#চন্দ্রকলা
#লামিয়া_ইসলাম
#পর্ব_২
জমিদার সাফোয়ান চৌধুরী তার রুমে বসে আছে। কিছুক্ষন আগে তার কাছে খবর এসেছে তার বাবার পুরানো ড্রাইভার আব্দুল মিয়া মারা গিয়েছে। মানুষ মরণশীল তাই তার মারা যাওয়ার খবরটা সবার কাছেই স্বাভাবিক লাগার কথা কিন্তু আব্দুল মিয়ার মৃর্ত্যুটা হয়েছে খুবই ভয়ানকভাবে। আব্দুল মিয়া সবসময় খুব ভোরেই উঠে যায়। কিন্তু আজ সে ঘুম থেকে না উঠার কারণে তার মেয়ে তার রুমে গিয়ে দেখতে পায় আব্দুল মিয়ার চোখ গুলো উঠানো। আর চোখগুলার গর্তের ভিতরে সিগারেটের ছাই দিয়ে ভরা। আর তার বুঁকের ভিতরে ছুরি দিয়ে কেটে লেখা হয়েছে ১ জানুয়ারি ২০০৩।
পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে হয়তো কেউ প্রচন্ড ঘৃণা থেকে এই কাজটি করেছে। কারণ কেউ তাকে শুধু খুন করতে চাইলে এতটা অত্যাচার করতো না। তবে তার মৃর্ত্যুর কারণ হিসেবে বিষ মনে করা হয়েছে। কারণ তার ঠোঁট নীল হয়ে আছে। কিন্তু তার শরীরে কোথাও সাপের কামড়ের দাগ নেই। লাশ পোস্টমর্টেম এর জন্য পাঠানো হয়েছে। সাফোয়ানের কেন যেন মনে হচ্ছে খুব বড় ঝড় আসতে চলেছে। ১০ বছর আগে হওয়া তার বাবা আর চাচার এক্সিডেন্টে এই আব্দুল মিয়া অলৌকিক ভাবে বেঁচে যায়। আব্দুল মিয়াও তখন তাঁদের সাথে গাড়িতে ছিল। কিন্তু আব্দুল মিয়ার ভাষ্যমতে গাড়ি খাঁদে পড়ার আগেই উনি গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে রাস্তার পাশে ঝোপে পরে। কিন্তু সাফোয়ানের সবসময় মনে হয়েছে আব্দুল মিয়া কিছু তো জানে। কিন্তু উপযুক্ত তথ্য প্রমানের অভাবে ও কিছুই করেনি।ওর এইসব ভাবনার মাঝখানেই সাফয়ানের মা তার রুমে এলো। এসেই সে তার ছেলেকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলো,
-সাফু কি হয়েছে তোর?
