#চন্দ্রকলা
#লামিয়া_ইসলাম
#পর্ব_৮
সাব ইন্সপেক্টর আজকে জমিদার বাড়ির পুরানো মালি রহমান মিয়ার সাথে দেখা করতে এসেছে। গত ২০ বছর ধরে রহমান মিয়া উজানপুর গ্রামে একবারের জন্য যায়নি। পুরো পরিবারসহ সে এত বছর ধরে ঢাকায় বাস করছে। যদিও বয়সের ভারে সে এখন অনেকটা বৃদ্ধ। আজ তার কাছে গিয়ে কয়েক দিন ধরে ঘটা ঘটনা গুলো বিস্তারিত বর্ণনা রহমান মিয়াকে দিল। তার কথা শুনে রহমান মিয়া অনেকটা অবাক হল এবং সে আরিফকে জমিদার পরিবারের ব্যাপারে এমন কিছু বলল যা শুনে আর আরিফের হুঁশ উড়ে গেল। সে রহমান মিয়ার থেকে এসব জেনে খুবই দ্রুত উজানপুরের দিকে রওনা হল।
শিরিন বেগম ও আমেনা বেগম বসে রান্না করছিল। হঠাৎ তাদের দুইজনের মনে হল তারা অনেকক্ষণ যাবত চন্দ্রকে কোথাও দেখছে না। তাই সে তাদের কাজের মেয়ে ফুলিকে ডেকে বলল,
– তোর বড় ভাবি কোথায় আছে?
– বড় মালকিন আমি তো ভাবিসাব রে ছাদে উঠতে দেখিছিলাম।
চন্দ্রের ছাদে ওঠার কথা শুনে তারা দুইজন হকচকিয়ে উঠলো। তাদের তাদের চেহারায় ভয়ের ছাপ দেখা গেল।
এ বাড়িতে এসে আজই প্রথম চন্দ্র ছাদে উঠেছে। বেশ ভালোই লাগছে পরিবেশটাকে চন্দ্রের কাছে। যদিও রিমার সাথে ঘটা ব্যাপারটা নিয়ে এসে এখনো কিছুটা মন খারাপ করে আছে। হঠাৎ করেই সে কোন দরজা ঠকঠক করা শব্দ পেল। শব্দের উৎস খুজতে গিয়ে সে দেখল চিলেকোঠার ঘর থেকে আওয়াজটা আসছে। কিন্তু চিলেকোঠার ঘরটিতে বাহির থেকে তালা দেওয়া। তারপরও সে চিলেকোঠার ঘরে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। যেইনা সে দরজার কাছে যাবে তখনই শিরিন বেগম এর ছাদে উঠে তাকে থামিয়ে দিল।
– মা আমার মনে হয় চিলেকোঠার ঘরে কেউ আছে। আমি গিয়ে দেখে আসি।
– আরে না না ওই কেউ নেই। দেখছে না দরজা বাহির থেকে তালা দেওয়া।
– কিন্তু মা আমি তো ভিতরে কারো দরজা ঠকঠক করার আওয়াজ পেয়েছি।
– আরে ওই ঘরে অনেক ইঁদুরের বাসা আছে। হয়তো তুমি ইঁদুরের দৌড়াদৌড়ি করার আওয়াজ পেয়েছো।
এই বলেই শিরিন বেগম চন্দ্রকে টানতে টানতে নিচে নিয়ে নিয়ে এলো। কিন্তু চন্দ্রর মন থেকে কৌতূহল হয় এখনো যায়নি। তার কেন যেন মনে হচ্ছে শিরিন বেগম তার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে।
সাফোয়ান আজকে ইন্সপেক্টর আসাদের সাথে কথা বলতে থানায় এসেছে। সে মূলত আগের দুইটা কেসের তদন্ত সম্পর্কে জানতেই এখানে এসেছে।
– দেখুন মিস্টার সাফওয়ান। আমার ১৫ বছরের ক্যারিয়ারও আমি এরকম কেস দেখিনি।
– কেন?
– আপনাদের বাড়ির পুরানো কাজের মহিলা যে ছুরিটি দিয়ে খুন হয়েছে। সেই ছুড়িতে শুধু তার নয় বরং আরো একজনের রক্তের নমুনা পাওয়া গেছে। তবে আরেকজনের যে রক্তের নমুনা পাওয়া গেছে সে রক্তটা অনেক পুরানো। ফরেন্সিকের রিপোর্ট অনুযায়ী কমপক্ষে ২০ বছর পুরানো কোন রক্তের নমুনা পাওয়া গেছে। আর উনার মৃত্যুর ছুরির আঘাতের কারণে হয়নি হয়েছে বিষের কারণে। আর ছুরিটাতে মরীচিকাও পাওয়া গেছে।
– আর ড্রাইভারের কেসের কি হলো?
– ওনার মৃত্যু বিষের কারণে হয়েছে । তবে উনার মৃত্যুতে যে বিষটা ব্যবহার করা হয়েছে সেই বিষটা ধীরে ধীরে কাজ করে।
– মানে?
– ধরুন এরকম যে উনাকে বিষ দেওয়ার এক ঘণ্টা পর থেকে বিষটা কাজ করতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে তার হাত পা অবশ হয়ে গেছে। আর তারপরেই খুনি উনার উপর অত্যাচার করেছে। আর তারপর ওনার মৃত্যু হয়েছে।
– ওহ। আর আমাদের বাড়ির স্টোর রুমে যে চোখ পাওয়া গিয়েছিল।
– হ্যাঁ চোখদুটো ওনার ওই। তবে ওনার মৃত্যুর পর চোখ দুটোকে কোন কেমিক্যালে ভিজিয়ে রাখা হয়েছিল সতেজ রাখার জন্য যেমনটা ল্যাবে বিভিন্ন নমুনা সংরক্ষণ করা হয়।
– আপনারা কি কাউকে সন্দেহ করছেন এই খুন দুটোর ব্যাপারে?
