#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_৩১
“আরভীকে কিভাবে চিনিস তুই সমুদ্র?”
“সেটা তোর না জানলেও চলবে। আর হ্যাঁ, আমি যেনো কখনো তোকে আরভীর আশেপাশেও না দেখি। আমার ভাবতে ঘৃণা হচ্ছে তুই আমার ভাই আর নাহিদ চৌধুরী আমার মামা হোন। কি করে পারলি মিনহাজ? তুই অন্তত এমন ছিলি না।”
মিনহাজ হাসলো সমুদ্রের কথায়। সত্যি’ই তো বলেছে সমুদ্র। মিনহাজ তো কখনো নাহিদ চৌধুরীর কোনো কাজে সাপোর্ট করে নি। তবে এবার কেন করলো? তাও এতো বড় একটা জঘন্য কাজে?
এর উত্তর মিনহাজের কাছে নেই। ভুল করেছে মিনহাজ। মস্ত বড় ভুল। যার কোনো প্রায়শ্চিত্ত নেই। সাথে করে সমুদ্রের প্রশ্নেরও কোনো উত্তর মিনহাজের জানা নেই। তাই সমুদ্রের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বললো,”রাতে থেকে যা এখানে। ফ্রিজে খাবার আছে। গরম করে খেয়ে নিস। আমি ঘুমোতে যাচ্ছি।”
এর’ই মাঝে ড্রয়িং রুমে থাকা টি-টেবিলের উপরে মিনহাজের মোবাইলটা টুংটাং শব্দে বেজে উঠে। মিনহাজ একবার সেদিকে তাকিয়ে আবার রুমের ভেতরে চলে যায়। গিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
সমুদ্র আজ অনেক ক্লান্ত। অনেকটা পথ অতিক্রম করে এখানে এসেছে। এসেই মারপিট করেছে। তারউপর আবার দুপুরের পর থেকে সিগারেটের ধোঁয়া ব্যাতিত কিছুই গলা দিয়ে নামে নি। মানসিক ক্লান্তি তো রয়েছেই সাথে। শরীর যেনো আর চলতে চাইছে না। মাথায় ঘুরছে হাজারো প্রশ্ন। কিন্তু যেই প্রশ্নটা অনেক বেশি পীড়া দিচ্ছে তা হলো আরভী এখন কোথায় আছে, কেমন আছে।
সমুদ্র চোখ বন্ধ করে দু’পা টি-টেবিলের উপরে তুলে দিয়ে সোফার সাথে হেলান দিয়ে বসে। কপালের উপর ডান হাত রেখে ভাবতে থাকে এখন কি করবে! আরভীকে কোথায় পাবে? এর’ই মাঝে আবারো মিনহাজের মোবাইল টুংটাং শব্দ করে বেজে উঠে। সমুদ্রের হঠাৎ করে মাথায় খেলে যায় মিনহাজের কাছে তো আরভীর নম্বর থাকবে। তা ভেবেই সমুদ্র মিনহাজের মোবাইল হাতে নেয়। মোবাইল আনলক করে হোয়াটসঅ্যাপ চেক করতেই দেখতে পায় আরভী ও মিনহাজের অগণিত ম্যাসেজ। সমুদ্র সব কিছু ভুলে সারা রাত জেগে এই ম্যাসেজ গুলো পড়তে থাকে। এই ম্যাসেজ গুলো থেকে যা জানতে পেরেছে তা হলো মিনহাজ নিজের আসল পরিচয় আরভীকে জানায় নি। হেমন্ত নামের নতুন একটা চরিত্র হয়ে ধরে দিয়েছিলো আরভীর কাছে। যে চরিত্র বসন্তের মাতাল হাওয়ার মতো আরভীর জীবনকে রঙধনুর সাত রঙে রাঙ্গিয়ে জীবনকে পরবর্তীতে সাদা-কালোর মাঝে সীমাবদ্ধ করে হারিয়ে গেছে।
পরের দিন ভোরে উঠে মিনহাজকে না জানিয়েই বেরিয়ে যায় সমুদ্র। অবশ্য যাওয়ার আগে মিনহাজের মোবাইল নিজের সাথে করে নিয়ে নিয়েছে। হয়তো কাজে দিবে এই ভেবে। তবে নিজের বাড়িতে না ফিরে সোজা নাহিদ চৌধুরীর বাড়ি যায় সমুদ্র। গিয়ে দেখে এখানে সবাই আনন্দ-উল্লাসে মেতে আছে। সমুদ্রের হাসি পায়। এরা অন্যের জীবনের সুখ কেড়ে নিয়ে নিজেরা উৎসবে মত্ত।
“সকাল সকাল এতো কিসের আনন্দ মামা?”
