#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২৫
৭৭.
শুনলাম তোমার ননদের মাইয়া এহনো এই বাড়িতেই আছে।তা তাকে কি সারাজীবন বসিয়ে রাখবা না-কি?মাইয়া মানুষ যখন, পরের বাড়িতে পাঠিয়ে দেও না কেন?স্বাধীন এই মাইয়ারে এত দিন খাওয়াছে।এই তো ম্যালা করছে।মাইয়াডারে বিয়া দিয়া ফালাও।
-;মামী মা।আপনি অতিথি মানুষ।অনেকদিন পরে আসছেন।কোথায় একটু আনন্দ,হাসি,মজা করবেন?তা না করে।আপনি আজকের এই শুভ্র দিনে কথাগুলো নিয়ে পড়ে আছেন?
-;রেনু তুমি ব্যাপরটা বুঝতাছো না।আরে পরের মাইয়া,পোলা নিয়ে এত মাতামাতি কিসের?ওদের নিয়ে মাতামাতি কম কর।নিজের ঘরেও দুইখান আছে সেটা কিন্তু ভুইলা যা-ইয়ো না।পরের মাইয়া,পোলার জন্য এত দরদ।আর নিজেরটার প্রতি কোনো দরদ নাই কেন?আবার ঢঙ্গ কইরায় বোবা মাইয়াডারে পড়াইতাছে।বলিই,টাহা কি গাছে ধরছে তোমার সোয়ামীর?এত যখন টাহা পয়সা আছে।আমারে দিয়া দেও।আমি গ্রামে গিয়া গরু কিনি।প্রত্যেক মাসে আমার থেকে লাভ নিয়া আইসো।
মামী মা থামুন।পুতুল আমাদের’টা খায় না, পড়েও না।ওর নিজের টাকায় ওর খরচ চলছে।এমনকি ওর মায়ের নামের সম্পত্তি যতটুকু প্রাপ্ত হোক পাওনা রয়েছে।সেইসব ওপরই ওর বসত ভিটা।ওইযে পশ্চিমে দিকের ছাপড়ার ঘরটা দেখতে পাচ্ছেন।ওটাতে পুতুল থাকে।ঝড় হয়,তুফান বয়।কিন্তু মেয়েটা আমাদের ঘরে এসে একটা রাত কাটাতে রাজি না।সে তার ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে ঘুমিয়ে থাকে।কয়েকদিন আগে বৃষ্টির জন্য যখন ঘরের চালের ফুটো দিয়ে টুপটাপ শব্দ করে পানি পড়ছিল।পুতুল ভাইদের কে নিরাপদে রেখেছে।নিজের ঘরে ছোট মাটির কলস এবং ভাঙ্গা হাঁড়ি পেতেছে।যাতে পানিটুকু মাটিতে কিংবা নিজের গায়ে এসে না লাগে।কিন্তু ঘরে ভিতরে জানালা বেয়ে পানি পড়ছে।বাহিরে ঠান্ডা বাতাসের সাথে বৃষ্টি জ্বালাতন সয্য করা দায় হয়েছে।নিজের গায়ে বৃষ্টির পানি পরে জ্বর এসেছে।জ্বরের জন্য
মেয়েটা বিছানা ছাড়তে পারছে না।আর আপনি তাঁকে নিয়ে আমার কাছে এসেছেন নিন্দা করতে।
পুতুলের হয়ে রেনুর সাফাই গাওয়াটা ভালো চোখে নিলেন না মনোয়ারা বেগম।পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন।এত চটাং চটাং কথা থামাও।আর মাইয়া মানুষ হইয়া তোমার গলায় দেখি খুব তেজ বাড়ছে।স্বাধীনের ঘরে আইসা মোটা চালের ভাত খাও।তার জন্য বুঝি এত সাহস বাড়ছে না।কলিজাটা মেলা বড় হইছে।এত চটাং চটাং কথা আমার লগে কমাইয়া কও বউ।মাইয়া মানুষের এত তেজ আমার পছন্দ নয়।গুরুজনের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নেই।কেমন শিক্ষা দিয়েছে তোমার বাপ,মা?আর ওই মেয়ের হয়ে এত সাফাই গাইছো।পড়াশোনা করাচ্ছো।দুইদিন পরে তোও ওরে পরের বাড়িতে বিয়া দিমু।তখন হাতে বই থাকব না।হাতে থাকব খুন্তি।মাইয়া মাইনষের আবার এত পড়া লাগে নিই?
