#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_১৯
আরভী ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহটা নিয়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।
আরভীর ধারণাই ঠিক ছিলো। এটা সমুদ্র। সমুদ্রকে দেখেই যেনো আরভীর নিজেকে আরো বেশি ক্লান্ত মনে হচ্ছে। এই ছেলে এমন কেন? প্রতিদিন কোনো না কোনো ভাবে আরভীকে জ্বালানোর ফন্দি আঁটে।
সেদিন সমুদ্রকে দারোয়ান দিয়ে বের করে দেওয়ায় সমুদ্র ভেবে রেখেছে আর কখনো এ বাড়ির প্রাঙ্গনে পা ফেলবে না সমুদ্র। তবে এ বাড়ির কেউ যদি সমুদ্রকে বাড়ির ভিতরে আসতে বলে সেটা অন্য কথা। তাই আজ বাড়ির বাহির থেকেই আরভীর মনোনিবেশ পাওয়ার চেষ্টা করছে।
আরভীকে বেলকনিতে দেখতে পেয়ে সমুদ্র দাঁত কেলিয়ে হেসে ইশারা করলো বাহিরে আসার জন্য। কিন্তু আরভী ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানায়। এতে সমুদ্র চোখ যুগল ছোট ছোট করে ইশারায় বুঝিয়ে দেয় আরভী এখন নিচে না নামলে হর্ন বাজানো বন্ধ করবে না।
প্রতিত্তোরে আরভী ইশারায় বুঝিয়ে দিলো যা ইচ্ছে করুন, আমি নিচে নামবো না।
আরভী ঘরে গিয়ে বসে রইলো। যাবে না বাহিরে। দেখা যাক কতোক্ষণ এভাবে বাইকের হর্ন বাজাতে পারে। একসময় ঠিক’ই ক্লান্ত হয়ে ফিরে যাবে এমনটাই ধারণা করলো আরভী।
এদিকে সমুদ্রও নিজের জেদে অটুট রইলো। আরভী যতোক্ষণ নিচে নামবে না ততোক্ষন একনাগাড়ে হর্ণ বাজিয়ে যাবে। আরভী কতোক্ষণ ঘরে বসে থাকতে পারে সেটা দেখে নিবে সমুদ্র।
মিনিট তিনেক পেড়িয়ে গেলো। না আরভী বাহিরে এলো আর না সমুদ্র থামলো। কিন্তু আশেপাশের লোকজন বিরক্ত হয়ে বাধ্য হলো ঘর থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য।
পাশের বাসার হাসান নামের এক ছেলে এগিয়ে এলো সমুদ্রের দিকে। চোখে-মুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলে বললো,”সমস্যা কি ভাই? এইসব কি শুরু করছেন? আপনার জন্য আশেপাশের কেউ একটু শান্তিতে ঘরে বসে থাকতে পারছে না।”
সমুদ্র উত্তর দিলো না আর না থামলো। আগের মতো করেই হর্ণ বাজিয়ে যাচ্ছে। এতে ছেলেটা আরো বেশি বিরক্ত হলো। তবে ছেলেটা কিছু বলবে তার আগেই আশেপাশের আরো কয়েকজন মানুষ এগিয়ে এলো সমুদ্রকে থামানোর জন্য।
জায়গাটায় বেশ হইচই পড়ে গেছে। সবাই সমুদ্রকে থামতে বলছে কিন্তু সমুদ্রের থামার কোনো নাম-গন্ধও নেই।
আফিফা আফরোজ বেলকনি থেকে সমুদ্রকে দেখে বাহিরে এলেন। সমুদ্রের কাছে এসে সমুদ্রকে থামানোর জন্য বললেন,”সমুদ্র বাবা বাহিরে কেন তুমি? ভেতরে এসো।”
হাসানের এতোক্ষণ সমুদ্রকে চেনা চেনা লাগছিলো। কোথায় যেনো দেখেছে বলে মনে হচ্ছিলো। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো না থাকায় ভালোভাবে সমুদ্রের চেহারা দেখতে পারছিলো না। যখন আফিফা আফরোজের মুখে সমুদ্রের নাম শুনলো তখন মনে পড়লো এই তো সেই ছেলেটা। যে কিছুদিন আগে ভাইরাল হয়েছিলো। ছেলেটা এবার বুঝলো পুরো কাহিনি। তাই হেসে বললো,”আরে বস তুমি! তাই তো বলি চেনা চেনা লাগে কেন।”
ছেলেটির কথায় সমুদ্র নিজেও হাসলো। নিজেকে এখন সেলেব্রিটি মনে হচ্ছে। যাক ভাইরাল হওয়াটা তবে কাজে দিয়েছে।
“প্রেমিক হতে হলে কত কি যে করতে হয় বলে বুঝানো যাবে না।”
“ক্যারি অন।” কথাটি হাসান ফিসফিস করে বললো যেনো আর কেউ শুনতে না পায়।
আরভী এতোক্ষন নিজের ঘরে বসে থাকলেও আর পারলো না। বাহিরে হইচই পড়ে গেছে বুঝতে পেরে সমুদ্রের সামনে হার স্বিকার করতেই হলো। এছাড়া মেয়র হিসেবেও তো আরভীর একটা দায়িত্ব আছে। এভাবে এই রাতের বেলা নিজের জেদের জন্য সবার ঘুম নষ্ট হবে এটা তো ঠিক নয়। তাই নিজের জেদ একপাশে রেখে বেড়িয়ে এলো বাড়ি থেকে। আরভীকে দেখে সমুদ্র হর্ন বাজানো থামিয়ে দেয়। আরভীর দিকে তাকিয়ে নিরবে হেসে উঠে।
সবাই এতোক্ষণ যাবত বলার পরেও সমুদ্র হর্ন বাজানো থামায় নি অথচ আরভী নিচে নামতেই থামিয়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা সবাই বাকা চোখে দেখলো।
