#মেঘের_আড়ালে_রোদ
#পর্ব_৩৩
Sabihatul_Sabha
কখন কার মৃত্যু কিভাবে আশে কেউ বলতে পারে না। মৃত্যু কারো বয়স দেখে না, যার ডাক যখন আসবে তাকে যেতেই হবে।
গ্রাম থেকে সবাই হসপিটালে গিয়ে দেখে মিরাজ চৌধুরী আর নেই। হসপিটালে নিয়ে আসার আগেই মা-রা গেছেন।
যেই কেইসের জন্য গ্রামে যেতে পারেনি সেই কেইসের তদন্ত করতে গিয়েই মৃত্যু ঘটেছে।
হালিমা বেগমের পাগলামি দেখে কেউ নিজের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। স্বামী হারিয়ে পাগলের মতো আচরণ করতে শুরু করেছেন।
নির্জন, চঞ্চল ছেলেটা জেনো একদম শান্ত হয়ে গেছে। সে জেনো বাবা নয় জীবনের চাবি হারিয়ে ফেলেছে। “চাবি ছাড়া যেমন তালা মূল্যহীন বাবা ছাড়া নির্জনের নিজেকে ঠিক তেমন মনে হচ্ছে। ”
মানুষ বলে ছেলেরা নাকি কষ্ট পেলেও কাঁদতে জানে না। নির্জন আজ তিনদিন দরজা বন্ধি। বাবা হারিয়ে একদম ভেঙে পরেছে।
ডাক্তার বললো এটা এক্সিডেন্ট কিন্তু সবাই এটা মেনে নিলেও মেঘলা কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না এটা এক্সিডেন্ট! ডাক্তার কিছু লুকাচ্ছে! এটা মার্ডার! প্লেন করে মিরাজ চৌধুরীকে খু’ন করা হয়েছে।
বাড়িটা কেমন নিশ্চুপ হয়ে গেছে। আনোয়ার চৌধুরী ছেলের এমন মৃত্যুতে নরম হয়ে গেছেন। আফরোজা বেগম কিছুই জানেন না। উনার শুধু শ্বাস চলছে কখন উনি নিজেই চলে যান সেই চিন্তায় আছে সবাই।
সকালে নাস্তা বানিয়ে সবাই কে ডাকলেন আমেনা বেগম।
নিরুপমা আস্তে ধীরে নেমে আসলো। মুখটা কেমন চুপ্সে আছে।
আমেনা বেগমঃ কি হয়েছে নিরু শরীর ভালো না..?
নিরুপমা হাসার চেষ্টা করে বললো,’ ভালো ভাবি। আব্বা ভাই কই.?”
আমেনা বেগমঃ আব্বার জন্য উপরে খাবার দিয়ে আসছে টুম্পার আম্মা। আর আপনার ভাই অফিসে চলে গেছে, অফিসে কাজের সমস্যা চলছে।
নিরুপমা খাবারের প্লেটে খাবার নিয়ে হালিমা বেগমের রুমের সামনে গেল।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখলো হালিমা বেগম জায়নামাজে বসে কাঁদছেন।
নিরুপমার চোখে জলে ভরে উঠলো। আজ হালিমার এই চোখের পানির জন্য যে সে নিজে দায়ী!! আজ ভাই হারিয়েছে কাল না জানি আরও কতোজন হারাতে হয়!! নিরুপমা খাবার প্লেট রেখে জলদি বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। জীবনের কালো অধ্যায় যে আবার শুরু হলো।
কি লুকাতে চাচ্ছে নিরুপমা..?
