#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_২৫
ইমতিয়াজ এখান থেকে বেড়িয়ে সোজা আরভীদের বাড়িতে এসেছে। আরভীও সবে মাত্র বাড়ি ফিরেছে। ইমতিয়াজকে দেখে বুঝে গেলো ইমতিয়াজ নিজের কাজে সফল হয়েছে।
আরভী সামান্য হেসে ইমতিয়াজকে জিজ্ঞেস করলো,”আরেহ ইমতিয়াজ! তোমার কাজ শেষ তবে?”
ইমতিয়াজও সামান্য হেসে প্রতিত্তোরে বললো,”জ্বি ম্যাম। যেসব প্রমাণ হাতে লেগেছে নাহিদ চৌধুরী আর রাজনীতিতে ফিরতে পারবেন বলে আমার মনে হচ্ছে না।”
কথাটি বলে ইমতিয়াজ আরভীর দিকে একটা ফাইল এবং একটা পেনড্রাইভ এগিয়ে দেয়।
আরভী ধীরগতিতে সেসব হাতে নিয়ে বিরবির করে বলে উঠে,”তোমার মৃত্যুর বদলা আমি খুব জলদি নিবো বাবা। সব প্রমাণ আমার হাতে চলে এসেছে। এবার শুধু সবার সামনে নাহিদ চৌধুরীর মুখোশ খুলে ছুড়ে ফেলার পালা।”
“ম্যাম আমি আজ তবে আসি।”
“সাবধানে থেকো। প্রয়োজনে তোমার বউ ও মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাড়িতেই কিছুদিন থাকতে পারো। যতোদিন না নাহিদ চৌধুরীর কিছু একটা ব্যাবস্থা হচ্ছে।”
“আপনি চিন্তা করবেন না ম্যাম। প্রয়োজন হলে আমি আপনাকে জানাবো।”
তারপর আরভী সম্মতি দিলে ইমতিয়াজ উঠে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়।
আরভী নিজের ঘরে গিয়ে সর্বপ্রথম পেনড্রাইভ ল্যাপটপের সাথে কানেক্ট করে। ভেতরে কিছু ফাইল ও একটা অডিও দেখতে পায়। কিসের অডিও জানার জন্য যখন অডিওটা প্লে করে তখন নাহিদ চৌধুরীর কথা আরভীর কর্ণগোচর হয়।
আরশাদ রায়হানের মৃত্যুর বর্ণনা শুনে আরভীর মুখে বিষাদের হাসি ফুটে উঠে। কতটা জঘন্য ভাবে মেরেছে আরশাদ রায়হানকে। নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট হয়েছে উনার।
আরভী চোখ বন্ধ করে নাহিদ চৌধুরীর প্রতিটি কথা মনোযোগ সহকারে শুনতে থাকে। আর মনের ক্যানভাসে কল্পনা করতে থাকে এই ভয়াবহ দৃশ্য। আরভীর চোখ থেকে অঝোর ধারায় নোনতা জল গড়িয়ে পড়ছে।
কিন্তু হঠাৎ নাহিদ চৌধুরীর মুখে হেমন্তের নাম শুনে ফট করে চোখ মেলে তাকায় আরভী।
হৃদপেশি দ্রুত গতিতে সংকোচন ও প্রসারণ হতে থাকে। আরভীর মন বারবার বলছে সব মিথ্যে হোক। এটা স্বপ্ন হোক। নাহিদ চৌধুরীর সাথে হেমন্তের কোনো যোগসূত্র না থাকুক। কিন্তু যেমনভাবে সত্য কখনো মিথ্যে পরিণত হয় না। তেমনভাবেই আরভীর ইচ্ছে অনুযায়ী এটাও স্বপ্নে পরিণত হয় নি। আরভী বাকহারা হয়ে পুরো অডিওটা শুনলো।
অডিও শেষ হতেই দুহাত দিয়ে পেছনের দিকে চুল টেনে ধরে আরভী। আরভীর মনের কোথাও একটা হেমন্তকে নিয়ে আশার প্রদীপ জ্বলে ছিলো। হয়তো ইমতিয়াজ ভুল ছবি পাঠিয়েছে এটা ভেবে। কিন্তু নাহিদ চৌধুরীর এসব কথা শুনে আজ সেই আশার প্রদীপ নিভে যায়।
আরভীর পুরো ঘর আলোয় ঝলমল করলেও মনের ভেতরটা নিস্তব্ধ অন্ধকারে ঢেকে আছে। কোথাও কোনো আলো নেই। যেনো মনির গহিনটা নিস্তব্ধ অন্ধকারের সাথে খেলায় মেতে আছে।
আরভী আস্তেধীরে উঠে দাঁড়ায়। কাঠের আলমারির কাছে গিয়ে আলমারি থেকে শুভ্র রঙের একটা শার্ট ও একটা ছবির অ্যালবাম বের করে। শার্ট ও অ্যালবাম বেলকনিতে নিয়ে ঘৃণার সহিত ফ্লোরে ফেলে দেয়। নিচে গিয়ে রান্নাঘর থেকে দিয়াশলাই ও ঘরে এসে হ্যাক্সিসল নিয়ে আবার বেলকনিতে চলে যায়।
