চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা #ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া #পর্ব-২০

0
569

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২০
৬২.
ফজরের নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে আছে পুতুল।আজ রাজিয়ার মৃত্যু বার্ষিকী।মানুষটা চলে গেছে কতগুলো বছর চলে গেলো।চোখ বুঝতেই মনে পড়ছে এই তো সেই দিনের কথা।মা তাঁকে নিয়ে মামা বাড়িতে উঠলো।মায়ের সাথে তার কত সুন্দর সুন্দর মূহুর্ত পার হয়েছে।কিন্তু তার ছোট ভাইটা মায়ের ভালোবাসা পায় নিই।ওহ তো জানে না।মা তাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গিয়ে এই সুন্দর ধরনী ছেড়েছেন।

সকাল বেলা মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে স্বাধীন বাড়িতে পা রাখে।পুতুল গায়ে চাদর জড়িয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে।ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা।স্বাধীন এগিয়ে আসে।

আম্মা আপনি নামাজ পড়ে ঘুমাতে যান নাই।
পুতুল মাথা নাড়িয়ে না বলল।চিরকুটটা এগিয়ে দিতেই স্বাধীন অবাক হয়ে হাত বাড়িয়ে নিলো।চিরকুটটা খুলতেই ছোট হাতের কিছু অল্পস্বল্প লিখা।স্বাধীন লিখাটুকু পড়ে পুতুল দিকে তাকায়।

আম্মা আপনি মনে রাখছেন এই দিনটার কথা।
আমি তোও মনে করছিলাম আপনি ভুইলা গেছেন।তাই ফজরের নামাজ পড়ে বোনের কবর জিয়ারত করে আসছি।পুতুল ঢোক গিলে মুখ দিয়ে শব্দ বের করা চেষ্টা করে।উ..উ… ছাড়া আরো কোনো শব্দ বের হয়না।কথা বলতে না পেরে ফুফিয়ে কেঁদে ওঠে।স্বাধীন,পুতুলের দুই চোখের পানি মুছে,তার বুকে মাথাটা রেখে জড়িয়ে মাথায় হাত ভুলিয়ে দিতে দিতে বলল।

আম্মা কাঁদে না।চুপ থাকো।আমি তোমারে নিয়া যাইতাছি।

কবর ওপর কয়েকটা ফুল ফুটে আছে,দূর্বলা ঘাস বেশ বড় বড় হয়েছে।পুতুল কবরস্থানের ভিতরে যেতে পারেনি।মেয়েদের কবরে সামনে যেতে নেই।বড় গেইটে সামনে দাঁড়িয়ে দূর থেকে ছাপসা চোখে তাকায়।চোখের পানি টইটম্বুর হতেই দুই হাতে মুছে নিলো।ওই যে,তৃতীয় স্থানে তার মায়ের কবর রয়েছে।তার মায়ের পাশে সারি সারি অনেক কবর রয়েছে।কার প্রিয়জনেরা এখানে কবরে ঘুমিয়ে আছে জানে না।শুধু জানে তার অতি প্রিয় একটি মানুষ এখানে এই কবরে শায়িত।
তার জনম দুঃখী মা।পুতুল গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে মোনাজাত ধরে দুই চোখের পানি ছেড়ে দিল।মোনাজাত শেষে মাটিতে বসে পড়ে।লোহার গেইট হাত ঢুকিয়ে ডাকবার কত আকুতি।তার মা আজ পুতুলের ডাকে সারা দেয় না।যেমন পাঁচ বছর আগে করেছিল।এভাবেই ঘুমিয়ে ছিল বাড়ি উঠোনে।কত ডেকেছে।কিন্তু চোখ মেলে বলে নিই।

