#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২২
৬৮.
স্বাধীন আজ ঢাকায় যাচ্ছে।পুতুল এই চারমাসে দিন রাত পরিশ্রম করে। নকশিকাঁথায় সুই সুতার সাহায্যে একেক রকমের নকশা করেছে।যেগুলো দেখলেই দুই চোখ শীতল হয়ে যায়।মেয়েটা রাতের অর্ধেকটা সময়-ই খেটেছে।জানি না।ঢাকায় এগুলো নিয়ে গেলে আদোও বিক্রি হবে কি না?তবুও এক বুক আশা নিয়ে পরিবারের সকলের থেকে বিদায় নিয়েছে।বিসমিল্লাহ ব’লে বাড়ি ছেড়ে ঢাকাগামী জন্য ট্রেনে উঠে পড়ে।এই ট্রেন ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশনে থামবে।তারপর পুতুলের তৈরি কাজগুলো ঢাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার পালা।ফুটপাতে হকারদের মতো স্বাধীনও হকারগিরি করতে নেমেছে।
শহরের পাকাঁ রাস্তার কিনারে জনসমাগমপূর্ণ স্থানে ফুটপাতে বসে এই বেচা কেনা।স্বাধীনের মতো অনেক হকারদের দেখা মিলছে।যারা ভ্যানগাড়িতে করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করছে।অনেকে মাথায় থাকা ছোট টুকরিতে ফেরি কিংবা ছোট খাটো দোকানে বিক্রি করে।গ্রীষ্মের রৌদ্র এবং বর্ষার বৃষ্টি হাত থেকে বাঁচতে বড় ছাতা নিচে আশ্রয় কিংবা বড় পলিথিনের আবরণ ব্যবহার করে।অল্প বয়সী কিশোর ছেলেদের হকারগিরি করছে।কেউ ফুচকা,চটপটি,গুমলি পুড়ি বিক্রি করছে।কেউবা আবার চা,পান,সুপারি,সিগারেট বিক্রি করছে।এদের আয় দৈনিক ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা।দৈনিক বেচা কেনা ভালো হলেই হয়।আর যদি ১৫০থেকে ৩০০ টাকা না হয়।তাহলে বাঁচার লড়াইটা কষ্টে হয়ে ওঠে।তাদের থাকতে হয় এই ঢাকা শহরের অলিগলির রাস্তায়।আজ এই ঢাকার বুকে স্বাধীন ফুটপাতের রাস্তায় বিছানা পেতেছে।বেচাকেনার প্রথম দিনটা ভালো হয়নি।তবুও আশা রাখছে নতুন সকালে হয়তো ভালো কিছু হবে।চোখের পাতা জোড়া বুঁজে নিলো।ওইদিকে তার পরিবার কি করছে জানা নেই?
পুতুল রাত জেগে পড়ছে।সামনে তার পরীক্ষা।সময় খুব একটা নেই।চারমাস নকশিকাঁথার কাজের জন্য সময় দিয়েছে।পড়াশোনা এতটা মনযোগী ছিলো না।যার জন্য অনেক পড়া গুলিয়ে বসে আছে।তবুও আবার রিভিশন দিচ্ছে।পরীক্ষা কোনো ভুল করতে সে চায় না।তার রেজাল্ট খারাপ হলে মামার উচু গলায় বলা কথাগুলো মিথ্যে হয়ে যাবে।তার জন্য মামা কম কষ্ট করেনি।এখনও করে যাচ্ছেন।আর সেই মামা মান রাখতে হলেও তাকে প্রত্যেকবারের মতোও এবারও ভালো রেজাল্ট করতে হবে।
রেনু ঘরে আলো জ্বালিয়ে ছোট ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে বসে আছে।
কি করছে মানুষটা?কি খেয়েছে?কোথায় থাকছে কে জানে?একটু যোগাযোগ করতে পারলে শান্তি লাগতো।স্বামীর চিন্তায় রাতে তার গলা দিয়ে ভাত নামে না।বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও কখনো একটা রাত দূরে থাকেনি।দিনে যতই কাজ থাকুক না কেনো?সেই কাজ শেষ করে ঠিকই সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে আসতো।মানুষটাকে ছাড়া কোনোদিন একা খাবার খায়নি।আজ সে নেই।একা এই ঘরটায় দম বন্ধ হয়ে আসছে।আল্লাহ তুমি কি আমার ডাক শুনতে পাচ্ছো।আমার স্বামী যেখানে থাকুক না কেন?তাকে তুমি ভালো রেখো।তার ভালোতেই আমার সুখ।সে গ্রামে কিংবা শহরে যেখানে রয়েছে।তাকে সুস্থ রেখো।তিনি বিহীন আমরা এতিম।তিনি ছাড়া আমি,আমরা কেউ ভালো থাকব না।তিনি আমাদের বেঁচে থাকার শেষ সম্বল।সেই সম্বলটুকু তোমার ভরসায় ওতো দূর দেশে পাঠালাম।আল্লাহ আমার স্বামীকে তুমি দেখে রেখো।তুমি ছাড়া আমার কারো কাছ থেকে কিছু যাওয়ার নেই।তুমি আমাদের রব।বিপদ আপদে তোমার কাছেই ছুটে যাওয়া।তোমার নামে সেজদা দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া।ওহ আল্লাহ তুমি মুখ ফিরিয়ে নিলে আমরা তোমার বান্দা যাব কোথায়?আল্লাহ তুমি তোমার প্রিয় বন্ধু হযরত মোহাম্মদ (সা:) উছিলায় আমাদের হেদায়েত পথে চালিত কর।আমরা শেষ নবীর উম্মত।আমাদের মতো এতো ভাগ্য ভালো আর কখনো কারো হয়নি।দরজার ওইপাশে দাঁড়িয়ে পুতুল মামীর সব কথা শুনতে পায়।এত রাতে মামীর ঘর থেকে কান্নার শব্দ পেয়ে ছুটে আসে।হালকা করে দখিনা দুয়ার ধাক্কা দিতেই মামীকে জায়নামাজে মোনাজাত অবস্থায় দেখতে পায়।পুতুল নিজের কান্না সংযত করে।দূয়ার চাপিয়ে চলে যায়।
৬৯.