-কই আম্মি ? কিছুই তো হয় নি। আমি একটু ক্লান্ত।
-আমাকে মিথ্যা বলিস না বাবা। আমি তোর মা। কি হয়েছে আমাকে বল। তুই কি আব্দুল ভাইয়ের মৃর্তুও নিয়ে চিন্তিত।
-তোমার থেকে লুকিয়ে আর লাভ কি আম্মি ? আগেই বলেছিলাম আমার বিয়ে করার দরকার নেই। দেখলে তো বিয়ের তোড়জোড় শুরু হতেই মরণ খেলা শুরু হয়ে গেছে। কতটা জঘন্যভাবে আব্দুল মিয়াকে খুন করা হয়েছে।
-উনার সাথে বিয়ের সম্পর্ক কি? হয়তো উনার কোনো শত্রু উনাকে মেরেছে। সেখানে তোর বিয়ে কিভাবে সম্পর্কিত।
-আম্মি উনার বুকে ছুরি দিয়ে কেটে লেখা হয়েছে ১ জানুয়ারি ২০০৩। আর ওই দিনে কি হয়েছিল আমরা সবাই জানি। ওই দিনটা আমাদের পরিবারের জন্য অভিশপ্ত।
১ জানুয়ারি ২০০৩ তারিখটা শুনেই যেন শিরিন বেগমের বুঁকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। কারণ ওই দিনে কি হয়েছিল টা বাহিরের পৃথিবী না জানলেও জমিদার পরিবার আর এই জমিদার বাড়ির দেয়াল গুলো খুব ভালো করেই জানে। অভিশপ্ত ছিল ওই রাতটা তাঁদের পরিবারের জন্য। তারপর ও সে ছেলেকে শান্ত করার জন্য অভয় দিয়ে বলে,
-আরে এরকম কিছুই না। সব তোর মনের ধারণা। বাবা এই সাদা লুঙ্গি আর গামছা টা গায়ে দিয়ে নে। হলুদের আচারকর্ম তো শেষ করতে হবে।
-আম্মি এইসবের দরকার কি? বিয়েটা কি আদৌ হবে। যা হচ্ছে মনে হচ্ছে বিয়েটা শেষ পর্যন্ত মনে হয় হবে না।
-হবে অবশ্যই হবে। কোনো অশুভ কথা বলবি না। আবার যেহেতু কনের গায়ে হলুদ উঠেছে তাই বিয়েটা অবশ্যই হবে। প্ৰত্যেকবার তো অনেক আগেই সব আশা শেষ হয়ে যায়।
শিরিন বেগম এই বলে নিচে নেমে গেল। শিরিন বেগম নিচে নামতেই দেখলো আমেনা বেগমের হাত থেকে রক্ত পড়ছে। তার হাতে হলুদ ও মেখে আছে। শিরিন বেগম উৎকন্ঠীত হয়ে দৌড়ে এলো আমেনা বেগমের কাছে। পাশেই বসে থাকা তাঁদের বাড়ির কাজের সাহায্যকারীকে বললো, তার ঘর থেকে ব্যাণ্ডেজ ও স্যাভলন নিয়ে আসতে। সে আমেনা বেগমের কাছে গিয়ে বললো,
-এসব কিভাবে হলো?
-জানিনা আমি। সাফোয়ান বাবার হলুদের জন্য বেটে রাখা হলুদ বাহিরে রাখা ছিল। বিলকিস আপাই হলুদ বেটেছিলো। কিন্তু আমি যখন এখন হলুদ হাতে নিয়ে বাটির মধ্যে হাত দিলাম। সাথে সাথে আমার হাত কেটে গেলো। হলুদ ঢেলে দেখি তার ভিতরে ছোট ছোট কাঁচের টুকরো। কেউ ইচ্ছা করেই এরকম করেছে। আমেনা বেগমের কথা শুনে শিরিন বেগম তাড়াতাড়ি করে বাকি হলুদ বাটা গুলো একটি চালনি তে ঢেলে উপর থেকে পানি ঢেলে দিলো। হলুদ গুলো পানির সাথে পরে গেলেই দেখা গেলো অসংখ্য কাঁচের টুকরো। শিরিন বেগম খেয়াল করতেই দেখলো এইটা তার মরহুম শাশুড়ি যে গ্লাসে পানি খেত সেই গ্লাসের ভাঙ্গা অংশ। কিন্তু ওই গ্লাস টা তো শোকেসে রাখা ছিল। সে শোকেস খুলে দেখলো গ্লাসটা নেই। কিন্তু এই শোকেস এর চাবি তো শুধু তার কাছেই থাকে তাহলে গ্লাসটা কিভাবে বের হলো এখান থেকে।
