#অন্যরকম_তুমিময়_হৃদয়াঙ্গণ
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২১
হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে নাজীবা। চোখ-মুখে মলিন বিষণ্ণতা। শাড়ির মধ্যে র’ক্ত ছিটিয়ে আছে। তার উপর গরম জ্যাকেট জড়ানো। জনাব ইসমাইল কে জড়িয়ে ধরে বিলাপ করে কান্না করচ্ছেন মিসেস ফেরদৌসী। একমাত্র ছেলের সঙ্গে এই কি হলো? আকবর সকলের বিষণ্ণময় চেহারা দেখে কাউকে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করল না। সে একলা হাতে হাসপাতালের যত ফর্মালিটিস আছে সব সামলে নিচ্ছে। কিন্তু সেও মনেমন বন্ধুর অসুস্থ দশার জন্য কষ্টে ভোগছে। কষ্ট দেখানোর সাধ্য নেই বলে ফর্মালিটিস পূর্ণ করার পর এককোণায় দাঁড়িয়ে পরিবারের মলিন চিন্তিত চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে। থার্টিফার্স্ট নাইট বুঝি বিপদ নিয়ে হাজির হয়েছে। রাতের বোধহয় দুইটার সময় চলছে। অপারেশন থিয়েটারে আফরাজ কে নেওয়া হলো, দু’ঘণ্টা পাড় হয়ে গিয়েছে। অথচ তার অবস্থা সম্বন্ধে এখনো সকলের অজানা রয়ে গেল। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে সকলের দৃষ্টি দরজার দিকে পড়ল। সামনে নার্স কে বের হতে দেখে সকলে আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকায়। কিন্তু নার্স তড়-জড় করে এসেই বলে,
“আপনাদের মধ্যে এ পজেটিভ ব্লাড গ্রুপ কার আছে?”
আকবর সঙ্গে সঙ্গে বলে,’জ্বী সিস আমার ব্লাড গ্রুপ এ পজেটিভ। আমাকে বলুন!’
“দেখুন আপনাদের পেশেন্ট এর কন্ডিশন অনেক ক্রিটিক্যাল। তার দু’ব্যাগ র’ক্ত লাগবে। আসুন আপনি।”
সকলের কৌতুহলী মুখশ্রী পুনরায় মলিন হয়ে গেল। আকবর তাদের দিকে একপলক চেয়ে নার্সের পিছু পিছু গেল। নাজীবা নিঃশব্দে কাঁদছে। যার আওয়াজ কারো কানেও ঠেকছে না। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) জনাব ইসমাইল বউমা-র দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তার বিবেক তাকে বলছে, তার ছেলের এ অবস্থার জন্য একমাত্র এই মেয়েই দায়ী। তাও পুনরায় এই মেয়েই। মিসেস ফেরদৌসী কান্নাময় সুরে বিলাপ করে বলছেন।
“বলছিলাম এই মেয়েটা অপয়া, মুখপুড়ি আমার ছেলে আফরাজ এর সঙ্গে থাকলেই তাকে মে’রে দেবে বলে ছিলাম না আপনাকে? দেখছেন খুশি তো এবার? আমার ছেলেটাকে জীবন-মৃত্যুর মাঝে ঠেলে দিলেন আপনারা। আর আপনি আম্মা আপনি না আপনার নাতিকে বেশি ভালোবাসেন। তাই বুঝি তার গলায় এই অপয়া মেয়ে-রে ঝুলিয়ে মরণের দিন দেখাচ্ছেন।”
