#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩
রেণু পুতুলের চুলগুলো বেনি করে দিচ্ছে।এতটুকু মেয়ের মাথায় কি ঘন চুল?আর কি সুন্দর সফট।মায়ের মতো দেখতে হয়েছে মেয়েটা।রুপের কোনো কিছুর কমতি নেই।চেহারায় কেমন আদরিনী ভাব।মেয়েটিকে দেখলেই তার গাল দু’টোতে শুধু চুমু বসাতে ইচ্ছে করে।পুতুল বড় হলে একদম কল্পনার দেশের সেই রাজকুমারি মতো লাগবে।এমন রাজকুমারী জন্য বুঝি,কোনো রাজকুমার ঘোড়ায় চড়ে নিশ্চয়ই আসবে।হঠাৎ পুতুল দিকে তাকিয়ে কিছু মনে পড়ে যায়।রেনু মন থেকে গভীর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বের হয়।মেয়েটি কথা বলতে পারেনা।আল্লাহ তাকে সব দিক থেকে পরিপূর্ণ করলেও একদিকে শূন্য করেছে।তার কথা না বলার জন্য তাকে যদি কেউ অবজ্ঞা,অবহেলা করে।তখন কি হবে?না,না আমি এসব কি ভাবছি?আল্লাহ নিশ্চয়ই তার জন্য উত্তম কিছু ভেবে রেখেছেন।
৬.
রাজিয়া বাবা কক্ষে বসে আছে।বিছানায় হাত দিতেই মনে হলো বাবার শরীরের সুগন্ধ এখনো লেগে আছে এই ঘরে।এই বুঝি বাবা, মা ব’লে ডাক দিবে।রাজিয়া ফুফিয়ে কান্না করে।
-;আব্বা…আব্বা!আপনি কই আব্বা?এই দেখেন।আপনার ঘরে আপনার মেয়ে রাজিয়া আইছে।এখন থেইকা আপনি আমারে যা বলবেন আমি সব শুনমু।আপনার কথার বাহিরের একটা টু শব্দ করুম না।আপনি যা শাস্তি দিবেন আমি সব শাস্তি মাথা পাইতা নিমু।তবুও আপনি ফিইরা আসেন।
আব্বা আপনি আমার সাথে রাগ কইরা সত্যিই চইলা গেলেন।একটি বার মাফ চাওয়ার সুযোগটুকু দিলেন না।আমি দোষী আব্বা।আপনার কথা না শুইনা মাঝ নদীতে ঝাপ দিছিলাম।সেই নদী আমারে ডুবাইয়া দিছে।আমার সব,সুখ শান্তি কাইড়া নিছে।আমি একটুও ভালা নাই আব্বা।আব্বা আমারে মাফ কইরা দেন।আমি আর ভুল করমু না আব্বা।রাজিয়া বিছানা সুয়ে কাঁদছে।তার আব্বা আর নেই।তাঁকে আর মা ব’লে ডাকবে না।শুধু একটি ভুলের কারণে আজ বাবা তার পাশে নেই।একদিকে বাপ,ভাই।আর অন্য দিকে স্বামী নামক লোকটা।
-;আমি চলে আসায় সে হয়তো ভালোই আছে।আমাকে এখন আর দরকার নেই।দুইদিন পর হয়তো নতুন কোনো রমনীকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে।আমাকে তার মনেই পড়বে না।আমি তার প্রয়োজন ছিলাম।প্রিয় জন হতে পারিনি আব্বা।আব্বা আপনারে কান্দাই আমি সেই সংসারে সুখী হতে পারি নাই।আপনার প্রত্যেকটা চোখের পানির মূল্য আমারে অভিশাপ দিয়া গেলো আব্বা?আমারে হতভাগী কইরা দিলো?
