#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_১৪
আজ অনেক বছর পর আরভী মেলায় এসেছে। শেষ কবে মেলায় এসেছিলো আরভীর সেটাও মনে নেই। তাই এখানে এসে আরভীর সব স্মৃতির পাতা গুলো মনে পড়ে যাচ্ছে।
আরশাদ রায়হান ও আফিফা আফরোজ এর সাথে প্রতিবছর মেলায় যেতো আরভী। আরশাদ রায়হান মারা যাওয়ার পর আরভী আর কখনো মেলায় আসে নি। যদি জানতো এখানে মেলা হচ্ছে তহলে আরভী এখানেও আসতো না।
তবে এখানে এসে মন্দও হয় নি। পুরোনো সব ভালো মূহুর্তের কথা মনে পড়ে গেছে। হয়তো আরশাদ রায়হান সাথে নেই। তবে উনার সাথে কাটানো মুহূর্ত গুলো যেনো তাজা হয়ে উঠেছে।
আরভী ও সমুদ্রের বাড়িতে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যায়। কথা ছিলো শুধু বিকেলের সময়টা কাটাবে। কিন্তু মেলায় গিয়ে পুরোনো কথা মনে পড়ে যায় বিধায় আরেকটু সময় থেকেছে মেলায়।
সমুদ্র আরভীকে আরভীর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিলে আরভী বললো,”এবার বলুন, এসবের পিছনে আপনার উদ্দেশ্য কি!”
“ভালোবাসি আর আপনার থেকে ভালোবাসা আদায় করাই আমার আসল উদ্দেশ্য।”
“সমুদ্র! আপনি বলেছিলেন আজকে বিকেলে আপনার সাথে সময় কাটালে আপনি আমাকে সত্যিটা বলবেন। আমি আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম সমুদ্র।” রেগে বললো আরভী
“আমি সত্যিটাই বলেছি ললনা। আমি আপনাকে সত্যিই ভালোবাসি। হ্যাঁ কথাটি আমি সকালেই আপনাকে জানাতে পারতাম কিন্তু জানাই নি কারন আমি আপনার সাথে সুন্দর কিছু মোমেন্ট ক্রিয়েট করতে চেয়েছি, কিছু সুন্দর সময় অতিবাহিত করতে চেয়েছি।”
“আপনাকে বিশ্বাস করাই আমার ভুল ছিলো।” ঝাঁঝালো স্বরে বললো আরভী।
“আর আমার জন্য সৌভাগ্য।”
“আচ্ছা আপনি কি যেনো বললেন? আমাকে ভালোবাসেন? তা কবে থেকে?”
“যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছি সেদিন থেকেই।”
আরভী হাসলো। তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,”এটাকে ভালোবাসা বলে না সমুদ্র। প্রথম দেখায় কখনো ভালোবাসা হয় না এন্ড আমি লাভ এট ফার্স্ট সাইটেও বিলিভ করি না।”
“তো আপনি কি কখনো কাউকে ভালোবাসেন নি? একটু মনে করে দেখুন তো, কখনো প্রথম দেখায় কারো প্রেমে পড়েছিলেন কিনা।” কথাটি বলে সমুদ্র আর দাঁড়ালো না। দ্রুত বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো।
আর আরভী সেখানেই স্হির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ভাবতে লাগলো সমুদ্র এমন একটা প্রশ্ন কেন করেছে! সমুদ্রের কথার ধরনে মনে হয়েছে সমুদ্র জেনেশুনে এমন একটা প্রশ্ন করেছে।
এটা সত্যি যে আরভী নিজেও এক সময় প্রথম দেখায় প্রেমে পড়েছিলো। ভালোবেসে ফেলেছিলো হেমন্তকে। কৈশোরের এক মুঠো আবেগ থেকেই এই প্রেমের সূচনা হয়েছিলো।
আচ্ছা! কোনোভাবে কি সমুদ্র হেমন্তকে চিনে? কারন এমন অনেক কিছুই সমুদ্র বলেছে যা একসময় হেমন্ত আরভীকে বলেছিলো। যেমন সেদিন বাটার স্কচ আইসক্রিমের কথা বলেছিলো যা হেমন্ত আরভীকে বলতো। আবার আজ মেলায় বলেছিলো শাড়ি, চুড়ি ও চুল মেয়েদের সৌন্দর্য। এটাও তো হেমন্ত বলতো। সমুদ্র যখন এ কথাটা বলেছিলো আরভী ভেবেছে হয়তো কাকতালীয় ভাবে হেমন্তের কথার সাথে সমুদ্রের কথা মিলে গেছে। কিন্তু এই মূহুর্তে যা বললো তা শোনার পর থেকে কেন যেনো মনে হচ্ছে সমুদ্র ও হেমন্তের মাঝে একটা সম্পর্ক রয়েছে।
সমুদ্র বাড়ি ফিরার পথে একটা ব্রিজের পাশে বাইক থামায়। তন্ময়ের আসার কথা ছিলো এখানে।
সমুদ্র বাইক এক সাইডে পার্ক করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখলো তন্ময় ব্রিজের উপর পা ঝুলিয়ে বসে আছে। সমুদ্র পাশে গিয়ে বসলে তন্ময় দুটো সিগারেট বের করে একটা সমুদ্রের হাতে দেয় ও একটা নিজের মুখে নিয়ে আগুন ধরায়।
“কি করতে চাইছিছ বল তো।”
“তেমন কিছু না। শুধু একটু হাইড এন্ড সিক খেলতে চাচ্ছি।” সামান্য হেসে প্রতিত্তোরে বললো সমুদ্র।
“এতে লাভ কি?”