পুতুল মা আমার,এই তো আমি।কান্না করে না।তুমি আমার লক্ষ্মী মা।মায়েরা কি কান্না করে?পুতুলকে তার মা আজ-ও আগের মতো হেঁটে এসে বুকে টেনে নেয় নিই।সাদা কাপড় পরে তার মা পর হয়ে গেছে।মায়েরা এত নিষ্ঠুর কেন?তাদের বুকে ধন,তাদের সন্তান ছেড়ে কি করে ঘুমিয়ে আছে এই মাটির কবরে।একটিবার কি মনে পড়ে না সন্তানের কথা?জানতে পারে কি?মা বিহীন এতিম সন্তানগুলো দুনিয়ার মাটিতে কি করে একলা রইবে?স্বাধীন,পুতুলের কান্না দেখে নিজের চোখের পানি লুকিয়ে এগিয়ে আসে।

আম্মা বাসায় চলো।সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ।তুমি বাসায় নেই।মিলন,সাজু খুঁজবে তোমায়।চল আম্মা।পুতুল স্বাধীনের কোনো ডাকে সারা দেয় না।স্বাধীন,পুতুলের মাথায় হাত দিতেই চমকে উঠে।পুতুল মায়ের শোকে অজ্ঞান হয়ে গেছে।জ্ঞান নেই।স্বাধীন তারাতাড়ি বাসায় দিকে ছুটে।তার মায়ের মৃত্যু যেইদিন হয়েছিল।মায়ের লাশ কবর দেওয়ার জন্য নিয়ে গেছিলো,এমনভাবে পুতুল অজ্ঞান হয়ে ঘরে কোণে পড়ে থাকে।কেউ জানতে পারেনি এতিম মেয়েটির ওপর কি যাচ্ছে?মামা,বোনকে বিদায় দিতে কবরে নিয়ে গেছে। কি অদ্ভুত তাই না?আমাদের আপন মানুষগুলো একদিন আমাদের কবরে রেখে আসবে।যেমন রাজিয়া বেলায় স্বাধীন ভাই হয়ে রেখে এসেছিল।ঠিক তেমনিভাবে আমার,আপনার।এবং আমাদের সকলের আপনজনেরা এভাবেই একদিন কবরের মাটিতে শায়িত করবে।সেইদিন চিতকার করে বলা হবেনা।তোমরা আমাকে এই মাটির ঘরে রেখে যেওনা। আমি তোমাদের সাথে থাকতে চাই।মা,বাবা,ভাই তোমরা নিয়ে যাও আমায়।আমি একা থাকতে খুব ভয় পাই।যখন দেখবে প্রিয় মানুষগুলো তোমার ডাকে সারা
দিচ্ছে না।তারা কাঁদবে।আহাজারি করতে করতে চলে যাবে।তোমায় রেখে যাবে সাড়ে মাটিতে।

৬৩.
ডাক্তার সাহেবা পুতুলকে কেমন দেখলেন?

দেখুন স্বাধীন সাহেব!মেয়েটি মা হারিয়েছে। হঠ্যাৎ শকটটা নিতে সে পারেনি।আপনার কথা অনুযায়ী এমন ঘটনা আগে ওহ একবার হয়েছে।ঘন্টা পর ঘন্টা জ্ঞান ছিলো না।আজ আবার সেই মায়ের সঙ্গে দেখা করা থেকে শুরু করে পুরনো কথা মনে পড়া।

এতটুকু বাচ্চা মেয়ে।যে বয়সে তার মা,বাবার সাথে থেকে হেসে খেলে সময়গুলো কাটানোর কথা।সেখানে মনের মাঝে পুরনো ক্ষত ঘা রয়েছে।তার ওপর মা হারা সন্তান।বাবা নেই।মানসিক অবস্থা তার কতটুকু ভালো থাকতে পারে বলতে পারেন।আমি জানি আপনি ওকে ভালো রাখার চেষ্টা করেছেন। এবং এখনও করছেন।এতে কোনো ত্রুটি রাখছেন না।পুতুলকে দেখে যতটুকু ধারণা করছি।মেয়েটি ভিতরে ভিতরে গুমরে মরছে।আপনার চোখের সামনে থাকলে হয়তো খারাপ কিছু হচ্ছে না।কিন্তু আপনার চোখের বাহিরে এমন কিছু ঘটেছে বা ঘটছে।যা আপনি জানেন না।সেটা হতে পারে বাড়ি কিংবা বাড়ির বাহিরে।আবার স্কুলের কোনো ব্যাপার নিয়ে ওহ হতে পারে।আশা করব চোখ,কান খোলা রাখবেন।মেয়েটি মা,বাবা নেই।আপনি একমাত্র শেষ ভরসা।আপনার কিছু হয়ে গেলে মেয়েটি ভবিষ্যত খুব একটা সুখের হবে ব’লে আমার মনে হয় না।নিজে সর্তক থাকুন।আর মেয়েটিকে নিরাপত্তায় জোরালো করুণ।হয়তো আপনার চোখ সহজেই কিছু ফাঁকি দিতে পারবে না।

