#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_২০
তন্ময় ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পর সমুদ্র তন্ময়ের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। এরকম টা তো হওয়ার কথা ছিলো না। তবে এমনটা কেন হলো? মিনহাজ কেন এতো বছর পর হঠাৎ বাংলাদেশে এলো! মিনহাজ চাইলে তো কানাডায় বসেই নাহিদ চৌধুরীকে সাহায্য করতে পারতো।
শুধু নাহিদ চৌধুরীকে সাহায্য করার জন্য এসেছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
এসবের উত্তর কেবল মিনহাজই দিতে পারবে। তাই সমুদ্র দ্রুত বেগে বিছানা থেকে উঠে গেস্ট রুমের দিকে যেতে লাগলো মিনহাজের সাথে কথা বলার জন্য।
দরজায় নক না করেই সমুদ্র গেস্ট রুমে ঢুকে পড়লো। ভেতরে গিয়ে দেখলো মিনহাজ পায়ের উপর পা তুলে ডিভাইনে বসে আছে। সমুদ্রকে দেখে পা নামিয়ে হেসে বললো,”আরে আয় আয়। এতো দেরি হলো কেন? আমি সেই কখন থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছি। কারন আমি জানতাম তুই আমার সাথে দেখা করতে আসবি।”
“তুই এখানে কেন এসেছিস?” মিনহাজের কাছে যেতে যেতে বললো সমুদ্র।
“আরু ডার্লিং কে দেখতে এসেছি।”
মিনহাজের এ কথায় সমুদ্র সময় ব্যায় না করে মিনহাজের শার্টের কলার হাটের মুঠোয় নিয়ে টেনে ধরে বললো,”আরভী, আরভী রায়হান ওর নাম।”
“আরে আরে আরে! কুল ম্যান, প্রেমে পরিছিস নাকি? অবশ্য আরভী প্রেমে পড়ার মতোই একটা মেয়ে। শুনেছি এখন নাকি আরো বেশি সুন্দরী হয়েছে!”
সমুদ্র মিনহাজের কলার আরো জোরে টেনে ধরে বললো,”সেসব জেনে তোর লাভ নেই। আরভীকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না।”
“সে না হয় ভাবলাম না। তবে আরভী কি সত্যিটা জানে? আমার তো মনে হচ্ছে কিছুই জানে না। কেননা আরভী সত্যিটা জানলে তোকে কখনো ওর আশেপাশে ঘেষতেও দিতো না।” বলে বাকা হাসলো মিনহাজ।
সমুদ্র এবার মিনহাজের কলার ছেড়ে দিয়ে মিনহাজের কলার ঠিক করে দিতে দিতে বললো,”দেখ, তোর সাথে কিন্তু আমার ডিল হয়েছিলো। সেটা ভুলে যাস না।”
“সেই ডিলে বলা হয়েছিলো তুই সবসময় নাহিদ চৌধুরীকে প্রটেক্ট করবি আর আমি আরভীর সামনে সত্যিটা আসতে দিবো না। কিন্তু তুই আমার বাবাকে প্রটেক্ট করতে পারিস নি। উল্টো আমার মনে হচ্ছে তোর জন্যই বাবাকে জেলে যেতে হয়েছে এবং এখন পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে।” খানিকটা চিৎকারের স্বরে বললো মিনহাজ।
“আমি কিছু করি নি মিনহাজ। আর আমি কিভাবে এটা করতে পারি তুই’ই ভাব।”
“এতো কিছু ভেবে আমার লাভ নেই। তুই বের হ রুম থেকে। আমি ঘুমোবো। আর তন্ময়ের সাথে মিলে আমার বা বাবার ফোন ট্রেস করার চেষ্টা করে লাভ নেই। মিনহাজ কখনো কাঁচা কাজ করে না। মাইন্ড ইট।”
সমুদ্র লিভিং রুমে অস্হির হয়ে পায়ে চারি করছে। মিনহাজ বাংলাদেশে থাকা মানেই সমুদ্রের জন্য অনেক বড় ঝামেলা। আরভীর সামনে যদি সত্যিটা চলে আসে তাহলে এতোদিনের সাজানো সব পরিকল্পনা মূহুর্তের মাঝেই নষ্ট হয়ে যাবে। এতো বছর অপেক্ষার পর যে সুযোগ সমুদ্র হাতে পেয়েছে তা এতো সহজে কি করে হাত ছাড়া করতে দেওয়া যায়?
