চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা #ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া #পর্ব-২৭

0
525

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২৭
হাসপাতালে করিডোরে বসে কাঁদছে পুতুল।ভিতরে ভাইয়ের টিটমেন্ট চলছে।সাজ্জাদ মামা পুতুলকে যত বোঝাচ্ছে।যে মিলনের কিছু হবেনা।ততই ফুফিয়ে কেঁদে ওঠে।অতিরিক্ত কান্না ফলে চেহারা লাল হয়ে আছে।দেখতে ভীষণ কিউট লাগছে।তার গায়ে শাড়ি মাথায় হিজাব পরা কন্যা।ইতিমধ্যেই স্বাধীন এসে পড়েছে।পুতুল মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

কিছু হবে না।আমি আছি।ডাক্তার কেবিন থেকে বের হয়ে আসলেই স্বাধীন,সাজ্জাদ কথা বলতে লাগল।

মিলন গাল ফুলিয়ে বসে আছে ঘরে কোনে।আজ একসপ্তাহ হবে তাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসছে।মানকি সাহেব তার আশেপাশে আসলেই খ্যাকখ্যাক করে উঠে।বেচারা মানকি সাহেব মিলনের রেগে থাকার কারণ বুঝতে পেরেছে কি না জানা নেই?কিন্তু মিলন চিতকার চেচামেচি করে থামতে দেখে সে-ও খেউ খেউ শুরু করতো।তাদের মাঝে মাখোমাখো একটা ভাব ছিল সেটা আগের থেকে কমেছে।পুতুল নিজের পড়াশোনা আর হাতের কাজ নিয়ে ব্যাস্ত থাকলেও পরিবারকে সময় দিতে ভুলে না।স্বাধীনের শ্বশুর বাড়ি লোকেরা সবাই চলে গেছে।কিন্তু শ্বশুর মশাই আসেনি।তিনি ব্যবসার কাজে গাজীপুর ছিলেন।তিনি আসতে পারেনি ব’লে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।তবে সময় পেলেই সে কোনো একদিন আসবেন।

৮৫.

বিলের সাধারণ পানিতে হালকা বাতাসের ঝাপটা।এই বাতাসে কেঁপে ওঠে জল।সৃষ্টি হয় জল তরঙ্গ।স্বাধীন জাল দিয়ে বিল থেকে মাছ তুলছে।দুপুরে বউ,বাচ্চাদেরকে একসাথে নিয়ে খাওয়াদাওয়া করবে।স্বাধীন বাড়িতে আসতেই মিলন,সাজু,পুতুল এক সঙ্গে হাজির হয়।স্বাধীন,রেনুকে ডেকে মাছগুলো হাড়িতে তুলে দেয়।ছেলেমেয়ে গায়ে এখনো স্কুলের জামা পরিধান।তারা সবে বাসায় ফিরেছে।প্রতিদিনের মতোও মিলন,সাজু দুষ্টুমিতে মেতে আছে।কিন্তু পুতুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে।কারণ কি?স্বাধীন পুকুরে গেলো গোসল সাড়তে।আর ছেলেমেয়েকে বলল,

-; গোসল সেরে নিতে!যোহরের আজান এই দিয়ে দিলো ব’লে।স্বাধীন,পুতুলের মুখটা চুপসে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে পারলোনা না।পরে এই বিষয়ে কথা বলবে।মামা চলে যেতেই পুতুল নিজের রুমে গিয়ে জামা পাল্টে বের হলো।ভাইদের গোসলের কথা ব’লে মামীর কাছে গেলো।তার হাতে হাতে মাছগুলো কুটে দিতেই তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।

পুতুল মাছ কুটা শেষ।এবার তুই গোসল করে নে।আমি মাছটা ধুয়ে এখনই হাঁড়িতে চড়িয়ে দিচ্ছি।পুতুল মাথা নাড়িয়ে চলে যায়।মেয়ের ভাবভঙ্গি দেখার সময় রেনু পায়নি।সে তাড়াতাড়ি করতে ব্যাস্ত।ভাত রান্না আরো আগেই হয়েছে।কিন্তু তরকারি রান্না করার মতো ঘরে কিছু ছিলো না।তাই স্বামী মাছ নিয়ে আসতেই এত তাড়াহুড়ো।যোহরের আজান দিলেই এরা নামাজ পড়ে এসেই বলবে খিতে পেয়েছে।ভাত খেতে দেওয়।

