#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_২০
#ইশরাত_জাহান
🦋
রাতের খাবার খেয়ে পিংকি ঘরে এসে বসেছে।ঠিক তখনই মিস্টার সমুদ্র আসেন পিংকির ঘরে।পিংকি মিস্টার সমুদ্রকে দেখে বলেন,”কিছু বলবে মামা?”
“হ্যা,তোমার সাথে কিছু কথা বলার দরকার আমার।”
“আচ্ছা,বলো।”
মিস্টার সমুদ্র পিংকির পড়ার টেবিলের সামনে যান।তারপর চেয়ার টেনে বসেন সেখানে।পিংকির দিকে তাকিয়ে বলেন,”জীবনের আসল সফলতা কোথায় জানোতো?”
পিংকি কিছু না বলে মিস্টার সমুদ্রর দিকে তাকায়।এমন কথার মানে কি?মিস্টার সমুদ্র পিংকিকে আবার বলেন,”জীবনের আসল সফলতা কারো জীবনে ভালোবাসার স্থান গড়ে নেওয়া।এত বিদ্যা শিখে কি লাভ যদি তুমি কোনো সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি হয়ে যাও?”
পিংকি মাথা নিচু করে ফ্লোরে তাকায়।মিস্টার সমুদ্র হালকা হাসেন।পিংকি মিসেস সাদিয়ার মত হলেও পিংকির মনে এই পরিবারের প্রতি ভালোবাসা আছে।এটা মিস্টার সমুদ্র জানেন।তিনি আবার বলেন,”তোমাকে আমি আমার দ্বীপ ও দীপান্বিতার থেকে কম দেখি না। জানো তুমি যখন হয়েছিলে তোমার নাম আমি রেখেছিলাম দীপা।আমার ছোট মেয়ে হবে দীপা।কিন্তু তোমার মা আমাকে রাখতে দেয় না এই নাম।তোমাকে কখনও সৎ বোনের মেয়ের চোখে দেখিনি।যদি তাই হতো তাহলে তুমি আজ এই বাড়িতে থাকতে পারতে না।আশেপাশের লোক যখন জিজ্ঞাসা করতো এই মেয়েটি কে?আমি বলতাম ও আমার জীবনের তৃতীয় এক অংশ,আমার সন্তান।ঢাকা শহরে এত এত হোস্টেল থাকতেও তোমাকে এখানে রাখা কারণ তুমি আমাদের আরেক নয়নের মণি।তুমি দ্বীপকে ভালোবাসতেই পারো।ভালোবাসা কারোর হাতের তালা চাবি না যে কাউকে ভালোবাসতে পারবে না।কিন্তু ভালোবাসলেই তাকে পেতে অন্যায় করবে এটা কিন্তু সবথেকে খারাপ একটা দিক।দ্বীপ তোমাকে কখনও ভালোবাসার চোখে দেখেনি।আমার ছেলেটার যোগ্যতা দিয়ে সরকারি স্কুল কলেজ পড়াশোনা করে আজ ক্যাডার হয়েছে।আমার কাছে কখনও কিছু আবদার করেনি।সেদিন তোমাদের মা মেয়ের কথাগুলো শুনে আমি দেখেছিলাম দ্বীপের চোখের ভীত ভাব।কাউকে হারানোর আতঙ্ক ছিলো।সত্যি বলতে সাদিয়া আমাকে তোমার সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিলে হয়তো রাজি হতাম বোনের খাতিরে।কিন্তু আমার ছেলেটার ভালোবাসা ব্যতীত কি শুধু ওই সম্পত্তিতে তুমি সুখী থাকবে?”
