#চন্দ্রকলা
#লামিয়া_ইসলাম
#পর্ব_৩
-খারাপ কিছু ঘটেছে বেপারী বাড়িতে।
-কি হয়েছে?
-হবু বৌমা নাকি হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। কিছুতেই জ্ঞান ফিরছে না।
-তাহলে সামিরাকে ওই বাড়িতে পাঠাও। ও গিয়ে দেখে আসুক। কি হয়েছে?
ছেলে সাফোয়ানের কথা শুনে শিরিন বেগম তার ভাইজি ডা.সামিরাকে চন্দ্রের বাড়িতে পাঠালো। সামিরার সাথে সাহেদ ও গেলো। সামিরা আর সাহেদ বেপারী বাড়িতে ঢুকতেই দেখলো চন্দ্রের রুমের সামনে অনেক ভিড়। সামিরা ভিতরে ঢুকতেই দেখতে পেলো শাহনাজ চন্দ্রের মুখে পানির ছিটা দিচ্ছে।
-আম্নেরা কারা? চিনলাম না তো। না বইলাই মাইয়া মানুষ ভরা ঘরে একটা পোলা মানুষ সহ ঢুইকা পড়লেন।
-আমরা জমিদার বাড়ি থেকে এসেছি। আমি শিরিন বেগমের ভাইজি সামিরা। আর ও জমিদার বাড়ির ছোট ছেলে সাহেদ। এবার নিশ্চয়ই আমাদের পরিচয় পেয়েছেন।
-বরযাত্রী কি এইর মধ্যেই আইয়া পরসে?
-না। আমি আপনাদের বাড়ি চিনি না তাই সাহেদ আমাকে নিয়ে এসেছে। আমি একজন ডাক্তার। চন্দ্রর কি হয়েছে দেখতে এসেছি।সামনে থেকে সরুন। আর রুম থেকে সবাই বের হোন তাড়াতাড়ি।
সামিরা একজন ডাক্তার এই কথা শুনেই রিমা আর রাহেলা বানুর মনে কামড় দিয়ে উঠলো। তারা ভয় পেতে লাগলো কেউ যদি তাঁদের করা নিকৃষ্ট কাজের কথা জেনে যায়। একে একে সবাইকে বের করে দিয়ে সামিরা চন্দ্রের হাতের পালস পরীক্ষা করলো। তার সাথে আনা ডাক্তারি ব্যাগ থেকে প্রেসার মেশিন বের করে প্রেসার মাপলো। তারপর ব্যাগ থেকে একটা ইনজেকশন বের করে চন্দ্রের শরীরে পুশ করলো।
-চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। ও হয়তো বিয়ে নিয়ে চিন্তায় ছিল। তাই প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে। একটা ইনজেকশন দিয়েছি। কিছুক্ষনের মধ্যেই জ্ঞান চলে আসবে। আর প্রেসার ও লো। হয়তো তার জন্য অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষন রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যাবে। আমি এখানেই আছি। দরকার পড়লে আমাকে ডাকবেন।
চন্দ্র ঠিক আছে শুনেই সাহেদ ফোনে করে সাফোয়ানকে জানাতে গেলো। আর সামিরা চন্দ্রের ঘর থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে চন্দ্রদের পুকুরপাড়ে গেলো।
——————————–
-মা। তোমার হবু বৌমা ঠিক আছে। লো প্রেসারের জন্য অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। আর কিছুই না।
– আলহামদুলিল্লাহ। তোদের বিয়ে ঠিকমতো সম্পন্ন হলে আমি দুই রাকাত নফল নামাজ পড়বো। আর বৌমার নাম একটা গরু সদকা দিবো। এখন যা যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। জুমার নামাজ পরে বেপারী বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিবি।
সাফোয়ান তার মায়ের কথায় সায় জানিয়ে চলে গেলো। শিরিন বেগম বধূ বরণের জন্য জিনিসপত্র নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো।
চন্দ্রের শুধুমাত্র প্রেসার লো হওয়ার জন্য অজ্ঞান হয়ে গেছে শুনে রিমা আর রাহেলা বানু যেন চমকে গেলো। তারা একে অপরের দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো। রাহেলা বানু রিমাকে টেনে তার ঘরে নিয়ে এলো।
-এই তুই ঠিকমতো আনছিলি কীটনাশকের বোতলটা। না অন্য বোতল লইয়া আইসোস।
-আমি ঠিক বোতলটাই আনছিলাম। জানিনা ওই কিভাবে বাইচ্চা গেলো। চলো মা এখন অন্যভাবে চেষ্টা করি ওরে মারার।
-পাগল হইসোস।অহন আর কিছুই করার যাইবো না। দেহস নাই ওর শশুর বাড়ির লোক আইয়া পড়ছে। ওই মাইয়াডা নাহি ডাক্তার। এখন কিছু করলে ধরা খাইয়া যামু। এখন ওই টাহাডা লইয়াই খুশি থাহোন লাগবো।
