#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২৩
৭১.
মিলন পড়া না পেরে দুই কান ধরে দাড়িয়ে আছে।ক্লাস টিচার আজকে বিষণ রেগেছে।মিলন,সাজু তাকে জ্বালিয়ে মারছে।এইতো একটু আগের ঘটনা।মিলন পড়া না পেরে সাজুকে কলম দিয়ে খোচাচ্ছিল।তাই স্যার রেগে ক্লাস থেকে বের করে দেন।ফাজিল দু’টো স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।
পুতুল ক্লাস রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে দুই ভাইয়ের কান্ড কারখানা।বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা সমানে ব’লে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে একে অপরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করছে।কি হয়েছে বুঝতে পারছে না?তবুও পুতুল তাকিয়ে রয়।এরমধ্যে ক্লাসের স্যার পুতুল যে অমনোযোগী সেটা দেখতে পেয়ে দাড় করায়।জানতে চায় কি সমস্যা?পুতুল মাথা নাড়িয়ে না ব’লে।
সমস্যা নেই যখন পড়ায় মনযোগ দেওয়া।কথাটা শেষ করে স্যার আবার বই দেখে পড়াতে শুরু করেন।পুতুল বইয়ের দিকে মনযোগী হয়।
শেষ পিরিয়ডের ঘন্টা পরতেই একে একে ক্লাস কক্ষ ছেড়ে বের হয়।মিলন,সাজু কান ছেড়ে চুপচাপ ক্লাস রুমে গিয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হয়।
দূরে যা?আমার সাথে কথা কবি না।যদি কথা কস?তাহলে মনে করব!তুই মরা মুরগী গু খাস।
ওয়াক্ক।ছি,মিলনের বাচ্চা এগুলো কি বলছিস?
আমি ঠিকই কইছি।আর আমি মিলন।শুধুই মিলন।এখানে মিলনের কোনো বাচ্চাটাচ্চা নেই।তোর আর আমার বাপের তিনখানা বাপ আছে।একটা বাড়িতে।আর বাকি দুইটা স্বাধীনের বাচ্চা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে।কথাগুলো শেষ করে দুই ভাই দুইদিকে গিয়ে বসে আছে।
পুতুলের আজ একটু দেড়ি হয়েছে।সে স্কুলের প্রাঙ্খনে দাঁড়িয়ে দুই ভাইকে হাত দিয়ে ডাকতে লাগল।কিন্তু দুইজনই এমন গাল ফুলিয়ে বসে থাকার কারণটা বুঝতে সময় লাগলো।এরা আবার ঝগড়া করছে।উফ,এরা আর ভালো হলোনা।পুতুল রেগে ওদের রেখে হাঁটা শুরু করলো।যার মানে আজকে সে এদের পাত্তা দিবে না।পুতুল একা একা চলে যাচ্ছে ব’লে সাজু,মিলন একসাথে দৌড়ে পুতুলের পিছন পিছনে হাঁটতে শুরু করে।পুতুলের পিছনে সাজু,মিলনকে আসতে দেখে সে হাঁটা বন্ধ করে পিছনে তাকায়।পুতুল দেখাদেখি তারাও পিছনে তাকায়।পুতুল হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলে তারাও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়।পুতুল থেমে গেলে তারা ওহ থেমে যায়।এভাবেই পুরো রাস্তা শেষ করে বাড়িতে পা রাখে।
পুতুল প্রতিদিন ভাইদের গোসল করিয়ে দেয়।আজকে সে চুপচাপ।সে গোসল করে নামাজ পড়ে,বিছানা চোখ বুজে সুয়ে আছে।সাজু,মিলন একসাথে মাথা চুলকে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রয়।যার মানে আপু আজকে বেশি রাগ করছে মনে হয়।তাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেও না।নিজেরাই গোসল ঘরে গেলো।মাথায় পানি দিয়ে সাবান চোখে লাগিয়ে এমন চিতকার মারছে।পুতুল,রেনু ভয় পেয়ে দৌড়ে আসে।সাজু,মিলন এর কান্ডে দু’জনই ভ্যাবাচ্যাকা গেলো।