__________________
দেখতে দেখতে কেটে গেল এক মাস। এই এক মাসে সবাই কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে, স্বাভাবিক হতে পারেনি হালিমা বেগম। স্বামী হারিয়ে কেমন চুপচাপ হয়ে গেছেন। পাল্টে গেছে নির্জন। আগের মতো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, এখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো, কথায় কথায় ফাজলামো করা সব বন্ধ হয়ে গেছে।
বাসায় আসছে খাচ্ছে আর রুমে যাচ্ছে কারো সাথে দ্বিতীয় কোনো শব্দ খরচ করছে না।
সকাল সকাল চেঁচামেচির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল সবার।
সবাই নিচে নেমে আসলেও নির্জনের কোনো খবর নেই সে ঘুমাচ্ছে।
আহনাফ শ্রাবণ আনোয়ার চৌধুরীর পাশে বসে আছে। আজাদ চৌধুরী রাগে নির্জনকে ডেকে আনতে বলেছেন।
নির্জন নিচে এসে দাঁড়ালো।
আজাদ চৌধুরী নির্জনের দিকে পেপার এগিয়ে দিয়ে রেগে বলে উঠলেন,’ এইসব কি নির্জন!!.? ‘
নির্জন কাগজটা হাতে নিয়ে একটু হাসলো তারপর সবার দিকে তাকিয়ে বললো,’ আপনারা এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন..? এখানে কি সার্কাস দেখানো হচ্ছে..? ”
আহনাফ ধমক দিয়ে বলে উঠলো, ‘ নির্জন আব্বু যা বলছে উত্তর দে।’
নির্জনঃ ভাই তুমিও! এতোদিন কাজ করিনি বলে কতো কিছু বলতে এখন কাজ নিয়েছি এটাতে তো কারো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
আজাদ চৌধুরীঃ কাজ নিয়েছো ভালো কথা, পুলিশের জব কেন নিতে হবে!!..? তুমি চাইলে এখনি অফিসে জয়েন হতে পারো।
নির্জনঃ আমি এই বিষয় আর কিছু বলতে চাচ্ছি না বড় আব্বু।
আজাদ চৌধুরী রেগে বলে উঠলেন,’ যা ইচ্ছে করো দরকার হলে ঘরে বসে খাও তাও পুলিশের চাকরি করতে পারবে না।’
নির্জন মৃদু হাসলো।
হালিমা বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে আবার রুমে চলে গেলেন৷
উনি খুব ভালো করেই জানেন ছেলে কেন স্বামীর পুলিশের চাকরি নিয়েছে। নির্জন তদন্ত করে সেই লোক পর্যন্ত পৌঁছাবে যে এতো নিষ্ঠুরভাবে ওর আব্বুকে মে’রেছে। সে প্রতিশোধ নিবে, একটা একটা করে সবাইকে বের করবে। চঞ্চল, হাসিখুশি একটা ছেলে শান্ত মস্তিষ্কে কতোটা ভয়ংকর হতে পারে তা কেউ কল্পনাও করতে পারবে না।
_____________
শ্রাবণের দিন দিন কাজের চাপ বাড়ছে। অফিসের ঝামেলার সাথে সাথে যুদ্ধ করতে করতে সে ক্লান্ত তবুও কোনো উন্নতি হচ্ছে না দিন দিন কোম্পানির অবস্থা খারাপ হচ্ছে । খারাপ সময় আসলে সব দিক দিয়ে আসে। বাড়িতে আসলে বাড়িটা কেমন নির্জীব লাগে অফিসে গেলে সব এলোমেলো লাগে। কোথায় আছে সব কিছুর সমাধান!!..???
শ্রাবণ কাগজপত্র গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মেঘলা তারাহুরো করে কফি রাখতে গিয়ে পায়ে কিছুটা ফেলে দিল।
শ্রাবণ দ্রুত পানি ডেলে দিল মেঘলার পায়ে।
মেঘলা ব্যাথা পেলেও হাসি মুখে বলে উঠলো, ‘ আমার কিছু হয়নি আপনার জন্য আরেক মগ নিয়ে আসি..? আপনার অফিসে দেরি হচ্ছে! আসলে নিচে একটা কাজ করতে গিয়ে আপনার কফির কথা মনে ছিল না..। ‘
শ্রাবণঃ চুপচাপ বসো। দেখি পা এদিকে দাও।
মেঘলাঃ কিছু হয়নি তো।
শ্রাবণ বরফ এনে মেঘলার পায়ে লাগিয়ে ঠান্ডার মলম লাগিয়ে দিল।
মেঘলাঃ আপনার ক….
