল সকালে নাস্তা শেষে কত হাসিখুশি ভাবে ঘর থেকে বের হলো তার ছেলেটা।
এদিকে নুহাশকে কল করলেও যথাযথ কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। নুহাশকেও সমপরিমাণ চিন্তিত মনে হয়েছে। রেহানা দিক শুন্য হয়ে বড়ো ছেলেকে কল করলেন। রেহানকে এসময় কল করলে কখনোই ফোনে পাওয়া যায়না। থানার নম্বরে কল করলে তাকে পাওয়া যেতে পারে। অফিস আওয়ারে পার্সোনাল ফোন ইউজ করেনা সে। রেহানার কাছে রেহানের থানার নম্ব নেই। ফোনে পাবেনা জেনেও পরপর দুবার কল করলো। ফলাফল পরিবর্তন হলো না। রেহানা দুশ্চিন্তায় কান্নায় ভেঙে পড়লেন। ঘরের কাজের মহিলা মিনু দৌড়ে আসেন।

‘আপা কাইন্দেন না। ভাইজানরে জানাই?’

রেহানা ফোন এগিয়ে দেয়। মুখে আঁচল চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে। মুখে বলে,

‘দিহানের বাপকে কল কর। বাসায় আসতে বল তাকে।’

মিনু বেগম সম্মতি জানায়। তৎক্ষণাৎ মুঠোফোন হাতে কল করে রেজওয়ান মির্জাকে। কিন্তু সময় কিংবা ভাগ্য কোনোটাই তাদের সাথে ছিলো না। রেজওয়ান মির্জার ম্যানেজার কল রিসিভ করে জানান তিনি বর্তমানে জরুরি কোনো মিটিং এ রয়েছেন। ঘন্টা খানেক সময় বাদেই তিনি ফ্রি হবেন। মিনুর মুখ শুকিয়ে আসে। ফোন কাটার পর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। রেহানার কান্না‌ দেখে তার ও কান্না পাচ্ছে।

‘তোর ভাইজান কি বললো মিনু?’

মিনু জবাব দেয়না। তার শুকনো মুখ দেখেই রেহানা বুঝতে পারে এখানেও কাজ হয়নি। চোখের পানি বাঁধ ভাঙে। মিনু ব্যর্থ শান্তনা দিতে চেষ্টা করে।

‘দিহান বাবা ছোট না আপা। চিন্তা করবেন না। পোলা মানুষ, আছে হয়তো বাইরে কোতাও। বাড়িতে আসলে এবার আপনে একটু কঠিন হবেন। আপনে কঠিন না হলে পোলা সোজা হইবে না।’

_____________

অন্তি আজ ভয়ংকার এক কান্ড ঘটিয়েছে। তন্নিদের বাসায় যাওয়ার কথা বলে সে সরাসরি মিরপুর থেকে গুলশানে চলে এসেছে। হাতে তার ছোট একটা বাগ। তার মধ্যে রয়েছে তার হাতে রান্না করা নুডুলস। এই সামান্য নুডুলস নিজ হাতে প্রিয় পুরুষটিকে খাইয়ে দিতেই তার মিরপুর থেকে গুলশান অবদি আসা। মিরপুরের আনাচে কানাচে সর্বত্রে দিহানের পরিচিত লোকের সমগম। কোনো‌ এক অঙ্গত কারণে দিহান সবার থেকে অন্তিকে আড়াল করে রাখতে চায়। এর কোনো সঠিক কারণ অন্তির জানা নেই। তবে একটা চাপা কৌতুহল বোধ তাকে সর্বদা তাড়া করে বেড়ায়। প্রেমের এতদিন হয়েগেলেও দিহানের সাথে অফিসিয়ালি তার কখনো মিট করা হয়নি। হাত হাত রেখে হাঁটা হয়নি। পাশাপাশি বসে গল্প করা হয়নি। যা হয়েছে সব ভীষণ গোপনে।‌ নিভৃতে!
এজন্য পরিচিত জায়গা থেকে‌ দূরে আসা। উদ্দেশ্য কেবল প্রিয় মানুষটার সাথে কিছু মুহূর্ত কাটানো। অন্যসব প্রেমিক যুগলদের মতো কফি খেতে খেতে গল্প করা। সুযোগ পেলেই আলতো হাতে হাত ছুঁয়ে দেওয়া! এছাড়া আর কি? এইতো তার চাওয়া! অন্তি নিজ মনে হাসে। সে বড্ড লোভী হয়ে পড়েছে। ভীষণ রকম নির্লজ্জতা তকে ঘিরে ধরেছে। এইযে সে এসব ভাবছে তা কি তার প্রেমিক পুরুষটা জানে? জানলে কি সে অবাক হবে? বিস্ময় ঘেরা গলায় বলবে,

‘তুমি তো ভীষণ ভয়ংকর রূপ! দিনে দুপুরে আমাকে লুট করার ছক কষছো! মায়া হয়না তোমার?’

