#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_১৩
আরভী চুল বেধে বাইকে বসতে বসতে সমুদ্রকে শুধালো,”কোথায় যাবেন?”
“শহর থেকে দূরে কোথাও। এই ইট-পাথরের দালানের মাঝে থেকে আপনার অনুভূতি হারিয়ে যাচ্ছে। যন্ত্রে পরিণত হচ্ছেন। আজ না হয় গ্রামীণ পরিবেশে কিছুটা সময় কাটিয়ে নিজেকে সতেজ করে তুলবেন!”
শহর থেকে বেড়িয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে বাইক চলছে। যার দুপাশের বিস্তৃত জায়গা জুড়ে সরিষা খেত দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে হলুদের রঙে সেজে আছে সব। খেতের শেষ প্রান্তে আবার সারি সারি তাল গাছ দেখা যাচ্ছে। মোট কথায় জায়গাটা সত্যিই অসাধারণ দেখতে।
কিছুটা দূরে গিয়ে সমুদ্র বাইক থামালো। আরভী বাইক থেকে নেমে চারপাশে তাকিয়ে দেখলো জায়গাটা একদম নির্জন। সমুদ্রের মতলব কি? হঠাৎ এমন একটা জায়গায় কেন বাইক থামালো?
আরভী ভ্যানিটি ব্যাগের চেইন খুলে ব্যাগের ভিতরে থাকা রিভলবার ধরে বললো,”এমন শুনসান একটা জায়গায় বাইক থামিয়েছেন কেন? দেখুন সমুদ্র আমি মেয়ে দেখে আপনার সাথে পেরে উঠবো না এমনটা ভুল করেও ভাববেন না। আমার ব্যাগের ভিতরে কিন্তু রিভলবার আছে।”
সমুদ্র ডান হাত দিয়ে নিজের মাথা চাপড়ে বললো,”ইট’স কলড উইম্যান। বুঝে কম চিল্লায় বেশি।”
“তো আপনি এমন একটা জায়গায় কেন বাইক থামিয়েছেন?”
“খেজুরের রস খেয়েছেন কখনো?”
“আপনি এই কথা জানতে এখানে বাইক থামিয়েছেন?” আরভী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
“ও ম্যাডাম, বাইক কেন থামিয়েছি একটু পরেই জানতে পারবেন। আগে বলুন খেজুরের রস খেয়েছেন কখনো?”
“হ্যাঁ খেয়েছি।”
“কাঁচাটা খেয়েছেন? একদম গাছ থেকে পাড়ার সাথে সাথে?”
“না, কাঁচাটা খেলে তো নিপা ভাইরাস হওয়ার সম্ভবনা থাকে।”
সমুদ্র আর কিছু বলললো না। নিচের দিকে তাকিতে কিছু একটা খুজতে লাগলো।
এদিকে আরভী বুঝতে পারছে না সমুদ্র কি করতে চাইছে। তাই এক পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ সমুদ্রের কীর্তিকলাপ দেখছে।
সমুদ্র হঠাৎ কিছু মাটির চাকা হাতে নিলো। ইশারায় বললো উপরের দিকে তাকাতে।
আরভী উপরের দিকে তাকিয়ে বুঝলো এখানে বেশ কিছু খেজুর গাছ রয়েছে। আর প্রতি গাছেই কলস বাঁধা রয়েছে রস সংগ্রহের জন্য।
দেখতে না দেখতেই সমুদ্র গাছে বেঁধে রাখা একটা কলসের দিকে ঢিল ছুড়লো। আর সাথে সাথেই কলসের এক পাশে ছোট একটা ছিদ্র হয়ে গেলো। যেখান দিয়ে খেজুরের রস নিচের দিকে পড়ছে।
আরভী সমুদ্রের এতো ভালো নিশানা দেখে অবাক হয়েছে। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”এই আপনার নিশানা এতো ভালো কি করে?”
“আরে ললনা, এতোবার এভাবে রস খেয়েছি যে এখন আমার নিশানা একদম জায়গামতো লাগে।”
“সমুদ্র, আপনি এতো বড় একটা ছেলে হয়ে এভাবে অন্যের ক্ষতি করছেন কেন?”