ডাক্তার তার কথা শেষ করে অন্য রোগী দেখতে চলে গেলো।স্বাধীন চিন্তায় পরে যায়।

অসীম তালুকদার সকাল আটটা বাজে বাসায় আসেন।বাড়িতে ঢুকতেই শুনতে পায় তার গুনধর ছেলে কাউকে কিছু না ব’লে হুট করে চলে গেছে।এটা শুনে চিতকার করতে শুরু করেন।

এটা কেমন ভদ্রতা?কাউকে কিছু না ব’লে চলে যাওয়ার মানে কি?কালকে এসেই আজকে হাওয়া।ফাজলামো হচ্ছে না কি?

জিহান,রিহান দুই ভাই একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।যার মানে তারা কিছুই জানে না।অর্পণ হঠাৎ চলে গেলো কেন?কথা ছিল আরো বেশ কয়েকদিন এখানে থাকবে।কিন্তু হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়া।

সাফিন ফোন লাগাও গুণধরকে।দেখো সে কোথায় আছে?সাফিন তালুকদার ভাতিজাকে ফোন দিচ্ছেন।কিন্তু অর্পণ ফোন তুলে নিই।দ্বিতীয়বার ফোনে রিং হওয়ার মাঝেই ফোন বন্ধ আসে।যার মানে সে ফোন বন্ধ করে দিয়েছে।অসীম তালুকদার রেগে যান।

এ’কে নিয়ে কি করব আমি?সব সময় দুই ভাইকে নিয়ে যতসব উল্টা পাল্টা কাজ করে।আমার মান সম্মান কিছু রাখেনি।আজ আবার তাদের ওহ সঙ্গে নেয়নি।বাহা..বা কি গুণধর সু পুত্র আমার?

আপনি সব সময় আমার ছেলেটার পেছনে লেগে থাকেন।একবার বাবা হয়ে তাকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন।করেন নিই।তা করবেন কেন?আপনি কথায় কথায় বকাঝকা এবং মাঝে মধ্যে গায়ে হাত তুলেন।আমি মা।তাই সন্তানের কষ্ট বুঝতে পারি।আমার সোনা বাচ্চা ছেলে কে নিশ্চয় কিছু ব’লেছেন।তাই কষ্ট পেয়ে সে বাড়ি ছেড়েছে।

অসীম তালুকদার বউকে কিছু না ব’লে হনহন করে দুতলা নিজের রুমে চলে যান।এই মা,ছেলে তাকে পেয়েছে কি?যখন যা করবে মেনে নিবে!

৬৪.
বিকাল বেলা সবুজ ঘাসের বুকে সূর্যের মতো লাল।শেফালী ঘাসে দেপান্তরে মাঠ।অর্পণ বাইকের সাথে পা ঝুলিয়ে বসে আছে।ফোনটা ইচ্ছে করে বন্ধ রেখেছে।আজ সকালে ঘুমটা ভেঙে গেছে।দ্বিতীয় বার চোখে ঘুম আসেনি।বাড়ি থেকে হঠাৎ চলে আসছে।কাউকে কিছু জানা নিই।তার বাপ হয়তো তার চলে যাওয়ার খবর এতক্ষণে পেয়ে গেছে।

অর্পণ তুই এখানে? বাসায় থেকে চলে আসছি কেন?