পিংকির চোখে পানি।মিস্টার সমুদ্র সব জানেন।শুধু মিস্টার সমুদ্র না দ্বীপ এই বাড়ির সবাই সবকিছু জানেন।কিন্তু তারপরও পিংকিকে এই বাড়িতেই রেখেছে।কতটা ভালোবাসে সবাই তাকে।মিস্টার সমুদ্র পিংকির চোখের পানি মুছে বলেন,”তোমাকে আমি শাসন করিনা একটাই কারণে তোমার উপর মেয়ের অধিকারে শাসন করলে তোমার মা এটা বুঝবেন না।আমি ছোটবেলা থেকে দ্বীপকে অনেক কাজেই বকা দিয়েছি।দীপান্বিতাকে থাপ্পড় দিয়েছি।কিন্তু কেউ এসে একটা প্রতিবাদ করেনি।কিন্তু তোমাকে তোমার ভালোর জন্য কিছু বললে কথা উঠবে আমি এই কাজ করার কে?আমি ঘরের কাজে আজ পর্যন্ত কথা বলিনি।এই জন্য তোমার মা যত পেরেছে সাবিনাকে খাটিয়েছে।আমি ইনকাম করে টাকা পাঠাতাম কিন্তু সাবিনা দ্বীপ দীপান্বিতা আমার মা এরা যতটা তার ভাগ পেয়েছে তার থেকে দ্বিগুণ ভাগ পেয়েছে তোমার মা।সাবিনা মানুষটি ছিলো নরম মনের।আমাকে খুব ভয় পেতো।কিন্তু আমি কখনও ওকে বকা দিতাম না বা মারতাম না।বিয়ের পর প্রথম আমি সাবিনাকে বলেছিলাম আমার বাবার দেওয়া আমানত সাদিয়া।সাদিয়াকে দেখাশোনা করা আমাদের দায়িত্ব।বাবা মারা যাওয়ার আগে হাফাতে হাফাতে বারবার বলেছেন,’ আমি তোমার মায়ের সাথে পাপ করেছি।যেদিন আমি সাদিয়ার মাকে বিয়ে করে আসি তারপর থেকে তোমার মা আমার সাথে আর একটিও কথা বলেনি।আমি এখন বুজেছি আমি অন্যায় করেছি।মাফ করে দিও আমাকে তোমরা।হয়ত আর বাঁচবো না।শরীরের ভিতর জ্বালাতন করছে খুব।আমার সাদিয়াকে কখনও সৎ বোনের চোখে দেখবে ন।ওর মা নেই আমিও হয়তো থাকবো না।আমার শরীরের অবস্থা ভালো না।তুমি ওকে ভালোবেসে আগলে রেখো।’
বলেই বাবা ওখানে আমার হাত ধরেই শেষ নিশ্বাস নেন।মৃত বাবাকে আমি বলতে পারিনি আমি ওকে ভালোবাসতে পারবো না।তবে আমি ওকে আপন বোনের মতোই দেখবো।সাদিয়াকে পড়াশোনা করাতে চেয়েছি কিন্তু ও পালিয়ে বিয়ে করে তোমার বাবাকে।তোমার বাবা এখন যতটা ভালো তখন এমন ছিলেন না।তখন ছিলেন বখাটে।তারপরও আমরা মেনে নিয়েছি।সাদিয়াকে আমি যা যা দিয়েছি তার এক কানাকড়ি আমি সাবিনাকে দেইনি।এই যে বাড়িটি দেখছো এটা আমি আমার সাবিনার নামে অর্ধেক লিখেছি আর অর্ধেক অংশ দ্বীপ ও দীপান্বিতার নামে। আর গ্রামের বাড়িটি সম্পূর্ণ তোমার আর সাবিনার নামে।”
বলেই গ্রামের বাড়ির কাগজ জেকেটের ভিতরের পকেট থেকে বের করে পিংকির হাতে দিলো।পিংকির বিবেকে নাড়া দিলো।হাত বাড়িয়ে নিতে পারলো না কাগজটি।এই জমিতে তার মায়ের থেকে তার মামার হক বেশি।কিন্তু তারপরও পুরো বাড়িটি মামা তার আর মায়ের নামে করে দিয়েছে।এতদিন তার মা কি না সম্পত্তির জন্যই তাকে এখানে রেখেছিলো।কিন্তু পিংকি জানে সে তো শুধু দ্বীপের জন্য ছিলো এখানে।
