#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_২১
“আপনার মনে হচ্ছে না আপনি একটু বেশি বেশি করছেন?”
“একদম’ই না কারন আমি জানি আমি বেশি বেশি করছি।”
আরভী দাঁতে দাঁত চেপে সমুদ্রের এ কথা হজম করে নেয়। এমনিতেই আজ অনেক ক্লান্ত তারউপর সমুদ্রের এসব কথা শুনে ইচ্ছে করছে যাস্ট সমুদ্রের মাথা ফাটিয়ে দিতে।
“আজ আমি অনেক ক্লান্ত সমুদ্র আর কাল আমি এ শহরের কয়েকটা জায়গা ঘুরে দেখবো এই শহরের সমস্যা গুলো কি কি। এছাড়া অচেনা একটা ছেলের সাথে কেন আমি এতো রাতে চা খেতে যাবো?”
“প্রথমত আমি আপনার অচেনা নই। দ্বিতীয়ত, আমি বেশি সময় নিবো না, যাস্ট টেন মিনিট।”
আরভী গভীর শ্বাস নিয়ে ভাবতে লাগলো যাবে কি যাবে না। সমুদ্র যে ধরনের ছেলে না গেলে অদ্ভুত কোনো কান্ড ঘটিয়ে বসবে। এদিকে সমুদ্রের সাথে যেতে আরভীর একদমই ইচ্ছে করছে না। তাই কিছুক্ষন ভেবে বললো,”সমুদ্র প্লিজ! আপনার যদি এতোই ইচ্ছে হয় আমার সাথে চা খাওয়ার তবে বাড়ির ভেতরে চলুন। সবাই একসাথে বসে চা খাবো।”
সমুদ্র নিজের বাইকে বসে বললো,”ভালোয় ভালোয় যেতে চাইলে চলুন নয়লে আমি যাচ্ছি মাইক ভাড়া করে আনতে।”
“আমি আপনার সাথে গেলে কেমন দেখায় ভেবেছেন একবারও? অবিবাহিত মেয়র একটা ছেলের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাও সেই ছেলে যে কয়েক দিন আগে লাইভে এসে মেয়রকে নিয়ে আজগুবি সব কথা বলেছে। আপনার মনে হয় না আমাদের দুজনকে একসাথে দেখলে সবাই উল্টো-পাল্টা ভাববে!”
সমুদ্র এবার বাইকের হ্যালমেট আরভীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,”এটা পড়ে নিন, কেউ চিনতে পারবে না। এই দশ মিনিটের জন্য আপনার সেফটি ও প্রাইভেসির পুরো দায়িত্ব আমার।”
আরভী বুঝলো সমুদ্রকে আর কিছু বলে লাভ নেই। এই ছেলে যেহেতু একবার বলেছে চা খেতে যাবে আরভীকে নিয়ে তার মানে যেকোনো ক্রমে আরভীকে নিয়ে গিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবে। তাই হ্যালমেটটা মাথায় পড়ে আরভী সমুদ্রের পিছনে বসে পড়লো।
বাইক চলছে তার নিজস্ব গতিতে। প্রবল হাওয়া আরভী ও সমুদ্রকে ছুয়ে দিয়ে যাচ্ছে। শীতের পোশাক পড়ে থাকায় আরভীর তেমন একটা ঠান্ডাও লাগছে না।
রাতের শহরটা বাইক থেকে দেখতে আরভীর কাছে বেশ লাগছে। এভাবে বাইকে বসে রাতের শহর দেখা হয় নি কখনো। নিমিষেই মধ্যেই যেনো সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। আরভীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মুচকি হেসে চলন্ত দৃশ্য উপভোগ করতে লাগলো আরভী।
সমুদ্র বাইকের মিরর এমনভাবে রেখেছিলো যেনো আরভীকে দেখা যায়। বাইক চালানোর মাঝে-মাঝে আরভীকে এক পলক দেখে নিচ্ছিলো সমুদ্র। কিন্তু যখন আরভীকে হাসতে দেখলো সাথে সাথে ব্রেক কষে বাইক থামালো।
