#লুকোচুরি_গল্প
#পর্ব_১৪
#ইশরাত_জাহান
🦋
সকাল সকাল ঘুম উঠে নীরা ফ্রেশ হয়ে চলে গেলো রান্নাঘরে।তখন ঠিক সাতটা বাজে।শীতের সকাল।নীরার মতো মেয়ের এই সময় কম্বল জড়িয়ে ঘুমানোর সময়।কিন্তু সে আজ রান্নাঘরে তাও কাপতে কাপতে এসেছে।মিসেস সাবিনা,মিসেস শিউলি ও দীপান্বিতা যখন নীরাকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে যায়।নীরা তাদের তাকানো দেখে চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞাসা করে,”কি হয়েছে?”
মিসেস শিউলি শাড়ির উপর চাদরটা ঠিক করতে করতে বলে,”নাতবৌ তুমি তো এত সকালে উঠবার পাত্রী না।আজ কি দেইখা উঠলা?”
দাদী রসিকতা করে বললেও পিংকি হাসতে হাসতে বলে ওঠে,”তোমার নাতবৌয়ের দেখো রাতের ঘুম ঠিক মত হয়নি।যে ডোজ দেওয়া হয়েছিল তাকে।রাতে তো না খেয়েই ভাং ধরে ঘুমিয়েছিলো।তাই হয়তো এখন এসেছে তাড়াতাড়ি খাওয়া দাওয়া করতে।”
নীরা কাজের রমণীদের মত করে ওড়না কোমরে বেধে বলে,”আমার বর একটু পড়ে নিজের কাজে যাবে।বউ হয়ে তো আর ঘরে বসে থাকতে পারি না।ডাইনিদের নজর পরে যাবে যে।তাই আমার জামাইয়ের উপর দিয়ে নজরদোষ সরানোর পাঁয়তারা করতে শুরু করেছি।”
কেউ বুঝলো না কথার মানে।কিন্তু এইটুকু বুঝেছে যে পিংকিকে ইঙ্গিত করে বলেছে।দীপান্বিতা বলে ওঠে,”মানে?”
“একটু পর আমার উনি ঘুম থেকে উঠবেন।এমনিতেই আমি না খেয়ে ছিলাম বলে তিনিও না খেয়ে আছেন।বউ হয়ে কি জামাইকে এত কষ্ট দিতে পারি!তাই এখন আমি নিজে আমার বরের জন্য রান্না করবো।তারপর আমি আর আমার জামাই একসাথে সকালের খাবার এক ঘরে খাবো। আশা করি কারো বদ নজর পড়বে না আমাদের নব দম্পত্তির উপর?”
মিসেস শিউলি নীরার রান্নার কথা শুনে অবাক হলেও পিংকিকে খোঁচা মারাতে খুশি হয়েছেন।তিনি বলেন,”কিসের সমস্যা হইবো নাতবৌ!কোনো সমস্যা নাই।আরে বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী একসাথে থাকে তবেই না ভালোবাসা বাড়বে।তুমি রান্না করতে পারবা নাকি আমরা সাহায্য করবো?”
“আজ প্রথম দিন রুটি বানাবো।আমাকে একটু দেখিয়ে দেও।এরপর থেকে আর দেখাতে হবে না।আমাকে শিখিয়ে দিলে আমি শিখে যাই।”
সবাই মিলে নীরাকে সাহায্য করলো।সাহায্য বলতে মুখে মুখে বলে দেয় আর নীরা সেভাবে আটা মাখিয়ে রুটি বেলতে থাকে।সবজি সিদ্ধ করতে দেয় তারপর তেলে দিয়ে ভাজি করে।পরিমাণগুলো সব মিসেস সাবিনা বলে দেন।
সবকিছু পারফেক্ট হইলেও পারফেক্ট হয়না নীরার রুটির সেপগুলো।একটি এশিয়া মহাদেশের মানচিত্র তো আরেকটি আফ্রিকা মহাদেশের।একেক রুটি একেক রকম হয়েছে।
সবাই মিটমিট হাসতে থাকে রুটিগুলো দেখে।অভ্র ঘুম ঘুম চোখে মাত্র এসেছে।রুটিগুলো দেখে বলে ওঠে,”মামী তুমি ডিজাইন করে রুটি বানিয়েছো?কি মজা আজকে অন্য রুটি খাবো।”
বলেই হাত তালি দেয়।ছোট অভ্র কি আর বুঝে যে এগুলো না পারার কারণে হয়েছে।সে তো ভিন্ন সাজের কিছু দেখলে তাতেই খুশি হবে।
পিংকি নীরাকে পিঞ্চ মেরে অভ্রকে বলে,”নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা।তোমার মামী পারেনা তো করবে কি।এগুলো করতে যোগ্যতা থাকা লগে।”