শিরিন বেগম এই বিয়ের মহলে কোনো ঝামেলা চাইলো না। তাই সে আবার হলুদ বাটতে বললো। আর গ্লাসের টুকরোগুলো একটা রুমালের মধ্যে পেঁচিয়ে সরিয়ে রাখলো। আর সাহায্যকারী মহিলা আর আমেনা বেগমকে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করলো। সে শুধু চাইছে এই বিয়েটা যেন ভালোয় ভালোয় মিটে যায়।
সাফোয়ান সাদা লুঙ্গি আর গায়ে গামছা দিয়ে নিচে নেমে আসতেই সবার মাঝখানে তাকে হলুদ ছুঁয়ানো হলো। হঠাৎ এক মুঠোবর্তী হলুদ কেউ তার পিঠে লেপে দিলো। সাফোয়ান পিছে ফিরতেই যা দেখলো তা দেখে সে অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেলো।
————————–
অনেকক্ষণ যাবৎ পানির ছিটা দেয়ার পর রিমা চোখ খুললো। তার চেহারা দেখেই সবাই বুঝতে পারলো সে ভয় পেয়ে আছে। সে এইদিক ঐদিক তাকিয়ে এত লোক দেখেই কিছুটা ভড়কে গেলো। হঠাৎ সে খোলা আলমারির দিকে তাকিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত ভাবে চেঁচাতে লাগলো,
-সাপ সাপ। ওই আলমারির ভেতরে সাপ আছে আমি দেখেছি। আমাকে দেখে ফণা তুলেছিল।
– ওই আলমারির ভিতরে সাপ আসবে কোথা থেকে। এই বাড়ির আশে পাশে তো কোনো জঙ্গল নেই। ফাজলামি করছিস। চন্দ্রর বিয়েতে একটা না একটা ঝামেলা তুই করার জন্য উঠে পরে লেগেছিস। যা এখানে থেকে।
শাহনাজের কথায় অপমানিত বোধ করে রিমা সেখান থেকে চলে গেলো। কিন্তু রিমাকে ধমকে পাঠালেও কেন জানি শাহনাজের মনের ভিতরে খচখচ করতে লাগলো। তাই চন্দ্রকে কাপড় বদলাতে পাঠিয়ে সে আর অনিমা মিলে আলমারির কাপড়গুলো উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলো। কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে পেলো না। শাহনাজ রেগে বলতে লাগলো,
-অনিমা বল তো তোর এই মেজো বোন এমন কেন? চন্দ্রর সুখ কি ওর সহ্য হয় না। কই সাপ কোথাও কিছুই নাই। এখন এইগুলো আবার গোছাতে হবে।
————————–
-তোরা এইখানে কি করছিস তোদের তো ঢাকা থাকার কথা?
-ধ্যাৎ ভাই। চৌধুরী বংশের প্রথম বিয়ে আর আমরা থাকবো না তা কি করে হয়। এখন এইসব বাদ দে আগে তোকে ইচ্ছেমতো হলুদ মাখাই।
এই বলেই ছেলে দুইটা ইচ্ছামতো সাফোয়ানকে হলুদ মাখানো শুরু করলো। সবাই তো তাঁদের কান্ড দেখে বোকা মনে হচ্ছে। সাফোয়ান চৌধুরীর মতো এত গম্ভীর মানুষকে এমন হাসি খুশি দেখে। আর ছেলেগুলো কি উচ্ছাসের সাথে তাকে হলুদ দিচ্ছে। আর সাফোয়ান চৌধুরীও তাঁদের কিছু বলসে না।
অবশ্য কিছুক্ষনের মধ্যেই কানাঘুসায় শোনা গেলো যে ছেলে দুইটি সাফোয়ান চৌধুরীর চাচাতো ভাই। আমেনা বেগমের দুই ছেলে। সাহিল চৌধুরী ও শাহেদ চৌধুরী। এই ছেলে দুইটি সাফোয়ানের সবচেয়ে কাছের। তবে তারা বেশিরভাগ সময় ঢাকায় থাকার কারণে কাছের আত্মীয় স্বজন ছাড়া কেউ তাঁদের সেরকম চিনে না।
