#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_২৯
সমুদ্র হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে। চোখ যুগল সীমাবদ্ধ উপরের ফ্যানের দিকে। আর মন মগ্ন গভীর ভাবনায়।
মানুষ যেমনটা চায় তেমনটা সবসময় হয় না। বেশির ভাগ সময়ই চাওয়ার বিপরীত’ই হয়। যেমন সমুদ্র যা ভেবে রেখেছিলো তা হয় নি। সব কিছু ঠিকভাবে চলতে থাকলেও আজ সব এলোমেলো হয়ে গেছে।
সমুদ্র তো ভেবেছিলো নাহিদ চৌধুরী ও মিনহাজকে দেশ থেকে সরিয়ে অন্য দেশে পাঠিয়ে দিলেই সব সমস্যার অবসান ঘটবে। আরভী কখনো জানতে পারবে না নাহিদ চৌধুরীর সাথে সমুদ্রের কোনো সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এখন আরভী সব জানে। সমুদ্রকে আরভী এতো সহজে নিজের জীবনে জায়গা দিবে না তা সমুদ্র ভালো করেই বুঝতে পারছে।
সমুদ্র গভীর শ্বাস নিয়ে চোখযুগল বন্ধ করে। হারিয়ে যায় অতীতের পাতায়। ফিরে যায় আট বছর আগে হৃদয়পুরে এসে আরভীকে পাওয়ার সময়টায়।
সকাল সাতটা বেজে পনেরো মিনিট। অনেক দিন ধরে নিজের ঘর থেকে বের হয় না সমুদ্র। এক প্রকার ঘড় বন্দী করে রেখেছে নিজেকে। নোমান আহমেদ ও ইয়াসমিন কিছু একটা আঁচ করেছে বুঝতে পারছে সমুদ্র। কিন্তু সমুদ্র চাচ্ছে না কেউ কিছু জানুক। যেই দমকা হাওয়া খানিক সময়ের জন্য এসে ভেতরটাকে তোলপাড় করে না বলেই হারিয়ে গেছে তাকে ভেবে আর কি লাভ? তার কথা ভেবে পরিবারকেই বা কেন কষ্ট দিবে সমুদ্র? তাই সবার কথা ভেবে আজ অনেক দিন পর ঘর থেকে বেড়িয়েছে সমুদ্র।
সময়টা ডিসেম্বররের শেষের দিকে হওয়ায় অনেক শীত পড়েছে। চারদিকে কুয়াশায় আচ্ছন্ন। দূরদূরান্তের কিছুই দৃশ্যমান হচ্ছে না। এই কুয়াশায় আচ্ছন্ন পরিবেশের মধ্য দিয়ে সমুদ্র একা হুডি পড়ে দু’হাত প্যান্টের পকেটে গুজে গন্তব্য হীন হয়ে হেঁটে চলেছে।
কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর হঠাৎ মিনহাজের হাসির শব্দ সমুদ্রের কানে আসে। এ শব্দ পেয়ে সমুদ্র দাঁড়িয়ে যায়। এটা কি সত্যিই মিনহাজ নাকি তা বুঝার চেষ্টা করে। কিন্তু মিনহাজ তো হৃদয়পুর থাকে না। আর হৃদয়পুর কখনো আসলে সবার আগে সমুদ্র দের বাড়িতে যায়। তাহলে এখানে মিনহাজের হাসির স্বর কিভাবে এলো? নাকি এটা অন্য কেউ? যার গলার মিনহাজের মতো!