সামিরা পুকুর পাড়ে একটা সিঁড়ির ওপর বসে আছে। হঠাৎ করে সে বুঝতে পারলো তার পিছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সে তাকাতেই দেখলো সাহেদ তার দিকে এক নজরে তাকিয়ে আছে।
-তুই এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
-না দেখলাম তুমি একা এভাবে বসে আছো। তাই তোমাকে সঙ্গ দিতে আসলাম।
– দেখ সাহেদ তুই যা চাচ্ছিস টা কখনো সম্ভব না। আমি তোর থেকে বয়সে ২ বছরের বড়। আমাদের পরিবার বা সমাজ কখনো এই সম্পর্ক মানবে না। তাই শুধু শুধু ঝামেলা করিস না।
-কেন মানবে না? আমি তো তোমাকে প্রেম করতে বলছি না। তুমি বললে কালই তোমাকে আমি বিয়ে করবো। আমি সাহেদ চৌধুরী একবার যা বলি আমি তাই করি।
সামিরা বুঝতে পারলো সে সাহেদকে যতই বলুক সাহেদ ওর কথা শুনবে না। গত ৩ বছরে ও অনেক বার সাহেদ কে বলেছে কিন্তু কোনো লাভ নেই। সাহেদ তার কথায় অনড়। তাই সে অগত্যা সেখান থেকে উঠে চলে গেলো। আর সাহেদ তার ভগ্ন হৃদয় নিয়ে পুকুরে ঢিল ছুড়ে তার দুঃখ বিলাস করতে লাগলো।
দুপুর তিন টায় বরযাত্রী এসে চন্দ্রদের বাড়িতে পৌছালো। ইতোমধ্যেই চন্দ্রের জ্ঞান ফিরেছে। চন্দ্রের জ্ঞান ফিরতেই অনিমা চন্দ্রকে আবার পরিপাটি করে দিলো। বিকাল তিন টায় ১০ লক্ষ ১ টাকা দেনমোহর ধার্য করে চন্দ্র জমিদার সাফোয়ান চৌধুরীর সাথে চিরজীবনের বাঁধনে বাধা পড়লো। বিদায় বেলায় চন্দ্র তার বাবার কাছে গেলো। তার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকেই তার বাবা কিরকম যেন করছে। এমন করছে যেন কিছু বলার চেষ্টা করছে। চন্দ্র যখন বধূ সাজে তার বাবার রুমে গেলো তাকে দেখে তার বাবার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে লাগলো। কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না। বুকভরা ব্যথা নিয়ে ফুল দিয়ে সাজানো পালকিতে উঠে চন্দ্র চৌধুরী বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
পালকি যখন চৌধুরী বাড়িতে পৌছালো সাঁঝের সময়। আসমান আবছা কালো হয়ে এসেছে। পাখিগুলো নীড়ে ফিরছে। ঠিক তখনি চন্দ্রর এই জমিদার বাড়িতে পা রাখলো। শিরিন বেগম আর সামিরা ধীরে ধীরে করে চন্দ্রকে নিয়ে চৌধুরী বাড়িতে প্রবেশ করলো।
চন্দ্রকে জমিদার বাড়ির বিশাল হলরুমে বসানো হয়েছে। আমেনা বেগম তাকে মিষ্টিমুখ করালো। শিরিন বেগম তার গলায় একটি মোটা স্বর্ণের চেইন পরিয়ে দিলো। আশেপাশে থেকে অনেকেই জমিদার সাফোয়ান চৌধুরীর বৌ এই জমিদার বাড়ির নতুন মালকিনকে দেখতে এসেছে। একটু রাত হয়ে এলেই সবাই আস্তে আস্তে বাড়ি যেতে লাগলো। চৌধুরী বাড়ির হলরুমের ভিড় ও ধীরে ধীরে কমে এলো। সবাই চলে যেতেই শিরিন বেগম চন্দ্রকে উপর তলায় সাফোয়ানের কক্ষে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলো।
সামিরা চন্দ্রকে সাফোয়ানের কক্ষে নিয়ে গেলো। সামিরা চন্দ্রের হাতে একটা লাল তাঁতের শাড়ি দিয়ে তাকে তাকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বললো। আর সে চন্দ্রের জন্য খাবার আনতে নিচে চলে গেলো। চন্দ্র লাল শাড়িটা পরে বাহিরে আসতেই দেখলো সামিরা তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। চন্দ্র আসতেই সামিরা বললো,
-বাহ আপনি তো খুব দ্রুত শাড়ি পড়েন ভাবি। আমি আবার এত ভালো শাড়ী পড়তে পারিনা। ইস আমার তোঃ মনে নেই আমার পরিচয় দিতে। আমি সামিরা। আপনার মামাতো ননদ। এখন আসুন তাড়াতাড়ি। খেয়ে নিন। সাফোয়ান ভাইয়া এসে পড়বে।