রেণু,রাজিয়া কান্নার শব্দে পেয়ে দৌড়ে আসে।
-;রাজিয়া।
-;ভাবী।আমার আব্বা আমার সাথে রাগ কইরা দুনিয়ায় ছাড়ছে।আমি আমার আব্বারে মেলা কষ্ট দিছি।সেই কষ্টের কারণে আমার আব্বা আজ আর নাই।আমি মাইয়া হইয়া বাপরে কবর ঘরে শুয়াছি।আমি তার মাইয়া নই।আমি রাক্ষসী।আমি আমার আব্বারে খাইয়া ফেলছি।আমারে তোমরা মাইরা ফালাও।আমি আর বাচঁতে চাই না।
-;শান্ত হও বোন।আল্লাহ মাল আল্লাহ লইয়া গেছে।আমাদের সবাইরে একদিন এই সুন্দর পৃথিবী ছাড়তে হইবো।কেউ আগে যাইবো কেউ আবার পরে যাইবো।দুইদিনের দুনিয়া কেউ চিরস্থায়ী নয়।কান্না করলেই কি তিনি ফিরে আসবেন?না তোও।তাহলে কান্নাকাটি করে কোনো লাভ আছে।লাভ নাই।নামায পড়।আর আল্লাহ দরবারে আব্বার লাইগা বেশি কইরা দোয়া কর।কুরআন পড়।তিনি সবকিছুর মালিক।
৭.
তোমারে যা যা বলাম ঠিক তাই করবা ঘটক।
একটা কথার এইদিক সেইদিক হইলে খবর আছে তোমার।আমি আমার ছেলের জন্য সেরা মাইয়া আনমু।মাইয়ার মা’ইরে বল’বা কি কি দেওন লাগবো?
সলিমুল্লাহ পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বের করে হাসে।ঘটকগিরি তার পেশা।গ্রামে গ্রামে ছাতা নিয়া হাটেন।আর সুন্দর সুন্দর মাইয়া খুঁজে এনে ছেলের মায়েদের কানে তুলেন।বিয়ে করানো জন্য।একটা খিলিপান বানিয়ে পকেটে ভরেন।আর মাথা নাড়ান।শাহাদাৎ আঙুলের মাথায় সাদা চুন।আরেকটা পান মুখে পুরে বলল,
-;আপনি কোনো চিন্তা কইরেন না আপা।আপনি যেমন বলছেন।ঠিক তাই বলুম।একটা কথার নড়চড় হইবোনা।
-;তাইলে আজ আসো ঘটক।
-;যাবো।কিন্তু যাওয়ার আগেই যদি কিছু টাকা দিতেন।বুঝেন তোও একেবারে খাট ফাটা রোদ্দুরে খালি হাতে আইছি।আমি আবার খালি পকেটে কোনো জায়গায় যাইতে পারিনা।শরমের তো একটা ব্যাপার স্যাপার আছে না-কি।নাসিমা বেগম শাড়ি আঁচলে গিটঠু দেওয়া।সেখান থেকে দুইশত টাকা বের করে দেন।
ঘটক টাকাটা নিয়ে পকেটে ভরে রাস্তার পথ মাপে।মোস্তফা সরোয়ারের জন্য পাত্রী দেখা হয়ে গেছে।এখন বিয়ে সানাই বাজিয়ে বউ ঘরে তুলে আনার পালা।নাসিমা বেগম মোটা যৌতুক নিয়ে ছেলেকে বিয়ে দিবেন।সুন্দরী রমনী ঘরে আসবে।তার সাথে ঘরের দামী জিনিসপত্র আর মোটা অংঙ্কে টাকা।
বুক চিন চিন করছে হায়।
মন তোমায় কাছে চায়।
ঘটক সরোয়ারের গলা শুনে মুখটা ভেঙ্গায়।
হুম আইছে নবাবের পুত্র।তার আবার বুক চিন চিন করে।
-;কি ‘রে ঘটক?তোর খবর কি?আমার জন্য মাইয়া ঠিক করছোস?না-কি….
