তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত #লাবিবা_আল_তাসফি ১৭.

0
715

#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি

১৭.
আবেগ, এই জিনিসটা মানুষের মধ্য থেকে বিবেগকে টেনে হেঁচড়ে বের করে আনে। সাময়িকী ভাবে জ্ঞান বুদ্ধিকে শুন্যের কোঠায় নামিয়ে আনে। অন্তি নিজেও জানে না তার এই ছোট একটা স্বীকারোক্তি তার জন্য কতটা যন্ত্রণাদায়ক হতে চলছে। তার বোকা মন খানিকের জন্য ভেবে নিয়েছিল পরিবারকে তার পছন্দের কথা জানালে তারা হয়তো সবসময়ের মতো করে তার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলবে,

‘এতে এত কান্নার কি আছে? আমার মেয়ে যা চাইছে সেটাই হবে।’

কিন্তু এটা কেবল তার ভ্রান্ত ধারণা হয়েই থাকলো। বাস্তবটাতো ছিল ভিন্ন কিছু! তার কথা শেষ না হতেই গালে দানবীয় আঘাতে ছিটকে পড়লো অন্তি। নিমিষে কি হলো কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারলো না সে। মাথার ভেতরটা কেমন ঝিম ধরে গেছে। এত তীব্র আঘাত এর পূর্বে কখনো সে কারো থেকে পায়নি। জল ভরা দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকাতেই তার বুকের ভেতরা কেঁপে ওঠে। নাহার অত্যন্ত শীতল দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। এত জোরে মেয়েকে আঘাত করেও তার ভেতর নূন্যতম ব্যাকুলতা দেখা গেলো না। কিন্তু অন্তির ঠিক মনে পড়ছে বেশ কিছুদিন পূর্বে অন্তি নিজ থেকে ডিম ভাজতে গিয়ে সামান্য তেল ছিটে পড়েছিল হাতে। ঠিক কতটাইনা ব্যাকূল হয়েছিলো সেদিন নাহার! চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছিলো। তার ফুলের মতো মেয়েটার হাতের ছোট্ট একটা অংশ জুড়ে লাল হয়ে ছিলো, এ সামান্য জিনিসটা তাকে কতই ঞা পিড়া দিয়েছিল! তবে আজ? অন্তি মাথা ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকায়। তার বুকটা আরো ভারী হয়ে আসে। সাহেদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। অন্তি দিশেহারা হয়ে পড়েছে যেন। কি এমন ভুল করেছে সে? এমন অদ্ভূত আচরণ কেন করছে সবাই? কেউ কিছুই বলছে না। এই নিরবতা বড্ড যন্ত্রণা দেয় তাকে। সহ্য না করতে পেরে কেঁদে উঠে বলে,

‘কি ভুল করেছি আমি? কেন এমন করছো তোমরা?’

তার এ কথার জবাব কেউ না দিলেও তার বড় চাচা গম্ভীর স্বরে তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘আমাদের পরিবারের এ সমাজে একটা মর্যাদা আছে সাহেদ। আমাদের পরিবারের ছেলে মেয়েরা শিক্ষিত এবং সভ্য। আমরা আমাদের পরিবারের সাথে তেমনি কোনো‌ ভদ্র সভ্য পরিবারের আত্মীয়তা করবো। তোমার মেয়েকে বোঝাও। এখনো সময় আছে। সময় থাকতেই ভুল শুধরে নাও।’

সাহেদ বড় ভাইয়ের কথায় লজ্জায় মাথা নুইয়ে নেয়। জবাবা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে সে। তার এত অহংকার যে মেয়েকে নিয়ে সেই মেয়ের কারণেই কিনা আজ তাকে এভাবে মাথা নামিয়ে রাখতে হাচ্ছে। বুকটা অসহ্য জ্বলছে তার। অতি আদরে কি সত্যিই মেয়েটাকে বিগড়ে ফেলেছে সে?

শাহিন সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। যাওয়ার জন্য প্রস্তুত নিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে।‌ ফ্লোরে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকা অন্তিকে একবার পরখ করে বলে ওঠে,

‘তোমাকে আমি এ পরিবারের ছেলে মেয়েদের মধ্যে সবথেকে বুদ্ধিমতী একজন ভাবতাম। ভাবতাম যে যেমনটা হোক না কেন তুমি হবে একজন পারফেক্ট মানুষ। যার প্রতিটা কাজে থাকবে সকলকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা। তোমার ভেতর সেই প্রতিভা আমি দেখেছি। কিন্তু এভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে কিভাবে? ছেলেটা তোমায় ঠিক কতদিন ধরে বিরক্ত করছে? পরিবারকে জানাওনি কেন?’