নাহিদ চৌধুরী সমুদ্রকে দেখে সমুদ্রকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। আর প্রফুল্লচিত্তে বলে,”ভাগ্নে, এবারের নির্বাচনে তোর মামা বিজয়ী হবে। দেখে নিস তুই। তার জন্যই একটু আনন্দ করছি সবাই মিলে।”
সমুদ্রের ভীষণ করে বলতে ইচ্ছে হলো তোমার মতো মামা পেয়ে নিজেকে বড় অভাগা মনে হচ্ছে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলে নি সমুদ্র। নিজেকে নাহিদ চৌধুরীর বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”মামা, তুমি মানুষ খুন করেছো?”
সমুদ্রের এ প্রশ্নে সবার আনন্দ-উল্লাস থেমে যায়। সবাই চুপ করে সমুদ্রের মুখপানে তাকিয়ে থাকে। কারন এখানে উপস্থিত সবার’ই জানা সমুদ্র স্বভাব-চরিত্র সম্পর্কে।
নাহিদ চৌধুরী সবার দিকে তাকিয়ে চোখে ইশারা করলেন বেড়িয়ে যেতে এ ঘর থেকে। সবাই বের হয়ে গেলে সমুদ্রের কাধে এক হাত রেখে শুধালেন,”তুই জানলি কিভাবে?”
“জেনেছি কোনো এক ভাবে। তুমি আগে বলো কেন করলে এমন? কি পেলে একজন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে?”
“রাজনীতিতে এসব খুনখারাপি একটু-আকটু করতে হয় ভাগ্নে। তা না হলে এই জগতে টিকে থাকা যায় না। এই যে দেখ, অনেক বার চেষ্টা করেছি এসব খুন-খারাপি না করে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার। কিন্তু পারলাম কই? আর যতোদিন আরশাদ আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে থাকবে ততোদিন আমি কোনো ভাবেই মেয়র হতে পারবো না এ কথা আমি বেশ ভালো করেই বুঝে গিয়েছিলাম। তাই অনেক ভেবেচিন্তে আর কোনো পথ না পেয়ে আমি এ পথ বেছে নিয়েছি। রাজনীতিতে এসব অনেক সাধারণ ব্যাপার ভাগ্নে।”
“তারমানে কি প্রয়োজন পড়লে তুমি আমাকেও খুন করবে?”
“ভাগ্নে! কি বলছিস এসব? আমি তোকে খুন করবো এ কথা তুই ভাবলি কি করে? আমি আমার এই জীবনে শুধু তোকে আর মিনহাজকেই স্বার্থ ছাড়া ভালোবেসেছি। সেটা নিশ্চয় জানিস তুই?”
সমুদ্র এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। কি স্বাভাবিক ভাবে কথাগুলো বলছেন উনি। যেনো খুন করা উনার জন্য অত্যন্ত সাধারণ একটা ব্যাপার। এখান তো এই মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেও ঘৃণা হচ্ছে।
সমুদ্র নাহিদ চৌধুরীর ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বললো,”আজ বুঝেছি কেন মা তোমাকে নিজের ভাই বলে কারো সামনে পরিচয় দেয় না। তোমাকে দেখে আমার ঘৃণা হচ্ছে মামা, তোমার প্রতি আমার ঘৃণা জন্মেছে। ভালো থেকো তুমি তোমার এই রাজনীতি নিয়ে।”
“ভাগ্নে শোন, ভাগ্নে!” বলে বারকয়েক পেছন থেকে ডাকলেন নাহিদ চৌধুরী। কিন্তু সমুদ্র দাঁড়ায় নি। চলে যায় এ বাড়ির ত্রিসীমানা ছেড়ে। ভেবে নেয় আর কখনো পদার্পণ করবে না এ বাড়ির প্রাঙ্গনে।