মিস্টার সমুদ্র বের হতে যেয়েও দরজায় দাড়িয়ে বলেন,”সম্পর্কে তৃতীয় ব্যাক্তি আসলে তারা কখনও সুখে থাকে না। লোভে পাপ পাপে মৃত্যু।এটা শুধু একটি প্রবাদ বাক্য নয় এটি একটি বাস্তব জীবনী। আশা করি আজ থেকে তুমি আমাদের নীরাকে দ্বীপের সাথে সুখে থাকতে দিবে।”
বলেই চলে যান মিস্টার সমুদ্র।পিংকি হাউমাউ করে কান্না করে দেয়।আজ তার খুব কষ্ট লাগছে।তার মা এতদিন কত খারাপ কথা বলতো এদেরকে নিয়ে।অথচ তারা কখনও এমন কিছুই করেনি।
অপরদিকে,
ডিনার করে দ্বীপ ও নীরা ঘরে চলে আসে।নীরা একটু মাথা আচড়াবে তাই আয়নার সামনে যায়।দ্বীপ তাকিয়ে আছে নীরার দিকে।নীরা মাথা আচড়াতে আচড়াতে আয়নায় দেখতে পেলো দ্বীপ তার দিকে তাকিয়ে আছে।নীরা দ্বীপের দিকে ঘুরে বাম ভ্রু উচু করে বলে,”কি হয়েছে?”
দ্বীপ নীরার কাছে এসে বলে,”আমি টিউব লাইট?”
নীরা হালকা হাসে।সন্ধায় হওয়া কথাটি এখনও মাথায় রেখেছে দ্বীপ।নীরা বলে,”ওটাতো রাগ করে বলছিলাম।”
“দুই দুইবার শুনেছি আমি তোমার মুখে যে আমি টিউব লাইট।তাহলে চলো আজ দেখিয়ে দেই আমি টিউব লাইট কি না,বউ।”
যেই নীরা এতদিন দ্বীপকে খেপাতো আজ সেই নীরা ঘাবড়ে যাচ্ছে।তোতলাতে তোতলাতে বলে,”আ আসলে ক কাল পরীক্ষা।এখন ত তো আমাদেরকে …”
কিছু বলার আগে চশমার ভীতর দিয়ে নীরার দিকে তাকিয়ে দ্বীপ বলে,”এক ডজন বাবু আনার প্রসেসটা আজ পরিপূর্ন করে ফেলি,কি বলো?আচ্ছা তোমার এতটুকু একটা জায়গায় বারোটি বাবু ঢুকলে কেমন লাগবে?”
সাথে সাথে নীরার হাত যায় তার পেটে।কল্পনা করতে থাকে এই পেটে বারোটি বাবু ঢুকলে তো পেট ফুলে ফেটে যাবে।দ্বীপ স্মিত হেসে বলে,”আমার কাছে ভালো উপায় আছে।প্রত্যেক বছরে আমরা যমজ বাবু নিবো। এতে করে ছয় বছরে বারোটি বাবু হয়ে যাবে।”
খুক খুক করে কেশে ওঠে নীরা।ছয় বছরে যদি পেট বড় হয় আর পেট কাটতে হয় তাহলে বাঁচবে আদৌ!তার উপর আবার একেক বছরে দুইটা করে বাচ্চা।ভাবতেই নীরার মাথা ঘুরছে।দ্বীপ ঘরে ঘরম পানির জন্য ফ্লাক্স রেখে দেয়।সেখান থেকে কুসুম গরম পানি গ্লাসে ঢেলে নীরাকে দেয়।নীরা পানি নিয়ে ঢকঢক করে পুরোটাই গিলে ফেলে।
দ্বীপ গায়ে থাকা নরম চাদরটি দুই হাতে নিয়ে চিকন আকারে করে।তারপর নীরার পিছনে নিয়ে নীরার কোমড়ে চাদরটি দিয়ে হালকা টান দেয় নীরাকে।নীরা হালকা নড়াচড়া করে।দ্বীপ নীরার দিকে তাকিয়ে বলে,”কি হলো বউ?এক ডজন বাবু চাই না তোমার!এত নড়াচড়া করলে হবে?”