ড্রয়িং রুমে মিস্টার সমুদ্র চা উপভোগ করছেন আর খবরের কাগজ দেখছেন।পিংকির শেষের কথাটি তার পছন্দ হয়নি।তিনি সচরাচর মেয়েদের কথায় বাম হাত ঢুকায় না।তবে আজ নীরার হয়ে প্রতিবাদ করে বলেন,”আজকালকার মেয়েরা ঘরের কাজ করতে চায় না।সেই তুলনায় আমার বউমা কিছু না পারলেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পারফেক্ট বউ হওয়ার।এটাই কি কম নয়?কাউকে সাহায্য করতে না পারো কিন্তু তাকে দুর্বল করতে উঠেপড়ে লাগাটা একটা অন্যায়।পাবলিকের সামনে তুমি আজ যাকে অপমান করবে ওই পুবলিক গুলো কিন্তু একসময় তোমার দিকেও আঙুল ঘুরিয়ে দিবে।এটা মাথায় রেখো।”
পিংকি আর কোনো প্রতিউত্তর করে না।খারাপ হলেও সে মিস্টার সমুদ্রকে মামার মত করেই ভালোবাসে।মায়ের মত সম্পত্তির আশায় লোভ দেখানো সম্পর্ক পিংকি করেনি।শুধু দ্বীপের প্রতি পিংকির এক আলাদা দুর্বলতা।
নীরার বানানো রুটিগুলো প্রথমদিকে খারাপ হলেও শেষের গুলো অনেক সুন্দর হয়েছে রাউন্ড আকারে হয়েছে।ভালো ভালো রুটিগুলো নীরা মিস্টার সমুদ্র ও মিসেস শিউলিকে দিয়েছে।বাকিগুলো বাড়ির অন্যান্য সবাই খাবে।সবার খাবারের ব্যাবস্থা করে নীরা নিজের ও দ্বীপের জন্য খাবার সাজিয়ে নেয়।তারপর ঘরের দিকে যেতে থাকে।কিছু একটা ভেবে ঘরে যাওয়ার আগে পিংকির কাছে এসে পিংকির কানে কানে বলে,”পাঁচ মিনিটের একটি ডোজ দেখেই তুমি এত খুশি!আফসোস,বাকি ২৩ ঘণ্টা ৫৫ মিনিটের ডোজ গুলো দেখতে পাও না।যে আমাকে থাপ্পড় দিয়েছে সে কিন্তু তা উশুল করেও নিয়েছে।ঘরের বাইরের লোক তুমি তাই বাইরের দিকটি দেখতে পাবে।ভিতরের কাহিনী তো ভিতরের লোকগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ।”
কথাগুলো বলেই নীরা চোখ টিপ দিলো।তারপর প্রস্থান করলো ঘরের দিকে।
ঘরে এসে নীরা দেখতে দ্বীপ ঘুমিয়ে আছে।ঘুমের ঘোরেও কি না তার চোখে চশমা।দ্বীপের পাশের যে জায়গাটিতে নীরা ঘুমায় ওখানে মিনি ঘুমিয়ে আছে।নীরা দ্বীপকে ডাকতে লজ্জা পাচ্ছে।কিভাবে ডাকবে বুঝতে পারছে না।যতই এদিক ওদিক লড়াই করুক তার কি লজ্জা কম নাকি।ডান হাত দিয়ে দ্বীপের বাহুতে আলতোভাবে নাড়া দিলো নীরা। আস্তে আস্তে কাপা কাপা হাতে দ্বীপকে ঝাকানি দিচ্ছে আর বলছে,”ক্যাডার সাহেব উঠুন।সকাল হয়েছে তো।একটু পর আপনাকে কলেজে যেতে হবে।”
বার কয়েক ডাকার পর দ্বীপ চোখ খুলে।চোখ খুলেই নীরাকে দেখে অবাক হয়ে বলে,”কি হয়েছে?”
“তারাতারি ফ্রেশ হয়ে আসুন।আপনাকে কলেজে যেতে হবে না?”
অবাক হলেও দ্বীপ চলে গেলো ফ্রেশ হতে।তারপর ঘরে আসতেই নীরা বলে,”এই নিন আপনার আর আমার জন্য নাস্তা এনেছি।একসাথে খাবো আমরা।”
কি হচ্ছে না হচ্ছে সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে দ্বীপের।এক থাপ্পড়ে কি নীরা বর পাগল হয়ে গেলো নাকি!কিছু না বলে খাটে বসলো দ্বীপ।নীরা এক প্লেটে সবজি নিয়ে তাদের মাঝখানে রাখলো।তারপর বলে,”এই নিন আমরা এক প্লেটে করে দুজনে খাবো।”
এমনি শীতের ঠান্ডা তার উপর নীরার এই রোমান্টিক কথাবার্তা শুনে শুকনো কাশি উঠলো দ্বীপের।বেচারা দ্বীপ একসাথে এতকিছু মেনে নিতে পারছে না।নীরা সাথে সাথে কুসুম গরম করা পানি ফ্লাক্স থেকে বের করে দ্বীপকে দিয়ে বলে,”এই নিন পানি।আপনার ঠান্ডার সমস্যা আছে।তাই আমি গরম পানি এনেছি।”
দ্বীপ চুপ করে পানি পান করলো।পানি পান করার পর দ্বীপ নীরার বানানো রুটিগুলো দেখলো।রুটির সেপগুলো দেখে দ্বীপ মনে মনে হাসতে থাকে।তার বউ পারে না তাও চেষ্টা করে এনেছে।এখন সরাসরি কিছু বললে কষ্ট পাবে।তাই চুপ করে নীরার সাথে এক প্লেটে রুটি ও সবজি খেলো।রুটি খেতে খেতেই দ্বীপ বলে,”একদম পারফেক্ট হয়েছে।সবজির ঝাল মশলা ঠিক ঠিক এবং রুটিও খেতে মজা হয়েছে।কিভাবে করলে?”