সমুদ্র নিজের মধ্যকার বিভ্রান্তি দূর করতে শব্দের উৎপত্তি স্থল অনুসরণ করে হাটতে শুরু করে। কয়েক পা সামনে এগিয়ে যাওয়ার পর দেখতে পায় মিনহাজ দাঁড়িয়ে। সমুদ্র অবাক হয়। মিনহাজ হৃদয়পুর এসেছে অথচ সমুদ্রদের বাড়িতে যায় নি! এই কথাটি বেশ ভাবায় সমুদ্রকে।
সমুদ্র মিনহাজের দিকে এগিয়ে যাবে ঠিক সে সময় সমুদ্র লক্ষ করে মিনহাজ একটা মেয়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়েছে। মেয়েটার মুখ অস্পষ্ট। কিন্তু তারপরেও এই মেয়েকে দেখে চেনা পরিচিত মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যাকে এতোদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে এই সে।
সমুদ্র সামনে এগোনোর সাহস পেলো না। মিনহাজের চোখের আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মেয়েটাকে ভালোভাবে দেখার জন্য। এই মেয়েই যদি সে হয় তাহলে মিনহাজের সামনে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না সমুদ্র। এই ভেবেই সমুদ্র মিনহাজের সামনে যায় নি।
সময় অতিবাহিত হতে থাকে। আর সমুদ্রের ভেতরকার উথাল-পাতাল বাড়তে শুরু করে। এক সময় সেই মূহুর্ত চলে আসে যখন সমুদ্র স্পষ্ট মেয়েটির মুখ দেখতে পায়।
সমুদ্রের থমকে দাঁড়ায়। মাথা শূন্য হয়ে যায়। নিজের ভালোবাসার মানুষটা নিজ ভাইয়ের প্রেমিকা তা মানতে পারছে না সমুদ্র। সমুদ্রের মুখে বিষাদের হাসি ফুটে উঠে। ভাগ্যের উপর অভিমান জন্মে। এমনটা না হলেও তো হতো।
এক’পা দু’পা করে সমুদ্র পিছিয়ে যায়। এই দৃশ্য সমুদ্র দেখতে পারছে না। বুকের ভেতরে চিনচিন ব্যাথা করছে। অশ্রুতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। সমুদ্র উল্টো ঘুরে দৌড়াতে শুরু করে। এ জায়গায় আর এক মূহুর্তের জন্যই অবস্থান করা যাবে না। এতো ভয়ানক দৃশ্য সমুদ্র আর দেখতে পারবে না। সহ্য হচ্ছে না এই দৃশ্য।
রাতে মিনহাজ সমুদ্র দের বাড়িতে আসে। এখানকারই একটা কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়েছে মিনহাজ। হোস্টেলে উঠেছে। তা জানতে পেরে নোমান আহমেদ ও ইয়াসমিন ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন।
ইয়াসমিন অভিমান করে বললেন,”হ্যাঁ রে মিনহাজ! আমরা কি তোর কেউ হই না? আমরা থাকতে কেন হোস্টেলে উঠেছিস তুই?”
“তেমন কিছুই না ফুপি, আসলে হঠাৎ করে ইচ্ছে হলো হোস্টেলে থেকে দেখি। একটু অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্যই বলতে পারো।”
“তাহলে এক মাস হোস্টেলে থাক, পরের মাসে না হয় এ বাড়িতে চলে আয়?” নোমান আহমেদ বললেন।
“আচ্ছা দেখা যাক।”
“দেখা যাক বললে হবে না। উনি যা বলেছেন তাই হবে। আর আজকে আর হোস্টেলে যেতে হবে না। এখানেই সমুদ্রের সাথে থেকে যা। এই ছেলের আজকাল কি হয়েছে কিছুই বুঝি না। তুই ওর সাথে থেকে দেখ কি হয়েছে।” শেষোক্ত কথাটি সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন ইয়াসমিন।
সবার মাঝে সমুদ্র কোনো কথা বললো না। চুপচাপ খেয়ে উঠে ঘরে চলে যায়।
ঘরে গিয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে বিছানায়। কিছুক্ষণ পর ঘরে মিনহাজ আসে। এসেই সমুদ্রকে এক ধাক্কায় নিচে ফেলে কোমরে দু হাত রেখে দাঁড়িয়ে বলে,”নাটক করা হচ্ছে আমার সাথে? আসার পর থেকে দেখছি আমাকে এড়িয়ে চলছিস। সমস্যা কি তোর? ফুপি বললো তুই নাকি আজকাল ভদ্র হয়ে গেছিস? কাহিনি কি বল তো। ছ্যাকা ঠেকা খেয়েছিস নাকি?”
