#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-১৩
৪০.
বারান্দায় বসে পায়ের ওপর পা তুলে আপন মনে পা নাচিয়ে যাচ্ছে মোস্তফা সরোয়ার।রেণু দিকে আড়চোখে তাকিয়ে পুরো শরীরে চোখ বুলিয়ে শয়তানি হাসি দিলো।তার এমন কাজে রেনু অস্তিত্বটা দ্বিগুণ বেড়ে যায়।গায়ের কাপড় দিয়ে নিজেকে ভালোভাবে মুড়িয়ে নিয়ে পুতুল আর স্বামী অপেক্ষা করতে লাগল।লোকটাকে তার সুবিধার লাগছে না।আসার পর থেকেই উল্টা পাল্টা কথা বলে যাচ্ছে।ইচ্ছে করছে সীল নোরা দিয়ে মাথাটা ফাটিয়ে দিতে।অসভ্য কোথাকার!
স্বাধীন ভয়ে বুক কাপছিল।বাড়িতে পা রেখেই বউকে খোঁজ করে।বউকে ঠিকঠাক দেখে দম ছাড়ে।কিন্তু মোস্তফা সরোয়ার কে চোখের সামনে দেখে মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে।
-;তুই।তুই এখানে আমরা বাড়িতে কোন সাহসে আসছিস?আমার বাড়িতে আসার সাহস পেলি কি করে?বের হ আমার বাড়ি থেকে।তোকে আমি পুলিশ কাছে দিবো।তোর মতো অমানুষ আমার বাড়িতে পা দিয়ে জায়গাটা নষ্ট করে ফেলেছিস।আমার বাড়িতে তোর জায়গায় হবে না।
-;আরে ভাইজান রাগ করেন কেন?আমি থাকতে আসি নাই।চইলা যামু।আমার জিনিস আমাকে বুঝিয়ে দিন।
-;তোর জিনিস মানে?
-;এই যে আপনার সামনে আমার মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমার বউ,বাচ্চা সবইতো আপনার বাড়িতে।তাদের কে আমার হাতে তুলে দিন।আমি চলে যাই।পুতুল মা বাবার কাছে আসো। মোস্তফা,পুতুল দিকে হাত বাড়াতে,পুতুল ভয় পেয়ে কয়েক কদম পিছনে চলে যায়।স্বাধীন চিতকার করে উঠে।
-;কে তুই?আর কিসের বউ,বাচ্চা?
-;আরে আপনি ভুইলা গেছেন।কিন্তু আপনার বোন ভালো করেই জানে আমি কে?তারে ডাক দেন।সেই বলব আমি কে?
-;তালাক দেও পর কিসের বউ?রাজিয়া এখানে নেই।এখন তুই বিদায় হ।
-;রাজিয়া কই গেছে?
-;সেটা তোকে বলার প্রয়োজনবোধ করছি না।
-;ওহ,বুঝতে পারছি।আমি তালাক দিছি দেইখা তোর বোন অন্য আরেকজনের সঙ্গে ভাগছে না-কি।শালী আমারে দিয়া হ….মোস্তফা কথা শুনে স্বাধীন নাক বরাবর ঘুসি মেরে বসে।স্বাধীন করা হঠাৎ আঘাতে মোস্তফা সরোয়ার বসে পড়ে।রেণু,স্বামী রাগ দেখে ভয় পেয়ে মুখে হাত দেয়।পুতুল একটু দূরে মোমের পুতুল মতো দাঁড়িয়ে আছে।মোস্তফা উঠে দাঁড়ানোর আগেই আবার একটা ঘুসি লাগিয়ে শার্টের কলার ধরে বাড়ির উঠোনে বাহিরে ছুড়ে মারে।
-;তোর মতো কুকুর রাস্তায় মানায়।ঘরে শোভা পায় না।আমার বোনকে নিয়ে আরেকটা কথা ব’লে তোর জিহ্বা আমি কে*টে নিবো।
-;আজকে যাচ্ছি।কিন্তু কাল আমি আবার আসব।আমার বউ,বাচ্চা চাই।তাদের না নিয়ে আমি যাবো না।
-;আমি স্বাধীন বেঁচে থাকতে তোর হাতে ওদের কোনোদিন তুলে দেব না।তোর যা করার করে নে।আমি ভয় পাই না।
মোস্তফা সরোয়ার নাকের আর ঠোঁটের রক্ত মুছতে মুছতে চলে যায়।এইদিকে পুতুল ঘরে ঢুকেই কান্না ভেঙে পড়ে।এই লোকটা জন্য তার মা বেঁচে নেই।আজ আবার এসেছে।নিশ্চয় তাকে জোর করে নিয়ে যাবে।পুতুল মনে ভয় ঢুকেছে।সে নিজেকে শান্ত করতে পারছেনা।লোকটা কোনোভাবে তার ভাইয়ের খোঁজ পেলেই নিয়ে যাবে।তার কাছ থেকে ভাইকে কেড়ে নিবে।পুতুল দৌড়ে মামা কাছে যায়।মামা পায়ে হাত দিয়ে বারবার ইশারা করছে।তার ভাইয়ের পরিচয় জেনো ওই লোকটা জানতে না পারে।একবার জানতে পারলেই ওরা নিয়ে যাবে তার কাছ থেকে।পুতুল ইশারা বুঝতে পেরে স্বাধীন শান্ত হতে বলল।কিন্তু মেয়েটা শান্ত হচ্ছে না।ফুফিয়ে কান্না করছে।
৪১.