বেলকনিতে এসে প্রথমে শার্টের উপর হ্যাক্সিসল ঢেলে তাতে দিয়াশলাই দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। বেলকনির দেওয়াল ঘেঁষে আগুনের সামনে বসে এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে আগুনের দিকে। তার কিছুক্ষণ পর অ্যালবাম থেকে একটা একটা করে হেমন্তের ছবি বের করে আগুনে জ্বালাতে থাকে।
বর্তমানে আরভীর হাতে হেমন্তের শেষ ছবিটি রয়ে গেছে। আরভী তাতে আগুন ধরিয়ে হাতে ধরে রেখে দেখতে থাকে। আগুন হাতের আঙুলের কাছাকাছি চলে এসেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এটা না ফেললে হাত পুড়ে যাবে। তা জানা সত্ত্বেও আরভী নিজের হাত সরালো না। বরং জ্বলতে দিলো হাতের আঙুল। এটাকে নিজের শাস্তি হিসেবে ধরে নিলো আরভী। হেমন্তকে ভালোবাসার শাস্তি। একজন প্রতারককে ভালোবাসা শাস্তি। বাবার খুনিকে ভালোবাসার শাস্তি।
জ্বলন্ত আগুন এক সময় নিভে যায়। আরভীর হাতের বৃদ্ধা আঙুল ও তর্জনী আঙুল কিছুটা পুড়ে যায়। এ দুটো আঙুলে ভীষণ ভাবে জ্বালাপোড়া করছে। সামান্য একটু আঙুল জ্বলেছে তাতেই এতো যন্ত্রণা হচ্ছে। তাহলে আরশাদ রায়হানকে যখন শ্বাস রোধ করে হত্যা করা হয়েছে তখন নিশ্চয় অনেক বেশি কষ্ট হয়েছে।
নিচে পড়ে থাকা ছাই আরভী হাতের মুঠোয় নেয়। মুখের সামনে হাত নিয়ে মুঠো হালকা করে স্বল্প বেগে ছাই নিচে ফেলতে থাকে। আর বিষাদ মাখা কন্ঠে বলে উঠে,”ভালোবাসার প্রতিদানে ধোঁকা দিয়েছেন আপনি আমায়। আমিও এই ধোঁকার প্রতিদানে মৃত্যু দিবো আপনাকে।”
রাত ন’টা বেজে সতেরো মিনিট। নাহিদ চৌধুরী এখনো অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন নিজের বিছানায়। হঠাৎ একজন ঘরের আলো জ্বালিয়ে দেয়।
নাহিদ চৌধুরীকে এরকম এলোমেলো হয়ে অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকতে দেখে সন্দেহ জাগে ছেলেটির মনে। ছেলেটি আস্তেধীরে নাহিদ চৌধুরীর দিকে এগিয়ে যায়। বার তিনেক “মামা” বলে ডাকে। কিন্তু নাহিদ চৌধুরীর কোনো সারা শব্দ নেই। ছেলেটি এবার টেবিলের উপর থেকে পানির জগ নিয়ে পানির ছিটে দিতে থাকে নাহিদ চৌধুরীর চোখে-মুখে।
সাময়িক সময় বাদে নাহিদ চৌধুরী চোখ মেলে তাকান। আর তা দেখে ছেলেটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে,”ঠিক আছো তুমি?”
নাহিদ চৌধুরী উঠে বসার চেষ্টা করলে ছেলেটি নাহিদ চৌধুরীকে সাহায্য করে উঠে বসার জন্য।
নাহিদ চৌধুরী খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে মনে চেষ্টা করেন উনার সাথে কি হয়েছিলো। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছেন না। শুধু মনে পড়ছে ইমতিয়াজ অ্যালকোহল এনেছিলো আর উনি সেটা পান করেছিলেন। তারপর আর কিছু মনে নেই।
ছেলেটি নাহিদ চৌধুরীকে চুপ থাকতে দেখে পুনরায় জিজ্ঞেস করে,”কি হয়েছে তোমার?”
“ভাগ্নে, আমার মনে হয় নেশাটা একটু চড়ে বসেছিলো।” অন্যমনস্ক হয়ে উত্তর দিলেন নাহিদ চৌধুরী।
“মামা আমি তোমাকে বলেছিলাম রাতে আমি তোমাকে নিতে আসবো। আর তুমি ছাইপাঁশ গিলে বসে আছো?”