আট বছর কেটে যায়। এর মাঝে মিনহাজ কানাডায় চলে যায়। সমুদ্র আর কখনো নাহিদ চৌধুরীর বাড়িতে যায় নি। নাহিদ চৌধুরী বারবার সমুদ্রের মুখোমুখি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিবার’ই সমুদ্র এড়িয়ে চলেছে উনাকে। ইয়াসমিনের সাথেও নাহিদ চৌধুরীর সম্পর্ক ভালো নয়। তাই নাহিদ চৌধুরী কখনো সমুদ্র দের বাড়িতে আসতেন না। কিন্তু সমুদ্র উনার কাছ থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে নিলে উনি বাধ্য হোন সমুদ্র দের বাড়ি আসতে। তবুও ফলাফল শূন্য।
সমুদ্র এখনো গাজীপুরের চৌধুরী গ্রুপ অব কম্পানিতে জব করছে। তবে এখন ম্যানেজার পদে নয়, সিনিয়র ম্যানেজার পদে আছে।
সময় চলছে নিজের গতিতে। সাথে শরীর টাও সময়ের সাথে সাথে সবার মতো করে এগিয়ে গেছে সমুদ্র। কিন্তু এগোতে পারে নি মনটা। মন তো এখনো সেই আট বছর আগের জায়গাতেই পড়ে আছে। সাথে প্রতিনিয়ত আরভীকে খুজে বেড়াচ্ছে। নিজেকে বড্ড তৃষ্ণার্ত মনে হয় সমুদ্রের। আরভীর তৃষ্ণাটা যেনো দিনে দিনে সমুদ্রকে নিরব মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আরভী হীন জীবনকে বড় পানসে লাগছে।
রাতে শুয়ে শুয়ে মোবাইলে ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রোল করছে সমুদ্র। হঠাৎ একটা ছবি সমুদ্রের সামনে এসে পড়ে যা দেখে সমুদ্রের হৃদপিন্ডের ধুকপুকান বেড়ে যায়। মুখে ফুটে উঠে হারিয়ে যাওয়া অমূল্য রত্ন খুজে পাওয়ার হাসি। খুশিতে চোখে পানি চলে আসে।
এই চোখের পানির জন্য ছবিটা স্পষ্ট দেখতে পারছে না সমুদ্র। তাই তাড়াহুড়ো করে চোখের পানি মুছে ছবিটা ঝুম করে দেখতে থাকে।
মেয়েটার চেহারায় অনেক পরিবর্তন এসেছে। না, মেয়ে বলা ঠিক হবে না। কেননা ছবিটি দেখে মনে হচ্ছে আরভী এখন সম্পূর্ণ নারীতে রুপান্তর হয়েছে। যাকে বলা যায় সমুদ্রের শখের নারী।
সমুদ্র আরভীর ছবিটি চোখের দিকে ঝুম করে। দেখতে পায় চোখ যুগল আর আগের মতো নেই। এই চোখ যুগল দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে চোখের চাহনি ঠিক কতটা তুখোড়। মুখের বাচ্চামো ভাবটাও নেই সাথে।
আচ্ছা হঠাৎ করে আরভীর ছবি সমুদ্রের নিউজফিডে কিভাবে এলো? এ প্রশ্নটা সমুদ্রের মনে উদয় হয়।
প্রশ্নের উত্তর জানতে সমুদ্র ছবিটি ঝুম আউট করে ক্যাপশন দেখে। যেখানে লেখা আছে,”এবার নাহিদ চৌধুরীর প্রতিদ্বন্দ্বীতে থাকছেন আরশাদ রায়হানের সুযোগ্য কন্যা আরভী রায়হান। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আরভী রায়হানও কি বাবা আরশাদ রায়হানের মতো সাধারণ জনগণের ভালোবাসা অর্জন করে জিতে নিতে পারবে মেয়রের পদ?”
ক্যাপশন পড়ে সমুদ্র বুকটা ধ্বক করে উঠে। এ কোন খেলায় নেমেছে আরভী? নাহিদ চৌধুরী নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য সব কিছু করতে পারে। সব কিছু মানে সব। এমনকি আরভীকে খুন পর্যন্তও করতে পারে। এতে উনার বিন্দু মাত্র হাত কাপবে না।
আরভীর ছবি দেখে একটু আগে যতোটা খুশি হয়েছিলো সমুদ্র এখন ঠিক ততোটাই ভয় হচ্ছে। আরভী কেন নির্বাচনে দাঁড়িয়েছে সমুদ্র তা অনুমান করতে পারছে। কিন্তু এ যে জেনে বুঝে আগুনে ঝাপ দেওয়ার সমতুল্য!
চলবে….
বি.দ্র. : কালকে গল্প দেওয়ার কথা বলেও দিতে পারি নি তার জন্য দুঃখিত।🙂