চন্দ্রকে চৌধুরী বাড়ি থেকে পাঠানো বেনারসি শাড়ীতে সজ্জিত করা হয়েছে। সাথে রয়েছে গা ভর্তি সোনার গহনা। তার রূপ যেন ঠিকরে পড়ছে। সকালের ঘটনার পরও রিমার শিক্ষা হয়নি। সে চন্দ্রকে দেখে শুধু হিংসায় জ্বলছে। সে তার মা রাহেলা বানুর কাছে গিয়ে বললো,
– কই তুমিতো বলেছিলে জমিদার বাড়ির ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হলে নাকি মারা যাওয়ার সম্ভাবনা আছে? কিন্তু ওর তো এখন পর্যন্তই কিছু হলো না। আর কিছুক্ষনের মধ্যে ও জমিদার বাড়ির বৌ হয়ে যাবে। ওর এত সুখ কিভাবে আমি সহ্য করবো।।
-আমি কি জানি। হক্কল মাইয়াই তো মইরা যায় যার লগে ওই জমিদারের বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু এইবার যে কিছু হইবো না এইডা কি আমি জানতাম। জানলে তো আমি তরেই হেগো সামনে আমার বড় মাইয়া বানাইয়া নিতাম। তুই জমিদার বাড়ির বৌ হইয়া যাইতি।
-তাইলে এখন কিছু করা যায় না মা। এক কাজ করো ওরে মাইরা ফালাও। আর আমারে বিয়ে দেও জমিদারের পোলার লগে।
-হয় এইডা করন যায়। তয় কেউ যদি জাইন্না যাই অনেক ঝামেলা অইবো।
– আরে মা কেউ জানবো না। জমিদার পরিবারের উপর তো এমনেই অভিশাপ আছে।ঘরে জমিতে দেয়ার কীটনাশক আছে। নিয়ে আইসা ওর দুধ ভাতে মিলাই দাও।
রাহেলা বানু রিমাকে দিয়ে কীটনাশক আনিয়ে চন্দ্রের জন্য মাখা দুধ ভাতে মিলিয়ে রেখে সে রান্নাঘর থেকে চলে যায়। তারপর অনিমা রান্না ঘরে এসে সেই ভাত চন্দ্রের জন্য নিয়ে যায়।চন্দ্রকে শাহনাজ সেই ভাত খাইয়ে দেয়ার পরেই চন্দ্র বলে তার ভালো লাগছে না। হঠাৎ করে শাহনাজের কথা কথা বলতে বলতেই চন্দ্র অজ্ঞান হয়ে পরে যায়। চন্দ্রের এই অবস্থা দেখে তো রিমা আর রাহেলা বানু পৈশাচিক আনন্দ পায়।
সাফোয়ানের সামনে সাহিল আর সাহেদ অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সাফোয়ান গম্ভীর ভঙ্গিতে বললো,
-তোমরা দুইজন এখানে কিভাবে তোমাদের তো ঢাকায় থাকার কথা। তোমাদের কতদিন বলেছি আমার অনুমতি ছাড়া উজানপুরে আসবে না।
-ভাই তোমার বিয়ে তাই আমরা সারপ্রাইস দিতে এসেছি।
-সারপ্রাইজ দিতে এসে যদি তোমাদের জীবন চলে যায় তখন আমি আম্মিকে ছোট আম্মিকে আমি কি জবাব দেবো।
সাহিল যেই না কিছু বলবে এই সময় দরজায় এসে শিরিন বেগম দাঁড়ালো। তার মুখে ভয় আর উৎকণ্ঠা দেখা যাচ্ছে।
চলবে………..
(যত বেশি রিএক্ট কমেন্টস ও শেয়ার হবে পরবর্তী পড়বো তত দ্রুত পরের পর্ব পোস্ট করা হবে। গল্প সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনা করতে গ্রুপে অ্যাড হউন।)
গ্রুপ লিংক :
https://facebook.com/groups/3532259070436906/