অন্তি হাসে। ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে। এগারোটার বেশি বাজে। তার হাতে এখনো পুরো সাত ঘণ্টা সময় রয়েছে। আসার পূর্বে দিহানকে টেক্সট করে এসেছে। সাহেব নিশ্চই কিছুক্ষণের মাঝেই হাজির হবেন। দেরী করার অভ্যাস নেই তার!
বুক ভরে শ্বাস নেয় অন্তি। এটাই তার‌ প্রথম একা এতটা পথ পারি দেওয়া। এটাই প্রথম বাড়িতে মিথ্যা বলে বের হওয়া। তার কি অনুশোচনা হওয়া উচিত? পরিবারকে ধোঁকা দেওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? পরক্ষণে অন্তির মন শক্ত ভাবে জবাব দেয়,

‘অবশ্যই উচিত‌ নয়। আমি তাদের কখনোই ধোঁকা দিতে চাইনি। তারা আমাকে বাধ্য করেছে এ পথকে বেছে নিতে।’

নিজ মনের শক্ত জবাবে কিছুটা অপরাধ বোধ ম্লান হলেও বুকের কোথাও একটা ভার অনুভব হয়। সাথে কিছুটা অস্বস্তি বোধ। আশপাশে এত এত মানুষের ভীড়ে একা দাঁড়িয়ে থাকতে কিছুটা আশঙ্কিত হয়। অহরহ গাড়ির হর্ণের শব্দে মাথা ভারী হয়ে আসতে চায়। অদ্ভূত এক ধরণের অনুভূতি তকে কাবু করে আনে। ঝকঝকে দিনটাকেও তার কাছে কেমন অন্ধকারে ঘেরা এক মন খারাপের দিন বলে মনে হচ্ছে। এমন তো হওয়ার কথা নয়! সামান্য পথ পাড়ি দিতে এতটা আতঙ্ক তাকে কাবু করার কথা নয়! তবে কেন? অন্তি বারবার ফোনের স্ক্রিনে নজর বুলিয়ে বিরবির করে,

‘দিহান দ্রুত আসুন। আমি ভয় পাচ্ছি!’

অন্তি বেছে সুন্দর গোছানো নিরব পরিবেশের একটা কফিশপে ঢুকেছে। ঢোকার পথে সুন্দর করে শপের নামটা দিহানকে টেক্সট করে দিয়েছে। বাহিরের ধুলাময় পরিবেশের তুলনায় এখানে নিরবে বসে থাকাটাই তার কাছে উপযুক্ত বলে মনে হয়েছে। অন্তি এক কাপ কফি অর্ডার করে জানালা থেকে বাহিরে নজর দেয়। এই রেস্টুরেন্টটা তৃতীয় তলায় অবস্থিত। তৃতীয় তলার উপর থেকে রাস্তার ভিউটা বেশ ভালো লাগছে। অন্তি আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। ক্লান্তহীন চোখ দুটো শতশত মানুষের ভীড়ে পরিচিত পুরুষটিকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়। ছুটতে থাকা গাড়িগুলোতেও দৃষ্টি আটকে পড়ছে। এই বুঝি সে এলো! ধোঁয়া ওঠা কফি ঠান্ডা হয়ে আসে। অন্তির চোখ দুটো ক্লান্ত হয়ে আসে। তবুও পরিচিত মুখটার দেখা মেলে না। অন্তি ক্লান্ত ভঙ্গিতে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। শপের এক সাইডে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা বুকসেল্ফ দেখে সেদিকে এগিয়ে যায়। চোখ আটকায় হুমায়ূনের ‘অপেক্ষা’ উপন্যাসের উপর। কেন যেন তার এই মুহূর্তে এই উপন্যাসটাই খুব করে টানছে। হয়তো এই উপন্যাসের এই নামটার বদৌলতেই!

চলবে……..

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালোবাসা নিবেন ❤️)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here