রেনু রেগে গিয়ে দু’টোকেই পিঠের মধ্যে ঠাসস ঠাসস করে থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো।মায়ের হাতের মা’র খেয়ে কলপাড়ে কান্না করছে।একে তোও চোখ জ্বলছে সাবানের ফ্যানার জন্য।আবার পিঠে থাপ্পড় পড়ায় পিঠ জ্বলছে।পুতুল চুপচাপ দুই হাত ভাজঁ করে দাঁড়িয়ে রইল।রেনু,মিলন,সাজুকে গোসল করিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে।সাজু তোয়ালে দিয়ে একটু পর পর চোখের আর নাকের পানি মুছে যাচ্ছে।আর মিলন চোখের পানি,নাকের পানি তোয়ালে দিয়ে না মুছে বসে আছে।মনের সুখে কান্না করছে।চোখের পানিতে গাল ভিজে আছে।নাকের সর্দি নাক থেকে বের হয়ে শূন্যে দুলনি খাচ্ছে।তবুও সে পরিষ্কার করবে না।এরজন্য যদি স্বাধীন মিয়ার বাড়ি ডুবে যায় তোও ডুবে যাক।এতে তার কিছু যায় আসে না।
সাজু নাকটা আবার মুছে খাটের ওপর গড়িয়ে কান্দে কান্দে উচ্চস্বরে বলল,
আজ আব্বা নেই ব’লে আমাদের ধরে মারছো।আব্বা খালি বাড়িতে আসুক।আমি বিচার দিমু রে…!ওই আব্বা গোও।রেনু আম্মা আমারে মাইরা লাশ বানাইয়া ফালাইছে।ওরে আব্বা রে…ওই আমার আব্বা গোও।আমারে বাঁচাও গোও…!পুতুল ঘরে ঢুকেই থ হয়ে গেছে।
এই মরা কান্না বন্ধ করবি না-কি শোলার ঝাড়ুটা নিয়ে আসবো।রেনু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুই ছেলেকে ধমক দিচ্ছে।পুতুল কি করবে বুঝতে পারছে না?তার হাতটা অটোমেটিক মাথায় চলে গেছে।
৭২.
রমিজ মেম্বার হুক্কা টানতে টানতে বলল,
কি’রে খবর কি?আজকে কয়েকদিন ধরে দেখছি স্বাধীনের খবর নেই।
ওটা কি মরছে না-কি?
আরে না স্যার।স্বাধীন না-কি ঢাকায় গেছে শুনলাম।
কস কি?এটা তো ভালো খবর!
আগে পুরো কথা হুনেন।
আচ্ছা বল।
সে ঢাকায় গেছে এটা সত্যি।কিন্তু অন্য কামে।ওই যে তার বাড়িতে সুন্দরী পিচ্চি বোবা মাইয়াখানা আছে না।কি যেনো নাম?হয়,পুতুল। মাইয়া নাম পুতুল।সেই মাইয়া না-কি নকশি কাঁথা সেলাই করে।সেগুলো নিয়ে ঢাকায় গেছে।বিক্রি করবে ব’লে।
পুতুল। ওহহহ।ওই বোবা ছেড়ি।যার মা পালাইয়া গেছিলো।তার প্রেমিক নাগরের লখে।
হয়।
নজরে রাখ।স্বাধীন কবে গ্রামে পা রাখে?আসলেই আমারে জানাইবি।
ঠিক আছে।
হুম এখন ভাগ।
আজ পনেরো দিন পর স্বাধীন গ্রামে ফিরে যাচ্ছে।পরিবারের জন্য এতদিন মনটা ছটফট করছে।কেমন আছে তারা,খুব জানতে ইচ্ছে করতো?তবুও খবর নিতে পারেনি।আজ বাসায় গিয়ে সবাইকে একসাথে দেখে চোখ জুড়িয়ে নিবে।সবাইকে দেখে মন শান্ত করবে।কতদিন হইছে বউ,পোলাপান থুইয়া এই অজানা শহরে রাত কাটিয়েছে।কষ্ট লাগতো।তবুও মনরে একটা কিছু দিয়ে বুঝ দিত।কষ্ট কাদের জন্য করছি?তাদের জন্যই তোও এই কষ্ট করা।
পুতুলের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে।নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত।সংসারের কোনো কাজে তার হাত দেওয়া বারণ।রেনু সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছে।পরীক্ষা শেষ হলে যেনো সংসারের কাজে হাত লাগায়।পুতুল মামীর কথাগুলো মেনে নিয়েছে।আর সাজু,মিলন নিজেদের দুষ্টুমি নিয়েই আছে।কিন্তু সেইদিন মায়ের মারের কথা ভুলেনি।সেটা মাথায় রাখছে।আব্বা আসলেই সবটা ব’লে দিবে।
৭৩.
রেনু,সাজু,মিলন,পুতুল আম্মা।তোমরা কই?