প্রতিদিনের মতো সূর্য পূর্বে দিকে উঠেছে।ভোরে মোরগ ফজরের আজান শেষ হতেই ডাকতে শুরু করেছে।পুতুল ঘর ছাড়ু দিয়ে উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে।মামী চুপচাপ হাড়িতে রান্না বসিয়েছে।প্রতিদিনের মতো আজ রান্না ঘর থেকে মামী কোনো ডাক দেয় নিই।ডেকে বলেননি,পুতুল এটা দিয়ে যা ওটা দিয়ে যা।কাজের সময় হাতের কাছে কিছু পাচ্ছি না।কোথায় কি রাখিস?এখন এক একটা খুঁজে পাওয়া যায় না।
মিলন,সাজু ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।বাড়িতে আজ কেমন নিঃশতব্দো।প্রতিদিনে মতো ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যায়নি।বাবা নেই বলে।পুতুল আপু বাড়িতে নামাজ পড়িয়েছে।মা কেমন চুপচাপ?ছোট ভাইটা প্রতিদিনের মতো কান্না করে বাড়ি মাথায় তোলেনি।সেও কেমন ভদ্র হয়ে গেছে।হাত,পা নাড়িয়ে খেলছে বাড়ির বারান্দায় ছোট খাটে।হয়তো সে ওহ বুঝে গেছে বাবা বাড়িতে নেই।মায়ের মন খারাপ।একটু প্যা পু করলেই পিঠে মার পরতে পারে।তাই শান্ত সৃষ্ট হয়ে আছে।কিন্তু বড় দুই ভাই।মিলন,সাজু কি শান্ত থাকবে? মোটেই না।কলপাড়ে হাত মুখ ধুতেধুতে বলল কি কি করবে সারাদিন?স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে চলবে তাদের বিশেষ শলাপরামর্শ আয়োজন।
রেনু খাবার বেড়ে দিতেই মিলন,সাজু চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়ে।রেনু আড়চোখে পুতুল প্লেটে তাকায়।
কি হলো?তুমি খাচ্ছ না কেন?খাবার পচ্ছন্দ হয়নি।
পুতুল মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।যার মানে তার খাবার পচ্ছন্দ হয়নি।
ঠিক আছে।এই খাবার রেখে দেও খেতে হবে না।আমি অন্য কিছু করে দিচ্ছি।রেণু আর কিছু বলতে নিলেই পুতুল সেই সুযোগে হাতের লোকমা ভাতটুকু মামীর মুখে পুরে দেয়।পুতুল জানে,তার মামী কাল থেকে না খাও।এভাবে না খেয়ে থাকলে নিজে ওহ অসুস্থ হবে।ছোট ভাইটা খেতে না পেয়ে কষ্ট পাবে।রেনু রেগে কিছু বলতে পারে না।মুখের খাবার চিবিয়ে খেয়ে পুতুলকে আবার কিছু বলতে নিলেই একই কাজ আবার করে বসে।এভাবেই বেশ কয়েকবার বড় লোকমা তুলে প্লেটের সব ভাত শেষ করে ফেলে।রেনু কিছু বলতে না পেরে দুই চোখের পানি ছেড়ে দেয়।পুতুল তার অন্য হাতে সাহায্যে মামীর চোখের পানিটুকু মুছে দিলো।যার মানে তুমি কেঁদো না।তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয়।রেনু আর পুতুলের ওপর রাগ করে থাকতে পারে না।দুই হাতে পুতুল কে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে।পুতুল মায়ের মতো মামীর কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়ে কেমন চুপটি হয়ে বসে আছে।মামীর গায়ে বুঝি মায়ের গন্ধ লেগে আছে।মামী তাকে জড়িয়ে ধরেছে।মনে হচ্ছে।পুতুল তার মাকে জড়িয়ে গালে গাল লাগিয়ে বসে আছে।
এতটা মায়া কাজ করে কেন?রেনু চেয়ে ও কেন রাগ করতে পারলোনা।এতটা মায়া নিয়ে কেন জন্মেছে পুতুল।
এই মায়া তার ভাই, মামা,মামী দেখতে পায়।কিন্তু বাকিরা ছাড়া।তাদের মধ্যে দুইজন তার রক্ত।তাদের চোখে লোভ দেখা যায়।তারা পুতুলকে আপন ভাবতে পারেনি কেন?কেন আদর দিয়ে একটিবার তাকে বুকে টেনে নেয়নি।বাবা নামক মানুষটাকে আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে ইচ্ছে করছে।তোমার মা,ছেলে দেখে যাও।আমি কতটা সুখে আছি।
৭০.