“আমি তো শুধু হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে সব করেছি।পরিমাণগুলো সব মামনি বলে দিয়েছিলো।”
বিয়ের পর থেকে নীরা দ্বীপের মা মিসেস সাবিনাকে মামনি বলে ডাকে। দ্বীপ খুশি হলো নীরা তার পরিবারকে আপন করে নিয়েছে।অবশ্য দ্বীপ জানতো নীরা এমনটি করবে।
খাওয়া দাওয়ার পর দ্বীপ আলমারি থেকে শার্ট ও ব্লেজার বের করতে যাবে ঠিক তখনই নীরা এসে তাকে একটি ব্লেজার পছন্দ করে বের করে দিয়ে বলে,”আজ থেকে আমার পছন্দ করে দেওয়া ড্রেস পড়েই যাবেন।”
দ্বীপ মাথা নাড়িয়ে হ্যা বুঝিয়ে দেয়। দ্বীপ ঘর থেকে বের হওয়ার আগে নীরা বলে ওঠে,”আমাকে কোন কোন চেপটার মুখস্ত করতে হবে দেখিয়ে দিবেন না?”
এবার আর দ্বীপ থমকে থাকতে পারলো না।নীরার কাছে এসে নীরার কপালে হাত দিয়ে বলে,”থাপ্পড় খেয়ে কি জ্বর টর বাদিয়েছো?কি সব উল্টা উল্টা কথা বলছো!”
“ইশ থাপ্পড়ের পর হয়ে ঔষধ দিয়েছিলেন ওটাতে ঠিক হয়েছি।”মনে মনে কথাটি বলে সরাসরি বলে,”থাপ্পড়ের সাথে মনে হয় মধু মিক্সড করা ছিলো।তাই তো এখন থেকে বরের সেবা করা শুরু করছি। আর আমার স্বামী যে কি না বিসিএস ক্যাডার আবার প্রফেসর তার বউকে কি অমনোযোগী হলে মানায়?তাই আমিও আজ থেকে পড়াশোনাতে মনোযোগ হবো।”
খুশি হলো দ্বীপ।নীরার মাথায় টোকা দিয়ে বলে,”পাগলী।”
তারপর নীরাকে সবকিছু দেখিয়ে বের হয় ঘর থেকে।ঘর থেকে বের হতেই নীরা আবার পিছন থেকে ডাক দেয় দ্বীপকে।বলে,”দাড়ান ক্যাডার সাহেব।”
ড্রয়িং রুমে মিস্টার সমুদ্র বাদে সবাই ছিলেন।মিস্টার সমুদ্র কাজে চলে গেছেন।নীরার ডাক শুনে সবাই তাকালো নীরা ও দ্বীপের দিকে।নীরা দ্বীপের কাছে এসে বলে,”টাই না বেধেই চলে যাচ্ছেন!আপনাকে এই লুকে টাই ছাড়া মানায় না।”
বলেই দ্বীপের কাছে এসে টাই বেঁধে দেয়।পিংকির দিকে তাকিয়ে নীরা শয়তানি হাসি দেয়।মূলত পিংকিকে দেখাতেই নীরা এই কাজ করেছে।
মিসেস শিউলি দুষ্টুমি করে বলেন,”কি আর করবে বলো নাতবৌ!আমার নাতি তো রসকষহীন মানুষ।বিদ্যা ছাড়া কিছু বুঝেই না।একদিনে বউয়ের এত সোহাগ ঠিক মাথায় সামলাতে পারছে না।তাই দু একটা ভুল করতেছে।”
তারপর দ্বীপের দিকে তাকিয়ে মিসেস শিউলি বলেন,”দেইখো,ক্লাসে পড়ানোর সময় বউয়ের সেবাযত্ন গুলো মাথায় আইনো না।তাহলে আবার সব গুলায় ফেলবা।বউ তো আর কলেজে থাকবে না তোমাকে সব সংশোধন করে দেওয়ার জন্য।”
সবাই একসাথে হেসে ওঠে। দ্বীপ গলা খাকারি দিয়ে চলে যায়।
চলবে…?