“লাভ লসের হিসেব পরে হবে। হঠাৎ গেম খেলতে ইচ্ছে করেছে তাই মাঠে নেমে পড়েছি।”
” দেখিস আবার খেলতে গিয়ে মাঠে স্লিপ খেয়ে হাত-পা ভেঙে বসে থাকিস না।”
“ইটস মি ইয়ার! সমুদ্র, সমুদ্র মুনতাসিন। আর সমুদ্র মুনতাসিন কখনো কোনো গেমে হারে নি। আর যদি হেরেও যাই তাহলে তুই আছিস তো, আমাকে জিতিয়ে দিবি।”
“মজা করছি না সমুদ্র। এভাবে মেয়েটার ইমোশন নিয়ে খেলা ঠিক হবে না। যেদিন সব সত্যিটা জানতে পারবে সেদিন কি হবে ভাবতে পারছিস কিছু?”
“ভবিষ্যৎ বলে কিছু হয় না। বর্তমানই সব। আজ মরে গেলে কাল কি হবে সেটা ভেবে আজকের দিনটা মাটি করতে চাই না। তাই পরের টা পরে দেখা যাবে।”
——-
সকালে নাহিদ চৌধুরী বসে চা খাচ্ছিলেন। সেসময় হিমেল উনার সামনে এসে দাঁড়িয়ে উসখুস করতে থাকে। তা একনজর দেখে নাহিদ চৌধুরী জিজ্ঞেস করলেন,”কিরে কিছু হয়েছে? এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
“ভাই একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।”
“কথা না বাড়িয়ে ডিরেক্ট পয়েন্টে আয়।”
“ভাই রাশেদ এক্সিডেন্টে মারা গেছে। এতোদিন লাশ শনাক্ত করা যাচ্ছিলো না দেখে মর্গে পড়ে ছিলো।”
“রাশেদ যেনো কে? নামটা আগে শুনেছি মনে হচ্ছে।” ভাবুক স্বরে বললেন নাহিদ চৌধুরী।
“ওই যে ভাই নতুন ছেলেটা। শাওন যার কথা বলেছিলো।”
“এক্সিডেন্ট করেছে নাকি কেউ মেরেছে?”
“ভাই, মাতাল হয়ে রাস্তার মাঝ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলো। পরে একটা ট্রাক রাশেদের উপর দিয়ে চলে যায়। সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে সব। এতো বাজে অবস্থা ভাই দেখলেই বমি চলে আসে।”
“জানাজা কখন?”
“জ্বি ভাই জোহরের নামাজের পর।”
“গাড়ি রেডি রাখিস আর সাংবাদিক দের জানিয়ে দিস। নাহিদ চৌধুরী অনেক মহান এটা যেনো সবাই জানতে পারে।”
রাতে ডিনার শেষে নিজের ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে আরভী। নাহিদ চৌধুরীর ভাগ্নের ছবি মেইলে আসার কথা। কেননা আরভী জেনেছে ছেলেটা ভীষণ প্যাচালো স্বভাবের। বড় কিছু করতে চাইছে। তাই সবার আগে এই ছেলের ব্যাপারে জেনে রাখা ভালো।
আরভী মেইল চেক করে দেখলো ছবিটি ফাইল আকারে আরভীর কাছে পাঠানো হয়েছে।
ছেলেটিকে দেখার জন্য আরভী ফাইলে ক্লিক করবে এমন সময় আননোন নম্বর থেকে আরভীর পারসোনাল নম্বরে কল আসে। আরভী কল রিসিভড করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আছে সমুদ্রের কন্ঠস্বর।
“হায় ললনা।”
“আপনি আমার নম্বর পেলেন কোথায়?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো আরভী।
“উফ ললনা, আপনি কেন ভুলে যান হায় এর বদলে হ্যালো বলতে হয়।”
“যেটা জিজ্ঞেস করেছি আগে সেটার উত্তর দিন।” দাঁতে দাঁত চেপে বললো আরভী।
“ভালোবাসের টানে সবই সম্ভব ললনা। আমার ভালোবাসাই আমাকে আপনার নম্বর দিয়েছে।”
“আজেবাজে কথা বলা বন্ধ করুন।”
“তাহলে চলুন ভালোবাসার কথা বলি।”
আরভী আর কিছু না বলে কল কেটে দিলো। কিন্তু সমুদ্র একের পর এক কল দিতেই লাগলো। আরভী বুঝলো এই সিম কার্ড আর ব্যবহার করা যাবে না। তাই সিম কার্ড মোবাইল থেকে খুলে রাখলো।
সমুদ্রের সাথে কথা বলে আরভীর সব বিরক্ত লাগছে। এই মূহুর্তে নাহিদ চৌধুরীর ভাগ্নের ছবিটিও দেখতে ইচ্ছে করছে না বিরক্তের জন্য।
