#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২১
৬৫.
রাতে বিদ্যুৎ নেই।পুতুল হাতপাখা দিয়ে দুই ভাইকে একটু পর পর বাতাস করছে।বারবার হাত পাখা চালানোর জন্য হাত ব্যাথা হয়ে যায়।পুতুল হাতপাখা নামিয়ে রাখে।
আপু গরম লাগছে।মশা কামড়ায়।
পুতুল কি করবে বুঝতে পারছে না?শীতে কারেন্ট যায় না।গরমের সময় এত জ্বালিয়ে মারে কেন?শীতের সময়টাতে ঠান্ডা কাঁপন ধড়িয়ে দেয়।এক দিক শান্তি লাগে,কারেন্ট নিয়ে প্যারা হতো না ব’লে।আর এখন বিরক্ত লাগছে।কারেন্ট নেই ব’লে।
সময়টা চৈত্র মাস চলছে।দিনের বেলা কাঠ ফাটাঁ রোদ মাথার ওপর থাকে।রাতের বেলা ভ্যাপসা গরমে জান প্রায় শেষ।কপালের ঘাম মুছে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।কিছু কয়লা মাটির হাড়িতে তুলে নেয়।কাগজ পুড়ে ধোঁয়া দিতে থাকে।এতে যদি মশার উত্তপাত কমে।
একে তো গরম,তার ওপর নতুন পাতার সঙ্গে ঝরে পড়া পাতার বিরহবিচ্ছেদ।কেমন একটা রুক্ষ রুক্ষ ভাব!এই যেমন আজকের চৈত্রদিন।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো।বাইরে ঝিঁঝিপোকার ডাক।তেতে ওঠা রোদ ছিলো। লু হাওয়া বলতে যেমন বোঝায়,তেমন এক গরম বাতাস ঢুকে পড়েছে ঘরের ভেতর। জানালার ওপাশে স্তব্ধ হয়ে আছে আম, কামরাঙা,জারুল,দেবদারু গাছের সারি। প্রত্যেকের গায়ে যেন লেগে আছে নোনতা বুনো গন্ধ।
আপু মশা কমে গেছে।কারেন্ট নেই।পড়া নেই।চলো না আমার বাড়ির উঠোনে খেলতে যাই।পুতুল ইশারায় বলল কি খেলতে চাও?মিলন গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল।ভেবেই যাচ্ছে।এই ভাবার শেষ হয় না।পুতুল,ভাইয়ের গাল থেকে হাত নামিয়ে দিলো,
আপু জুতা চুরি খেলি।পুতুল মাথা নাড়িয়ে না বললো।
তাইলে হাঁড়িপাতিল দিয়ে খেলি।আচ্ছা এটা বাদ।চল কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসিয়ে দেই।
সাজু বিরক্ত হয়ে বলল,
দূর কি কস?এসব বাদ।নাটায় নিয়ে ঘুড়ি উড়াইয়া আসি।মিলন চোখ ছোট্ট করে বলল,
বলদ,রাইতের বেলা কি ঘুড়ি উড়াবি?চোখে তোও দেখবি না?এখন এক চোখ কানা।পরে দেখবি দুই চোখ কানা হইয়া গেছে।
তাইলে তুই বল,কি খেলবি?
একাধক্কা খেলি।
না।
বরফপানি।
না।
মারবেল দিয়ে খেলি চল।
না।
লাটিম ঘুরানো।
না।
ক্রিকেট খেলি।
না।
ফুটবল!
না।
তুই চুপ থাক বানরের নানা ভাই।সব কিছুতেই খালি না,না করে।
আপু এখন তো গরম পড়ছে।তাইলে পুকুরের ঘাটে পিছলা বানিয়ে সিলিপ কাটি।পানিতে গোসল হলো।আর মন ঠান্ডা হবে।পুতুল সাজুকে না বললো,হাতের ইশারার লুকোচুরি খেলতে চায়।যেহেতু রাত,এটাই সঠিক সময়।বাড়ির বাহিরে যেতে হলো না।খেলতে সুবিধা হলো অন্ধকারের জন্য।এতে মিলন,সাজু সায় দিলো।
৬৬.