– এখনো পর্যন্ত কেউ আমাদের সন্দেহের তালিকা নেই। তবে সন্দেহ করতে হলে প্রথমে আপনাদের পরিবারের কাউকেই করতে হবে। কারণ যাদব খুন হয়েছে তাদের সাথে আপনাদের খুব গভীর সম্পর্ক রয়েছে।
– ওকে অফিসার। এই কেসের ব্যাপারে আর কোন সাহায্য লাগলে আমাকে জানাবেন।
– জি অবশ্যই।
আরে বেশ কিছুক্ষণ ইন্সপেক্টর আসাদের সাথে কথা বলে সাফওয়ান বাড়ির দিকে রওনা দিল। তবে সে তার গাড়ি কিছুক্ষণ চালানোর পর তার মনে হলো একটা সাদা গাড়ি নিয়ে কেউ তাকে ফলো করছে। কে এরকম তাকে ফলো করছে তা দেখার জন্য সে তার গাড়িটি থামালো। তবে সে গায়ে থামানোর সাথে সাথেই সাদা গাড়িটি অন্যদিকে মোড় নিয়ে চলে গেল।
সাহিল আজ অনেক দিন পর ঘুরতে বেরিয়েছে। গ্রামে সে অনেক আগে এসেছিল। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের ঝামেলার কারণে এই কয়দিন সেই বের হতে পারিনি। তাই আজকে সে সুযোগ পেয়ে বের হয়েছে। সাহিল হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের শেষ মাথা আর মাথার জঙ্গলে চলে এলো। সাহিল চারপাশ দেখতে দেখতে জঙ্গলের বেশ ভিতরে চলে গেল। যখন তার খেয়াল হয়ে গেছে সে অনেক চলে এসেছে তখন সেইদিক ঐদিক তাকাতে লাগলো। কিন্তু কিভাবে তার কোন রাস্তা খুঁজে পেল না। এখানে ফোনের নেটওয়ার্ক এর কাজ করছে না। আশেপাশে তাকাতেই হঠাৎ তার নজরে এলো একদিকেই একজন মহিলা আসছে। মহিলাটির কারনে একটি কালো শাড়ি। তবে তার মাথায় দেওয়া লম্বা ঘোমটার কারণে সে তার চেহারা দেখতে পেল না।
– বাবু আপনি এখানে কি করছেন?
– আমি গ্রাম ঘুরতে বেরিয়েছিলাম হারিয়ে গিয়েছি।
-গ্রামে বুঝি আপনি নতুন?
-হ্যা। অনেকদিন পর এসেছি।
– চলুন আপনাকে এই জঙ্গল পার করে দেই।
– ঠিক আছে চলো।
– চলুন ওই দিক থেকে যাই।
– কিন্তু ওই দিক থেকে তো মনে হচ্ছে জঙ্গলে আরো ভিতরে চলে যাব।
– আরে না না বাবু। ওই দিক থেকে শর্টকাটে যাওয়া যাবে।
সাহিল ধীরে ধীরে মেয়েটির পিছে পিছে চলতে লাগলো। কিছু দূর যেতেই মেয়েটি সাহিলের দিকে ফিরে তাকালো। মেয়েটিকে এভাবে হঠাৎ করে তার দিকে তাকাতে দেখে সাহিল কিছুটা ভড়কে গেলো। সাহের কিছু বলার আগেই মেয়েটি তার হাতের মুঠো খুলল। এবং ছাই এর মত কিছু তার দিকে উড়িয়ে দিলো। আর সাথে সাথেই সাহিল সেখানে বেহুঁশ হয়ে পড়লো।
সাফোয়ান থানা থেকে সোজা বাড়ি ফিরলো। তার রুমে ঢুকেই সে দেখলো চন্দ্র জানালার কাছে বসে আছে। সে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো। তারপর সে তোয়ালে নিয়ে পুকুরে গোসল করতে চলে গেলো।
সাফোয়ানকে ফিরতে দেখেই চন্দ্র রান্না ঘরের দিকে ছুটলো। সে সেখানে গিয়ে নিজেই লেবুর শরবত বানিয়ে সাফোয়ানের জন্য রুমে গেলো। শিরিন বেগম সাফোয়ানের জন্য তার চিন্তা দেখে আড়ালে মুচকি হাসলো।
চন্দ্র রুমে ফিরতেই দেখলো সাফোয়ান রুমে এসে পড়েছে। সে সাফোয়ানের দিকে গ্লাসটি এগিয়ে দিলো। সাফোয়ান দুই চুমুক খেয়েই চন্দ্রর দিকে গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,
– মিষ্টি হয়নি ঠিক মতো। তুমি একটু খেয়ে দেখো।
চন্দ্রর মনে হলো যে সে হয়তো চিনি কম দিয়েছে টা সেও দুই চুমুক খেলো।
-কই আমার কাছে তো মনে হয় ঠিকই আছে।
-হ্যা। আবার মিষ্টি ঠিক আছে। তা চন্দ্র জানো তো এক পাত্র থেকে ভাগাভাগি করে খেলে ভালোবাসা বাড়ে। এভাবে কয় দিন আমার সাথে খেলে দেখবে তুমি আমার প্রেমে পরে গেছো।
সাফোয়ানের কথা শুনে চন্দ্র লজ্জায় লাল হয়ে গেলো। তাই সে দৌড়ে রুম থেকে পালালো।
চলবে……..