চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা #ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া #পর্ব-১২

0
572

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-১২
৩৭.
ফজরের আজান হয়ে গেছে।হেমন্ত রানী দূয়ারে কড়া নাড়ছে।শীতের অবস্থান হেমন্তের পর বসন্তের আগে।হেমন্তের ফসল ভরা মাঠ যখন শূন্য ও রিক্ত হয়ে পড়ে,তখনই বােঝা যায়,ঘন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে শীত আসছে।উত্তরের হিমেল হাওয়ায় ভর করে হাড়ে কাপন লাগিয়ে সে আসে তার নিজস্ব রূপ নিয়ে।প্রকৃতিতে সৃষ্টি হয় এক ভিন্ন সৌন্দর্য।এ সৌন্দর্য পূর্ণতা পায় শীত সকালে।
পুতুল ফজরের আজান শেষ হতেই কাঁথা ছেড়ে মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিলো।বিছানা ছেড়ে পায়ে স্যান্ডেল পরে কলপাড়ে আসে।ওযু করে নামাজে দাঁড়ানো আগেই মিলন,সাজুকে টেনে উঠালো।ফজরের নামাজের জন্য মামা ওঠে গেছে।তাদের দুইজনকে ডাকতে এই এলো ব’লে।পুতুল এত ডাকছে এদের কোনো নড়চড় নেই।পুতুল বুদ্ধি করে মাটির কলস থেকে ঠান্ডা পানি গ্লাসে উঠিয়ে নিলো।ওদের মুখে ওপর পানি ফেলতেই,

-;ওরে সাজুর বাচ্চারে।তুই আবার হিসু আমার মুখের ওপর করেছিস।শালা তোর কপালে বউ নাই।সর তুই।মিলন কথা শেষ করেই সাজুকে লাথি দিয়ে খাট থেকে ফেলে দিল।সাজু মুখ কালো করে বলল।

-;মিথ্যে কথা।আমি হিসু করিনি।তুই প্রত্যেকবার হিসু করে আমার নাম দিস।তুই এত পঁচা কেন?

-;আমি পঁচা না-কি তুই পঁচা?তুই সব সময় এমন করিস বেয়াদব।মিলন বাকি কথা শেষ করার আগেই পুতুল ঠাসস করে ভাইয়ের পিঠে থাপ্পড় মেরে বসে।রাগী চোখে তাকাতেই দুটোই চুপচাপ উঠে পড়ে।স্বাধীন ডাক দিতেই গরম কাপড় আর মাথায় টুপি পড়িয়ে দুই ভাইয়ের কপালে চুমু একে দেয়।তারা চলে যেতেই পুতুল নামাজ দাঁড়িয়ে পড়ে।মাথায় ওড়না হিজাবের মতো করে পড়তেই মেয়েটিকে শুভ্রময় লাগছে।

৩৮.
সকালে সূর্যমামা যখন উকি দেয় গাছ ও ঘাসের উপর তখন রাতের ঝরা শিশির সােনার মতাে জ্বল জ্বল করতে থাকে।শীতের সকালের এক অসাধারণ আকর্ষণ সরষে ফুলের হলুদ মাঠ।সকালের সূর্যালােক যেন তার নিপুণ হাতে প্রতিটি সরষে গাছকে নবরূপে ঢেলে সাজায়।পশু-পাখি সূর্যের আলাে দেখে আনন্দিত হয়।কৃষকরা গরু ও লাঙল নিয়ে মাঠে যায়।তাদের হাতে শােভা পায় তুঙ্কা।ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সূর্যের মুখ দেখার জন্য বারবার জানালার ফাঁকে উঁকি মারে।কোথাও বা ছেলেমেয়েরা খড় সংগ্রহ করে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করে,আর হাসি-তামাশায় মেতে উঠে।বৃদ্ধ লােকেরা রোদ পােহায়।কিছু লােক খেজুরের রস বিক্রি করতে বের হয়।অনেকেই ঘরে তৈরি পিঠা ও খেজুরের রস খেতে পছন্দ করে।বেলা বেশি হওয়ার সাথে সাথে শীতের সকালের দৃশ্য ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।বেলা বেড়ে চলে, কুয়াশা দূরীভূত হয় এবং লােকেরা তাদের নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।স্বাধীন দুই বাদরকে নিয়ে নামাজ পড়ে বাড়িতে পা রাখতেই ভাপা পিঠার গন্ধ পাওয়া যায়।পুতুল,রেণু মিলে ভাপা পিঠা তৈরি করছে।মাএ তিন চারটা পিঠে হয়েছে।বাকি পিঠাগুলো তৈরি করতে একটু সময় লাগবে।কিন্তু মিলন,সাজুর ধৈয্য নেই।হাঁড়ি থেকে পিঠা নিয়ে তাতে কামড় বসিয়ে দিয়েছে।পিঠা খেতে খেতে বলল।