পাট ক্ষেতে ছাগল বন্দি।
জলে বন্দি মাছ।
সখা গোও…আমার মন বালা না।
কিছু পুরুষ চিকন চাকন,কিছু পুরুষ বুড়ি ওয়ালা।
টাকা পয়সা থাকলে বেশি।তারা বউ পায় ভালা।
সখা গোও…. আমার মন ভালো না।
কে আমার আব্বার মন খারাপ করলো?কিসের জন্য মন ভালা না আব্বা?বউ লাগবো।
চোখের সামনে বাবাকে দেখেই জিহ্বা কামড় দিলো।উল্টো পথে পালানোর চেষ্টা করলে স্বাধীন ধরে ফেলে।সাজু ভীতুর মতো বলল,
আব্বা ছাড়ো।আর গাইতাম না।
আচ্ছা গাইবেন ভালা কথা।কিন্তু এমন অদ্ভুদ গান কোথা থেকে শুনলেন?না ব’লে কিন্তু ছাড়বো না।
ওই মফিজ মামা থেকে।
এই মফিজ কে?
এইপার থেকে ও-ই পারে নিয়ে যায়।নৌকায় করে সেই মফিজ মামা।সে বৈঠা বাইতে বাইতে বলতো।আমি শুনতেই মুখস্থ করেছি।
আজকের পর যেনো এমন গান গাইতে না শুনি।শুনলে কিন্তু গালটা শক্ত করে টেনে লাল করে দিবো।মনে থাকবে।
সাজু মাথা নাড়িয়ে বলল,
আচ্ছা।
স্বাধীন ছেড়ে দিতেই দৌড়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে পড়ে।মিলন বরশি দিয়ে মাছ ধরতে বসেছে।হাতে আছে টসটসে লাল পেয়ারা।সাজুকে এইদিকে আসতে দেখে পেয়ারা কামড় বসিয়ে দিলো।
কি’রে বাঁদরের নানা ভাই।তোর আবার কি হইলো?
কিছু না।
কিছু না হইলে এমন ভ্যাটকা মাছের মতো ভ্যাটকাইয়া আছোত কেন?
কই ভ্যাট কাইলাম?
তোর বাঁদর মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে।তুই পেঁচা।
আমি পেঁচা হলে তুই কি?
আমি সুন্দর।
তুই সুন্দর।
হুম।আপু বলছে।
আপু সুন্দর তাই আপুর চোখে সব সুন্দরই লাগে।তুই তোও বাঁদরের ভাই বাঁদর!
কি আমি বাঁদর?তবে রে সাজুর বাচ্চা।আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন।মিলন পুকুরের কাঁদা মাটিতে হাত দিয়ে কাঁদা মাটি উঠিয়ে সাজুর মুখে ছুঁড়ে মারে।মিলন দেখাদেখি সাজু ওহ কাঁদা ছোড়াছুড়ি শুরু করে।পুতুল পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখে মিলন,সাজু কাঁদা দিয়ে ভূত সেজে আছে।পুতুল দুই ভাইয়ের কান্ড দেখে হাসতে থাকে।পুতুলকে হাসতে দেখে দুই ভাই গাল ফুলিয়ে দুইদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকে।
আপু আজকে হাঁসের পুটকি খাইছে।তাই বেশি বেশি হাসতাছে।সাজু’র অদ্ভুত কথায় মিলন রেগে এক ধাক্কা দিলো।মিলন হঠাৎ করে ধাক্কা দেওয়া সাজু পানিতে পড়ে গেলো।
কি কস এগুলো?বাঁদরের নানা ভাই।চুপ থাক।সাজু কোমড় সমান পানিতে পড়ে হা করে তাকিয়ে রয়।মিলন রেগে পুকুরের পানির একটু ওপরে বড় কাঁঠাল গাছে বসে পড়ে।পা পানিতে নামিয়ে দেয়।পুতুল দুটোকে এত ডাকছে তবুও কোনো সাড়া দিচ্ছে না।পুতুল এদের সাথে না পেরে মামাকে ডেকে পাঠায়।
৬৭.