সাজু আর মিলন বাসায় ছিলো না।খেলাধুলা করে এসে দেখে আপু কান্না করছে।আপুকে কান্না করতে দেখে দৌড়ে দুই ভাই আসে।
-;আব্বু,আপু কান্না করছে কেন?আম্মু,আপু কান্না করে কেন?
-;আপু কি ব্যাথা পেয়েছে?
মিলন,আর সাজুকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেনু।বলল,
-;আপু সামনে পরীক্ষা তাই চিন্তায় কান্না করছে।রেজাল্ট যদি খারাপ হয়।
মিলন,রেণু গাল ধরে বলল,
-;আম্মু,আপুর রেজাল্ট একটুও খারাপ হবেনা তুমি দেখে নিও।আপু ভালো করবে।মিলন, সাজু দুই দিক থেকে বোনকে জড়িয়ে ধরে।
একটু দূর থেকে স্বাধীন,রেণু সবটাই দেখে।রাজিয়া মারা যাওয়ার পর পুতুল তার ভাইকে কোলে পিঠে করে মানুষ করে।কিন্তু মিলন বড় হতেই স্বাধীনকে আব্বু এবং রেনুকে আম্মু ডাকতে শুরু করে।এই পাঁচ বছরের ছেলেটি জানতেই পারেনি।তার মা তাকে দুনিয়ার আলো দেখাতে গিয়ে নিজের মায়া ত্যাগ করেছে।স্বাধীন পরবর্তী বলতে চাইলে পুতুল বলতে নিষেধ করে।এতটুকু বয়সে যখন জানবে তার মা নেই।সেই ধাক্কাটা সামলাতে পারবে না।তাই পুতুল জন্য রেনু,স্বাধীন কখনোই আর কিছুই ব’লে নিই।গ্রামের সবাই এক সময় রাজিয়া ব্যাপারটা জানলেও গুরুত্ব দেয় না।সবাইকে স্বাধীন ব’লেছে।তার দুই ছেলে এক মেয়ে।পুতুল জানে সে তার মায়ের এক মেয়ে।তার কোনো ভাই নেই।তার মায়ের সাথে সাথে তার ভাই মারা গেছে।এটাই এতদিন মেনে এসেছে।সরোয়ার পরিবার কেউ জানুক তার ভাই বেঁচে আছে।এটা সে চায় না।আর চায় না ব’লে নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখে।মিলন জানে রাজিয়া তার ফুপু ছিল।এটা তার ফুপুর মেয়ে।সে তাদের দুই ভাইয়ের আপু।আর কারো নয়।সাজু যেমন একটু শান্ত সৃষ্ট।তেমনই মিলন চঞ্চল চটপটে ছেলে।
৪২.
মোস্তফা মার খেয়ে বাড়িতে পা রাখতেই নাসিমা দৌড়ে আসে।ছেলে এমন আঘাত কেমতে পেলো জানে না?কিছু বলতে নিলেই মোস্তফা রাগে কটমট করতে থাকে।
পাঁচ বছর পর জেল থেকে বের হয়ে সেলুন থেকে চুল,দাঁড়ি কাটিয়ে গেলাম।আর আমাকে কি-না অপমান করে বের করে দিলো।খুব দেমাগ দেখায়।ওদের দেমাগ আমি ভাইঙ্গা যদি গুড়া না করছি তোও।আমার নাম মোস্তফা সরোয়ার না।মা,ছেলে দেখা শুরু করেন।পুতুলকে আমি বিয়া দিমু।
-;কি কস তুই?স্বাধীন শুনলে খবর আছে।
-;কি করব আমার?আমার বা*ল করতে ও পারব না।আইন মতে আমি ওর বাপ।তাই আমি যা কমু তাই হইবো।মা’ইয়া বোবা।অল্প বয়সী সুন্দরী আছে।চালচুলোহীন ছেলে দেখ।পঙ্গু পোলা হইলেও হইবো।বিয়া ওর এই বছর দিমু।
-;শুনছি।তোর মাইয়া পড়ে।তার কি হইবো?