-;হুম,পিঠা মজা।

পুতুল মিষ্টি হাসি দিলো।মামীকে দিয়ে মামার জন্য তিনটা পিঠা পাঠিয়ে বাকিগুলো শেষ করে নিলো।এগারো বছরের ছোট মেয়েটি আজ সংসারে কাজে পারদর্শী।পড়াশোনা চলছে এখনো।সামনে সমাপনী পরীক্ষা।

রেনু সাত মাসের উঁচু পেট নিয়ে স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে পিঠা এগিয়ে দেয়।স্বাধীন বউকে ধরে আস্তে করে চেয়ারে বসিয়ে দিলো।রেনু’র পা ফুলে গেছে।শরীরে পানি এসেছে।দ্বিতীয়বার মা হচ্ছে রেনু।চেহারা কেমন গুল মুল হয়ে গেছে।বেশি কাজ করতে পারে না।অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠে।পুতুল বাসায় যতখন থাকে সব কাজই করে রাখে।সে প্রতিদিন সকালে ফজরের নামাজ পড়েই বাড়ি,ঘর,উঠোন ঝাড়ু দেয়।থালাবাসন ধুয়ে রাখে।সকালে হাড়িতে করে রান্না চড়িয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে,দুই ভাইয়ের পড়াশোনা থেকে সবই খেয়াল রাখে।তার কোনো অভিযোগ নেই।মেয়েটি এতটা ভালো কেন?জানা নেই রেনুর।

-;বউ তোমার কি বেশি খারাপ লাগে?আমার থেকে কিন্তু কিছু লুকিয়ে রাখবা না।

-;উত্তেজিত হচ্ছ কেন?আমি ঠিক আছি।খারাপ লাগলে জানাবো।তুমি আছো তোও।

-;আমি থেকেও তো আমার বোনকে সেই দিন বাঁচাতে পারিনি।কতটা কষ্ট নিয়ে দুনিয়ায় মায়া ত্যাগ করেছে।ভাই হয়ে রক্ষা কোথায় করলাম?

-;ওইসব পুরনো কথা কেন মনে রাখ?ভুলে যা-ও না।

-;সব কথা চাইলে কি ভুলে যাও যায়?আমার সামনেই সন্তান দুটো মা বিহীন কষ্ট পায়।আমি বুঝতে পারি।

রেনু,স্বাধীনের মন ভালো করতে কথা ঘুরিয়ে বলল,

-;পুতুলের কিন্তু প্রাইমারি স্কুল শেষ হয়ে আসছে।নতুন স্কুলে ভর্তি করানোর কথা কিছু ভাবলেন।

-;হ্যা,তালেপুর হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবো।

-;এই যা,শুধু কথা বলছি।আপনার জন্য ভাপা পিঠা এনেছিলাম।সেটা দিতে ভুলে গেছি।খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে?আজকের পিঠা পুতুল তৈরি করেছে।আমি শুধু হ্যাল্প করেছি।কিভাবে,কতটুকু দিয়ে করতে হবে।স্বাধীন হালকা গরম পিঠা মুখে দিয়ে বলল।

-;আম্মার হাতের রান্না দারুণ হয়েছে।

৩৯.
পুতুল পড়তে বসেছে।সামনে পরীক্ষা।মামা মান,সম্মানের কথা চিন্তা করেই এত মনোযোগ দিচ্ছে।কোনোমতে মামাকে তার রেজাল্ট নিয়ে নিরাশ করতে চায় না।এত কষ্ট সব কি এমনই এমনই বৃথা যেতে দিবে?কখনোই না।সে দেখিয়ে ছাড়বে।পড়াশোনা তার জন্য বেস্ট অপশন ছিল।আর এখনো আছে।এই পড়াশোনা জন্য তাকে মানুষেরা কম কথা শুনাতে ছাড়ে নিই।সবার সকল অত্যাচার সব মুখ বুঝে সয্য করেছে।প্রতিদিন ক্লাসে মনযোগী হতে হয়েছে।ওই পাঁচজন তাকে শান্তি মতো পড়তে দেয় নিই।কখনো বই,খাতা ছিঁড়ে ফেলছে।কখন তাকে কটুকথা শুনিয়েছে।তার দোষ একটাই ছিল।সে কেন তাদের সাথে শত্রুতা করলো।অথচ পুতুল নিজে থেকে কিছুই করে নিই।তবুও কথা শুনতেই হতো।পাঁচ বছর হয়ে এলো তার স্কুল জীবনের সমাপ্তি হতে চলেছে।আবার নতুন স্কুল,নতুন পরিবেশ হবে।সেখানে কি অপেক্ষা করছে তার জন্য?জানা নেই।তবুও সে পড়বে।তার স্বপ্ন পূরণ সে করবে।সব চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ায় মনযোগ দিলো।