পুতুল পড়াশোনা পাশাপাশি নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে।বাসায় নকশিকাঁথা সেলাই করে।সেগুলো আবার বাজারে বিক্রি হচ্ছে কম দামে।ন্যায্য পাওনা সে পাচ্ছে না।তবুও যা হচ্ছে সে তাতেই খুশি।সামনে শীতের জন্য হয়তো চাহিদা বাড়বে।অর্ডার আরো বেশি আসবে।
‘নকশি কাঁথা’ শব্দের প্রচলন হয়েছে। কাঁথাকে খেতা,কেন্থা ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়।
কাঁথা তৈরি হয় সাধারণত পুরনো কাপড়, শাড়ি,লুঙ্গি দিয়ে।সাধারণ কাঁথা বছরের সব সময়ই ব্যবহূত হতে পারে,কিন্তু নকশি কাঁথা বিশেষ উপলক্ষে ব্যবহূত হয় এবং তা পুরুষানুক্রমে স্মারক চিহ্ন হিসেবে সংরক্ষিত থাকে।ভারতের বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো অঞ্চলে এ ধরনের কাঁথাকে বলে শুজনি। প্রয়োজনীয় পুরুত্ব অনুযায়ী তিন থেকে সাতটি শাড়ি স্তরীভূত করে সাধারণ ফোঁড়ে কাঁথা সেলাই করা হয় এবং সেলাইগুলি দেখতে ছোট ছোট তরঙ্গের মতো। সাধারণত শাড়ির রঙিন পাড় থেকে তোলা সুতা দিয়ে শাড়ির পাড়েরই অনুকরণে নকশা তৈরি করা হয়। তবে কাপড় বোনায় ব্যবহূত সুতাও কাঁথার নকশা তৈরিতে ব্যবহূত হয়, বিশেষত রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে।
আম্মা।পুতুল হাতের নকশিকাঁথা পাশে রেখে মাথা তুলে।
আম্মা এভাবে আপনি কিছুই করতে পারবেন না।নকশিকাঁথা কাজ করছেন ঠিকই।কিন্তু পারিশ্রমিক হিসেবে যেটা আপনার পাওয়ার কথা।সেটা আপনি পাচ্ছেন না।তাই আমি চাইছি।আপনার এই হাতের কাজ গ্রামের এই ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে আটকে না থাকুক।গ্রামে গঞ্জে এটার সীমাবদ্ধ না হোক।তাই আমি চাই আপনার তৈরি করা কাজগুলো ঢাকায় যাক।ঢাকায় এর চাহিদা ব্যাপক।আবার শুনছি।বিদেশের মাটিতে এই নকশিকাঁথা না-কি বিক্রি করা যায়।বিদেশে একবার আপনার হাতে কাজ পৌঁছে গেলে।আপনি ভাবতে পারছেন চমৎকার সময় হাতে চলে আসবে।মামা কথায় পুতুল নিজের হাতের কাজে চোখ বুলিয়ে নেয়।তার তৈরি করা কাজগুলো কি একদিন সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছাবে।এটা কি সম্ভব?বার্মন হয়ে আকাশের চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর মতো ব্যাপারটা।প্রত্যাশার থেকে যদি বেশি হয়ে যায়।ভয় হয়।সে কি পারবে নিজের জন্য একটা আলাদা পরিচয় করতে?পুতুলকে চুপচাপ থাকতে দেখে স্বাধীন হাটু গেড়ে পুতুল মাথায় হাত রাখে।
আম্মা আপনি এত চিন্তা কেন করেন?রিজিক এর মালিক আল্লাহ।তিনি আমাদের জন্য যা ঠিক করে রাখছেন তাই হবে।এত ভেবে কাজ নেই।আপনি হ্যা ব’লে দিন।বাকিটা আমি করে নিবো।
পুতুল মাথা উঁচিয়ে ইশারায় বলল,
মামা তুমি কিভাবে কি করবে?ঢাকায় কাউকে যেতে হবে।আর নয়তো কাউকে আনতে হবে।কাউকে রাখার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই।
আম্মা আপনি চিন্তা কইরেন না।ঢাকায় মাসে আমি একবার যাব।আমি হব আপনার হ্যাল্পার।আমিই করব সব।পুতুল সাহস করে কিছু বলতে পারছেনা।তবুও কোনোমতে মত দিল।এখন দেখা যাক কি হয়?