আরভী নিজেকে শান্ত করতে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। বাহিরে বেশ ঠান্ডা। কেমন শীত শীত লাগছে। শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে ঠান্ডায়।
আজ আকাশে মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে। চাঁদ বরাবরই আরভীর প্রিয়। আগে যখন কারেন্ট থাকতো না আরভী ছাদে চলে যেতো চাঁদ দেখতে। ছাদের এক পাশ থেকে আরেক পাশে দৌড়ে যেতো। আর দেখতো চাঁদও আরভীর সাথে সাথে চলছে। তা দেখে আরভী খিলখিলিয়ে হেসে উঠতো। আরভীর হাসি দেখে আরশাদ রায়হান ও আফিফা আফরোজও উচ্চস্বরে হেসে উঠতেন। এসব ভেবে আরভী ম্লান হাসলো। তারপর ঘরের দিকে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো।
ঘুড়ে দাঁড়ানোর পর আরভীর মনে হলে বাউন্ডারি ওয়ালের উপর কিছু একটা দেখেছে। ঘুরে সেদিকটা তাকালে দেখতে পেলো সেখানটায় কিছু নেই। আরভী ভাবলো মনের ভুল হয়তো।
মনের ভুল ভেবে আরভী আবার ঘুরতে নিলেই চোখে পড়ে কে যেনো একটা ওয়াল টপকে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করতে চাইছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বুঝতে পারে এটা সমুদ্র।
সমুদ্রকে দেখে আরভী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এসব করার বয়স শেষ অথচ এই ছেলে এখনো এসব করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। না জানি আগে কি করতো!
আরভী বেলকনির রেলিঙের উপর হাত রেখে দেখতে থাকে সমুদ্রের কীর্তিকলাপ।
সমুদ্র ওয়াল টপকে বাড়ির ভিতরে এসে নিজের হাত ও শার্ট ঝাড়তে থাকে। সমুদ্রের মুখে ফুটে উঠে বিশ্ব জয়ের হাসি। নিজেই নিজেকে বাহবা জানিয়ে আরভীর বেলকনির দিকে তাকায়।
আরভীর বেলকনির দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় আরভী সমুদ্রের দিকেই তাকিয়ে আছে। আরভীকে দেখে সমুদ্রের মুখের হাসি খানিকটা কমে যায়।
আরভী সমুদ্রকে দেখিয়ে শব্দহীন হাত তালি দিয়ে বললো,”আপনি কি এর আগে মানুষের বাড়ির ওয়াল টপকে চুরি ডাকাতি করতেন নাকি মেয়েদের বিরক্ত করতে রাত-বিরেতে ওয়াল টপকাতেন?”
“আজ্ঞে এর একটাও না ললনা। ভালোবাসার টানে যেভাবে আপনার নম্বর জোগাড় করেছি ঠিক একই ভাবে ভালোবাসার টানে ওয়াল টপকে আপনার কাছে চলে এসেছি।”
আরভী সমুদ্রের সাথে কথা বাড়াতে চাইলো না। জোরে জোরে দারোয়ানকে ডাকতে লাগলো।
আরভীর ডাকে দারোয়ান ছুটে এলে আরভী বললো,”এই ছেলেটাকে বাড়ির বাইরে রেখে আসুন।”
কথাটি বলে আরভী চলে গেলো। তবে সমুদ্র এবার আরভীকে প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। কারন আরভীর এ কথাটি ছিলো অপমান জনক। এ কথাটি সোজা সমুদ্রের ইগোতে গিয়ে লেগেছে। এ কথা আর ঘার ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া দুটোই এক মনে হচ্ছে সমুদ্রের কাছে।
“শুনলেন না আপামনি কি বললো? বাহিরে চলুন।”
দারোয়ানের কথায় সমুদ্র বেলকনির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে হনহন করে বেড়িয়ে গেলো বাড়ি থেকে।
আরভী ঘরে ঢুকার পর মনে পড়লো ছবির কথা। তাই আর দেরি না করে ফাইলে ক্লিক করলো ছেলেটাকে দেখার জন্য। কিন্তু যে ছেলেটার ছবি স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে আরভী সে ছেলেটাকে একদম’ই আশা করে নি। ছেলেটিকে দেখে আরভী স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। আরভী কখনো ভাবতেও পারে নি এই হবে নাহিদ চৌধুরীর ভাগ্নে। এটা আরভীর কল্পনার বাহিরে ছিলো।
চলবে….