আচ্ছা মামা গরিবের স্বপ্ন দেখতে মানা কেনো?গরিবের কি স্বপ্ন থাকতে নেই?গরিব ব’লে কি আমি স্বপ্ন দেখতে পারি না।পুতুলের এমন প্রশ্নের কি জবার দিবে স্বাধীন বুঝতে পারছে না?হাতের মাঝে ছোট্ট সাদা কাগজ।তার মাঝে কালো কলমের দুই,তিন লাইনের শব্দগুলো লিখা।রাতে মেয়ের রুমে আসতেই মেয়ের বইয়ের মাঝ পাতায় একটু লুকিয়ে রাখা সাদা কাগজের অংশ।বাকিটা বাহিরে বের হয়ে আছে।স্বাধীন পুরো কাগজটা মেলে ধরতেই লেখাগুলো দৃশ্যমান হয়।পরের কাগজের লেখাগুলো পড়েই স্বাধীন কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে যায়।

কাগজে লিখা কথাগুলো…!
আজ আমাদের স্কুলের শ্রেনী শিক্ষক প্রশ্ন করেন।বড় হয়ে কে কি হতে চাও?তা তোমরা মুখে নয়,কাগজে লিখে দেখাও।সবাই সবার কথা লিখে ছিল।আমিও লিখেছি।কিন্তু সবার বেলায়ই স্যার খুশি হলেন।কিন্তু আমার বেলায় তার উল্টো হলো।স্যার আমার কাগজটা মেলে ধরে বলল,

ডাক্তার।তুমি ডাক্তার হতে চাও?
পুতুল মাথা নাড়িয়ে যতটা খুশি মনে তাকিয়ে ছিল।ততটাই ভেঙে পড়ে পরবর্তী কথাগুলো শুনে।

পুতুল,তুমি কথা বলতে পারোনা।তোমার এই স্বপ্ন দেখা বারণ।আজ যদি দশটা বাচ্চাদের মতো কথা বলতে পারতে তাহলে তোমার ইচ্ছেটায় গুরুত্ব থাকত।স্যারের কথায় সবাই হেঁসে ছিল।স্যার ধমক দিতেই সবাই চুপচাপ হয়ে যায়।আর স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

মন খারাপ করো না।তুমি একে তোও কথা বলতে পারো না।তার ওপর গরিব বাবার সন্তান।দুনিয়ার সম্পর্কে তোমার ধারণা কম।রোহিতপুর গ্রাম থেকে বেড়ে ওঠা কন্যার ডাক্তার হওয়াটা মুখের কথা নয়।তবুও দোয়া করি।ডাক্তার না হলেও অন্য কিছু করতে পারো।জীবন কারো জন্যই থেমে থাকে না।আমরা জীবিকার তাগিদে একটা না একটা পদ ঠিকই বেছেই নেই।
প্রথম পিরিয়ডের ঘন্টা বেজে জানান দিলো সময়ই শেষ।স্যার চলে যেতেই পুতুল নিচু মাথা ওপরে তুলে।তার দুই চোখে অথৈই নোনা জলে টইটম্বুর।একটু ছুয়ে দিতেই সে আপনিই ইচ্ছায় টপ করে পড়ে যাবে।অথচ কেউ জানতেই চাইলোনা।সে কেনো ডাক্তার হওয়াটা বেছে নিলো?

৮৬.
মা।আমার মা।চোখের সামনে মায়ের লাশটা পরে।শুনতে পাই,অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে মায়ের মৃত্যু হয়েছে।ঠিক সময় চিকিৎসাটা সে পায়নি।ডাক্তার অবধি পৌছাতে একটু দেড়ি হলো।আমার মা পুরোপুরি চিকিৎসা না পেয়ে কষ্ট পেতে পেতে দমটা ছেড়ে দিলো।আমার মা মারা গেলো।ডাক্তার পারেনি আমার মা’কে বাঁচাতে।আমি মা’কে হারিয়েছি।আমার মা যদি ঠিকঠাক চিকিৎসা পেতো।তাহলে আজ আমার পাশে আমার মা-ও থাকতো।মা হারালাম।ভাই পেলাম।কিন্তু মনের ভিতরের ঘা’টা শুকায়নি।এরমধ্যেই ছোট রিফাত মামীর গর্ভে এলো।ঘরের মধ্যেই মামীর ওই আতনার্দ এখনো কানে বাজে।মামীর সেই চিতকার আমাকে শান্তি দেয়না।কিন্তু আমি সেই সময় মামীর পাশে থাকতে পারেনি।মামীর কষ্ট দেখে মায়ের কষ্টগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।আজও আমি শান্তি পাইনা।
স্বাধীন ওই পেজের নিচের লিখা টুকু পড়ে থমকে যায়।হাত থেকে থেকে কাজটা পড়ে যেতে নিলে ধরে ফেলে।মনযোগ দেয় শেষের লাইনগুলোতে।

