#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_১২
সময় এগারোটা বেজে সতেরো মিনিট। সমুদ্র ও আরভী একটা ক্যাফেতে মুখোমুখি বসে আছে। এ সময়ে এখানে তেমন একটা লোকজন থাকে না বলেই আরভী সমুদ্রকে এখানে ডেকেছে।
সমুদ্র ব্যাস্ত ধোয়া উঠা কফির স্বাদ নিতে। আর আরভী ব্যাস্ত সমুদ্রের প্রতিটি কার্যকলাপ পরক্ষ করায়।
“আমার দিকে এভাবে নজর দিবেন না ললনা, আমি কালো হয়ে যাবো।”
সমুদ্রের এ কথায় আরভী নিজের দৃষ্টি সমুদ্রের থেকে সরালো না। বরং আরো তীক্ষ্ণ করলো। সন্দিহান স্বরে জিজ্ঞেস করলো,”আপনি তো কফি খাওয়ায় ব্যাস্ত, আমি আপনাকে দেখছি তা বুঝলেন কি করে?”
সমুদ্র এবার কফির কাপ টেবিলের উপর রাখলো। আরভীর দিকে তাকিয়ে বাকা হেসে বললো,”এক কাজ করুন, আপনি কফি খান আর আমি আপনার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকি। তাহলেই আপনার উত্তর পেয়ে যাবেন।”
যুক্তিহীন প্রশ্ন করেছে বুঝতে পেরে আরভী পরিবেশ স্বাভাবিক করতে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। আর তা দেখে সমুদ্র কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো,”এই পুলিশ আর রাজনীতির মানুষ মানেই সন্দেহের কারখানা। বিনা কারনে নির্দোষ মানুষদেরকে সন্দেহ করাই এদের প্রধান কাজ।”
“আমি আপনাকে সন্দেহ করছি আপনার এমন কেন মনে হলো?”
“আমাকে আপনি নিজের টাকায় কফি খাওয়াচ্ছেন এটা শুনলে যে কেউই বলে দিবে আমার থেকে কিছু একটা চাই আপনার। আর যেভাবে তাকাচ্ছেন আমার নিজেরই মনে হচ্ছে আমি একজন খুনের আসামি।”
আরভী বেশি কথা বাড়াতে চাইলো না। তাই সোজাসুজি প্রশ্ন করলো,”কেন করছেন এসব? এসব করার পিছনে আপনার আসল উদ্দেশ্য কি?”
“কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয় ললনা। গিভ এন্ড টেইক ছাড়া এ পৃথিবীতে কিছুই হয় না।”
সমুদ্রের কথায় আরভী তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। আরভীর আগে থেকেই সন্দেহ হয়েছিলো সমুদ্র এসব করছে নিজের স্বার্থের জোরে। কোনো প্রেম-ভালোবাসার বিষয় নেই এখানে।
“কি চাই আপনার?”
“থাক বলে লাভ নেই। আপনি দিতে পারবেন না।” কথাটি বলে সমুদ্র আবার কফি খাওয়ায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।
“আরভী রায়হানের কাছে সব আছে। আপনি শুধু বলুন আপনার কি চাই। বলার সাথে সাথে পেয়ে যাবেন। কি লাগবে আপনার টাকা, বাড়ি, গাড়ি?”
“ছ্যাহ এসব দিয়ে মানুষ কি করে? এসব তো আমার বাপেরও আছে।”
“তো কি চাই আপনার?”
“আরে থাক না! আমি জানি আপনি দিতে পারবেন না। শুধু শুধু বলে লাভ নেই।”
আরভীর মাঝে এবার এক অদৃশ্য জেদ চাপলো। আরভীর মনে হলো সমুদ্র যা চাইবে তা অন্তত আরভী দিতে পারবে। আরভীও কারো থেকে কম নয়। আরভীর কাছে যথেষ্ট পরিমাণ অর্থ-সম্পদ রয়েছে।
“আপনি জাস্ট বলে দেখুন। বলার সাথে সাথেই পেয়ে যাবেন।”
আরভীর কথায় সমুদ্র আরভীর দিকে তাকালো। কফির মগ পুনরায় টেবিলের উপর রেখে বাকা হেসে বললো,”আজকের বিকেলটা।”
সমুদ্রের কথা আরভী ঠিক ধরতে পারলো না। তাই জিজ্ঞেস করলো,”আজকেল বিকেলটা মানে?”
“আজকেল বিকেলটা মানে আপনি আজকের পুরো বিকেল জুড়ে আমার সাথে সময় কাটাবেন। তাহলেই আমি আপনাকে জানাবো কেন করছি এসব, এসবের পিছে আমার কি উদ্দেশ্য রয়েছে।”
আরভী ভেবেছিলো সমুদ্র অর্থ-সম্পদ চাইবে। কেননা সমুদ্রের হাব ভাবে এরকমটাই আরভীর মনে হয়েছিলো। তাই আরভী চুপ করে ভাবতে লাগলো সমুদ্রের কথায় রাজি হওয়া উচিত কিনা।
এদিকে আরভীকে চুপ থাকতে দেখে সমুদ্র কফির মগে চুমুক দিয়ে বললো,”জানতাম আপনি পারবেন না।”
“কখন আর কোথায় থাকতে হবে?”