অন্তি সরল দৃষ্টিতে মুখ তুলে তাকায়। তার চোখের পানি এখনো গাল গড়িয়ে পড়ছে। চোখদ্বয় ফুলে লাল হয়ে উঠেছে। তার ক্রন্দনরত মুখ দেখে শাহিনের মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। এই আদুরে মেয়েটার সাথে এত কঠিণতা সত্যিই বেমানান। মেয়েটাকে ভালোবেসে বোঝাতে হবে। তার রক্ত কখনো ভুল পথ বেছে নিবে না! ভাইকে নিরবে ডেকে এ ব্যাপারে কথা বলবে।
এতক্ষণ নাহার চুপ থাকলেও বড় ভাসুরের প্রশ্নে মেয়েকে উত্তর না দিতে দেখে রেগে গেলেন খুব। রূঢ় গলায় বলে উঠলেন,

‘তোমাকে এতদিন এই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে? বড়রা প্রশ্ন করলে জবাব দিতে হয় এই সামান্য ম্যানারসটাও দেখছি ভুলে বসেছ?’

নাহার যখন খুব রেগে যায় তখন কেবল তুমি করে কথা বলে। অন্তি মায়ের কথাতেই বুঝে নিয়েছে তার রাগের পরিমাণ। কিন্তু সে নিরুপায়। বড় চাচার প্রশ্ন সে ইচ্ছা করে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল কারণ সে চেয়েও দিহানকে পরিবারের কাছে খারাপ করতে পারবে না। যে মানুষটাকে সে এত ভালোবাসে পরিবারের কাছে সে মানুষটাকে কিভাবে সে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে খারাপ করে তুলবে? সে যদি সত্যিটা বলে তবে সেটাও তার পরিবারের কেউ ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। এসব ভেবেই সে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু আজ হয়তো ভাগ্য বা নিয়তি কোনোটাই তার সাথে নেই। অন্তি ঢোক গিলল। সরাসরি কারো চোখে চাইতে পারলো না। মাথা নিচু রেখেই বিরবির করে বললো,

‘সে কখনোই আমায় বিরক্ত করেনি।’

নাহার মেয়ের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। পরক্ষণে ক্ষুদ্ধ হয়ে বললেন,

‘অনেক বড় হয়ে গেছ দেখছি! আমিতো এতদিন লক্ষ্যই করিনি আমি নিজ হাতে পালছি যে মেয়েকে সে এত বড়ো হয়ে গেছে! মিথ্যা বলতে শিখে গেছ? রাস্তার একটা গুন্ডাকে বাঁচাতে চাইছো? এত অধঃপতন! তুমি না বললেও রাস্তার ছেলেরা কেমন হয় আমরা জানি। তোমার রুচি নিচে নামলেও আমাদেরটা নামেনি। ওসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নেও।’

এতক্ষণ চুপ থাকলেও অন্তি এবার মাথা উঁচু করে মায়ের চোখে তাকালো। ভয়হীন ভাবে প্রতিবাদ করে উঠলো,

‘তোমাদের রুচি নিচে না নামলেও তোমাদের মানসিকতা নিচে নেমে গেছে মা। না জেনেশুনে তুমি কিভাবে কাউকে বারবার রাস্তার ছেলে বলতে পারো? কতটুকু জানো তুমি তার ব্যাপারে?’

সাহেদ অবিশ্বাস্য চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা খুঁজে পেলেন না তিনি। নাহার ক্ষিপ্ত হয়ে দ্বিতীয় বারের মতো থাপ্পর লাগালেন অন্তির নরম গালে। একই গালে পরপর দুবার এহেন আঘাতে গাল অবশ হয়ে পরেছে অন্তির। হঠাৎ করেই চারপাশ কেমন করে দুলে উঠলো। চোখের সামনের সবকিছু কেমন অন্ধকার হয়ে আসতে লাগলো। একসময় ওভাবেই লুটিয়ে পড়লো। নাহার শক্ত হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। শাহিন মেঝ ভাইয়ের বউয়ের এমন ক্ষিপ্ত স্বভাবে প্রচন্ড বিরক্ত হলেন। তার সামনে তার পরিবারের মেয়েদের গায়ে হাত তোলা চুড়ান্ত রকমের বিয়াদপি। যেখানে মা নিজেই সভ্যতা জানেনা সেখানে মেয়ে কিভাবে শিখবে? শাহিন কঠিন গলায় ভাইকে বললেন,