কিছু একটা করতে হবে। মিনহাজকে হৃদয়পুরে রাখা যাবে না। অন্য কোথায় নিয়ে যেতে হবে।
এরই মাঝে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে নোমান আহমেদ এলেন। ঘরের এক কোনে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কৌতুকের স্বরে বললেন,”বাবা মজনু, তোমার সাত দিন কি এখনো শেষ হয় নি?”
সমুদ্র নোমান আহমেদের দিকে তাকালো। হুট করে মাথায় এক বুদ্ধি খেলে গেলো। নোমান আহমেদের পাশে বসে ভদ্র ছেলের মতো মুখ বানিয়ে বললো,”বাবা, তুমি যা বলবে তাই হবে। শুধু শেষ বারের মতো একটা কথা রাখো প্লিজ।”
“না না, তোর আর কোনো কথা আমি শুনবো না। তোর উপর কোনো বিশ্বাস নেই আমার। তুই যে কেমন পল্টিবাজ তা আমি বেশ ভালো করেই জানি।”
“আরে আমার পুরো কথা তো শুনো আগে! আমি এবার নিজের জন্য কিছু চাইবো না। আমি তো মিনহাজের জন্য তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাইছিলাম। বুঝোই তো ছেলেটার উপর দিয়ে কি যাচ্ছে।”
মিনহাজের কথা শুনে নোমান আহমেদ নড়েচড়ে বসলেন। মিনহাজকে নিজের ছেলের মতোই দেখেন উনি। বরং সমুদ্রের থেকেও মিনহাজকে বুদ্ধিমান মনে হয় উনার কাছে।
সমুদ্র বুঝলো নোমান আহমেদ শুনতে চায় সমুদ্রের কথা। তাই গলা ঝেড়ে বলতে শুরু করলো,”দেখো বাবা, ও প্রতিবার এসে আমাদের সাথে কত টাইম স্পেন্ড করে। অথচ এবার এসেই ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে আছে। আমার মনে হচ্ছে কি জানো বাবা? ছেলেটা ডিপ্রেশনে চলে গেছে। জানোই তো নিজের বাবাকে কত ভালোবাসে মিনহাজ! তাই আমাদের উচিত ওর এই খারাপ সময়ে ওর পাশে থাকা। ওর যত্ন নেওয়া। ওকে হাসি-খুশি রাখার ব্যবস্থা তো আমাদেরই করতে হবে তাই না? আমাদের ছাড়া ওর আছেই বা কে?”
“হ্যাঁ আমিও খেয়াল করেছি এটা। আমি ভেবেছি হয়তো রাতে ঘুমোয় নি দেখে ঘুমোচ্ছে। আমাদেরও তো তাই বললো।”
“মিথ্যে বলেছে বাবা। ও ঘুমোতে ঘুমোতে এখানে এসেছে। আমি একটু আগে ওর ঘরে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ও ছোট বাচ্চাদের মতো কাঁদছে। ওর কান্না আমার সহ্য হচ্ছিলো না। আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকা ছেলেটার চোখের পানি আমি দেখতে পারছিলাম না। তাই তো এখানে এসে এভাবে হাটছিলাম আর ওর কথাই ভাবছিলাম।”
“ছেলেটা কাঁদছে? আমাকে আগে বলিস নি কেন? দাঁড়া আমি তোর মাকে নিয়ে ওর কাছে যাচ্ছি।” বলে উঠে দাঁড়ালেন নোমান আহমেদ। কিন্তু সমুদ্র সাথে সাথে নোমান আহমেদকে থামিয়ে দিয়ে বললো,”আরে বাবা কি করছো? এভাবে হবে না তো।”
“তাহলে? ছেলেটাকে কি মন মরা হয়ে ঘরে বসে থাকতে দিবো নাকি? আমি আর তোর মা গিয়ে একটু সঙ্গ দেই। হয়তো ছেলেটার ভালো লাগবে।”
“বাবা একটু বুঝার চেষ্টা কর। এভাবে হবে না। ওকে এই পরিবেশে রাখা যাবে না। এখানে থাকলে বারবার ওর বাবার কথা মনে পড়বে। এর থেকে ভালো চলো আমরা সবাই মিলে কোথাও একটা ঘুরতে যাই। ঘুরতে গেলে হয়তো একটু রিফ্রেশ লাগবে ওর।”
“এই অবস্থায় ও ঘুরতে যাবে বলে তোর মনে হয়? আর এক মিনিট! তুই হঠাৎ এতো দায়িত্ববান হলি কিভাবে? না মানে এর আগে তো কখনো কাউকে নিয়ে এতো ভাবতে দেখি নি তোকে। ব্যাপারটা কি বলতো।!”