“দুঃখিত। আপনারা যার যার বাড়িতে যেতে পারেন এবার। আশা করছি আর কোনো শব্দ আপনারা পাবেন না।” মিনতি করে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো আরভী।
সবাই সমুদ্র ও আরভীর দিকে আড় চোখে তাকিয়ে যার যার বাড়ি চলে যেতে লাগলো। তবে সবার মাঝ থেকে কেমন এক চাপা গুঞ্জন শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।
আরভী প্রচন্ড জেদি একটা মেয়ে। আর আরভীর সেই জেদ সমুদ্র ভাঙ্গতে পেরেছে। ব্যাপারটা বেশ মজার মনে হলো আফিফা আফরোজের কাছে।
“আন্টি আজ আমি আসি। ভালো থাকবেন। আর বিরক্ত করার জন্য সরি।”
আরভী অবাক হলো। শুধু আরভীকে বের করার জন্য এতো কান্ড ঘটালো ছেলেটা!
মনের সন্দেহ দূর করতে আরভী সমুদ্রকে জিজ্ঞেস করলো,”আরে অদ্ভুত তো! আমাকে এখানে আসতে বলে এখন নিজেই চলে যাচ্ছেন?”
“আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছিলাম কিন্তু আপনাকে বিরক্ত করার সাথে সাথে আজ আপনার জেদকেও আমার সামনে হার মানাতে বাধ্য করলাম। আসলে কি জানেন? মেয়েদের এতো জেদ শোভা পায় না। হাসতে শিখুন সাথে সবাইকে হাসাতে শিখুন। তাহলেই অনুভব করতে পারবেন পৃথিবীটা কত সুন্দর।” বলে সমুদ্র চলে গেলো। আর আরভী সেখানেই ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
——-
“হোয়াট! এতো এতো কনস্টেবল পাহাড়ায় রাখার পরেও নাহিদ চৌধুরী জেল থেকে পালালেন কি করে?”
“স্যার হঠাৎ করে সব লোডশেডিং হয় আর জেনারেটর ও কাজ করছিলো না। যখন জেনারেটর ঠিক হয় তখন নাহিদ চৌধুরী বা হিমেল কেউই জেলে ছিলেন না।”
এ কথা শুনে তন্ময়ের হাত কপালে চলে যায়। যেরকম কড়া সিকিউরিটির ব্যবস্থা করা হয়েছিলো তাতে নাহিদ চৌধুরীর পক্ষে পালানো সম্ভব ছিলো না। তারমানে বাহির থেকেও কেউ সাহায্য করেছে। আর বাহির থেকে সাহায্য করার জন্য একজনই আছে। সে হলো মিনহাজ।
তন্ময় কিছু একটা ভাবলো। মিনহাজ বাংলাদেশে এলে অনেক বড় একটা ব্লেন্ডার হয়ে যাবে। বিশেষ করে সমুদ্র ঝামেলায় পড়ে যাবে।
তন্ময় তাড়াতাড়ি করে সমুদ্রকে কল করলো। কিন্তু সমুদ্র রিসিভড করছে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল ন’টা বাজে। মানে সমুদ্র এখনো ঘুমোচ্ছে।
“যেই মেয়েটাকে সেদিন নাহিদ চৌধুরীর বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে মেয়েটাকে হাই সিকিউরিটিতে রাখার ব্যবস্থা কর। পারলে মেয়েটাকে পরিবারসহ ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ায় রাখার চেষ্টা কর। মেয়েটার যেনো কোনো ক্ষতি না হয়। ” কথাটি বলে তন্ময় তাড়াহুড়ো করে র্যাব হেডকোয়ার্টার থেকে বেড়িয়ে গেলো। উদ্দেশ্য সমুদ্রকে সবটা জানানো।
আরভী অনেকক্ষণ যাবত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। সমুদ্র হয়তো ভেবেছে আরভী কখনো হাসে না। কিন্তু এটা ভুল। আরভী পুরোনো স্মৃতি মনে করে মাঝেমধ্যেই হাসে। কিন্তু নিজের সেই হাসি সবাইকে দেখাতে চায় না আরভী। কেননা আরভী সবার সামনে দেখাতে চায় আরভী কঠোর মনের একটি মেয়ে। পিতৃহারা কোমল মনের মেয়ে হয়ে থাকলে এ সমাজ যে আরভীর জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। পারবে না এ রাজনীতির জগতে টিকে থাকতে।
তন্ময় সমুদ্রের ঘরে গিয়ে দেখলো সমুদ্র গভীর ঘুমে মগ্ন। এই ছেলেকে এখন ডাকলে এতো সহজে উঠবে না। বেড সাইড টেবিলের উপর তাকাতেই পানির জগ তন্ময়ের নজরে পড়লো। বেশি কিছু না ভেবে পানির জগ হাতে নিয়ে পুরো পানিটা সমুদ্রের উপর ঢেলে দিলো।
তন্ময়ের এই কাজে এক ঝটকায় সমুদ্রের ঘুম উড়ে গেলো। কপাল কুচকে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে। নিজের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো তন্ময় সমুদ্রের উপর পানি ঢেলে দিয়েছে। সমুদ্র বেশ বিরক্ত হলো। সকাল সকাল তন্ময়ের করা এই কাজ সমুদ্রের একদমই পছন্দ হলো না। তাই চোখ-মুখ কুচকে বললো,”আরে ইয়ার, এতো সকাল সকাল জ্বালাচ্ছিস কেন?”