হুট করে বাইক থামানোর জন্য আরভী নিজের ব্যালেন্স সামলাতে পারে নি। ফলে আরভীর এক হাত সমুদ্রের কাধে চলে যায় ও অপর হাত পেছন থেকে সমুদ্রের ব্লেজার টেনে ধরে।
সমুদ্র জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বুকের বা-পাশে হাত রাখে। হৃদপিণ্ডটা কেমন জোরে জোরে লাফাচ্ছে! মনে হচ্ছে বাইরে বেরিয়ে আসবে এখনি।
আরভী যখন বুঝতে পারে এক হাত সমুদ্রের কাধে ও অপর হাত দিয়ে সমুদ্রের ব্লেজার টেনে ধরে আছে তখন বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায়। তাড়াতাড়ি করে সমুদ্রের কাধ থেকে হাত সরিয়ে ও ব্লেজার ছেড়ে দিয়ে আশেপাশে তাকায়। কিন্তু চা খাওয়ার মতোন তেমন কোনো রেস্টুরেন্ট বা স্টল কিছুই নজরে পড়ছে না। কিন্তু সমুদ্র তো চায়ের কথা বলেছিলো।
আরভী অনেকটা সংকোচ নিয়ে সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করলো,”এখানে থামালেন কেন?”
সমুদ্র আরভীর উত্তর দিলো না। তবে বুকের উপর হাত রেখেই বললো,”আমাকে স্পর্শ করবেন না ললনা। আপনার স্পর্শ আমার একদমই ভালো লাগে নি।”
সমুদ্রের কথা শুনে আরভী পূর্ণ দৃষ্টিতে সমুদ্রের দিকে তাকালো। এতোই যদি আরভীর স্পর্শ ভালো লাগে না তাহলে কেন আরভীকে এতো বিরক্ত করে আরভী তা ভেবে পেলো না। আর আরভী কি ইচ্ছে করে স্পর্শ করেছে নাকি? সমুদ্র এমন ভাবে বলেছে যেনো আরভী ইচ্ছে করে সমুদ্রকে স্পর্শ করেছে। তাই সত্যিটা সমুদ্রের সামনে উপস্থাপন করতে আরভী বললো,”আপনি এভাবে বাইক থামিয়েছেন বলেই তো আমার হাত আপনার কাধে চলে যায়। নয়লে আমারও এতো শখ নেই আপনাকে স্পর্শ করার।”
“তবুও সব দোষ আপনার।”
সমুদ্রের কথায় আরভী অবাক হলো। বাইক থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বললো,”আরেহ অদ্ভুত তো! আমি কিছু করলাম’ই না তারপরও সব দোষ আমার?”
“হ্যাঁ আপনার। কারন আপনি হেসেছেন বলেই তো আমি হুট করে বাইক থামিয়েছি। নয়লে তো এক্সিডেন্ট করে বসতাম।” কথাটি বলে সমুদ্র থামলো। আরভীর দিকে তাকিয়ে দেখলো আরভী সমুদ্রের দিকে অবাক হওয়া চাহনি নিক্ষেপ করে আছে। সমুদ্র আরভীর চোখে চোখ রেখে বলতে আরম্ভ করলো,”আপনার হাসি আমার বুকের মাঝে ঢেউ তুলেছে ললনা। যেদিন আপনাকে প্রথম দেখি সেদিনও আপনার মুচকি হাসির মায়ায় পড়েছিলো আমার একুশ বছরের বাধ্য মন। তারপর থেকেই আমার এই বাধ্য মনটা অবাধ্য হয়ে যায়। না চাইতেও বার-বার আপনার কথা ভাবে। আপনাকে কাছে পেতে চায়। আপনি’ই বলুন এতে আমার কি দোষ ললনা? সব তো এই অবাধ্য মনটার জন্য হচ্ছে। তবে আমি কেন এই প্রেমের দহনে পুড়ছি?”