-;মাইয়া মানুষ এত পইড়া কি করব?দিন শেষে পরে বাড়িতে গিয়া চুলা গুতাইবো।ওর পড়া লাগব না।সব বাদ।বিয়া দিমু।পরে বাড়িতে যাইয়া ঘর সংসার করব।
-;আইচ্ছা তুই শান্ত হ।বিয়া দিমুনি।তয় আমার একটা কথা বলার ছিল।পুতুল আর কোনো ভাই,বোন নাই।এই সুযোগে পুতুল হাত করতে হইবো।আঠারোতে পা দিলেই আমাদের নামে বাড়ির সম্পত্তি লেইখা নিতে হইবো।সম্পত্তি না পাইলে দুইদিন পর রাস্তায় নামতে হইবো।ফকির হইতে চাস।
-;কেন ফকির কেন?পুতুলকে রাজি করাও।যেভাবেই হোক।সম্পত্তি আমাদের হলেই হলো।এরপর ওহ মরলো না বাঁচলো।তাতে আমার কি?
সারাদিন চলে গেলো পুতুল ঘরে ঢুকার পর আর ঘর থেকে বের হয়নি।খাবার মুখে তুলে নিই।রাতে খাবার রেনু বেড়ে দিতেই মিলন,সাজু আপু কাছে খাবার নিয়ে যায়।
-;আপু,আপু উঠ।তোমার জন্য খাবার আনছি।তাড়াতাড়ি খাও।
পুতুল মাথা নাড়িয়ে না করে দিল।সে খাবার খাবে না।কিন্তু মিলন,সাজু পুতুল কথা শুনতে রাজি নয়।দুইজন ঘরে আসার আগেই সাবান দিয়ে হাত ভালো করে ধুয়ে আসছে।ভাত সাথে লাউ শাক মাখিয়ে বোনের মুখে তুলে দিল।যার মানে হা কর।পুতুল দুইবার মাথা নাড়িয়ে না করে।কিন্তু মিলন হাতে খাবার তুলে বলল।
-;ওরে আল্লাহ আমার হাত ব্যাথা হইয়া গেল। তাড়াতাড়ি মুখে নেও।আমার এতটুকু হাত।তোমার জন্য কতক্ষণ ধরে রাখব বাপ।
মিলন কথা শুনে পুতুল চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।সাজু পাশে বসে হাসছে।পুতুল বুঝতে পারছে।তাকে না খাইয়ে এ থামবে না।তাই চুপচাপ খাবারটা মুখে পুরে নিলো।
একবার মিলন খাবার খাওয়াচ্ছে।আরেকবার সাজু খাবার মুখে তুলে দিচ্ছে।এভাবেই এক প্লেট ভাত শেষ হয়েছে।রাতের খাবারের সাদা ভাত,লাউ শাক ভাজি,আর মুসুরি ডাল ছিল।
তবুও এই খাবারটাতে শান্তি রয়েছে।এটা কষ্টের টাকায় কেনা।হালাল খাবার অল্পতেই পেট ভরে যায়।আর হারাম টাকায় যতই খাবার খাওয়া হয় না কেন?তবুও অভাব অপূর্ণ থাকে।মনে হয় পেট ভরে নিই।আরও খাবার প্রয়োজন ছিল।
দুই ভাইকে ঘুম পারিয়ে পশ্চিম দিকের জানালা খুলে পুতুল দাঁড়িয়ে রয়।আজ তার দুই চোখে ঘুম নেই।শীত শীত করছে তবুও জানালা খুলে দাড়িয়ে আছে।আকাশে বিশাল আকৃতির চাঁদ উঠেছে।তার চারপাশে তারা জ্বলজ্বল করছে।সেই চাঁদ দিকে তাকিয়ে থাকতেই দেখতে পায়।মায়ের হাসিমুখখানা।পুতুল মায়ের মুখটা মনে করেই হাসে,আবার কাঁদে।সামনে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে জানে না?পাঁচ বছর সবকিছু ভালোই চলছিল।তাহলে আবার পাঁচ বছর পর কেন এলো?তার বাবা নামক লোকটা জন্য ঘৃনা ছাড়া কিছুই নেই।সেই লোকটা তার জন্য তার ভাইয়ের জন্য সুবিধাজনক নয়।কে জানে সামনে তার সাথে কি হতে চলেছে?
চলবে…