শ্রাবণঃ চুপ!! আমার কফি লাগবে না। একটু রেস্ট নাও ….
মেঘলা ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ বসে রইলো। শ্রাবন অফিসের জন্য রেডি হয়ে মেঘলার দিকে তাকালো।
মেঘলা হ্যাঁ করে শ্রাবণকেই দেখছিলো। এক মাসে লোকটা কতোটা চেঞ্জ হয়ে গেছে। রাতদিন কাজ করে নিজের অবস্থা করেছে কি!!..? একটুও নিজের যত্ন নেয় না।
শ্রাবণ ফাইল হাতে নিয়ে বের হতে গিয়েও ফিরে তাকালো ” বউ থেকেও পানসে মুখে অফিসে যেতে হয়।”
মেঘলা ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
” তাহলে কি কাল থেকে আপনার জন্য অফিসে যাওয়ার আগে মিষ্টি এনে রাখবো!..?”
শ্রাবণ হেঁসে বললো, ‘ বউ চাইলে শুধু অফিসে যাওয়ার আগে কেন! চব্বিশ ঘণ্টা মিষ্টি দিতে পারে।’
মেঘলাঃ কিন্তু আপনি তো মিষ্টি পছন্দ করেন না।
শ্রাবণ ফুশ করে একটা শ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। বউ কে কি মিষ্টির কথা বললো আর বোকা বউ কি বুঝলো!!..?
আহনাফ রেগে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মহুয়া কাচুমাচু করছে। এই এক মাস খুব সুন্দর করে আহনাফ কে ইগ্নোর করেছে। আহনাফের এসিস্ট্যান্টের কাজ ছেড়ে টিউশনি করাচ্ছে। বাড়ির কারো মন মানুষিকতা ঠিক নেই সেই জন্য চলে যাওয়ার কথাও বলতে পারছে না।
আহনাফঃ এই এক মাসে আমি কতোবার খবর পাঠিয়ে ছিলাম..?
মহুয়াঃ একই বাসায়,একই ছাঁদের নিচে তাও কেন চিঠি লিখে খবর পাঠাতে হবে!.?
আহনাফঃ আমার ইচ্ছে। এখন বলো আমাকে ইগ্নোর কেন করছো..?
মহুয়াঃ আমি কাউকে ইগ্নোর করিনি।
আহনাফঃ তাহলে আমার এসিস্ট্যান্টের কাজ কেন ছেড়েছো..?
মহুয়াঃ আমার এসিস্ট্যান্টের কাজ ভালো লাগে না।
আহনাফঃ তাহলে আমার বাচ্চা সামলানোর জবটা নিতে পারো।
মহুয়াঃ আপনার বাচ্চা!..?
আহনাফঃ হুম, রাজি হলে…
মহুয়াঃ আপনার বউ, বাচ্চা আছে…?
আহনাফঃ বউ তো আছে তবে বাচ্চা এখনো ডাউনলোড হয়নি, বউ বাচ্চার জব নিতে চাইলে….
মহুয়া রেগে বলে উঠলো, ‘ অসভ্য লোক।’
আহনাফঃ অসভ্য আর সভ্য যাই বলো দুইটার থেকে একটা জব তো নিতেই হবে। হয় এসিস্ট্যান্ট হয়ে যাও না হয় আমার বাচ্চার জবটা নিয়ে নাওও। আমার আম্মুও নাতিনাতনির মুখ দেখুক।
মহুয়া লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিল। ছাঁদের দরজা লাগানো চাইলেও পালাতে পারবে না।
আহনাফঃ তুমি লজ্জা পাচ্ছ..? অথচ আমি লজ্জা পাওয়ার মতো এখনো কিছুই বলিনি।
মহুয়াঃ আমি মোটেও লজ্জা পাচ্ছি না, আমার আপনার দিকে তাকাতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
আহনাফঃ কেন আমি দেখতে কি একটু বেশিই আকর্ষণীয় যে তাকালেই, কাছে আসো কাছে আসো এমন ফিলিংস হবে!!…
মহুয়া কানে দুই হাত দিয়ে বলে উঠলো ” চুপ করেন, আপনি দেখতে খুবই বাজে, আমি ভেবে পরে যানাবো।”
আহনাফঃ মনে জেনো থাকে… বলেই পকেট থেকে একটা বেলীফুলের মালা বের করে মহুয়ার দিকে এগিয়ে আসলো।
আহনাফঃ এতো বড় চুল সামলাতে সমস্যা হয় না..?