‘রূপন্তি তোমাদের মেয়ে হতে পারে কিন্তু মনে রেখো ও এই খান বংশের একটা অংশ। তোমরা শাসন করবে তা মেনে নিব কিন্তু গায়ে হাত তোলার মতো সাহস করো কিভাবে? আমি এখানে গুরুজন থাকতে তোমার স্ত্রী কিভাবে মেয়েকে আঘাত করে? আগে নিজের স্ত্রীকে সভ্যতা শিখাও।’

শাহিন ব্যাস্ত পায়ে উপরে চলে যান। বাড়িতে ডাক্তার ডাকা হয়। তেমন কিছুই হয়নি, দুর্বলতার জন্য সেন্স হারিয়েছে। সামান্য কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে চলে যান তিনি। নাহার মেয়ের রুমের দরজায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মা হিসেবে কি সে অনেক খারাপ? কতটা খারাপ মা হলে আঘাত করে মেয়েকে এভাবে শয্যায় ফেলে দেওয়া যায়! বুকটা হাহাকার করে ওঠে। মুখে আঁচল চেপে কেঁদে ওঠেন তিনি। সাহেদ স্ত্রীকে রুমে নিয়ে যান। মেয়েকে আঘাত করা নিয়ে কোনো কথা বলেননা তিনি। ইতিমধ্যে নাহার নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। পুনরায় তাকে এ ব্যাপারে বলে আর কষ্ট দিতে চাননি তিনি। কেবল স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছেন,

‘তোমাকে আরো ধৈর্যশীল হতে হবে নাহার। অনেক কিছুর মোকাবেলা করতে হবে কিন্তু ধৈর্য হারালে চলবে না। ধরে নাও এটা একজন মা হিসেবে তোমার চ্যালেঞ্জ।’

______________

জীবনের অতিব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হচ্ছে বিয়ে। যেখানে বাছাই করে নেওয়া হয় একজন জীবন সঙ্গীকে। দোকানে পছন্দ হওয়া ড্রেসটার মতো করে জীবন সঙ্গী বাছাই করা চলে না। এজন্যই বোধহয় এ সমাজের বাবা মায়েরা তাদের সন্তানের জন্য সেরা জীবনসঙ্গী বাছাইয়ের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিতে চায়। হোক জোর করে কিংবা সমঝোতার মাধ্যমে। তবে উদ্দেশ্য একই; সন্তানের সুখ! তবে সন্তানের চাহিদা কেন তারা বুঝতে চায় না? কেন বোঝে না যে ভালোবাসা ছাড়া সংসার হয় না?

এ প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পায়না অন্তি। চারদিক থেকে কেবল শুন্যতায় ঘেরা এক অদ্ভুত জবাব আসে। যার অর্থ তার জানা নেই। আচারের বোয়াম হাতে ডায়নিং এ যেতেই সাহেদ মেয়ের জন্য চেয়ার টেনে দেয়। বড় করে হেসে বলে,

‘আজকের রান্নাটা ফাস্টক্লাস হয়েছে। জলদি বসেপরো। টেস্ট করে দেখো। মাংসটা কিন্তু আজ আমি রেঁধেছি। সাহেদ নওয়াজ খানের হাতের ছোঁয়া পেতেই রান্নার স্বাদ দশগুণ বেড়ে গেছে বুঝলে। হেহে!’

তাকে হাসাতে বাবার এই সামান্য প্রচেষ্টা অন্তির বিফলে যেতে দিতে ইচ্ছা হলো না। কষ্ট চেপে বাবার সাথে তাল মিলিয়ে সে ও হেসে উঠলো। ইশশ! যদি সে গতকাল ওমন বোকামি না করতো আজ দিনটা তবে ভিন্ন হতো। এইযে বাবার সাথে তাল মিলিয়ে হাসতে তার কেমন জড়তা অনুভব হচ্ছে! একই টেবিলে খেতে বসতেও কতটা জড়তা! তখন হয়তো এমনটা হতো না। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মনের কোণে প্রশ্ন জাগে ঐ মানুষটাকি জানে তাকে নিয়ে অন্তি নামক মেয়েটার জীবনে কেমন ঝড় চলছে? জানলে সে কি করবে? রাজকুমার রূপে তাকে উদ্ধার করতে আসবে? নাকি না জানার মতো করে মুখ ঘুরিয়ে নিবে?

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here