বউমা-র কথায় খাদিজা বেগম শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকান। ছেলের অসুস্থতায় মায়ের আর্তনাদ এতবছর পর দেখে হৃদয়ের স্পন্দন অনুভব করছেন তিনি। গম্ভীর মুখ করে নাতবউয়ের দিকে তাকান। নাজীবাও শান্ত নেই সকলের তুচ্ছতাচ্ছিল্যতা তাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিচ্ছে। সে যত নিজেকে শক্ত করতে চাইছে তত সে দুর্বল হয়ে পড়ছে। না পারতে সে দাদি শ্বাশুড়ি-র দিকে তাকায়। অত্যন্ত এ আশায় তার দাদি শ্বাশুড়ি তার প্রতি সদয় হোক। কিন্তু কিছু মুহূর্ত পর তার আশা নিরাশায় পরিণত হলো। খাদিজা বেগম লাঠি ঠকঠক করে নাজীবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যান। নাজীবা মলিন মুখে দাদি শ্বাশুড়ির দিকে চেয়ে ম্লান কণ্ঠে আওড়ায়।
“প্লিজ দাদি আপনিও আমায় তাড়িয়ে দিয়েন না। আপনার নাতি কে ছাড়া আমি বাঁচব না গো দাদি। খুব ভালোবাসি তাকে। প্লিজ দাদি।”
ফুঁপিয়ে উঠে মেয়েটা। খাদিজা বেগম এর চোখ থেকেও পানি পড়তে লাগল। তবুও তিনি এতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করলেন না। কোমল ভাবে নাজীবার বাহু চেপে ধরে সিটের বসা থেকে দাঁড় করিয়ে নেন। নাজীবা শরীর কান্নার কারণে মৃদু মৃদু কাঁপছে। খাদিজা বেগম কিঞ্চিৎ মুহূর্ত নাতবউকে পরখ করলেন। এই মুখশ্রীর মানবী-কে তিনি নিজ ইচ্ছায় একমাত্র নাতির সঙ্গে বিয়ে করিয়ে ছিলেন। আজ এমনও দিন এলো যে, মেয়েটাকে তার নিজ হাতে বের করে দিতে হচ্ছে। নাজীবা-কে অপারেশন থিয়েটারের রুম থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে এনে বলেন,
“দেখো নাতবু তুমি কয়েকদিনের জন্য আমার ফার্মহাউস এ চলে যাও। ফার্মহাউস এর ঠিকানা সম্পর্কে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি কল করে ড্রাইভার কে রেডি করে নেবো। সে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে বাহিরেই আছে। তাকে বলব ভালোমত যাতে তোমাকে পৌঁছে দেয়। ওখানে গেলেও অত্যন্ত নিজেকে দূরে রেখে সকলের মনে জায়গা করতে পারবে। আমি জানি স্ত্রী হিসেবে তোমার মনে কি চলছে। কিন্তু এই সময়টা তোমার জন্য খারাপ। তাই কয়েকদিন ফার্মহাউস এ চলে যাও। সব ঠিক হলে তোমাকে নিয়ে আসব।”
দাদি শ্বাশুড়ি-র কথায় নাজীবার হৃদয় থেকে বড় বোঝা নেমে গেল। তৎক্ষণাৎ দাদি-কে জড়িয়ে ধরে বলে,
“দাদি বিশ্বাস করুন আমি নিজেও বুঝিনি ঐসময় আসলে ঘটলটা কি? আমি আর উনি….।”
খাদিজা বেগম তাড়াহুড়ো করে বলেন,
“না নাতবু এখন কিছু বলো না। তোমাকে রাতে ফোন দেবো তখন বলিও। এখন সঠিক টাইম নয়।”
দাদির কথায় নাজীবা বলতে গিয়েও পারল না। সত্যটা জানা যে খুব জরুরী। কিন্তু পরিবেশের প্রতিক্রিয়ায় সেও মানতে বাধ্য। অতএব, দাদির সালাম নিয়ে বেরিয়ে যেতে গিয়েও থেমে যায়। পিছু মোড়ে আড়চোখে অপারেশন থিয়েটারের দিকে তাকায়। আফরাজ-কে ছেড়ে যেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না তার। পরিস্থিতি আজ পক্ষে হলে অবশ্য সে আফরাজ এর কাছে থাকতো। অবিচ্ছিন্ন মনকে কোনো মতে বুঝ দিয়ে দাদি শ্বাশুড়ির কথা মেনে ফার্মহাউস যাওয়ার জন্য বেরিয়ে গেল। খাদিজা বেগম ঠোঁট কামড়ে চেয়ে রইলেন। চোখ থেকে এক-দুই ফুটো পানি গাল ভেদ করে ঝরে গেল। চোখ মুছে তিনি নাজীবার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলেন,