আরভী চুপ করে রইলো। বলার মতো কিছু খুজে পেলো না। আরভীকে নিরব থাকতে দেখে সমুদ্র সামান্য হেসে আবারো বাইক স্টার্ট দিলো। সমুদ্রকে বাইক স্টার্ট দিতে দেখে আরভী চুপচাপ সমুদ্রের পেছনের সিটে বসে পড়লো।
মিনিট দুয়েক পর সমুদ্র ব্রিজের পাশে বাইক থামালো। তখন মাঝরাস্তায় সেসব কথা বলেই প্রায় তিন-চার মিনিট চলে গেছে। এখন আরভী ঘড়ির কাটায় কাটায় দশ মিনিট কাউন্ট না করলেই হয়।
ব্রিজে বেশ অনেক মানুষই রয়েছে। এ সময়ে বিভিন্ন শ্রেনীর ছেলে-মেয়ে, কপোত-কপোতীরা এখানে আসে সুন্দর কিছু সময় অতিবাহিত করার জন্য।
যেখানটায় ভিড় কম সমুদ্র আরভীকে নিয়ে সেখানে গেলো। ব্রিজের উপর উঠে বসে আরভীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,”চাইলে আমার পাশে বসতে পারেন।”
আরভী আড় চোখে সমুদ্রের দিকে তাকালো। তারপর তখনকার কথার রেশ ধরে বললো,”তখন কে যেনো বলেছিলো আমার স্পর্শ তার ভালো লাগে না?”
সমুদ্র সামান্য হাসলো। ডান হাত দিয়ে মাথা চুলকে বললো,”তখন একসাথে দুটো ঝটকা দিয়েছিলেন তো তাই নিতে পারি নি।”
আরভী সমুদ্রের হাত ধরলো না। নিজ থেকেই উঠে বসলো ব্রিজে। ব্রিজে তেমন একটা আলো না থাকায় কেউ ভালোভাবে চিনবে না আরভীকে। এছাড়া এখানের সবাই নিজেদের নিয়েই ব্যাস্ত। তবে এমন একটা জায়গায় সমুদ্রের সাথে এসে কেমন যেনো লাগছে আরভীর। যেদিকেই চোখ যাচ্ছে শুধু কপোত-কপোতী দের দেখা যাচ্ছে।
“এই অর্ক, এদিকে আয়।”
সমুদ্র দূরের এক বাচ্চা ছেলেকে নাম ধরে এদিকে ডাকলে আরভী কৌতুহলী চোখে সমুদ্রের দিকে তাকায়। তারপর আবার বাচ্চা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখে ছেলেটা হাসিমুখে এদিকেই আসছে।
ছেলেটা সমুদ্র ও আরভীর কাছে এসে চায়ের ফ্লাক্স নিচে রেখে বললো,”কোনটা দিমু বস? দুধ চা নাকি রঙ চা?”
সমুদ্র আরভীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কোনটা খাবেন?”
“রঙ চা।”
“এরকম একটা পরিবেশের সাথে রঙ চা যায় না ললনা। আজ বরং দুধ চা খান।”
“নিজেই যখন ভেবে রেখেছেন তাহলে আবার আমাকে কেন জিজ্ঞেস করলেন?”
“ভদ্রতা বলে একটা কথা আছে না?”