-;না,না।কি যে বল না মিয়া!একবারে আসল রতন আইনা দিমু।রতনে রতন চিনবো।আর শুয়োর চিনবো কচু।
-;কি বলি তুই?ঘটকের বাচ্চা তোরে আমি খাইয়া ফালামু।
-;আরে আরে রাগ করেন ক্যান।আমি শুধু কথার কথা বলছি।আপনার মা যেমন আপনারে নিয়া রত্ম গর্ভা।তেমনই আপনি রতন।আর রতনে জন্য রতন আনুম।এতে দোষের কি আছে?আজকে তাইলে আসি।ঘটক জট চলতি কেটে পরে।সরোয়ারের লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ে ছিল।ঘটকরে ঘনো ধোলাই দেওয়ার জন্য।কিন্তু চলে যাওয়া লুঙ্গি হাঁটু নিচে নামিয়ে নিলো।বাড়িতে ঢুকার আগেই গালি দিলো।
-;ঘটক শালার বাচ্চা।
ঘটক তিন রাস্তায় উঠে সরোয়ার বাড়ি দিকে তাকিয়ে বলল,
-;হুম আইছে।আমারে নাকি খাইয়া ফালাইবো।আমি কি মাছ,মাংস নাকি যে তেল নুন ছাড়া খাইয়া ফালাবি।বেয়াদবের বাচ্চা।
৮.
কি গোও স্বাধীন মিয়া।শুনলাম তোমার বোন নাকি আইছে।তা বাপ,ভাইয়ের মুখে চুলকানি দিয়ে চইলা গেছিলো।আবার আইছে পোয়াতি হইয়া।লগে ছোট একখানা মাইয়া দেখলাম। ওটা কি তোমার ভাগ্নী না-কি?
স্বাধীন ধানের জন্য জমিতে সেচ দিচ্ছিলো।এমন সময় উপরোক্ত কথাগুলো শুনে হাত থেমে যায়।মাথা তুলে তাকাতেই রমিজ মেম্বারে দেখতে পায়।তবুও কোনো কথা না ব’লে কাজে আবার হাত লাগায়।
মেম্বারের কথার উত্তর না দেওয়া।আবার বলল,
-;যার লগে পালা গেছিল।সে না-কি তোমার বোনের বাড়ি থেইকা বাহির কইরা দিছে?কথাটা আছা না-কি।
-;আমার বোনের বাহির করছে।না-কি করে নাই।সেটা নিয়া আপনার এত মাথা ব্যাথা ক্যান মেম্বার সাব?আপনি নিজের চরকায় তেল দিন।আমার বোনরে নিয়ে ভাবার জন্য আমি আছি।তার ভাই তার লগে আছে।
-;ওহ।তাইলে তুমি ভাই হইয়া তার পাশে খাঁড়াইবা।আর আমাদের গ্রামের যে বদনাম হইছিল।তার কি হইবো?রোহিত পুরে মাইয়া হইয়া।নতুন চওড়া পোলার লগে ভাইগা গেছিল।
-;সেটা আমার এবং আমার ঘরের ব্যাপার।আপনি এসব কথা না ব’লেই খুশি হব।
-;তুমি একটা শিক্ষিত পোলা হইয়া।মুর্খ মাইষের মতো কথা কও।
-;আমার ঘরের কথা পরে কাছে বলা পচ্ছন্দ নয়।এতে যদি মনে হয় আমি মূর্খ।তবে তাই।
স্বাধীনের ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলা মেম্বারের পচ্ছন্দ হইলো না।মেম্বার চলে যেতেই ক্ষেতের কাজ শেষ করে বাড়িতে যায়।
ভর দুপুর বেলা গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে সর্ষের ইলিশ দেখে পুতুলের আনন্দের শেষ নেই।এটা তার বিষণ প্রিয় খাবার।যদিও সে এই মাছের কাটাঁ বেছে খেতে পারে না।মা বেছে দিলেই পেট ভরে সেইদিন ভাত খেতো।বাবার বাড়িতে এই মাছটা সহজে রান্নাই হতোনা।অথচ সকালে মামা নিজের হাতে বাজার করে দিয়ে গেছে।বউকে দিয়ে আগেই জিজ্ঞেস করে নিয়েছিল।ভাগ্নী তার কি খেতে পছন্দ করে?আজ তার পচ্ছন্দের রান্না করা হয়েছে।যদি ওহ ইলিশ মাছটা খুব দাম।এতো দাম দিয়ে গরিবরা খেতে পারেনা।তবু্ও ভাগ্নীর জন্য ছোট আকারে একটি ইলিশ মাছ এনেছে।যার দাম বর্তমানে ছয়শত
টাকা।মাছের মাথা আর লেজ মিলিয়ে পাঁচ পিছ মাছ হয়েছে।
৯.