ভালো লাগছিলো না।তাই ঢাকায় ব্যাক করেছি।পরীক্ষা সামনে।পড়তে হবে।চল হোস্টেলে ফিরে যাই।

তুই পড়ার জন্য চলে আসছি। বিশ্বাস হয় না।

এতে বিশ্বাস করার কিছু নেই।চল।অর্পণ বাইকে উঠে পড়ে।মাহিম বলল,

তুই যা আমি তোর পিছনে আছি।

ওকে।

অর্পণ বাইক টান দিতেই।মাহিম ফোন লাগায় অসীম তালুকদার কে।

আসসালামু আলাইকুম।স্যার,অর্পণকে পেয়ে গেছি।অর্পণ ঢাকায় ফিরেছে।

ওল্লাইকুমুস আসসালাম।ওর দিকে খেয়াল রেখো।অসীম তালুকদার কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখেন।একটা মাএ ছেলে।ওর কিছু হয়ে হয়ে গেলে সে বাঁচবে কি নিয়ে?বাবা হয়ে বন্ধুর মতো কখন ছেলের সাথে আচরণ করতে পারেনি।সবসময় গুরু গম্ভীর ভাব মুখে ধরে রাখেন।তিনি ভয় পান।তার অতি আদরে বাঁদর না হয়ে যায়।আর সেই ভয়ের জন্যই ছেলেকে বুকে অবধি জড়িয়ে ধরেন না।রাবেয়া জরায়ুতে টিউমার হয়েছিল।অপারেশন করে ফেলতে হয়েছে।দ্বিতীয় সন্তানের আশা তিনি আর করেন নিই।তার মা,বাবা অপারেশন কথা শুনে নারাজ হলেও ছেলের জন্য বউকে কিছু বলতে পারেনি।তার ওপর পুত্র সন্তান আগেই জম্ম দিয়েছে।হয়তো এরজন্য রাবেয়া প্রতি সন্তুষ্ট প্রকাশ করেন।অথচ অসীম তালুকদারের ঘর আলো করে যেইদিন অর্পণ আগমন ঘটে।অসীম হাসপাতালে দাঁড়িয়ে ব’লেছিল।

ডাক্তার এটা আমার মেয়ে।অসীম তালুকদারের মুখে হাসি লেগেছিল।

মিস্টার তালুকদার আপনার কন্যা সন্তান নয়।পুত্র সন্তান হয়েছে।অসীম তালুকদার অবাক হয়ে যান।ভাবেন।ডাক্তার মিথ্যে ব’লেছে।তাই তোয়ালে থাকা হ্রদ পুষ্ট সন্তানকে চেক করেন।
মেয়ের আশায় যে বাবা বসেছিল।তার পুত্র হয়েছে।যার ভয়ে বউকে আল্টাসোনোগ্রাফি পর্যন্ত করতে দেন নিই।দ্বিতীয়বার বাচ্চার জন্য চেষ্টা করলে জানতে পারে তার স্ত্রী আর কখনো মা হতে পারবে না।তিনি নারাজ হননিই।বরং ছেলেকে দুই হাতে আগলে নেন।দুই বছর পর্যন্ত ছেলে তার কাছে আদরে মানুষ হয়েছে।তারপরে নিজের কাজের জন্য দেশে বাহিরে দিনের পর দিন থাকতে শুরু করে।তখনই ছেলে মায়ের সঙ্গে বেশ মানিয়ে বড় হয়ে উঠেছে।নিজের হুস জ্ঞান বলতে তার মায়ের আঁচল তার প্রিয় হয়ে যায়।আর বাবা সম্পর্কে হয়ে ওঠে একজন শক্ত কঠোর পুরুষ।বাবারা রাগী হয়।তারা কঠোর হয়।তারা কখনোই নরম হয় না।বাবা হয়ে সন্তানের সাথে নরম আচরণটা এখন সময়ের সাথে আসে না।ছেলে বড় হচ্ছে।আর তার মাথার টেনশন বাড়ছে।এলাকায় উল্টা পাল্টা কান্ড ঘটানো থেকে শুরু করে সব কাজ করতে শুরু করেছে।তার সুনামে অসীম তালুকদারের পেট মোচড় মারে।অসীম তার ইহ জম্মে করেন নিই।তা ছেলের দ্বারা অসম্ভবকে সম্ভব করে ছেড়েছে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here