“এটা পরিস্থিতির খেল বাবা। পরিস্থিতি আমাকে বদলে দিয়েছো। আমার দিকে তাকিয়ে দেখো একবার। তাহলেই দেখতে পাবে আমার চোখে-মুখে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে।”
নোমান আহমেদ ভালো মতোন সমুদ্রের মুখের দিকে তাকালেন। সমুদ্রের চোখে মুখে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ উনি দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু উনি এটা জানতে পারলেন না এই চিন্তার ছাপ মিনহাজের জন্য নয় বরং সমুদ্রের নিজের জন্য।
উনি কিছুটা সময় ভেবে বললেন,”তোর মায়ের সাথে কথা বলে জানাচ্ছি তোকে।”
“আর শুনো বাবা, আমি যে তোমাকে এসব বলেছি তা যেনো মিনহাজ জানতে না পারে। ইভেন তোমরাও যে জানো সেটাও মিনহাজকে বুঝতে দিয়ো না। এতো বড় ছেলে হয়ে কাঁদছিলো আর তোমরা সেটা জেনে গেছো এটা ভেবে বেচারা অনেক লজ্জা পাবে।”
“ছেলে দেখে কি কাঁদতে পারবে না?”
“তুমি এসব বুঝবে না বাবা। আমি মিনহাজকে ভালোভাবেই চিনি। সেই থেকেই বলেছি। বাকিটা তোমাদের ব্যাপার।” বলে লিভিং রুম থেকে বের হয়ে এলো সমুদ্র।
যাক, এদিকটা সামলানো হয়ে গেছে। এখন ভালোয় ভালোয় মিনহাজ রাজি হলেই হয়। অবশ্য রাজি না হয়ে উপায় নেই। সবাই জোর করলে ঠিকই বাধ্য হবে যেতে।
নাহিদ চৌধুরীর পালানোর কথা গোপন রাখা হয়েছে। জেল থেকে পালিয়ে গেছে এ কথা পাবলিক জানতে পারলে পুলিশের উপর আঙুল উঠবে যে তারা ঠিক ভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারে না। কিন্তু এতে সমুদ্রের বেশ সুবিধা হয়েছে। এটা জানা জানি হলে নোমান আহমেদ হয়তো রাজি হতেন না। এখন যেহেতু জানেন না সেহেতু মনে হয় না বেশি একটা সমস্যা হবে।
যেহেতু কয়েকটা দিন হৃদয়পুর থাকা হবে না সেহেতু আরভীকেও জ্বালাতন করা যাবে না। এই ভেবে সমুদ্রের মন খারাপ হলো। কিন্তু এখন আর মন খারাপ করে লাভ নেই। এর থেকে ভালো হৃদয়পুর থেকে যাওয়ার আগে আজ সন্ধ্যায় একটু জ্বালিয়ে আসা যাক।
রাত আটটা বেজে দশ মিনিট। আরভী এখনো বাড়ি ফিরে নি। সমুদ্র সেই সাতটা হতে দাঁড়িয়ে আছে। মশার কামড়ে প্রায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সমুদ্র। তবুও দাঁড়িয়ে আছে আরভীদের বাড়ির বাহিরে। অবশ্য দারোয়ান একবার বলেছিলো ভেতরে গিয়ে অপেক্ষা করার জন্য। কিন্তু সমুদ্র রাজি হয় নি। এরই মাঝে একটা মশা সমুদ্রের কপালে বসে। সমুদ্র হাত দিয়ে মশাটিকে তাড়িয়ে দিয়ে বিরবির করে বললো,”তোরা আমার পুরো শরীরে চুমু খাচ্ছিস খা। আমি না করেছি নাকি? তবে ভুলক্রমেও মুখের দিকে নজর দিবি না। এটা আমার বউয়ের আমানত।”
প্রায় মিনিট সাতেক পর আরভীর গাড়ি দেখতে পেলো সমুদ্র। আরভীর গাড়ি বাড়ির কাছাকাছি আসলে সমুদ্র গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পথ রুখে দাড়ালো।
আরভী বসে বসে ফেসবুক স্ক্রোল করছিলো। হঠাৎ গাড়ি থেমে যাওয়ায় সামনে তাকিয়ে দেখলো সমুদ্র দাঁড়িয়ে আছে।
আরভী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে গাড়ি থেকে নেমে সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে শুধালো,”কি সমস্যা? পথ আটকে দাড়িয়ে আছেন কেন?”