মহুয়াঃ আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।
আহনাফ বেলীফুলের মালা এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো ” তোমার জন্য ”
_____________________
ছোঁয়া একটু পর পর নির্জনের রুমে উঁকি দিচ্ছে। মহুয়াকে নিয়ে আসতে চেয়ে ছিলো কিন্তু আহনাফের জন্য পারলো না।
নির্জনের সামনে যেতে সে ভয় পাচ্ছে!! কি আজব এক সময় সারাদিন ঝগড়া মারামারি লেগে থাকত আর আজ একটু কথা বলবে কেমন ভয় লাগছে।হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর সাথে কথা বলতে ভয় কাজ করে।
আজকাল ছোঁয়ার দিন কাটে ভার্সিটি আর ছোট মামির ঘরে। ছোট মামির কষ্ট গুলো কেমন নিজের মনে হয়।
ছোঁয়া নির্জনের রুমে প্রবেশ করার আগেই আজাদ চৌধুরীকে রেগে ফোনে কারো সাথে কথা বলতে দেখে থেমে যায়।
আজাদ চৌধুরীঃ তুমি থেমে যাওওও এর পরিণাম ভালো হবে না!! আমি খুব জলদি তোমার মুখোমুখি হব।
…………….
আজাদ চৌধুরীঃ তুমি আমাকে আগের রুপে ফিরে যেতে বাধ্য করছো…
…………..
আজাদ চৌধুরীঃ তোমার বউ বাচ্চার প্রতি তো মায়া কর।
…..
আজাদ চৌধুরীঃ তোমার এমন দিন আসবে রাস্তার কুকুর ও ফিরে তাকাবে না আফজাল।
আজাদ চৌধুরী রেগে মোবাইল দেয়ালে ছুড়ে ফেললেন।
ছোঁয়া ভয়ে চুপসে ঠাসস করে নির্জনের রুমে গিয়ে লুকিয়ে গেলো।
আজাদ চৌধুরী আশেপাশে তাকিয়ে মোবাইল তুলে নিয়ে রুমের দিকে চলে গেলেন।
ছোঁয়া বুকে থুথু দিয়ে লম্বা শ্বাস নিলো। বড় মামা ভীষণ রাগী নিশ্চয়ই অফিসের কারো সাথে ঝামেলা হয়েছে প্রচুর রেগে আছেন।
নির্জন ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে ছোঁয়া কে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হলো। এই এক মাসে আজ প্রথম ছোঁয়া নির্জনের রুমে আসলো।
নির্জনঃ ছোঁয়া…
ছোঁয়া প্রথম ভয় পেয়ে গেলো নির্জন কে দেখে হেঁসে বললো, ‘ নির্জন তুমি…’
নির্জনঃ আমার রুমে তো আমিই থাকবো। কিছু প্রয়োজন..?
ছোঁয়াঃ হুম..
নির্জনঃ কি..? জলদি বলে বের হ।
ছোঁয়া চুপ করে আছে।
নির্জনঃ এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে না থেকে যা বলবি বল।া
ছোঁয়াঃ তুমি কি বিরক্ত হয়েছ আমাকে দেখে..?
নির্জন ছোঁয়ার দিকে না তাকিয়ে শার্টের বোতাম লাগিয়ে নিলো।
নির্জনঃ এতো অভিনয় না করে কি লাগবে বলে বের হ, আমি বাহিরে যাব।
ছোঁয়াঃ তোমাকে লাগবে….!
নির্জন ঘড়ি হাতে নিয়ে থমকে যায় কিছু সময়ের জন্য। এই একটা কথায় এমন কি ছিল!..?
চলবে….
ভুলত্রুটি মার্জনীয়