বাড়ির সামনে দিয়ে গান বাজিয়ে ছুটে চলছে একজন লোক।পুতুল,স্বাধীন সে দিকে তাকাতেই দেখলো।মিলন,সাজু কিছু কাঁচা পয়সা দিয়ে বরফ জাতীয় কিছু চেটেপুটে খাচ্ছে।পুতুল এসব চিনে না।কিন্তু স্বাধীন তার
শৈশবের সেই পুরনো সৃতিতে ডুবে গেলো।সে ওহ এক সময় ছুটে যেতো বরফকলের কাছে।চার আনা,আট আনা পয়সা দিয়ে কিনে খেতো সাদা বরফ, লাল-সবুজ আইসক্রিম অথবা নারকেল-পাউরুটি দেওয়া মালাই।হিম হিম ঠান্ডায় জুড়িয়ে যেত শরীর।চৈত্র মাসে যাঁরা রোজা রাখার অভিজ্ঞতা পেয়েছেন,তাঁরা জানেন ইফতারিতে লেবুপাতার গন্ধ,চিনি আর বরফ দেওয়া শরবতের স্বাদ কত মধুর হতে পারে! মাথায় ঘোল ঢালা নিয়ে যতই হাসাহাসি করি না কেন,এক শ,দেড় শ বছর আগে চৈত্র–বৈশাখের তীব্র গরমে ঘোল আর মাঠাই ছিল পরম বন্ধু।স্বাধীন এগিয়ে গিয়ে সাজু,মিলনের হাতে সবুজ,গোলাপি মিশ্রনে বরফি তুলে দিলো।সাজু,মিলন নিজেদের তুই হাতেরগুলো চেটেপুটে খাচ্ছে। পুতুল,রেনু,আর নিজের জন্য নিয়ে বাসায় যায়।মামার খাওয়ার ধরণ দেখে পুতুল মুখে দিলো।গরমের দিন এমন বরফিটা মুখে দিতে বেশ লাগছে।খাবারটা ভীষণ মজা।স্বাধীন,রেনু নাম ধরে ডাকতেই বের হয়ে আসে।একসাথে পরিবারের সবাই মিলে বারান্দায় বসে খেতে লাগলো।সবার ঠোঁটগুলো বিভিন্ন রঙের হয়ে আছে।একে অপরের দিকে তাকিয়ে সবাই একসাথে হেঁসে উঠে।শৈশবগুলো মিষ্টি স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলো ভীষণ ভাবে মনকে নাড়া দিয়ে যায়।
শৈশবের সেই দিনগুলি,
ফিরবে না হায়।
শত কাজের ফাঁকেও,
এ মন,ছুটে যায়।
চলবে…..
আসসালামু আলাইকুম।গল্পটা এতদিন না দেওয়ার জন্য আমি সত্যি দুঃখিত।কেন দেয় নিই?কারণটা অনেকে জেনে গেছেন।আবার অনেকে জানেন না।আমাদের ছোট আপুটা আমাদের মাঝে আর নেই।পৃথিবীর আলো সে দেখতে পায় নিই।আজ তার চলে যাওয়ার তিনদিন পূর্ণ হয়েছে।