এখন বাজে দুপুর দুইটা।স্বাধীন গোসল করে যোহরে নামাজটা তাড়াতাড়ি পরে নিলো।খাবার খেতে বসেছে।তার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে।ভাত মেখে মুখে এক লোকমা তুলতে নিয়ে সেই ভাত প্লেটে রেখে।বউকে জিজ্ঞাসা করলো।
-;রাজিয়া ভাত খেয়েছে।
-;হুম!
-; আর তুমি খেয়েছো?
-;
-;কি হলো কথা বলছো না কেনো?
-;আপনি আগে খান।আমি পরে খাইয়া নিমু নিই।
-;তাই।আমাকে ছাড়া কখনো তুমি খেয়েছো।সকালে ভোর সাড়ে সাতটা আমাকে খাইয়ে তারপরে খাবার মুখে তুলেছো।আর এখন বলছো পরে খাবে।বেলা কতটা হলো খেয়াল আছে।একটু পরেই দিবে আছরের আযান।তুমি আমার সাথে খেতে বসো।দাঁড়াও আমি তোমার জন্য ভাত নিচ্ছি।স্বাধীন ভাতের পাতিলের টাকনা সরাতে দেখতে পায়।একটি ভাত ও অবশিষ্ট নেই।
রেনু মাথা নিচু করে ফেলে।তার স্বামী যে হঠাৎ ভাতের পাতিলে হাত দিবে।একটুও বুঝে উঠতে পারেনি।
-;তুমি আমায় মিথ্যে ব’লে বউ।
-;আসলে ঘরে চাল শেষ হয়ে গেছে।তোমায় সকালে বলব একটুও খেয়াল ছিল না।তারপর বাজার থেকে আসলে যখন।তখন তোমার হাতে কোনো টাকা নেই।সব বাজারে শেষ।তাই আমিও তোমায় কিছু বলিনি।
-;সকালে টাকা নেই দেখে কথাটা ব’লে না।রাতে খাবার আসবে কোথা থেকে?
-;আসলে পাশে বাড়ির ভাবীকে ব’লে রাখছি।তিনি রাতের জন্য দুই পটের চাল দিবে।তাই ভাবলাম কাল সকালেই বলব।
-;হুম।এই দিকে এসোও।হা কর।
-;কি?
-;বলছি হা কর?রেণু হা করতেই প্রথম লোকমা বউয়ের মুখে তুলে দিল।তুমি আমার বাচ্চার মা।তোমাকে না খাইয়ে রাখলে আমার ছেলেটা ওহ কষ্ট পাবে।তোমরা কষ্টে থাকলে আমি ওহ ভালো থাকব না।আর কখনো আমার থেকে কিছু লুকিয়ে রাখবা না।যত কষ্ট হোক আমাকে সব বলবা।কথাটা শেষ করে নিজেও একই প্লেটে খাবার ভাগ করে খেলো।দূর থেকে এমন দৃশ্য দেখে রাজিয়া চোখ দুটো জুড়িয়ে গেলো।
স্বামী,স্ত্রী ভালোবাসা বুঝি একেই ব’লে।শত কষ্টের মাঝে থেকেও ভালোবাসা কোনো কমতি নেই।এদের মতো সুখি কয়জনই বা হয়।
চলবে…
কালকে লিখে রাখছিলাম পোস্ট করব ব’লে। কিন্তু ২৮ তারিখ নেট যে খেল দেখালো।তাতে পোস্ট করা সম্ভব হয়নি।সকালে খালামুনি বাসায় ছিলাম।ফোন হাতে ধরা সময় একদম পায়নি।এখন বাসায় এসে পোস্ট করলাম।কালকে অনেক কমেন্ট আমি দেখতেই পায়নি।নেট সমস্যার জন্য।কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারায় আমি সত্যি দুঃখিত।