“ভদ্রতার ভ টাও তো আপনার মাঝে নেই।”
“আই নো ললনা।” কথাটি আরভীকে বললো সমুদ্র। তারপর অর্কের দিকে তাকিয়ে বললো,”এই শুন, মেডামের চায়ে মিস্টি বেশি দিবি। মেডাম মনে হয় মিস্টি খান না দেখেই মিস্টি করে কথা বলতে জানেন না।”
অর্ক খিলখিলিয়ে হেসে বললো,”আয়চ্ছা বস। নো চিন্তা। দেখবেন কাইলকা থেইকা মেডাম মিস্টি মিস্টি কথা কওয়া শুরু করবো।”
দুজন মিলে আরভীকে নিয়ে মজা করছে আর আরভী চুপচাপ তা মেনে নিবে তা কি করে হয়? তাই দুজনকে চুপ করাতে আরভী ঝাঝালো স্বরে বলে উঠলো,”আপনার টাইম কিন্তু শেষ সমুদ্র। আমাকে নিয়ে আরেকবার মজা করে দেখুন। আমি সাথে সাথে চলে যাবো।”
আরভীর গলার স্বর অর্কের কাছে কেমন চেনা পরিচিত মনে হচ্ছে। এতোক্ষন আরভীর দিকে ভালোভাবে তাকায় নি অর্ক। কিন্তু এবার ভালোভাবে তাকানোর পর বুঝতে পারলো স্বয়ং আরভী রায়হান অর্কের সামনে বসে।
আরভীকে দেখে অর্ক খুশি হয়ে বললো,”আরে আপনে! আপনেরে তো আমি চিনি। আমার আম্মায় আপনেরে ভোট দিছে।”
ছেলেটির কথার ধরন আরভীর কাছে মজার লাগলো। তাই ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,”তাই বুঝি? তাহলে তোমার আম্মাকে আমার পক্ষ থেকে এত্তো এত্তো ধন্যবাদ জানিয়ে দিও কেমন?”
“আয়চ্ছা। ভালোই হইছে আপনের দেহা পাইয়া গেছি। আমাগো এলাকা থেইকা কয়ডা পোলা প্রতিমাসে চান্দা তুলে। এই টেহা দিতে গিয়া আমাগো অনেক কাম করা লাগে। আর টেহা না দিলে আমাগো উপর জুলুম করে। এইডা একটু দেইখেন তো কিছু করা পারেন কিনা। তাইলে আমাগো মেলা উপকার হইবো।”
সমুদ্র অর্কের কথা শুনে ব্রিজ থেকে নেমে দাঁড়িয়ে অর্ককে নিজের কাছে টেনে এনে বললো,”তুই এ কথা আমাকে আগে কেন জানাস নি অর্ক?”
“আপনে সাধারণ মানুষ। আপনেরে কইলে আপনে কি করতে পারবেন? হেগোর কাছে অনেক পাওয়ার আছে।”
আরভী নিজেও ব্রিজ থেকে নেমে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,”তোমাদের এলাকা কোনটা?”
“উত্তরে যে বস্তি আছে ওইডাই।”
——
আরভী ও সমুদ্র ব্রিজের নিচের পানির দিকে তাকিয়ে চা পান করে যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ করে সে সময়কার কথা আরভীর মনে পড়ে গেলো। আরভী তখন খেয়াল না করলেও আরভী এখন সেসব ভেবে মনে পড়লো সমুদ্র সেসময় বলেছিলো একুশ বছরের বাধ্য মন। আরভী সমুদ্রের দিকে তাকালো। সমুদ্রকে দেখে তো কোনোদিক দিয়েই একুশ বছরের মনে হয় না। সমুদ্র হয়তো আরভীর সমবয়সী হবে। আরভীর থেকে বড় হলেও বড়জোর এক থেকে দু বছরের বড় হবে। তবে তখন কেন এটা বলেছিলো সমুদ্র?
সমুদ্রের বয়স আসলে কত তা জানার জন্য আরভী সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,”আপনার বয়স কত সমুদ্র?”
“ঊনত্রিশ চলছে।”
“তবে তখন কেন বলেছিলেন একুশ বছরের বাধ্য মন?”
সমুদ্র মুখের সামনে চায়ের ওয়ান টাইম কাপটা ধরেছিলো। কিন্তু আরভীর কথা শুনে আবার নামিয়ে নিলো। আরভীর দিকে না তাকিয়েই প্রতিত্তোরে বললো,”কারন আমি আপনাকে আরো আট বছর আগে থেকে চিনি।”
চলবে….