“অনেক দিন পর দেখেছিলাম তো তাই আর নিজেকে সামলাতে পারি নি। মাথাটা খুব ধরেছে রে।” বলে দুই আঙুল দিয়ে মাথায় স্লাইড করতে লাগলেন নাহিদ চৌধুরী।
“তুমি বস আমি আসছি।” বলে ছেলেটি ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।
মিনিট ছয়েক পর হাতে একগ্লাস লেবু পানি নিয়ে আবার ফিরে আসে।
নাহিদ চৌধুরীর সামনে গ্লাসটি ধরে বলে,”খেয়ে নাও। ভালো লাগবে।”
নাহিদ চৌধুরী গ্লাসটা হাতে নিলে ছেলেটি জিজ্ঞেস করে,”এসব কে এনেছিলো? ইমতিয়াজ? আর খাবে ভালো কথা একটু পরিমাণ মতো খাবে তো নাকি? কতটুকু খেলে নেশা হবে তা অনুমান করে খেতে পারলে না?”
“হ্যাঁ ও’ই এনেছিলো। কিন্তু আজ আমি এক বোতলও খাই নি। প্রতিবার প্রায় দু’বোতল শেষ করে ফেলি। তাও নেশা চড়ে না। আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা মেশানো ছিলো ওটায়।” ভাবুক হয়ে বললেন নাহিদ চৌধুরী।
“বাদ দাও। এই লেবু পানিটা খেয়ে তাড়াতাড়ি এটা পড়ে নাও।” একটা শপিং ব্যাগ নাহিদ চৌধুরীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো ছেলেটা।
নাহিদ চৌধুরী ব্যাগ হাতে নিয়ে ব্যাগের ভেতর থাকা জিনিস বের করে দেখেন একটা বোরখা ও নিকাব রয়েছে। তা দেখে উনি হতভম্ব হোন।
অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করেন,”ভাগ্নে! এটা তো মেয়েদের বোরখা। আমি পড়বো কেন?”
“এটা না পড়লে এলাকা ছেড়ে তুমি পালাতে পারবে না। জান বাঁচানো ফরজ। আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি এটা পড়ে নাও।”
“কিন্তু ভাগ্নে!”
“কোনো কিন্তু নয় মামা। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। প্লিজ তাড়াতাড়ি পড়ে নাও।” তাড়া দেখিয়ে বললো ছেলেটি।
“বলছিলাম আর কোনো পথ নেই?”
“মামা!” চিৎকার করে বলে ছেলেটি।
“রাগ করছিস কেন? পড়ছি তো।” বলে বোরখা ও নিকাব পরা শুরু করলেন নাহিদ চৌধুরী। এ ছাড়া যে আর কোনো গতি নেই। এই দিনও দেখতে হলো! শেষমেশ কিনা মেয়েদের বোরখা!
——
কালরাতে পুরোনো স্মৃতি গুলোর সাথে আরভী নিজের মনের সমস্ত অনুভূতি গুলো পুড়িয়ে ফেলেছে। আরভীর এটা ভেবে রাগ হচ্ছে আরভীর কেন মনে হতো সব মিথ্যে, হেমন্ত আরভীকে ঠকাতে পারে না।
দু’দিন আগেও নিজের উপর রাগ হয়েছিলো হেমন্তকে ভুল বুঝেছে তা ভেবে আর আজ আবারও রাগ হচ্ছে হেমন্তকে পুনরায় বিশ্বাস করে।
আরভী এই আট বছরে নিজের অনুভূতি লুকাতে শিখে গেছে। আর তাই তো সকালে ঘুম থেকে উঠার পর আফিফা আফরোজ ধরতে পারেন নি কিছু।
আরভী খাবার টেবিলে বসে এক হাতে ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রোল করছে ও অপর হাতে খাবার খাচ্ছে। আর তা দেখে আফিফা আফরোজ তেঁতে উঠে বললেন,”হয় খাবার আগে শেষ কর নয়লে আগে মোবাইল চালা। দু কাজ কখনো একসাথে করতে নেই মনে রাখিস।”
আফিফা আফরোজের কথায় আরভী মোবাইল রেখে দিতে গেয়েও রাখলো না। নোটিফিকেশন এর টুংটাং শব্দে চেক করে কিসের নোটিফিকেশন।
দেখতে পায় হোয়াটসঅ্যাপে ফায়াজ একটা ঠিকানা পাঠিয়েছে। মূলত দুদিন আগে ফায়াজকে হেমন্তের ছবি দিয়ে বলেছিলো লোক লাগিয়ে এই ছেলেকে খুজে বের করতে। এতো তাড়াতাড়ি খুজে বের করতে পারবে তা ভাবে নি আরভী।
ঠিকানা’টি একটা রিসোর্টের। যার লোকেশন বান্দরবন। তারমানে হেমন্ত এখন বান্দরবন অবস্থান করছে। আরভী তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।
যেহেতু হেমন্তের ঠিকানা পাওয়া গেছে সেহেতু এভাবে কিভাবে হেমন্তকে ছেড়ে দিবে আরভী? হেমন্তের সাথে তো দেখা করতেই হবে। অনেক হিসেব-নিকেশ যে বাকি রয়ে গেছে।
চলবে…