কেন মামী মা?মেয়েরা কি পড়াশোনা করে না?মেয়েদের এত ছোট নজরে দেখেন কেন?মেয়েরা চাইলেই সব পারে।একটা ভাঙ্গা সংসার মেয়েরা যেমন নিজ হাতে গড়তে পারে।তেমনই ভাঙ্গতে ওহ পারে।যে মেয়ে পরের বাড়িতে রাঁধতে জানে।আবার সেই হাতে ঘরের বাহিরে শিক্ষা আলো জ্বালাতে পারে।আজকের মেয়েরা ঘরে বাহিরে দু’টো দিকেই সামলাতে জানে।আপনি জানেন মেয়েরা ডাক্তার,পুলিশ,উকালতি থেকে শুরু করে সব কিছুতেই এগিয়ে যাচ্ছে।নারী কোনো দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই।
ওহ তা পুরুষের মতোই চালচলন করলেই কি মেয়ে মানুষ,পুরুষ মানুষ হয়ে যায়?তাদের মতোই চলার এত শখ?শোনো বউ,মাইয়া মানুষ হইছে ননীর পুতুল।তারে যে পাত্রের রাখব।সেই পাত্রের আকারে সে ধারণ করব।
আর মাইয়া মানুষের যে পর্দায় রাখতে হয় তা কি ভুইলা গেছো?
৭৮.
না,মামী।আমি আমার মেয়ে এবং ছেলেকে ইসলামের ধর্মীয় শিক্ষায় নিয়োজিত রেখেছি। মেয়েকে পর্দায় রাখার জন্য একটু একটু করে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।তারা পাচঁ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে।তাদের আরবি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।তার পাশাপাশি বাংলা….!
হইছে থামোও তুমি।পাঁচ ওয়াক্তের নামাজের পাশাপাশি আরবি পড়াইছো।এর বাহিরে তুমি কি করছো?একটা সন্তানকে তুমি মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহণের জন্য দিয়েছো।সব দেখি দুনিয়ার আরাম আয়েসের জন্য দিয়েছো।দুনিয়ায় আনন্দ নিয়ে আছো।আখিরাত নিয়ে তোমাদের কোনো চিন্তাই নাই।যদি চিন্তা থাকত।তাইলে মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহনের জন্য পাঠাতে।যাও তো বউ।আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।তোমার কথা শুনলে মাথা গরম হইয়া যায়।
যাচ্ছি মামী মা।তবে যাওয়ার আগে একটা শেষ কথা ব’লে যাই।আমার কোলে এই সন্তানকে কিন্তু আমি এবং আমার স্বামী মাদ্রাসায় পড়ানোর অনেক ইচ্ছা আছে।
তাকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করব।
আরেকটা কথা।যেটা আমি এবং আমার স্বামী ছাড়া কেউ জানে না।
আমরা পুতুলের বেলায় সর্ব প্রথম চেষ্টা করেছিলাম।গণ শিক্ষায়।যার মাধ্যমে হাফেজি পাস করে বের হবে।কিন্তু তার কথা বলতে না পারার জন্য সব জায়গায় থেকে খালি হাতে ফিরেছিলাম।সর্বশেষ আশার হাতছানি পাই তালেপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে।তা-ই মেয়ের ভবিষ্যতে কথা চিন্তা করেই সেখানেই পড়তে দেওয়া হয়।
তাকে কিন্তু মেয়ে ব’লে কিংবা তার কথা বলতে না পারার জন্য দূর ছাই করিনি।আর তার পোশাক বেশ মার্জিত।সালোয়ার,কামিজ,কেচি বেল্ট এবং মাথায় হিজাব পরিধান করে স্কুলে যায়।কয়েকদিন থাকলেই দেখতে পারবেন।তার পোশাকে কোনো অশালীন কিছু নেই।