রেনু,স্বামীর কন্ঠ পেয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে।স্বাধীন কিছু বলার আগেই রেনু উঠোনের মধ্যেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে।স্বাধীন হাতের ব্যাগটা ফেলে বউকে জড়িয়ে ধরে।কপালে চুমু বসিয়ে বলল,
আরে বউ কান্দ কেন?আমি আইসা পড়ছি তোও।আমি ভালা আছি।
তুমি কেমন ভালো আছোও?তা তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি আমি।চেহারা শুকিয়ে কাঠ।সুন্দর মানুষটা কালো হয়ে গেছে। ঢাকায় কি অনেক কষ্ট?এমন শুকিয়ে গেছো কেন?ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো নাই।
আসলে বউ ঢাকায় তো তুমি নাই।তোমার রান্না খাইতে না পাইরা আমি শুকাইয়া গেছি।
এখন যেহেতু চলে আসছি।তাহলে আমার বউয়ের মজার মজার খাবার খেয়ে ঠিক হয়ে যাব।আমাকে আবার আগের মতো লাগবে।স্বাধীন বউয়ের কথা ঘুরাতে বলল,
তা বাকিরা কই দেখছি না যে?
ওরা আছে আশেপাশেই।তোমার গলা পেলেই চলে আসবে।রেনু,পুতুলকে ডাকতেই মাগরিব নামাজ পড়া শেষ করে।ঘর থেকে বের হয়।দুই বাঁদর আগেই দৌড়ে আব্বাকে জড়িয়ে ধরে।তাদের বিচারের শেষ নেই।স্বাধীন ছেলেদের দেখে পান জুড়িয়ে যায়।সাদা পাজামা -পাঞ্জাবি পড়া।মাথায় সাদা টুপি পরে আছে।দেখেই মনে হচ্ছে।মাএ নামাজ পড়ে এসেছে।রেনু,পুতুলকে ডেকেই ছোট ছেলেকে ঘর থেকে আনতে যায়।
আব্বা আমি তোমারে কত মিস করছি।আম্মা পচাঁ আমাদের ভালোবাসে না।আমারে এমনে এমনে মারছে।মিলন,সাজু হাত পা দেখাতে লাগল।আব্বা,তুমি আম্মার বিচার করবা।স্বাধীন হেঁসে উঠে।
ওহ রেনু!তুমি নাকি আমার ছেলেদের মারছো।হুম,এটা কি ঠিক হইলো?আমার আব্বাগুলো কত ভালো?তারা কি করছে?রেনু ঘর থেকে ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে উঠোনে আসে।
আমি তো ওগো সৎ মা।তাই খালি শুধু মারি। ভালোবাসি না।আর তারা যা করে সব ভালো করে।একদম সাধু বাবা।
পুতুল বারান্দায় এককোনায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে।সবার মতো সে দৌড়ে আসেনি।স্বাধীন,রেনুর কোল থেকে ছোট ছেলেকে নিয়ে কপালে চুমু বসিয়ে,আদর করলো কিছুক্ষণ।তারপর রেনু কোলে তুলে দিল।
স্বাধীন এগিয়ে এসে পুতুলের মাথায় হাত রাখে।ডেকে ওঠে।
আম্মা।আম্মা।ওহ আম্মা।আমার আম্মা।কপালে মাঝে একটা চুমু দিয়ে জিজ্ঞেস করে।
আম্মা তুমি কেমন আছো?পুতুল দুই চোখের পানি মুছতে মুছতে ইশারায় বলল,
সে ভালো আছে।পুতুলের চোখের পানি বন্ধ হয় না।সে যতই চোখের পানি মুছে ততই চোখ থেকে আরো বেশি পানি বেরিয়ে আসে।চোখ দু’টো আজ এতটা বেহায়া কেমনে হলো?পুতুল বুঝতে পারে না।এতদিন নিজেকে সামলে নিলেও আজ মামাকে দেখে বেশি আবেগি হয়ে গেছে।
মামাকে হালকা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে ফুফিয়ে ওঠে।স্বাধীন,পুতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।চারদিকে তাকিয়ে দেখে পরিবারের প্রত্যেকের মুখে হাসি লেগে আছে। স্বাধীনের বাড়িতে আজ ঈদের খুশি লেগেছে।
স্বাধীনের চোখ দুটো জুড়িয়ে গেলো।রাতের আধারের ওই আকাশ দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,এটাই আমার জান্নাতের বাগান।আমার সুখ।আমার মতো এতোটা সুখী আর কেউ নেই।আমি পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ।আল্লাহ তোমার নেয়ামত খেয়ে আমি ভালো আছি।সুখেই আছি।শত কোটি শুকরিয়া তোমার দরবারে।
ঘর টা যদি সুখের হয়।
তারে জানি স্বর্গ কয়।
ভালোবাসার মাঝে স্বর্গ,
আর কোথাও নয়?
চলবে…..
ইচ্ছে করছে আজকেই সমাপ্ত টেনে দেই।কিন্তু মস্তিক বলছে,কিছু মানুষের কটু কথায় গল্পের মাঝে সমাপ্তি টেনো না।৫০ পর্বের গল্পটা নষ্ট করো না।সবুর করো।সবুরের ফল মিষ্টি হবে।এখনো গল্পের অনেক কিছু বাকি।