“উফ আপনি বড্ড বেশি প্রশ্ন করেন ললনা। দেরি না করে আমার মতো হাত পেতে খেতে থাকুন। দাঁড়ান আগে আমি দেখাই।” বলে সমুদ্র নিজের দুহাত মিলিত করে রসের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।
খেজুরের রস উপর থেকে সোজা সমুদ্রের হাতে পড়ছে। সমুদ্র এবার সামান্য ঝুকে নিজের মুখ হাতের সাথে লাগিয়ে রস পান করতে লাগলো।
“কি করছেন সমুদ্র? নিপা ভাইরাস হতে পারে তো।”
সমুদ্র প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। তৃপ্তি সহকারে রস খেতে লাগলো। মিনিট দুয়েক পর মাথা তুলে বললো,”দেখলেন এভাবে খেতে হয় রস। নিন আপনিও খেয়ে দেখুন। এই রসের স্বাদই আলাদা।”
“কিন্তু!”
“আমাদের জীবন একটাই। তাই এই এক জীবনে যতোটা পারুন জীবনটাকে উপভোগ করুন। বৃদ্ধ হয়ে বা অন্য কোনো কারনে মরার থেকে ভালো জীবনটাকে উপভোগ করতে করতে মরুন। তাহলে দেখবেন মরেও শান্তি।”
এই প্রথম সমুদ্রের কোনো কথা আরভীর ভালো লেগেছে, সমুদ্রের কোনো কথায় আরভী সামান্য হেসেছে। কথাটা কিন্তু মন্দ বলে নি সমুদ্র। এই ছোট্ট জীবনটা ক’জনই বা উপভোগ করতে জানে? বেশির ভাগ মানুষই তো স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে কত খাদ্য পরিহার করে। তাই উপভোগ করার সুযোগ হাত ছাড়া করতে নেই ভেবেই আরভীও সমুদ্রের মতো হাত বাড়িয়ে রস খেতে লাগলো।
প্রথম যখন আরভী রস পান করার জন্য ঝুকে হাতে চুমুক দিলো তখন তৃপ্তিতে আরভীর চোখ যুগল বন্ধ হয়ে আসে। ভিতরটা কেমন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। আরভীর এখন আফসোস হচ্ছে কেন আগে কাঁচা রস খেয়ে দেখলো না তা ভেবে। কাচা রসের সামনে জ্বাল দেওয়া রস কিছুই না এমনটা মনে হচ্ছে আরভীর কাছে।
কলস থেকে রস পড়া বন্ধ হলে আরভী সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাতের উলটো পীঠ দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,”খারাপ না।”
“আরো খাবেন?”
“খাওয়া যেতে পারে।” আরভী কিছুটা ভাবুক স্বরে বললো।
আরভীর কথা শুনে সমুদ্র নিরবে হাসলো। আবারো ঢিল ছুড়লো আরেকটি কলসের দিকে। সেটা থেকে রস পরতে শুরু করলে আরভী খতে শুরু করে। কিন্তু মিনিট দুয়েক পর হঠাৎ সমুদ্র চেচিয়ে বলে,”ললনা, মার খেতে না চাইলে তাড়াতাড়ি বাইকে উঠুন।”
কথাটি বলে সমুদ্র বাইকে উঠে বসলো। কিন্তু আরভী সেখানেই ঠাই দাঁড়িয়ে থেকে জানতে চাইলো,”কেন, মার কেন খাবো?”
“আরে তাড়াতাড়ি উঠুন। পিছনে তাকিয়ে দেখুন কলসির মালিক মোটা লাঠি নিয়ে আমাদের দিকে তেড়ে আসছে।”
সমুদ্রের কথামতো আরভী পিছনের দিকে তাকালো। দেখলো সত্যিই একটা লোক লাঠি হাতে এদিকটায় তেড়ে আসছে। কি দিনকাল এলো? মেয়র চুরি করে রস খেতে গিয়ে তাড়া খেয়েছে, লোকে শুনলে কি বলবে?
“দাঁড়িয়ে আছেন কেন? তাড়াতাড়ি উঠে বসুন।”
সমুদ্রের কথায় আইভীর ধ্যান ভাঙ্গলো। আরভী তাড়াতাড়ি করে বাইকে উঠে বসলো।
বাইক আবারো নিজের গতিতে চলছে। তখন হাত মুখ মুছতে না পাড়ায় হাত-মুখ কেমন চটচটে হয়ে আছে। আরভীর একদমই ভালো লাগছে না। তাই আরভী দু আঙ্গুল দিয়ে সমুদ্রের পিঠের দিকের শার্ট টানতে লাগলো।
হঠাৎ শার্টে টান অনুভব করে সমুদ্র ভাবলো হয়তো আরভীর সমস্যা হচ্ছে। তাই দ্রুত বাইক থামালো। পিছনের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলো,”সমস্যা হচ্ছে কোনো?”