একইভাবে বাকি দুই ছেলেকে মাদ্রাসা শিক্ষায় দিতে চেয়েছি।কিন্তু তাদের ইচ্ছে ছিলো বোনের কাছাকাছি থাকা।তা-ই তোও শত চেষ্টা করে ওহ দুই ছেলেকে মাদ্রাসা পড়াতে পারিনি।তাই ছোট ছেলের সাড়ে তিন বছর বয়সে সাধারণত মসজিদ ও মাদ্রাসা ভিত্তিক করে দিব।
মাদ্রাসার প্রাথমিক স্তর মক্তব,নূরানি বা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা নামে অভিহিত।ফোরকানিয়া শব্দের মূল ফুরকান যার অর্থ বিশিষ্ট।মিথ্যা থেকে সত্যকে সুস্পষ্টভাবে পৃথক করে বলে পবিত্র কুরআন-এর আরেক নাম আল ফুরকান।প্রাথমিক স্তরের যেসব মাদ্রাসায় কুরআন পাঠ ও আবৃত্তি শেখানো হয় সেগুলিকে বলা হয় দর্সে কুরআন।সাধারণত স্থানীয় কোন মসজিদেই আশেপাশের পরিবারের ছোটদের প্রাথমিক পর্যায়ের ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়।মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিনরাই সাধারণত এর শিক্ষক বা উস্তাদ হন।
৭৯.
রেনু কথা শেষ করে।ছোট ছেলেকে নিয়ে পুতুলের ঘরে ঢুকেন।মেয়েটা জ্বরে ঘোরে কেমন নেতিয়ে পড়েছে।এই মেয়েকে নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত।স্বামী বাড়িতে আসলেই তাকে আরেকবার বলবেন গঞ্জের ডাক্তার দেখিয়ে আনতে।
লুঙ্গি ধরে দুই ভাই খাটে বসে আছে।একটু পর পর নিজেদের দিকে নিজেরাই তাকায়।পরশু নানু বাড়ির লোকেরা এসেছে।তাদের সাথে সবাই দেখা করে গেছে।হাতে ও বেশ কচকচে দশ-টাকা,বিশ টাকা নোট গুছে দিয়েছেন।টাকা গুলো দুইজনের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে।তাদের সমবয়সী কিছু ছোট বাচ্চাদের দিকে টাকা ছুঁড়ে মারতে মারতে বলল,
এই নে টাকা।এই তুই নে।এই নে।তোরা চকলেট কিনে খাইস।তুই বরফি খাইস।তুই জুস খাইস।এমন করে সবার মাঝে টাকা ছুঁড়ে মারতে লাগল।সবাই যখন নতুন কচকচে টাকাগুলো মাটি থেকে তুলে হাতে নিতে গেলো।তখনই মিলন,সাজু ওদের হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে নিলো।দরজার সামনে মানকিং সাহেব চোখের পলক একটু পর পর ফেলে তাকিয়ে আছে।আর বাকিরা হা করে তাকাতেই মিলন,সাজু লুঙ্গি ধরে খাটে বসে বলল,
ওই তাকাইয়া আছস কেন?কি কবি ক?তোরা কইলে আমি কমু হ।
মিলন,সাজুর কমকান্ডে কুত্তা কেউ কেউ করে উঠে।
আজ বারে শুক্রবার ছিল।এই জুম্মা দিনেই তাদের সুন্নাতখানা কাজ করে।দুই ভাই গোসল সেরে যোহরে নামাজ পরে আসতেই আসল কাজটা করে ফেলে।সাজ্জাদ মামা,এবং আব্বা দুই ভাইয়ের চোখ হাত দিয়ে ধরতেই কেমন যেনো ব্যাথা পায়।কান্না করে উঠতেই দেখে তাদের কাম সাইরা লাইছে।দুই ভাইয়ের চিতকার চেচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে।তাদের কান্না থামানোর সাধ্য কারো হয়নি।নানা,নানু এবং বাকিদের মিষ্টি মিষ্টি কথায় কান্না বন্ধ হয়নি।দুইজনের হাতে টাকা দিতেই ঠান্ডা হয়।এবং কান্না আস্তে আস্তে বন্ধ হয়েছে।
৮০.