“ইয়ার মিনহাজ! ঘুম পেয়েছে অনেক। ঘুমোতে দে। কালকে কথা বলবো তোর সাথে।”
মিনহাজ কিছু একটা বলতে নিয়েও বললো না। এর মাঝেই সমুদ্র বেডে উঠে উলটো ঘুরে শুয়ে পড়ে আবার।
প্রায় এক ঘন্টা পর মিনহাজের ফোন বেজে উঠে। কিন্তু মিনহাজ কল ধরছে না। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। সমুদ্র পাশ ফিরে মিনহাজের দিকে তাকিয়ে দেখে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে মিনহাজ।
সমুদ্র উঠে মিনহাজের পাশ থেকে মিনহাজের ফোন হাতে নিতেই দেখতে পায় “My love” লেখাটা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
সমুদ্রের প্রচন্ড হিংসে হলো মিনহাজের উপর। বাংলাদেশে এতো মেয়ে থাকতে মিনহাজের জীবনে এই মেয়েকেই কেন আসতে হলো? মেয়েটা সমুদ্রের জীবনে এলে কি খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো? একদমই না। উলটো সমুদ্র মেয়েটিকে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে আগলে রাখতো। অসীম ভালোবাসায় নিজের মায়াজালে আঁটকে নিতো।
সমুদ্র মিনহাজের দিকে তাকায়। ইচ্ছে করছে মিনহাজের থেকে মেয়েটিকে ছিনিয়ে নিতে। কিন্তু এ যে অসম্ভব। ভালোবাসা কি আর জোর করে পাওয়া যায়? সমুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোবাইল ফোনটি জগ ভর্তি পানির মধ্যে ফেলে দেয়। এই মোবাইলটিকে বড্ড জঘন্য মনে হচ্ছে। জঘন্য মোবাইলদের নষ্ট হয়ে যাওয়াই উচিত। সেটাও জগের পানিতে ডুবে।
সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে তাকাতেই সমুদ্র দেখতে পায় মিনহাজ হাতে ফোন নিয়ে সমুদ্রের দিকে চোখ-মুখ কুচকে তাকিয়ে আছে। মিনহাজের চোখে-মুখে বিরক্তের ছাপ স্পষ্ট।
সমুদ্রকে উঠতে দেখে মিনহাজ বলে উঠে,”টিট ফর ট্যাট।”
কথাটি বলে মিনহাজ ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়। সমুদ্র বুঝলো না মিনহাজ কেন এই উক্তিটি বলেছে। ভাবতে ভাবতে বেড সাইড টেবিল থেকে নিজের মোবাইল হাতরে খুঁজতে গেলেই বুঝলো মোবাইলটি টেবিলে নেই। মোবাইল না পেয়ে সমুদ্র যখন টেবিলের দিকে তাকালো তখন দেখলো মোবাইলটার অবস্থা বেহাল। জগ ভর্তি পানিতে ডুবন্ত অবস্থায় রয়েছে । এবার সমুদ্র মিনহাযের কথার মানে বুঝতে পেরেছে। আর বুঝতে পেরে নিজের শখের মোবাইলটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। টিউশন করিয়ে এই মোবাইলটা নিজ টাকায় কিনেছিলো সমুদ্র। তাই না চাইতেও মোবাইলটার সাথে অনেক আবেগ জড়িয়ে আছে।
এভাবে কয়েকটা দিন কেটে যায়। সমুদ্র প্রায়ই পথে-ঘাটে মিনহাজ ও আরভীকে একসাথে দেখতে পায়। তাদের দুজনের সুন্দর সুন্দর মুহূর্ত সমুদ্রকে নিজ চোখে দেখতে হয় তাও আড়াল থেকে। দুজনকে একসাথে দেখে নিজেকে বড্ড পাগল পাগল মনে হয়। ইচ্ছে করে সবকিছু ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে যেতে।
কিন্তু এতো কিছুর মাঝেও কিছু কথা সমুদ্রকে বেশ করে ভাবায়। মিনহাজ কেমন আগের থেকে অদ্ভুত হয়ে গেছে। অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড করছে। তবে সবথেকে অদ্ভুত কান্ড হলো মিনহাজ এখনো আরভীর কথা সমুদ্র ও তন্ময়কে জানায়নি । এরকমটা প্রথমবার হয়েছে যে মিনহাজ সমুদ্রকে কিছু জানায় নি। এর আগে মিনহাজের জীবনে যাই ঘটুক না কেন সমুদ্র ও তন্ময়কে সবার আগে জানাতো। তবে এবার কেন ব্যাতিক্রম হলো?
সমুদ্র অনেক চেষ্টা করছে নিজেকে সামলানোর কিন্তু পারছে না। ওদের একসাথে দেখলেই মনের মাঝে দহন জ্বলে উঠে। সবকিছু ধ্বংস করে ফেলতে ইচ্ছে করে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মিনহাজকে ছাই করে দিতে ইচ্ছে করে। তাই অনেক ভেবে চিনতে সমুদ্র হৃদয়পুর ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কেননা এখানে থাকলে নিশ্চিত উল্টো-পাল্টা কিছু ঘটিয়ে বসবে।
চলবে….