“আমাকে মাফ করে দিও নাতবু। তোমাকে ভীষণ পছন্দ ছিল আমার। কিন্তু নাতি আমার বংশের একমাত্র উত্তরাধিকারী। তার শূন্যতায় তো জায়গাটা খালি রয়ে যাবে। তার যেনো ক্ষতি নাহয় সে ব্যবস্থা করতেই তোমাকে ফার্মহাউস এ পাঠানো। ওখান থেকে তুমি তোমার আসল গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। এরপর আর কারো কোনো অভিযোগ থাকবে না।”
____
“শাবাশ মেরে সের। তোর শুট তো একদম বরাবর হয়েছে। কোনো এপড় ওপড় অব্দি হয়নি। এর জন্য তোদের কে পুরষ্কার দেওয়া উচিৎ।”
জনাব দাহাব এহসান গা’র্ন শুটার দু’জন কে ইঙ্গিত করে কথাগুলো বললেন। তিনি হেঁটে দেওয়ালের কাছে আসলেন। দেওয়ালে টাঙানো ছু’ড়ি থেকে দুটা ছু’ড়ি হাতে লুকিয়ে নেন। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)যা কারো চোখে না পড়লেও জনাব লিয়াকত এর চোখে ঠিকই ধরা পড়েছে। মনেমন তিনি আতংক-বোধ করছেন। তার শ্বশুর কি কারণে ছু’ড়ি হাতে নিল তা একটু হলেও আঁচ করতে পেরেছেন। ঢোক গিলে রুমের এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ান। দাহাব এহসান আয়নার মধ্যে দুজনের প্রতিফলিত রুপের দিকে চেয়ে হিংস্র হয়ে উঠলেন। দ্রুত এসে দু’জনের শরীরে দাঁত বসিয়ে চেপে ধরে বার কয়েক ছু’ড়ি দিয়ে আঘাত করলেন। একেবারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে তারা। তাদের শরীরের র’ক্ত চুষে খেয়ে নেন তিনি। জনাব লিয়াকত এরূপ বিবশ দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারলেন না। তৎক্ষণাৎ রুম থেকে বেরিয়ে যান। পাবলিক ওয়াশরুমে ঢুকে বমি করে ফ্রেশ হয়ে নেন। মিসেস হিয়া বাবার রুমের ধারে কাছেও গেলেন না। কেননা লোক দুটার আওয়াজ তিনি ভালোই শুনতে পেয়েছেন। তিনি জানেন, তার বাবা সত্য প্রকাশ্যে না আসার জন্য তাদের খেয়ে ফেলেছেন। তাই তিনি আর নিজেকে দরদী সাজালেন না। স্বামী-কে দেখে চিন্তিত মুখোভঙ্গি নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে যান। লিয়াকত স্ত্রীর দিকে ভুরু নাচিয়ে বলেন,
“কি এখন কি লেকচার দিতে আসছো?”
“শুনেন না আজকে সকালে আপনি কল ধর ছিলেন না বলে আমি মনে মনে চিন্তায় পড়ে গিয়ে ছিলাম। আর এখন তাবাসসুমকে কলে পাচ্ছি না। আপনার কল না হয় রিং হয়েছিল কিন্তু তাবাসসুম এর কলে তো রিং-ই হচ্ছে না। আমাদের মেয়েটা-র খোঁজ করে দেখুন না। বাবাকেও বলে লাভ নেই। উনি কখনো আমাদের চিন্তা করেননি। সারাক্ষণ সম্পদ আর কামনা লালসার মাঝে ডুবে মরা পুরুষ তিনি।”
“কি বলছো তাবাসসুম ফোন ধরছে না? কথাটা আগে কেনো জানাওনি? ওহ খোদা না জানি মেয়েটা কোথায় আছে!”