“এখানের মশা গুলো এতো খারাপ কেন? সেই কখন থেকে আমাকে বাজে ভাবে স্পর্শ করে যাচ্ছে।”
আরভী বুঝতে পারলো না সমুদ্রের কথায় কেমন প্রতিক্রিয়া করা উচিত। তাই কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে ক্লান্ত স্বরে বললো,”আপনি এমন কেন বলুন তো! আপনার তো যথেষ্ট বয়স হয়েছে অথচ এখনো আপনি ছেলেমানুষী করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। আপনি কি শুধু আমার সাথেই এমন ব্যবহার করেন নাকি সবার সাথেই?”
“এখানে আমার কোনো দোষ নেই ললনা। আপনাকে দেখলে আমার ভেতরকার ছেলে মানুষী জেগে উঠে। এখানে আমি কি করতে পারি আপনি’ই বলুন।” চোখে-মুখে অসহায়ত্বের ছাপ ফুটিয়ে তুলে বললো সমুদ্র।
“দেখুন সমুদ্র।”
“দেখছি’ই তো। বলুন ললনা।” বলতে বলতে আরভীর দিকে খানিকটা এগিয়ে এলো সমুদ্র।
সমুদ্রকে এগিয়ে আসতে দেখে আরভী কয়েক পা পেছনে গিয়ে বিরক্তির স্বরে বললো,”এই এই দূরে সরে দাড়ান প্লিজ।”
তারপর সমুদ্র দাঁড়িয়ে গেলে আবার বড় এক ঢোক গিলে খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে বললো,”লিসেন, আপনি যা করছেন তা একদমই ঠিক না। আপনার ব্যাপারে আমি যতোটুকু জেনেছি আপনি ভালো পরিবারের ছেলে। আর আপনার আজেবাজে কোনো রেকর্ডও নেই। নিঃসন্দেহে আপনি ভালো একটা ছেলে। তাহলে আমার সাথে এমন বখাটেপনা কেন করছেন?”
“চা খাবেন?”
“আমি আপনাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছি সমুদ্র। ”
“আমার সাথে চা খেতে চলুন তবেই উত্তর পাবেন। জানেন’ই তো আমি আবার গিভ এন্ড টেইক পলিসি মেনে চলি।”
“হ্যাঁ আমি আপনার সাথে যাই আর আপনি আগের বারের মতো এমন কথা বলবেন যা আমাদের জন্য অর্থপূর্ণ নয়।”
“কিন্তু আপনাকে যে আমার সাথে যেতেই হবে ললনা। আর আপনি তো জানেন’ই আমি কতটা জেদি। যা বলি তা করেই ছাড়ি। এবার আপনি ভাবুন আপনি ভালোয় ভালোয় আমার সাথে যাবেন নাকি এলাকায় মাইকিং করে আপনাকে আমার সাথে যেতে বাধ্য করতে হবে।”
চলবে….