সাফোয়ান চৌধুরীর নাম শুনতেই চন্দ্রর কেমন যেন একটা আলাদাই অনুভূতি হলো। তার পুরো শরীরে আলাদাই এক শিহরণ বয়ে গেলো। এই মানুষটাকে সে অনেক বার দূর থেকে দেখেছে কলেজে যাওয়ার সময়। সবার কাছে শুনেছে সে অনেক রাগী মানুষ। কিন্তু মানুষটা নাকি সবার অনেক উপকার করে। আর আজ সে এই মানুষটার ঘরেই বৌ হয়ে এসেছে। এই মানুষটার মন সে জয় করতে পারবে তো। খাওয়া শেষে সামিরা রুম থেকে বের হয়ে গেলো। চন্দ্র বেশ কিছুক্ষন যাবৎ সাফোয়ানের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
রাত তখন দুইটা। চারদিকে ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ।তখন সাফোয়ান বাড়িতে এলো। সে আব্দুল মিয়ার দাফনকার্যের জন্য গিয়েছিলো। সে ভাবতে লাগলো বাড়িতে ঢুকেই তার মায়ের ঘরে যাবে। হয়তো দেরি করে বাড়িতে আসার কারণে তার মা অনেক রেগে আছে। বাড়িতে ঢুকেই যেই না সে তার মায়ের ঘরের দিকে যাবে হঠাৎ সে কিছু পরে যাওয়ার শব্দ পেলো দোতালায়। তাই সে তড়িঘড়ি করে দোতালায় উঠলো। কিন্তু দোতালায় উঠে সে যা দেখলো টা দেখে সে বিস্মিত হয়ে গেলো। কারণ সে দেখলো এক লাল শাড়ি পরিহিত অপূর্ব সুন্দরী নারী তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।দোতলার বারান্দা থেকে আসা চাঁদের আলোয় সেই সুন্দরী নারীর চেহারা দেখা যাচ্ছে। বাহির থেকে আসা ফুরফুরে বাতাসে তার কোমর পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো উড়ছে।আর তার পায়ের কাছেই ছুরিবিদ্ধ হয়ে পরে আছে তাঁদের বাড়ির কাজের মহিলা রাজিয়া। এই লোমহর্ষক দৃশ্যটা ছিল খুবই ভয়াবহ রকমের সুন্দর।
হঠাৎ করেই নারীটি চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে গেলো । সাফোয়ান দৌড়ে এসে নারীটিকে আগলে নিলো তার বক্ষস্থলে। চন্দ্রর জ্ঞান ফিরতেই সে দেখতে পেলো তার আশেপাশে বাড়ির সবাই এসে জড়ো হয়েছে। তার শাশুড়ি শিরিন বেগম তার শিয়রে বসে আছে। সে উঠে বসেই অস্থির হয়ে বলতে লাগলো,
-আমি এখানে। আমি একটু আগে রুমের সামনে একটা লাশ দেখেছি। খুব ভয়ানক বিশ্রী অবস্থায় ছিল লাশটা।
-মা শান্ত হও। কিছু হয়নি সব কিছু ঠিক আছে। শান্ত হয়ে যাও।
শিরিন বেগম ধীরে ধীরে চন্দ্রের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করলো। এমন সময় সাফোয়ান রুমে প্রবেশ করলো। সে কণ্ঠে গম্ভীর্যভাব নিয়ে বললো,
-থানা থেকে পুলিশ এসেছে। তারা চন্দ্রকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়।
-জিজ্ঞাসাবাদ মানে? তারা কি মনে করেছে আমার বৌমা দোষী।
-আম্মি শান্ত হও। ওনারা শুধু চন্দ্রের সাথে কিছু কথা বলতে চায়। আর কিছুই না। তুমি শান্ত হও।
-কথা বলতে চায় মানে কি আমি বুঝি না। এই বাড়িতে মেয়ে টা আসতে না আসতেই ওকে পুলিশের সামনে জবাবদিহি করতে বসিয়ে দেবো।
-ফুফি তুমি বোঝার চেষ্টা করো। খুনটা যেহেতু এই বাড়িতে হয়েছে।আর চন্দ্র ভাবি প্রথমে দেখেছে তাই তাকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাইছে। তুমি চিন্তা করোনা। চন্দ্র ভাবীকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় আমি উনার সাথে থাকবো।
সামিরার কথায় আশ্বস্ত হয়ে শিরিন বেগম চন্দ্রকে জিজ্ঞাসা বাদের জন্য অনুমতি দিলো। চন্দ্র মাথায় ঘোমটা দিয়ে সামিরার সাথে গিয়ে ড্রয়িং রুমে ইন্সপেক্টরের সামনে গিয়ে বসলো।
চলবে…………..
(চন্দ্রকলা গল্প টা আপনাদের কাছে এত ভালো লাগছে শুনে আমি সত্যিই অনেক কৃতজ্ঞ আপনাদের প্রতি। বেশি বেশি করে লাইক কমেন্টস করুন। আর কমেন্টসে শুধু নেক্সট নেক্সট না লিখে গল্প সম্পর্কে আপনাদের মতামত জানান। এতে আমি আরো উৎসাহিত হয়ে তাড়াতাড়ি পরবর্তী পর্ব পোস্ট করবো।)
গ্রুপে জয়েন করুন আর চন্দ্রকলা গল্পটা নিয়ে বেশি বেশি পোস্ট করুন তাহলে পরবর্তী পড়বো তাড়াতাড়ি পাবেন।
গ্রুপ লিংক :
https://facebook.com/groups/3532259070436906/