মামা আমি ডাক্তার হতে চাই?আমার স্বপ্নটা তুমি পূরণ করে দেও না।তুমি তো সবাইকে ভালো রাখো।সবাইকে হাসিখুশিতে রাখতে চাও।তোমার হাতে ম্যাজিক আছে।তোমার হাতের ছোঁয়ায় সবকিছুর সমাধান হয়ে যায়। সেই ম্যাজিকে দ্বারায় আমার ইচ্ছেটা পূরণ করে দেও না।

স্বাধীন মেয়ের লিখার এই কথাগুলোর কি উওর দিবে জানা নেই?চোখ দুটো বুঝে নিতেই ভেসে ওঠে।

মামা আমি ডাক্তার হব।রোহিতপুর গ্রাম থেকে বেড়ে ওঠা কন্যার ডাক্তার হওয়ার গল্পটা সবাইকে জানাতে এবং দেখাতে চাই।গ্রাম থেকেও পড়াশোনা চালিয়ে নিজের ইচ্ছে পূরণ করা যায়।

স্বাধীন এখন কি করবে বুঝতে পারছে না?মেয়ের স্বপ্ন পূরণ।সেটা কি স্বাধীন পূরণ করতে পারবে?নিজের বাবা মারা যাওয়ার পর তার পড়াশোনা হলো না।তবুও কতটা আশা ছিল।সেই সব মিথ্যে হলো।তার মতোই কি তার মেয়ের সাথে একই ঘটনা হবে?তার পুরনো ক্ষততে মলম লাগিয়ে শুকিয়ে ফেলেছে।কিন্তু মেয়ের এই ক্ষতটা কি দিয়ে সাড়াবেন?

৮৭.
পাচঁ বছর পর….

সময় কখনো কারো অপেক্ষায় থাকে না।সে নিজ গতিতে চলে।সময় যখন নিজ গতিতে এগিয়ে তাহলে অতীত নিয়ে পরে থাকার মানে কি?সেটা তোও বোকার কাজ।দেখতে দেখতে সময় এগিয়ে গেছে।সেই ছোট্ট পুতুল আর ছোট নেই।বড় হয়ে গেছে।সামনে সতেরোতে পা দিবে।নতুন বছরের একমাস পর এসএসসি পরীক্ষা শুরু।মামার কথায় পুতুল সাইন্স গ্রুপ নিয়ে পড়াশোনা করছে।স্বপ্ন তার ডাক্তার হওয়া।কিন্তু মামা পারবে তোও?তার স্বপ্ন অবধি টেনে নিতে।পুতুলের পড়াশোনা জন্য এখন নকশিকাঁথায় কাজ তুলতে পারে না।তবে মামী তার কাজে সাহায্য করে।সংসারের কাজ শেষ করেই সময় নিয়ে নকশিকাঁথা সুই,সুতোর বুনন তুলে।স্বাধীন মামা সেইসব ঢাকায় বিক্রি করতে যায়।আবার ফিরে আসে হাসি মুখে।কখনো কখনো হতাশা হয়ে।যেমনটা পাচঁ বছর আগে হয়েছিল।অল্প টাকার পুঁজিতে লাভ না হলেও চালান উঠেছিল।তবুও কাজ থেমে নেই।কাজ চলছে পুরো থমে।একদিন এই কাজগুলো ঢাকা,শহর ছেড়ে বিদেশে মাটিতে নাম করবে।
পুতুল পড়াশোনা পাশাপাশি ভাইদের খেয়াল রাখে।আগে ছিল দু’জন।এখন ভাইদের দলে তিনজন হয়েছে।এদের নিয়েই তার সময়গুলো দ্রুত চলে যাচ্ছে।তাছাড়া মামা,মামী রয়েছে।তারা কঠোর পরিশ্রমই।তাদের কাজ নিয়ে ভুল ধরার সাহস নেই।

হৃদয় ছোঁয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয়েছিল এ পথচলা।একে অপরের কাছে আসার উষ্ণতায়,ভালোবাসা আর বিশ্বাসে অটুট বন্ধনে ছায়া ঘেরা পুতুল নামক রমনীর মধ্যেই জীবন সর্ব সুখ।যার মুখে কথা নেই।তবুও চোখের ভাষায় কত কত কথার ফুল ঝুড়ি সাজায়।তার বয়সী কত মেয়ের জীবনে প্রেম এসেছে।আবার চলেও গেছে।আবার বিয়ের ফুল ফুটেছে।তার সুন্দর চেহারা জন্যও কত সম্বদ্ধ এসেছে।কিন্তু কথা বলতে না পারায় তারা নিজেরাই চলে গেছে।এতে পুতুলের আপসোস নেই।সে এতে শান্তি পায়।তার পড়াশোনা মনোযোগ। এছাড়া বাহিরের কোনোকিছু তাকে টানে না।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here