জনাব লিয়াকত তৎক্ষণাৎ শার্ট পরে বাসার থেকে বেরিয়ে যান। মিসেস হিয়া পায়চারী করতে থাকেন। তিনিও ক্লান্ত নিজের বাবার এসব কর্মে। কিন্তু তিনিও বা কি করতে পারবেন? সবটা লোভে পড়ে করলেন এখন প্রায়শ্চিত করতে চাইলেও রেহাই পাচ্ছেন না। হঠাৎ ফোনে কল চলে আসায় তিনি কলটি রিসিভ করেন। অপরপাশের লোকটি বলেন,
“ম্যাম আপনি যে নার্স কে বেঁধে রাখতে বলেছিলেন আম… আমরা বেঁধে রেখে ছিলাম। কিন্তু গত পরশু সেই নার্সকে দাহাব স্যার নিজের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন।”
কথাটি শুনে দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেন মিসেস হিয়া। ‘ঠিক আছে এমাউন্ট পাঠিয়ে দিচ্ছি’ বলেই তিনি কল রেখে দিলেন। অপরপাশের লোকটি আর এসবের খবর রাখল না। সে তার পাওনা পেল মানে তার কাজ শেষ। মিসেস হিয়া দ্রুত পায়ে হেঁটে বাবার রুমের সামনে আসলেন। ভদ্রতার খাতিরে দরজায় নক করলেন। দাহাব এহসান শব্দ শুনেও অশুনা করলেন। মিসেস হিয়া উত্তর না পেয়ে স্বেচ্ছায় ঢুকে পড়লেন। সামনে দেখে অবাক। তার বাবা ফোনের মধ্যে অস্থির হয়ে কি যেনো টাইপিং করছেন। তিনি স্বচ্ছল পায়ে এগিয়ে সাড়া দেন। দাহাব এহসান টাইপিং শেষে রুম কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। তার হাসিতে যেন অমূল্য রত্ন হাসিল করার মত খুশি উপচে পড়ছে। মিসেস হিয়া বাবার পাগলামীপনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলেন,
“আপনার কি হয়েছে বাবা? এভাবে উল্লাস কেন করছেন? এমন ভাব ধরলেন যেনো নাজীবা-কে হাত করতে পেরেছেন।”
শেষ কথায় খুব তাচ্ছিল্যেতা প্রকাশ করলেন তিনি। দাহাব এহসান বুঝতে পারলেন তবুও মুখশ্রী জুড়ে যে হাসি তা বিলীন হতে দিলেন না। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন,
“আজ যাই বল না কেনো মা! আমি ভীষণ খুশি। মুরগি নিজে আমার খামারে আসবে এর চেয়ে খুশি আর কি হতে পারে আমার জন্য?”
মিসেস হিয়া তার বাবার কথা বুঝলেন না। পুনরায় প্রশ্ন করতে নিলে দাহাব এহসান চোখ রাঙানি দিলেন। রুমের থেকে বেরিয়ে যেতে হাতে ইশারা করলেন। মিসেস হিয়া অপমানিত বোধ করলেন। ক্ষোভ চেপে রুম থেকে বেরিয়ে যান।
চলবে……
(আজকে হোস্টেলে চলে এলাম। বাসার জন্য মন খারাপ লাগছে। মাত্র লিখলাম এটুকু। জানি ভুলত্রুটি থাকবে বানানে এবং ছোটও হয়েছে। তাই ক্ষমা করে দিবেন সবাই। আর দোয়া করবেন আমার জন্য। আল্লাহ হাফেজ)