“আমি হাত পরিষ্কার করবো।”
সমুদ্র চারদিকে একবার চোখ বুলালো। কোনো বাড়িঘর নেই আশেপাশে। কিন্তু সামনের রাস্তা ধরে না গিয়ে যদি বাম দিকে ঘুরে যায় তাহলে একটা ছোট্ট খাল পড়বে। তাই সমুদ্র বাইক স্টার্ট দিয়ে নিজের গন্তব্য বদলে নতুন গন্তব্যের দিকে যেতে লাগলো।
খালের জায়গাটায় গিয়ে দেখলো এখানে মেলা হচ্ছে। বেশ জমজমাট দেখা যাচ্ছে মেলাটি। সমুদ্র আরভীর দিকে তাকিয়ে বললো,”থাক আর ও পথে যাবো না। চলুন মেলায় ঘুরি।”
আরভীকে আর কষ্ট করে খালে নেমে হাত মুখ ধুতে হলো না। মেলার এক অস্হায়ী দোকান থেকে পানি কিনে আরভীকে দিয়েছে। আরভী একটু আড়াল হয়ে হাত মুখ ধুয়ে আবার মাস্ক পড়ে নিয়েছে।
মেলায় কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করার পর সমুদ্রের চোখ পড়লো রেশমি চুড়ির উপর। সমুদ্র আরভীকে নিয়ে সেদিকটায় গেলো। আরভীর দিকে তাকিয়ে দেখলো আরভী আকাশী ও সাদা রঙের লং কুর্তি পড়ে আছে। সমুদ্র আরভীর কুর্তির সাথে মিলিয়ে সাদা ও আকাশী রঙের রেশমি চুড়ি হাতে নিলো। দুটো করে সাদা ও দুটো করে আকাশী রঙের চুড়ি একত্রিত করে আরভীর দিকে এগিয়ে দিলো পড়ার জন্য। কিন্তু আরভী নাকচ করে বললো,”আমি এসব পড়ি না।”
“মেয়েদের সৌন্দর্য প্রকাশ পায় শাড়ি, চুড়ি ও চুলে। আর আপনি চুড়ি পছন্দ করেন না? সিরিয়াসলি?”
“আমার এসব ভালো লাগে না।”
“দেখুন ললনা, আপনার কাছে দুটো অপশন আছে। হয় আপনি নিজে পড়ে নিন নয়লে আমি জোর করে পড়িয়ে দিবো। আর এখানে এতো লোকের সামনে আপনি আমাকে কিছু বলতেও পারবেন না।”
সমুদ্রের কথা শুনে আরভী অনিচ্ছা সত্বেও বাধ্য হলো চুড়ি পড়তে।
আরভী দুহাতে চুড়ি পড়লে সমুদ্র আরভীর হাতের দিকে তাকিয়ে প্রফুল্লচিত্তে বললো,”দেখেছেন এবার কত সুন্দর দেখাচ্ছে আপনাকে।”
আরভী নিজেও হাতের দিকে তাকিয়ে রইলো। আসলেই অনেক বেশি সুন্দর লাগছে।
সমুদ্র এবার পাঁচ টাকা দামের দুটো আইসক্রিম কিনলো। একটা আরভীর হাতে দিয়ে বললো,”এর আগে কখনো এই আইসক্রিম খেয়েছেন? এটা কিন্তু দামী আইসক্রিমের থেকেও মজার।”
“হুহ ছোটবেলা অনেক খেয়েছি।” আরভী মুখ বাকিয়ে বললো।
আর আরভীকে মুখ বাকাতে দেখে সমুদ্র উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। তারপর হাসি থামিয়ে বললো,”নিজের ভিতরের আরভী রায়হানকে টেনে বের করুন। আমার বিশ্বাস এই আরভী রায়হানের থেকে আপনার ভিতরে লুকিয়ে থাকা আরভী রায়হানই সেরা।”
চলবে…..
বি.দ্র. : আজকের পর্বে ভুল কিছু লিখে থাকলে ক্ষমা করবেন। খেজুরের রস বিকেলে পাওয়া যায় কিনা তা নিয়ে আমারও সন্দেহ ছিলো। কারন এই ব্যাপারে আমি তেমন একটা জানি না। এক ফ্রেন্ডকে জিজ্ঞেস করলে ও বললো যাদের নিজেদের গাছ রয়েছে তারা নাকি সারাক্ষণই গাছে কলস বেঁধে রাখে। আর এই কলস নাকি সর্বোচ্চ ১২-১৫ ঘন্টা বেঁধে রাখা যায়।