“আপনার বাড়ি থেকে আমি আপনাকে পিক করে নিবো। সময় বিকেল তিনটে বেজে চল্লিশ মিনিট।”
“ওকে ডান।” বলে আরভী ক্যাফে থেকে বেড়িয়ে গেলো। আর আরভী বেড়িয়ে যেতেই সমুদ্রের ঠোঁটের কোনে দেখা দিলো এক রহস্যময় হাসি।
——
নাহিদ চৌধুরীর সামনে শাওন মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে। আর নাহিদ চৌধুরী রিভলভার হাতে নিয়ে একটা টিস্যু দিয়ে পরিষ্কার করছেন। কাজটি এতো মনোযোগ সহকারে করছেন যেনো এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ আর কিছুই হতে পারে না।
সবাই চুপচাপ থাকায় পরিবেশ একদম শান্ত হয়ে আছে। এসি চলছে তাও শাওনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে।
নাহিদ চৌধুরী নিজের রিভলভার পরিষ্কার করে শাওনের দিকে তাকালেন। গম্ভীরমুখে জিজ্ঞেস করলেন,”তিনঘন্টার কাজে তিনদিন সময় নিয়েছিস। তারউপর নতুন ছেলেটাকেও সঙ্গে করে আনিস নি। তুই তো দেখা যায় এখন আর আগের মতো কাজই করতে পারছিস না। তোকে এখন কি করা যায় বল তো! মেরে নদীর জলে ভাসিয়ে দিবো নাকি তোর শরীর টুকরো টুকরো করে কুকুরকে খাওয়াবো?”
শাওনের বুক দুরুদুরু কাপছে। আজ শাওনের সাথে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে তা শাওন বুঝতে পারছে। তাই নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে বললো,”স্যার আমি রাশেদকে অনেক খুজেছি। কিন্তু হুট করে কোথায় যেনো হাওয়া হয়ে গেছে ও। ওর গ্রামের বাড়িতেও গিয়েছি আমি। কিন্তু রাশেদ সেখানেও যায় নি।”
“নিজের ভুল বুঝতে পেরে পালিয়েছে হয়তো। কিন্তু তুই কেন এখনো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস।”
“স্যার, বিশ্বাস করুন,,,” শাওন নিজের কথা শেষ করতে পারলো না। এর আগেই শাওনের কপাল বরাবর নাহিদ চৌধুরী শুট করে দিলেন। সাথে সাথে দেহের ভার ছেড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে শাওন। রক্তে পুরো ফ্লোর ভিজতে শুরু করেছে। রক্ত ছড়িয়ে পড়ছে পুরো ফ্লোর জুড়ে।
হিমেলের জন্য এসব স্বাভাবিক হলেও ইমতিয়াজ এর জন্য এ ঘটনা ছিলো প্রথমবার। নাহিদ চৌধুরী যখন গুলি ছুড়েন তখন গুলির শব্দে ইমতিয়াজের পুরো শরীর কেপে উঠেছিলো। আর এখন শাওনের রক্ত দেখে কেমন মাথাটা ঘুরতে শুরু করেছে।
কি আশ্চর্য ব্যাপার! চোখের সামনে একটা মানুষ মারা যাচ্ছে। আর কারো মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। যেনো এটা খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। আর নাহিদ চৌধুরী কি অসাধারণ ভাবে ছেলেটাকে গুলি করলেন। একদম কপাল বরাবর গিয়ে লেগেছে । মনে হচ্ছে এ হাত কখনো নিজের টার্গেট মিস করে না।
“দেখলে ইমতিয়াজ! কাজে ভুল হলে কত বড় শাস্তি পেতে হয়। এটা তো কমই ছিলো, বিশ্বাসঘাতকদের আমি এর থেকেও বেশি ভয়ংকর মৃত্যু দেই। তারপর তার শরীর টুকরো টুকরো করে কেটে রাস্তার কুকুর দিয়ে খাওয়াই।”
নাহিদ চৌধুরী কথাটি ইমতিয়াজকে বললেন যেনো ইমতিয়াজ এসব দেখার পর, শোনার পর সাবধান হয়ে যায়। কখনো যেনো নাহিদ চৌধুরীর সাথে ছল না করে।
নাহিদ চৌধুরী ইমতিয়াজকে এ কথাটি কেন বলেছেন তা বুঝতে পেরেছে ইমতিয়াজ। এটা এক সতর্ক বার্তা ছিলো ইমতিয়াজের জন্য।
ইমতিয়াজের শরীর এখনো মৃদ্যু বেগে কাপছে। মনে হচ্ছে শাওনের মৃত্যু যন্ত্রণা ইমতিয়াজ নিজে অনুভব করতে পারছে।
“এই কে আছিস? এই লাশটা নদীতে ফেলে আয়।” নাহিদ চৌধুরী নিজের ঘরে যেতে যেতে বললেন।