নীরা এবার জোরে এক নিঃশ্বাস নিয়ে গড়গড় করে বলে,”ভালো রেজাল্ট করতে হবে তো।এখন পড়তে বসবো।”
দ্বীপ ছেড়ে দেয় নীরার কোমড় থেকে চাদরটি।বলে,”রাত অনেক হয়ে গেছে।এখন ঘুমাও আমি ভোরের দিকে এলার্ম দিয়ে দিচ্ছি।তখন আবার রিভিশন দেওয়া যাবে।”
দ্বীপের বলতে দেরি নীরার খাটে যেয়ে শুয়ে পড়তে দেরি হয়নি।দ্বীপ লাইট অফ করে এসে নীরার থেকে দূরত্ব রেখে শুয়ে পড়ে।শুতে শুতে দ্বীপ নীরাকে বলে,”চিন্তা করো না বউ।তোমাকে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে দেওয়ার দায়িত্ব যেমন আমার,তোমাকে এক ডজন বাবু এনে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।”
নীরা চোখ বন্ধ করে মিটমিট হাসতে থাকে।
সকালে,
নীরা তার রেজিস্ট্রেশন কাগজ ও প্রয়োজনীয় সব কিছু গুছিয়ে নিজেকে রেডি করছে।দ্বীপ নীরাকে একটি বোরকা কিনে দিয়েছে।নীরা এখন সেই বোরকা পরেছে।আজ প্রথম বোরকা পরলো।কেমন জানি লাগছে নীরার কাছে।তারপরও তার ক্যাডার সাহেব দিয়েছে তাই এক আলাদা ভালো লাগা কাজ করছে।কেয়া এসেছে নীরার কাছে।নীরা বলেছে আসতে।সবাই একসাথে যাবে।মিস্টার রবিন,মিসেস নাজনীন ও নীরব এসেছে নীরার সাথে দেখা করতে।মিস্টার সমুদ্রও আজ অফিসে যায়নি।দ্বীপ বারবার নীরাকে এক কথাই বলে,”এটা কিন্তু তোমার টেস্ট পরীক্ষা না।তাই এবার সম্পূর্ণ সময় বসে থেকে পরীক্ষা দিবে।মাথা ঠাণ্ডা রাখবে।তোমার জন্য আমি পানি দিয়েছি।গলা শুকিয়ে আসলে পানি খাবে।”
নীরা এবার বলে ওঠে,”আপনি আমাকে সেই সকাল থেকে এই এক কথা কেনো বলছেন?”
“আগেরবার টেস্টে তো হাফ এক্সাম দিয়ে বেড় হয়েছিলে।তোমাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই।”
“আপনি কিন্তু আমাকে এক্সামে যাওয়ার আগে অপমান করছেন।”
সবাই হেসে দেয় এদের কথায়।মিস্টার রবিন ও মিসেস নাজনীন মিলে নীরাকে কিছুক্ষণ আদর করেন।তারপর গাড়ির কাছে চলে আসেন সবাই।দ্বীপ ও নীরা ফ্রন্ট সিটে বসেছে।রিক ও কেয়া ব্যাক সিটে বসেছে।দ্বীপ নীরাকে নিয়ে চিন্তায় আছে।যদিও বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিজ দায়িত্বে দ্বীপ নীরাকে পড়িয়েছে।কিন্তু এই মেয়ের তো ঠিক ঠিকানা নেই।পড়ার ভিতর গানের কথা ভাবে।পরীক্ষার হলে কি করবে কে জানে?
সবাই যে যার মত ঘরে এসেছে।দীপান্বিতা অভ্রকে নিয়ে হাঁটছে।নীরব বাসায় যেতে নিবে দেখে দীপান্বিতা ও অভ্র একসাথে দাড়িয়ে আছে।দীপান্বিতা তাকিয়ে আছে নীরবের দিকে।নিরব কিছু একটা ভেবে দীপান্বিতার কাছে এসে বলে,
চলবে…?