পুতুল বিছানা ছেড়ে আছরের নামাজটুকুও পড়ে নিয়েছে।জ্বরটা কেমন ছেড়ে দেয় আবার বেড়ে যায়।শরীর প্রচন্ড দূর্বল লাগছে।মুখটা তিতো হয়ে আছে।পেটে কিছু রাখাটা কষ্ট কর।যাকিছু খাচ্ছে সব বমি করে ফেলে দিচ্ছে।বাড়িতে মেহমান আসছে।তাদের কাছে অবতী যাবে সেই ক্ষমতাটুকু নেই।ঘরের কোণে চুপটি করে বসে থাকতেই।দুই ভাই মামার রুম থেকে ডেকে উঠে।
ওই আপু।তুমি কই?এখানে আসো।আমায় নিয়ে যা-ও।আমি যাব তোমার কাছে।
মিলনের ডাক শুনে।পুতুল আসছি টুকু উচ্চস্বরে বলবে সেই সাহস টুকু হচ্ছে না।পুতুলের থেকে সাড়া না পেয়ে মিলন ঠোঁট উল্টে খাটে গাল ফুলিয়ে বসে রয়।স্বাধীন আছরের নামাজ পড়ে বাসায় এসেছে।
শুনছেন।আপনি পুতুলকে নিয়ে একটু ডাক্তার কাছে যাবেন।মেয়েটার গায়ের জ্বর কমছে আবার বাড়ছে।ঠিক মতো খাবরটুকু খাবে সেই অবস্থা নেই।পেটে কিছুই রাখতে পারছে না।স্বাধীন মাথার টুপিটা খুলে পুতুলের রুমে পা দেওয়ার আগেই দরজার বাহিরে দাড়িয়ে কাশির মতো শব্দ করে রুমে পা দেয়।মামার গলা পেতেই পুতুল নিচু মাথা উপরে তোলে।
মামা কপালে হাত দিয়ে জ্বরটা বোঝা চেষ্টা করেন।দেখেন জ্বরটা আবার বাড়ছে।অথচ যোহরে সময় কিছুটা কমেছিল।
আম্মা চলেন!ডাক্তার দেখাবো।
পুতুল মাথা নাড়িয়ে না বলল।যার মানে সে যেতে চায় না।তার ভালো লাগছে না।স্বাধীন পুতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে রুম থেকে চলে যায়।মামা চলে যেতেই টুপ করে চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু ঝড়ে পড়ে।গায়ে নকশিকাঁথা দিয়ে শুয়ে পড়ে।ঘুমানোর চেষ্টা করে।যদি ঘুমিয়ে চায় তাহলে হয়ত জ্বরটা তাকে কাবু করতে পারবে না।পুতুল ঘুমের চেষ্টা করে।
চোখ মেলে তাকাতেই দেখে মামা তার মাথার সামনে বসে আছে।মাথায় হাত দিতেই দেখতে পায় জল পট্রি মাথায়।তার পাশেই ডাক্তার বসে আছেন।ডাক্তার কি সব যেন মামাকে বলছে?পুতুলের সেইসবে মনযোগ নেই।শরীরটা কেমন হালকা লাগছে।আর গা দেখে মনে হচ্ছে ঘাম দিচ্ছে।নকশিকাঁথা সামনের হালকা অংশ ঘাম লেগে ভিজে আছে।পুতুল উঠার চেষ্টা করলেই মামা নিষেধ করেন।ডাক্তার সাথে মামা বের হয়ে যেতেই একটুও পর মামী রুমে ঢুকেন।ভিজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দেন।আর গায়ে কাপড়টা পাল্টে নিতে বলল।
চলবে….
আসসালামু আলাইকুম।হাসপাতাল থেকে বাসায় আসছি।এখন থেকে গল্প ঠিক সময় পাবেন।অনিয়মিত আর হব না।