আরভী রেডি হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দেখছে এই নতুন গেট আপে আরভীকে কেউ সহজে চিনতে পারবে কিনা। না তেমন একটা চিনা যাচ্ছে না। মুখে মাস্ক ও জিরো পাওয়ারের চশমা পড়লে কেউই আরভীকে চিনতে পারবে না।
আরভী ড্রেসিং টেবিলের উপর পড়ে থাকা কালো ফ্রেমের চশমায় হাত দিলো। আর তখনই বাহির থেকে হর্নের শব্দ আরভীর কানে ভেসে এলো। আরভী বুঝলো সমুদ্র এসেছে।
সমুদ্র আসলে কি চাইছে আরভী কিছু বুঝতে পারছে না। উদ্দেশ্য বলার জন্য কেউ এমন শর্ত রাখে আরভীর জানা ছিলো না।
আরভী দ্রুতবেগে চশমাটা পড়ে নিজেকে আরো একবার আয়নায় দেখে নিলো। না, তেমন একটা চেনা যাচ্ছে না। এবার তাহলে বের হওয়া যায়। নয়লে লোকজন যখন দেখবে এলাকার মেয়র একটা ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে ব্যাপারটা মোটেও ভালো দেখাবে না। তারউপর সমুদ্র সেই ছেলে যে গতকাল লাইভে এসে এতো বড় কান্ড ঘটিয়েছি।
আরভী বাড়ি থেকে বেড়িয়ে দেখলো সমুদ্র বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে কালো সানগ্লাস।
আরভী সমুদ্রের কাছে গিয়ে বললো,”এটা এক সাইডে পার্ক করে রাখুন, আমি ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলছি।”
“ও ম্যাডাম। বাইক কি আপনার বাড়ির সামনে পার্ক করে রাখার জন্য এনেছি নাকি?”
“তো আমি আপনার সাথে বাইকে করে যাবো আপনি ভাবলেন কি করে?”
“থাক যেতে হবে না আপনার। আমিও আপনার সাথে আপনার গাড়িতে করে যাবো না। আর আপনারও প্রয়োজন নেই আমার উদ্দেশ্য জানার।”
আরভী না চাইতেও বাধ্য হলো সমুদ্রের বাইকে চড়তে। আরভী সমুদ্রের থেকে অনেকটা দূরত্ব রেখে বসেছে যেনো সমুদ্রের শরীরের সাথে আরভীর শরীরের স্পর্শ না লাগে।
সমুদ্র বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বললো,”সমুদ্রের মাঝে এতো এতো বিশালতা যে সমুদ্র কাউকে না করতে পারে না। তাই আপনি যদি আমাকে ধরে বসতে চান বসতে পারেন। আমি না করবো না।”
“কোনো প্রয়োজন নেই।”
সব কিছু পেছনে ফেলে বাইক চলতে লাগলো সামনের দিকে। আরভীর বেশ অস্বস্তি হচ্ছে। কারন বড় হওয়ার পর আরভী কখনো কারো বাইকে উঠে নি।
তবে এই মূহুর্তে আরভীর নিজের বোকামির জন্য নিজের দুগালে দুটো থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে। বাইকে উঠার আগে চুলগুলো বেধে নেওয়ার কথা মাথায় কেন এলো না তা ভেবে।
আরভী কোনো রকমে এক হাত দিয়ে নিজের চুল ধরে আছে। তবুও চুল হাত থেকে বেড়িয়ে নিজের মতো করে উড়ে চলেছে। আরভী ভাবছে সমুদ্রকে বলবে কিনা বাইক থামাতে। এভাবে চুল ধরে রাখতে গিয়ে হাত ব্যাথা হয়ে গেছে। কিন্তু আরভীকে কিছু বলতে হলো না। তার আগেই সমুদ্র বাইক থামিয়ে দিলো। কিন্তু আরভী বুঝলো না সমুদ্র কেন নিজের বাইক থাকালো। তাই কারন জানতে জিজ্ঞেস করলো,”এখানে বাইক থামালেন যে? আমরা কি এসে পড়েছি?”
কথাটি বলে আরভী আশেপাশে তাকালো। কিন্তু এখানে বিশেষ কিছুই আরভীর নজরে পড়ছে না। শুধু দুয়েকটা দোকান দেখা যাচ্ছে সামনে।
“আজ্ঞে না ললনা। আপনি আগে নিজের চুল বেধে নিন। এ চুলগুলো আমাকে বড্ড জ্বালাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না আপনার চুলের ঘ্রাণ নিবো নাকি বাইক চালাবো। বাই দ্যা ওয়ে কি শ্যাম্পু ইউস করেন?”
আরভী বুঝলো এতোক্ষন আরভীর চুল সমুদ্রের চোখে-মুখেও বাড়ি খাচ্ছিলো। তবে চুলের ঘ্রাণ নেওয়ার কথাটা আরভীর মোটেও পছন্দ হলো না। তাই সমুদ্রের কথার প্রতিত্তোর না করে আরভী নিজের চুল বাধায় ব্যাস্ত হলো।
চলবে….