রাজিয়া,আরে এই রাজিয়া বাহিরে আসো।দেখে যাও তোমার স্বামী আইছে।

উঠোন থেকে কারো গলার শব্দ পেয়ে পুতুল বই বন্ধ করে দিলো।মাথায় ওড়না দিয়ে ঘর থেকে বের হতেই চমকে উঠে।মোস্তফা সরোয়ার তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।মুখে হাসি,হাতে মিষ্টির প্যাকেট।এই লোকটা এতদিন বাদে এই বাড়িতে কেন এসেছে?পুতুল জানতে চায় না।এই লোকটার মুখ সে কোনোদিন দেখতে চায় নিই।আজ সেই লোকটা তার সামনেই মিথ্যে হাসি নিয়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে।রাগে শরীর কাপছে।চোখ দিয়ে পানি আসছে।পুরনো অতীত মনে হতেই।মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে। এই লোকটা দায়ী।তার মায়ের খু*নি।এরজন্য আজ তাদের মাঝে মা নেই।তাদের মা,ছেলের জন্য দিন,রাত তার মা কষ্ট পেয়েছে।কেঁদেছে।তার মায়ের কান্না স্বাক্ষী সে নিজে হয়েছে।আজ তাদের জন্য সে এবং তার ভাই এতিম।তার মা’কে কেঁড়ে নিয়ে।আজ আবার কেন এসেছে?চিতকার করে বলতে ইচ্ছে করছে।

কেন এসেছেন?মাঝ নদীতে ফেলে দিয়ে এতদিন পরে দেখতে এসেছেন।বেঁচে আছি না-কি মরে গেছি।আমি আপনার এই মুখ দেখতে চাই না।আপনি একজন প্রতারক।মিথ্যেবাদী।একজন জুলুম কারী।পুতুলের গলা দিয়ে একটা কথা বলতে পারলোনা।আজ খুব করে আপসোস হচ্ছে!আল্লাহ কেন তার গলায় স্বর দিলেন না।গলার আওয়াজ থাকলে কথা তুলে ধরতো বাবা নামের অমানুষটার সামনে।এমন লোককে অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতো।কিন্তু পুতুল মুখ দিয়ে চেষ্টা করে ওহ একটা শব্দ বের করতে পারেনি।

পুতুল রাগে দুঃখে মামাকে ডাকতে ক্ষেতে দিকে গেলো।সবুজ ধানের সীমানা পেরিয়ে আলু ক্ষেতের সামনে দাঁড়িয়ে মামাকে হাত দিয়ে ডাকতে লাগল।কিন্তু তার ইশার বা কোনো শব্দ স্বাধীনের কানে যায় নিই।সে নিচু হয়ে ক্ষেতের মাঝে উল্টো দিক হয়ে কাজ করে যাচ্ছে।পুতুল ডাক মামার কানে পৌঁছায় না।পুতুল আলুর ক্ষেতে নেমে গেলো।কাদামাটিতে তার পা,গায়ের থ্রী পিছ নষ্ট হচ্ছে।সেই দিকে মনযোগ নেই।সে মামাকে তার উপস্থিতি বুঝাতে ব্যাস্ত।হাতের বাহুতে ছোট একটি নরম হাত পড়তেই স্বাধীন ঘুরে তাকিয়ে চমকে যায়।পুতুলের চেহারা লাল হয়ে আছে।অতিরিক্ত কান্না ফলে কোনো কিছু বলার মতো অবস্থা নেই।স্বাধীন ভয় পেয়ে গেলো।বাড়িতে কিছু হলো কি?

-;আম্মা কি হয়েছে?আপনি কান্না করছেন কেন?বাড়িতে সব ঠিক আছে তো।রেণু কিছু হয়েছে?আপনি কান্না বন্ধ করুন।আমায় খুলে বলুন।পুতুলের কান্না বন্ধ হয়না।স্বাধীনের টেনশন বেড়ে যায়।ক্ষেতের কাজ ফেলে বাড়ির দিকে দৌড় লাগায়।পুতুল তার পিছনে ছুটে চলে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here