“মিনহাজ বাংলাদেশে।”
তন্ময়ের দু শব্দের এই বাক্য শুনে সমুদ্র চমকে উঠলো। কিছুক্ষন তন্ময়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো তন্ময় সত্যি বলছে নাকি মজা নিচ্ছে।
সমুদ্রের মনোভাব ধরতে পেরে তন্ময় সমুদ্রের পাশে বসে বললো,”নাহিদ চৌধুরী কাল রাতে পালিয়েছে। মিনহাজ ছাড়া আর কেউ এমন করতে পারে বলে আমার মনে হয় না। হয়তো মিনহাজ বাংলাদেশে এসেছে। তুই একটু যোগাযোগ করার চেষ্টা কর মিনহাজের সাথে।”
“মিনহাজ আবারও ভুল করছে।” চিন্তিত স্বরে বললো সমুদ্র।
“দেখ বাবা-মা যেমনই হোক না কেন কোনো সন্তান তার বাবা-মায়ের খারাপ দেখতে পারে না। তাই হয়তো!”
“তাই বলে নাহিদ চৌধুরীর মতো একটা মানুষকে তার কৃতকর্মের শাস্তি থেকে বাঁচাবে?” কথাটি বেশ জোরেই বললো সমুদ্র।
“শান্ত হ সমুদ্র। এখন যতো দ্রুত সম্ভব মিনহাজের সাথে যোগাযোগ কর তুই। মিনহাজ বাংলাদেশে এসে থাকলে কিন্তু তোর জন্য ঝামেলা।”
সমুদ্র মোবাইল হাতে নেয় মিনহাজকে কল করার জন্য। কিন্তু মিনহাজের নম্বরে কল করার আগেই হঠাৎ সমুদ্রের ঘরে কেউ একজন এসে বলে উঠলো,”আমাকে রেখেই তোরা আড্ডা দিচ্ছিস! দিস ইজ নট ফেয়ার ইয়ার।”
কথাটি শুনে সমুদ্র থেমে গেলো। মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বড়সড় এক ঢোক গিলে মাথা তুলে তাকালো। মিনহাজ! হ্যাঁ মিনহাজই সামনে দাঁড়িয়ে। তন্ময় ও সমুদ্র একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে নিলো একবার। তারপর সমুদ্র মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো,”আরে তুই! বাংলাদেশে কখন এলি?”
“কাল সন্ধায়, কাজ ছিলো একটু।”
“নাহিদ চৌধুরীকে তুই পালাতে সাহায্য করেছিস?” মিনহাজের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো তন্ময়।
“হুম কি করবো বল? শত হোক জন্মদাতা তো, তাই উনার কষ্ট কেন যেনো আমার সহ্য হয় না।”
“আর তোর সেই জন্মদাতা যে হাজারো মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে সেসব?”
“আমি প্রতিবাদ করি না এমন তো নয়? আমি প্রতিবারই প্রতিবাদ করি।”
“প্রতিবাদ করে কিচ্ছু হবে না মিনহাজ। তোর বাবা শাস্তি না পেলে ঠিক হবে না। তাই ভালোয় ভালোয় বলে দে নাহিদ চৌধুরী এখন কোথায় আছে।”
“কাল সারা রাত ঘুমোতে পারি নি এসবের চক্করে। আমি গেস্ট রুমে ঘুমোতে যাচ্ছি। আমাকে কেউ ডিস্টার্ব করবি না। গুড নাইট এভরিওয়ান, সরি নাইট না মর্নিং হবে।” কথাটি বলে হাই তুলতে তুলতে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো মিনহাজ।
“একে যতো দ্রুত সম্ভব আবার কানাডায় রেখে আয় সমুদ্র। নয়লে আমি ভুলে যাবো এই বাদরটা এক সময় আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো। আমি বাধ্য হবো বাপ-ছেলে দুজনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে।” বলে তন্ময় হনহন করে সমুদ্রের ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।
চলবে….