আমি যদি আজ ছেলে হতাম।আর কথা বলতে পারতাম।তাহলে নিশ্চয় মাথায় করে রাখতে।আমাকে অবহেলা করতে পারতে না।কারণ আমি তোমাদের বংশের বাতি হতাম।শেষ বয়সের বাবার দায়িত্ব নিতাম।কিন্তু আপসোস আল্লাহ তোমাকে কন্যা দান করায় বেজার হয়েছো।ভেবেছো।উচ্ছিষ্ট সে।পরের বাড়ি আমানত হবে।তোমাদের সে দেখবে না।তাই ভেবেছো।আর দিন শেষে কষ্ট দিয়েছিলে আমাকে এবং আমার মা জননীকে।কিন্তু আমার প্রিয় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন।
প্রথম কন্যা সন্তান হলো সৃষ্টির সেরা উপহার। যার একটি কন্যা সন্তান হবে।সে একটি জান্নাতের মালিক।যার দুটি সন্তান হবে।সে দুই দুইটি জান্নাতের মালিক।আর তিনটি কন্যা সন্তান হবে।সে তিনটি জান্নাতের মালিক।এবং যে তাদেরকে দ্বীনি শিক্ষা দিবে এবং যত্নের সাথে লালন পালন করবে ও তাদের উপর অনুগ্রহ করবে।সেই ব্যক্তির উপর অবশ্যই জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে সুবহানাল্লাহ।আল্লাহ যখন বেশি খুশি হন তখন কন্যা সন্তান দান করেন। অনেকেই কন্যা সন্তান চায় না।কিন্তু একজন মেয়ে তার বাবা মাকে যে পরিমাণ ভালোবাসতে পারে।তা একটি ছেলে শত চেষ্টা করলেও পারেনা। কন্যারা ফুলের মতো নিষ্পাপ।তারা বিশ্বকে সৌন্দর্য দিয়ে ভরিয়ে দেয়।কন্যা সন্তানকে অবহেলা নয়।ভালোবাসতে শিখুন।
স্কুল ছুটির পরে বাসায় এসেছে। দুই জনের একজন বাসায় থাকেনি।স্কুলের ব্যাগ বাসায় রেখেই হাওয়া।পাজামা হাঁটু পর্যন্ত মুড়িয়ে সাজু,মিলন আড়ালি ক্ষেতে নেমে গেছে।ছোট ছোট পুটিমাছ হাত তুলতেই ফসকে বের হয়ে যাওয়া মিলনের রাগ হলো।আবার অন্য মাছ ধরতে নামে।সাজু পর পর কয়েকটা পুটিমাছ তুলেছে।সেগুলো মাটির ছোট কলসে রেখে আবার মাছ ধরতে ব্যস্ত হলো।মিলন মাছ না পেয়ে রেগে আগুন।মিলন স্বাধীনের মাছ ধরার ট্যারা নিয়ে এসেছে।টাকি,পুটি,ছোট কই,চিংড়ি পেয়েছে।টাকি,কই ট্যারা দিয়ে মেরেছে।সব শেষে পুকুরের পাশে আসতেই বাইঙ্ মাছ পেয়েছে মিলন।
ওই বাইঙ্ মাছ পাইছি আমি।আজকে যাইয়া,গরম ভাত দিয়া ভাজা মাছ কচমচ করে খামু।সাজু পানি দে।দেখ কেমন করছে সে?
মাছটা সাপের মতো মজরাতে শুরু করছে।কাদার জন্য ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না।সাজু মিলনের হাতে পানি ছুড়ে মারল।মিলন হাতের ওটা দেখে চিতকার মারল।
ওই মিলন।ওই এটা ছাড়।এটা মাছ না।এটা কানা সাপের বাচ্চা।সাজুর কথায় মিলন হাতের দিকে তাকিয়ে একটা চিতকার দিলো।দিক দিশা না পেয়ে হাতে রাখা ওটা দূরে ছুঁড়ে মেরে পাগলের মতো দৌড় দিতে শুরু করলো।
ওই মিলন দাঁড়া।আমারে থুইয়া যাইস না।আমি আইতাছি।কে শুনে কার কথা মিলন দৌড়ের ওপরে আছে।দুইবার পিছলে ক্ষেতে পড়েছে।আবার উঠে দৌড়ের ওপর আছে।
সাজু হাতে ট্যারা আর মাছের কলসি নিয়ে দৌড়ে পিছনে ছুটে।
চলবে…..